মন্ত্রীদের অজ্ঞতা এবং আমাদের বিড়ম্বনা by শাহরিয়ার কবির
মুক্তিযুদ্ধের ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের
বিচারের উদ্যোগ যেমন যুগান্তকারী ঘটনা, একইভাবে এত বছর পর মুক্তিযুদ্ধে
সাহায্যকারী বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগও কম প্রশংসনীয় নয়।
এ বিষয়ে 'কালের কণ্ঠে' প্রকাশিত একটি সংবাদ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
এতে বলা হয়েছে_'মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রথমবারের
মতো সরকার ১৪ ভারতীয় ও চার পাকিস্তানীসহ ৩৩ বিদেশী নাগরিক এবং একটি
সংগঠনকে সম্মাননা দেবে। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বিশেষ অনুষ্ঠানের
মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের সম্মাননা জানাবেন। এ বিষয়ে
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবিএম তাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন,
স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহায্য ও সহযোগিতার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই সম্মাননা জানানো
হবে। তিনি আরও বলেন, ৩৯ বছরেও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য কোন বিদেশী
নাগরিককে সম্মাননা জানানো হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন
সরকার এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিমন্ত্রী জানান, এ
পর্যন্ত যেসব নাম পাওয়া গেছে এবার তাঁদেরই সম্মাননা জানানো হচ্ছে। পরে আরও
নাম পেলে তাঁদেরও সম্মাননা জানানো হবে।
'... বিশেষ সম্মাননা পেতে যাচ্ছেন যেসব বিদেশী নাগরিক তাঁরা হলেন_ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, শ্রী জগজ্জীবন রাম, ফিল্ড মার্শাল এসএ মানেক শ, লে জে জগজিৎ সিং অরোরা, জয়প্রকাশ নারায়ণ, গোবিন্দ হালদার, জেনারেল রুস্তমজী (মুক্তিযুদ্ধকালীন বিএসএফ প্রধান), ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে (বিএসএফ), ব্রিগেডিয়ার গোলক মজুমদার (বিএসএফ), সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শহীদ অরুণ ত্রেপাল, সিপাহী শহীদ আলবার্ট এক্কা, ফাইং অফিসার শহীদ এনজেএস সিখান, ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরী এবং শ্রী সমর সেন। পাকিস্তানী নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা সম্মাননা পেতে যাচ্ছেন তাঁরা হলেন_ আসমা জাহাঙ্গীর (মানবাধিকারকর্মী), কবি আহমেদ সেলিম, তাহেরা মাজহার আলী ও এয়ার মার্শাল আজগর খান। যুক্তরাষ্ট্রের যাঁরা সম্মাননা পেতে যাচ্ছেন তাঁরা হলেন_ এডওয়ার্ড কেনেডি, আর্চার কে ব্লাড, ডা. রোনাল্ড জোসেফ, পণ্ডিত রবি শংকর, জর্জ হ্যারিসন, জোয়ান বয়েজ, সিনেটর ফ্যাঙ্ক চার্চ ও সিনেটর স্যাক্সবি। এ ছাড়াও কিন টেন ওরুট বাগে (নেদারল্যান্ডস), প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান, এলআই ব্রেজনেভ (রাশিয়া), নিকোলাই পদগর্নি (রাশিয়া), ব্রুক ডগলাস (যুক্তরাজ্যের তৎকালীন লেবার পার্টির নেতা), রাসেল জনস্টন (যুক্তরাজ্য), সায়মন ড্রিংকে (যুক্তরাজ্য) সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। সংগঠন হিসেবে সম্মাননা পাচ্ছে 'ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব জুরিস্ট (জেনেভা)।' (কালের কণ্ঠ, ১৫ মার্চ ২০১০)
গত চৌদ্দ মাস ধরে লক্ষ্য করছি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার অনেক মহৎ কর্ম সম্পাদনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেও নীতিনির্ধারকদের অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে অন্তিমে তা পর্বতের মুষিক প্রসবের মতো দাঁড়াচ্ছে। যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার শুধু নয়, জনগণ মহাজোটকে প্রধানত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধান পুনর্প্রবর্তনের জন্যই বিপুল ভোটে বিজয়ী করে ক্ষমতায় এনেছে। ১৩ বছর ঝুলে থাকা বঙ্গবন্ধু হত্যার একটি দায়সারা তদন্ত করে আত্মঘোষিত কয়েকজনকে বিচার করে শাস্তি দেয়া হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং '৭২-এর সংবিধান পুনর্প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সরকারের অকারণ কালপেণ, নীতিনির্ধারকদের নানাবিধ নির্বুদ্ধিতাপ্রসূত উক্তি অবিরাম শ্রবণ করতে গিয়ে আমরা যারপরনাই ক্লান্ত ও বিরক্তবোধ করছি। গত সপ্তাহে যেমন মহাজোট সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বললেন, সরকার নাকি হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে না, দুই একজনের বিচার করবে এবং তাও না কি প্রতীকী!
মন্ত্রীর এহেন বক্তব্য পত্রিকায় দেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমাদের প্রশ্ন করা হয়েছে, এসব কী শুনছি? টেলিভিশনের কয়েকটি 'টক শো'তেও বার বার বলতে হয়েছে_ '৭৩-এর 'আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনালস) আইন' সম্পর্কে কিংবা 'প্রতীকী বিচার' সম্পর্কে মাননীয় মন্ত্রীর অজ্ঞতা সম্পর্কে। যুদ্ধাপরাধীদের 'প্রতীকী বিচার' অভিনব কোন বিষয় নয়। যেমন ১৯৬৭ সালে বরেণ্য ফরাসী লেখক জাঁ পল সার্ত্র এবং ব্রিটিশ মনীষী বার্টার্ন্ড রাসেল ভিয়েতনাম যুদ্ধে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য আমেরিকাকে দায়ী করে প্যারিসে গণআদালত বসিয়ে এর বিচার করেছিলেন। তাঁদের পথ অনুসরণ করে আমরা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসিয়ে '৭১-এর শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বিচার করেছিলাম। ইরাক যুদ্ধে আমেরিকাকে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী করে খোদ আমেরিকার প্রাক্তন এ্যাটর্নি জেনারেল রামজে ক্লার্ক দুটো গণআদালতের আয়োজন করেছিলেন। এগুলোই প্রতীকী বিচার_যা সরকার নয়, সচেতন নাগরিকরা করেন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠন এবং তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের জন্য যে অনন্যসাধারণ আইন প্রণয়ন করেছেন সেখানে প্রতীকী বিচারের কোন সুযোগ নেই। অপরাধ প্রমাণ হলে এই আইনে মৃ্ত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। এই আইনের অধীনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে_সেটি সম্পূর্ণ স্বাধীন। সরকার কখনও বলতে পারে না দু'একজন, না দু'একশ' জন অথবা দু'এক হাজার জনের বিচার হবে। কতজনের বিচার কতদিনে হবে এবং কীভাবে হবে_সব কিছু নির্ধারণের এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের, অন্য কারও নয়। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এদের যে কারও স্বজন তথ্যপ্রমাণসহ যদি বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের শরণাপন্ন হন, তাকে বিচারপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করার এখতিয়ার সরকারের নেই। এটা ভিকটিমের শুধু সাংবিধানিক অধিকার নয়, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন এবং সভ্যতার বোধ সংরণের বিষয়টি এর সঙ্গে জড়িত।
আমাদের আইন প্রতিমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, সরকারের অনভিজ্ঞতার কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিলম্ব ঘটছে। অজ্ঞতা বা অনভিজ্ঞতা কোন অপরাধ নয়, জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞানতা দূর করা যায়। তবে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে অজ্ঞতা যদি কোন অবদান রাখে তা শুধু সরকারের সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না_সমগ্র জাতির জন্য সমূহ বিড়ম্বনা ও বিপর্যয় ডেকে আনবে।
এ ক্ষেত্রে আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা জ্ঞাপনের বিষয়টি আনতে পারি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন তাজ যেদিন জাতীয় সংসদে এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন এবং সংসদ সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করেন তার পরদিনই মন্ত্রীকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। এ বিষয়টি ১৯৯৭ সালে মুক্তিযুদ্ধের রজতজয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নিকট আমরা উত্থাপন করেছিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান অনেকে রেখেছেন। প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশের জনগণের অবদানের কথা যদি বলি তাহলে বহু কোটি মানুষের কথা স্মরণ করতে হবে। তখন প্রতীকী অর্থে ১০০ জনের তালিকা প্রস্তুত করে আমরা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে দিয়েছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম, রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তাঁদের বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্মানিত নাগরিকের মর্যাদা প্রদানের জন্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ফিল্ড মার্শাল মানেক শ ও জেনারেল অরোরার নামে রাজধানীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণের প্রস্তাবও করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর শহীদ সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রস্তাব অনেকেই করেছেন। তখন আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ না করলেও ৩৯ বছর পর এই জরুরি কাজটি করতে যাচ্ছে এতে আমরা নিঃসন্দেহে আনন্দিত।
তবে সমস্যা হচ্ছে কীভাবে এ কাজটি হবে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে কি অন্য সবার মতোই একটি সম্মাননাপত্র দেয়া হবে? কলকাতায় যদি বঙ্গবন্ধুর নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক থাকতে পারে, ঢাকায় কেন ইন্দিরা গান্ধী সরণি থাকবে না এ প্রশ্নের জবাব সংবর্ধনার উদ্যোক্তা মাননীয় মুক্তিযোদ্ধা প্রতিমন্ত্রীর জানা থাকতে হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে আমরা যেমন 'প্রতীকী বিচার'-এর তামাশা দেখতে চাই না তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধুদের সংবর্ধনার ক্ষেত্রেও অজ্ঞতাজনিত কোন সিদ্ধান্ত সরকার ও জাতির জন্য বিব্রতকর হোক এটা আমরা চাইতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী 'কালের কণ্ঠ'কে বলেছেন, যাদের নাম পেয়েছেন তাদের ভেতর থেকে নাকি প্রথম দফায় ৩৩ জনকে বাছাই করেছেন। এই তালিকা তাঁকে কারা দিয়েছেন আমি জানি না, তবে এ বিষয়ে আমরা যারা কাজ করছি_অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সাংবাদিক সালাম আজাদ, কলামিস্ট মোনায়েম সরকার কিংবা এই অধম লেখক যে দিইনি এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। তালিকা দেখে মনে হয়েছে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আওয়ামী লীগের আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ কিংবা তাঁরই সহযোগী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জোহরা তাজউদ্দীনসহ মহাজোটের শীর্ষ নেতাদের কারও সঙ্গেই পরামর্শ করেননি।
ভারতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে অরোরা, মানেক শ'র নাম নিশ্চয়ই আসবে। তবে সেই সময় মুজিবনগর সরকারে যাঁরা ছিলেন তাঁরা জানেন শ্রীমতি গান্ধীর উপদেষ্টা ডিপি ধর, পিএন হাকসার, পররাষ্ট্র সচিব টিএন কল ও পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের অবদান মুক্তিযুদ্ধে কতটুকু। এ বিষয়ে আমাদের চেয়ে ভাল বলতে পারবেন প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম উপদেষ্টা মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভার দু'জন সদস্য করণ সিং ও আইকে গুজরাল এখনও বেঁচে আছেন। ক'দিন আগেই করণ সিং ঢাকা এসেছিলেন। ভারতীয় দূতাবাসের নৈশভোজে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি সর্বক্ষণ তাঁর সঙ্গেই ছিলেন।
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী কষ্ট করে যে নামগুলো সংগ্রহ করেছেন তাঁদের সম্পর্কেও যথেষ্ট জানেন বলে মনে হয় না। ভারতের বিএসএফের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক রুস্তমজীর নামের আগে জেনারেল বসানো হয়েছে। বিএনএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান গোলক মজুমদারের নামের সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার লাগানো হয়েছে। নিঃসন্দেহ মুক্তিযুদ্ধের এঁরা অসামান্য অবদান রেখেছেন এবং দু'জনেরই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধারণের সুযোগ হয়েছিল আমার। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এঁরা দু'জনেই ভারতের পুলিশ সার্ভিসের ক্যাডার, কস্কিনকালেও সামরিক বাহিনীতে ছিলেন না, তাই এঁদের জেনারেল বা ব্রিগেডিয়ার হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ৩৩ জনের তালিকায় যুক্তিসঙ্গত কারণে ভারতের প্রতিরামন্ত্রী জগজ্জীবন রামের নাম আছে, কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং এবং অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবনের নাম নেই। কোন বিবেচনায় তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরিকে প্রথম তালিকায় রাখা হয়নি এর জবাব তাঁর নিশ্চয়ই জানা আছে।
ক্যাপ্টেন তাজ জানতে না পারেন আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার কিংবা অন্য সেক্টর কমান্ডাররা নিশ্চয়ই একবাক্যে বলবেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল সরকারের বিশাল অবদানের কথা। আবদুর রাজ্জাকরা বলতে পারবেন জেনারেল উবানের অবদানের কথা। সেই সময় ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডে যারা ছিলেন তাদের কথা আমাদের সেক্টর কমান্ডাররা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। এদের কয়েকজনের সাক্ষাতকার আমি গ্রহণ করেছিলাম আজ থেকে ১৪-১৫ বছর আগে। এদের ভেতর জেনারেল জ্যাকব, জেনারেল থাপান, জেনারেল লছমন সিংয়ের কথা আমরা ভুলে যেতে পারি না। ভুলতে পারি না জেনারেল সগৎ সিং ও জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার কথা। আমাদের দুই মন্ত্রী মতিয়া আপা ও নাহিদ ভাই জানেন মুক্তিযুদ্ধে সিপিআইয়ের নেতাদের অবদানের কথা। রণেন মিত্র, ইলা মিত্র, নিখিল চক্রবর্তী, গীতা মুখার্জী, শান্তিময় রায়, বিশ্বনাথ মুখার্জী ও স্বাধীন গুহর মতো সিপিআই নেতারা কার্যত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গিয়েছিলেন। মহাজোটের অন্যতম নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন নিশ্চয়ই জানেন সিপিএমের জ্যোতি বসু ও একে গোপালনের কথা। ভারতের কথাশিল্পী দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক আখ্যায়িত করেছিলেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।
মাত্র দেড় মাস আগে কলকাতার মৃন্ময়ী বোসের কাছে জেনেছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কিংবদন্তির কণ্ঠশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর, মান্না দে, সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরী ও চিত্রনির্মাতা বিমল রায়ের অবদানের কথা। কবি কাইফী আজমী, শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন ও অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমানের অবদানের কথা আমি অনেক আগে লিখেছি। কলকাতার মৈত্রেয়ী দেবী, জাস্টিস মাসুদ, উৎপলা মিশ্র, জন হেস্টিংস, সুকুমার বোস, সমর গুহ, ড. ত্রিগুণা সেন, বহরমপুরের ইপ্সিতা গুহ, ত্রিপুরার অনিল ভট্টচার্য_কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ঋত্বিক ঘটক, এস শুকদেব ও গীতা মেহতার অসাধারণ প্রামাণ্যচিত্রের কথা কি কখনও ভোলা যাবে? কিশোর পারেখের আলোকচিত্র এখনও ছাপা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে। এমন কোন মুক্তিযোদ্ধা কি আছেন_ অংশুমান রায়ের 'শোন একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে' কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের 'মাগো ভাবনা কেন' অথবা ভূপেন হাজারিকার 'জয় জয় জয় জয় বাংলাদেশ' শুনে উদ্দীপ্ত হননি? শিল্পী বাঁধন দাস তুলি ফেলে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন। চিত্র সমালোচক প্রণব রায় এবং তাঁর শিল্পী বন্ধুরা ছবি বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য। আকাশবাণীর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণবেশ সেন আর উপেন তরফদারের অবদান ভুলে যাওয়া চরম অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক হবে। তারা শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায় থেকে আরম্ভ করে ভারতের বরেণ্য লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের অবদানের কথা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলা যায়।
অর্থমন্ত্রী মুহিত ভাই নিশ্চয়ই বলতে পারবেন আমেরিকায় রিচার্ড টেইলরদের অবরোধের কথা। তাঁরা কীভাবে পাকিস্তানী যুদ্ধজাহাজকে শিকাগো বন্দর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কীভাবে মার্কিন প্রশাসনের বাংলাদেশবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন জনমত সংগঠিত করেছেন এ নিয়ে 'ব্লকেড' নামে একটি বইও লেখা হয়েছে যেটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সুযোগ্য পুত্র মেসবাহউদ্দিন মুনতাসীর। ক্যাপ্টেন তাজকে যারা তালিকা সরবরাহ করেছেন তারা কীভাবে ফরাসী মনীষী ও রাজনীতিবিদ আঁদ্রে মালরোর নামটি ভুলে গেলেন? জার্মানীর চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ কিংবা মন্ত্রী পিটার শোরের অবদানের কথা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে বেশি কেউ না জানলেও আমরা যারা ইতিহাস নাড়াচাড়া করেছি তারা তো কিছুটা হলেও জানি।
তালিকায় জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেনের নাম দেখে ভাল লেগেছে। কোন বিবেচনায় জাতিসংঘে সোভিয়েত প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক কিংবা প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকোর নাম বাদ যাবে? পাকিস্তানে আসগর খানের পাশাপাশি অতি অবশ্যই ওয়ালি খানের কথা বলতে হবে। পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির শামিম আশরাফ মালিক, বাজী নাসিম, আফসান্দিয়া খটক কিংবা পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের নেতা মাস্টার খান গুলের কথা ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে যে পাকিস্তানী নাগরিক প্রথম বাংলাদেশ সফর করেন তিনি পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক 'ডন' এর নির্বাহী সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক মাজহার আলী খান। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার ওপর ধারাবাহিকভাবে ডন-এ লিখে চাকরি হারিয়েছিলেন তিনি। '৭১-এ ঢাকায় কমিশনার ছিলেন আলমদার রাজা যিনি পরে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গণহত্যার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলেন। তার 'ঢাকায় ডিবাকল' গ্রন্থেও এই গণহত্যার হৃদয়বিদারক কিছু বিবরণ দিয়েছেন, যিনি আমাদের আমন্ত্রণে ২০০১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় সম্মেলনে এসেছিলেন। আলমদার রাজা এখন মৃ্ত্যুশয্যায়, আসমা জাহাঙ্গীরের আগে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া উচিত। আমরা কেন ভুলে যাচ্ছি পাকিস্তানের সাহসী সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসকারানহাসের কথা!
গত বছর কাঠমন্ডু নেপালের রাষ্ট্রপতি ডা. রামবরণ যাদবের সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা বলেছেন। নেপালের পার্লামেন্টের প্রাক্তন স্পিকার দামান ধুঙ্গানা কিংবা নেপাল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের অবদানের কথা আমরা জানি। বাংলাদেশকে প্রথম কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদানকারী রাষ্ট্র ভুটানের রাজাকে সম্মান জানাতে কেন আমাদের কার্পণ্য থাকবে? কেন প্রথম তালিকায় একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত বিদেশী মুক্তিযোদ্ধা অস্ট্রেলিয়ার ডব্লুএএস ওডারল্যান্ড বীরপ্রতীকের নাম থাকবে না? ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পর বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে পোল্যান্ডের কথা উল্লেখ করেছিলেন। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন তাজ কি জানবার চেষ্টা করেছেন পোল্যান্ডের সরকারপ্রধান তখন কে ছিলেন? ১৪ জন নোবেল বিজয়ী '৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা করে যে অসাধারণ বিবৃতি দিয়েছিলেন তাঁদের খুঁজে বের করা কঠিন কোন কাজ নয়। হানা পাপানাক ও গুস্তাভ পাপানাকের অবদানের কথা তখনকার মার্কিন সংবাদপত্রেও পাওয়া যাবে।
শুরুতেই বলেছি মহাজোট সরকারের অনেক সাধু উদ্যোগ অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে উদ্যোক্তাদের অজ্ঞতার কারণে। মন্ত্রী হলেই সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হবে এমন কথা কেউ বলছে না। তবে যিনি যে কাজটি করবেন সে বিষয়ে তাঁর সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। অভিজ্ঞতা না থাকলে অভিজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মহান বিদেশী বন্ধুদের সংবর্ধনা নিঃসন্দেহে মহৎ উদ্যোগ। ভাল হয় স্বাধীনতার ৪০তম বার্ষিকীতে অন্ততপক্ষে শীর্ষস্থানীয় ১০০ জন বন্ধু বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যদি ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। এতে বহির্বিশ্বে আমাদের মর্যাদা যেমন বাড়বে_দুঃসময়ের বন্ধুদেরও উপযুক্ত সম্মান জানানো হবে। তবে প্রথম ১০০ জনের তালিকায় কারা থাকবেন এটা মহাজোটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং অভিজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেই ঠিক করতে হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের এই অভিজ্ঞতার অভাব কখনও কখনও সমূহ উদ্বেগ ও আতঙ্কের কারণ হচ্ছে। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে ট্রাইবু্যনালের সম্ভাব্য তদন্ত কর্মকর্তা বা আইনজীবী হিসেবে যাদের নাম দেখছি_তাতে সংশ্লিষ্ট যে কারও মনে হবে বিচারের নামে বুঝি কোন প্রহসন হতে যাচ্ছে। আমরা বার বার বলছি তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের দক্ষতা, সততা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের ওপর নির্ভর করছে এই মামলার সাফল্য। এ ক্ষেত্রে কোন রকম গোঁজামিল, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বা অহেতুক কালপেণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রহসনে পরিণত করবে।
১৫ মার্চ ২০১০
'... বিশেষ সম্মাননা পেতে যাচ্ছেন যেসব বিদেশী নাগরিক তাঁরা হলেন_ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, শ্রী জগজ্জীবন রাম, ফিল্ড মার্শাল এসএ মানেক শ, লে জে জগজিৎ সিং অরোরা, জয়প্রকাশ নারায়ণ, গোবিন্দ হালদার, জেনারেল রুস্তমজী (মুক্তিযুদ্ধকালীন বিএসএফ প্রধান), ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে (বিএসএফ), ব্রিগেডিয়ার গোলক মজুমদার (বিএসএফ), সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শহীদ অরুণ ত্রেপাল, সিপাহী শহীদ আলবার্ট এক্কা, ফাইং অফিসার শহীদ এনজেএস সিখান, ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরী এবং শ্রী সমর সেন। পাকিস্তানী নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা সম্মাননা পেতে যাচ্ছেন তাঁরা হলেন_ আসমা জাহাঙ্গীর (মানবাধিকারকর্মী), কবি আহমেদ সেলিম, তাহেরা মাজহার আলী ও এয়ার মার্শাল আজগর খান। যুক্তরাষ্ট্রের যাঁরা সম্মাননা পেতে যাচ্ছেন তাঁরা হলেন_ এডওয়ার্ড কেনেডি, আর্চার কে ব্লাড, ডা. রোনাল্ড জোসেফ, পণ্ডিত রবি শংকর, জর্জ হ্যারিসন, জোয়ান বয়েজ, সিনেটর ফ্যাঙ্ক চার্চ ও সিনেটর স্যাক্সবি। এ ছাড়াও কিন টেন ওরুট বাগে (নেদারল্যান্ডস), প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান, এলআই ব্রেজনেভ (রাশিয়া), নিকোলাই পদগর্নি (রাশিয়া), ব্রুক ডগলাস (যুক্তরাজ্যের তৎকালীন লেবার পার্টির নেতা), রাসেল জনস্টন (যুক্তরাজ্য), সায়মন ড্রিংকে (যুক্তরাজ্য) সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। সংগঠন হিসেবে সম্মাননা পাচ্ছে 'ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব জুরিস্ট (জেনেভা)।' (কালের কণ্ঠ, ১৫ মার্চ ২০১০)
গত চৌদ্দ মাস ধরে লক্ষ্য করছি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার অনেক মহৎ কর্ম সম্পাদনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেও নীতিনির্ধারকদের অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে অন্তিমে তা পর্বতের মুষিক প্রসবের মতো দাঁড়াচ্ছে। যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার শুধু নয়, জনগণ মহাজোটকে প্রধানত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধান পুনর্প্রবর্তনের জন্যই বিপুল ভোটে বিজয়ী করে ক্ষমতায় এনেছে। ১৩ বছর ঝুলে থাকা বঙ্গবন্ধু হত্যার একটি দায়সারা তদন্ত করে আত্মঘোষিত কয়েকজনকে বিচার করে শাস্তি দেয়া হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং '৭২-এর সংবিধান পুনর্প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সরকারের অকারণ কালপেণ, নীতিনির্ধারকদের নানাবিধ নির্বুদ্ধিতাপ্রসূত উক্তি অবিরাম শ্রবণ করতে গিয়ে আমরা যারপরনাই ক্লান্ত ও বিরক্তবোধ করছি। গত সপ্তাহে যেমন মহাজোট সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বললেন, সরকার নাকি হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে না, দুই একজনের বিচার করবে এবং তাও না কি প্রতীকী!
মন্ত্রীর এহেন বক্তব্য পত্রিকায় দেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমাদের প্রশ্ন করা হয়েছে, এসব কী শুনছি? টেলিভিশনের কয়েকটি 'টক শো'তেও বার বার বলতে হয়েছে_ '৭৩-এর 'আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনালস) আইন' সম্পর্কে কিংবা 'প্রতীকী বিচার' সম্পর্কে মাননীয় মন্ত্রীর অজ্ঞতা সম্পর্কে। যুদ্ধাপরাধীদের 'প্রতীকী বিচার' অভিনব কোন বিষয় নয়। যেমন ১৯৬৭ সালে বরেণ্য ফরাসী লেখক জাঁ পল সার্ত্র এবং ব্রিটিশ মনীষী বার্টার্ন্ড রাসেল ভিয়েতনাম যুদ্ধে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য আমেরিকাকে দায়ী করে প্যারিসে গণআদালত বসিয়ে এর বিচার করেছিলেন। তাঁদের পথ অনুসরণ করে আমরা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসিয়ে '৭১-এর শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বিচার করেছিলাম। ইরাক যুদ্ধে আমেরিকাকে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী করে খোদ আমেরিকার প্রাক্তন এ্যাটর্নি জেনারেল রামজে ক্লার্ক দুটো গণআদালতের আয়োজন করেছিলেন। এগুলোই প্রতীকী বিচার_যা সরকার নয়, সচেতন নাগরিকরা করেন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠন এবং তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের জন্য যে অনন্যসাধারণ আইন প্রণয়ন করেছেন সেখানে প্রতীকী বিচারের কোন সুযোগ নেই। অপরাধ প্রমাণ হলে এই আইনে মৃ্ত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। এই আইনের অধীনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে_সেটি সম্পূর্ণ স্বাধীন। সরকার কখনও বলতে পারে না দু'একজন, না দু'একশ' জন অথবা দু'এক হাজার জনের বিচার হবে। কতজনের বিচার কতদিনে হবে এবং কীভাবে হবে_সব কিছু নির্ধারণের এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের, অন্য কারও নয়। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এদের যে কারও স্বজন তথ্যপ্রমাণসহ যদি বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের শরণাপন্ন হন, তাকে বিচারপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করার এখতিয়ার সরকারের নেই। এটা ভিকটিমের শুধু সাংবিধানিক অধিকার নয়, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন এবং সভ্যতার বোধ সংরণের বিষয়টি এর সঙ্গে জড়িত।
আমাদের আইন প্রতিমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, সরকারের অনভিজ্ঞতার কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিলম্ব ঘটছে। অজ্ঞতা বা অনভিজ্ঞতা কোন অপরাধ নয়, জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞানতা দূর করা যায়। তবে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে অজ্ঞতা যদি কোন অবদান রাখে তা শুধু সরকারের সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না_সমগ্র জাতির জন্য সমূহ বিড়ম্বনা ও বিপর্যয় ডেকে আনবে।
এ ক্ষেত্রে আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা জ্ঞাপনের বিষয়টি আনতে পারি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন তাজ যেদিন জাতীয় সংসদে এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন এবং সংসদ সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করেন তার পরদিনই মন্ত্রীকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। এ বিষয়টি ১৯৯৭ সালে মুক্তিযুদ্ধের রজতজয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নিকট আমরা উত্থাপন করেছিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান অনেকে রেখেছেন। প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশের জনগণের অবদানের কথা যদি বলি তাহলে বহু কোটি মানুষের কথা স্মরণ করতে হবে। তখন প্রতীকী অর্থে ১০০ জনের তালিকা প্রস্তুত করে আমরা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে দিয়েছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম, রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তাঁদের বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্মানিত নাগরিকের মর্যাদা প্রদানের জন্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ফিল্ড মার্শাল মানেক শ ও জেনারেল অরোরার নামে রাজধানীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণের প্রস্তাবও করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর শহীদ সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রস্তাব অনেকেই করেছেন। তখন আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ না করলেও ৩৯ বছর পর এই জরুরি কাজটি করতে যাচ্ছে এতে আমরা নিঃসন্দেহে আনন্দিত।
তবে সমস্যা হচ্ছে কীভাবে এ কাজটি হবে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে কি অন্য সবার মতোই একটি সম্মাননাপত্র দেয়া হবে? কলকাতায় যদি বঙ্গবন্ধুর নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক থাকতে পারে, ঢাকায় কেন ইন্দিরা গান্ধী সরণি থাকবে না এ প্রশ্নের জবাব সংবর্ধনার উদ্যোক্তা মাননীয় মুক্তিযোদ্ধা প্রতিমন্ত্রীর জানা থাকতে হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে আমরা যেমন 'প্রতীকী বিচার'-এর তামাশা দেখতে চাই না তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধুদের সংবর্ধনার ক্ষেত্রেও অজ্ঞতাজনিত কোন সিদ্ধান্ত সরকার ও জাতির জন্য বিব্রতকর হোক এটা আমরা চাইতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী 'কালের কণ্ঠ'কে বলেছেন, যাদের নাম পেয়েছেন তাদের ভেতর থেকে নাকি প্রথম দফায় ৩৩ জনকে বাছাই করেছেন। এই তালিকা তাঁকে কারা দিয়েছেন আমি জানি না, তবে এ বিষয়ে আমরা যারা কাজ করছি_অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সাংবাদিক সালাম আজাদ, কলামিস্ট মোনায়েম সরকার কিংবা এই অধম লেখক যে দিইনি এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। তালিকা দেখে মনে হয়েছে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আওয়ামী লীগের আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ কিংবা তাঁরই সহযোগী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জোহরা তাজউদ্দীনসহ মহাজোটের শীর্ষ নেতাদের কারও সঙ্গেই পরামর্শ করেননি।
ভারতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে অরোরা, মানেক শ'র নাম নিশ্চয়ই আসবে। তবে সেই সময় মুজিবনগর সরকারে যাঁরা ছিলেন তাঁরা জানেন শ্রীমতি গান্ধীর উপদেষ্টা ডিপি ধর, পিএন হাকসার, পররাষ্ট্র সচিব টিএন কল ও পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের অবদান মুক্তিযুদ্ধে কতটুকু। এ বিষয়ে আমাদের চেয়ে ভাল বলতে পারবেন প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম উপদেষ্টা মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভার দু'জন সদস্য করণ সিং ও আইকে গুজরাল এখনও বেঁচে আছেন। ক'দিন আগেই করণ সিং ঢাকা এসেছিলেন। ভারতীয় দূতাবাসের নৈশভোজে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি সর্বক্ষণ তাঁর সঙ্গেই ছিলেন।
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী কষ্ট করে যে নামগুলো সংগ্রহ করেছেন তাঁদের সম্পর্কেও যথেষ্ট জানেন বলে মনে হয় না। ভারতের বিএসএফের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক রুস্তমজীর নামের আগে জেনারেল বসানো হয়েছে। বিএনএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান গোলক মজুমদারের নামের সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার লাগানো হয়েছে। নিঃসন্দেহ মুক্তিযুদ্ধের এঁরা অসামান্য অবদান রেখেছেন এবং দু'জনেরই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধারণের সুযোগ হয়েছিল আমার। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এঁরা দু'জনেই ভারতের পুলিশ সার্ভিসের ক্যাডার, কস্কিনকালেও সামরিক বাহিনীতে ছিলেন না, তাই এঁদের জেনারেল বা ব্রিগেডিয়ার হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ৩৩ জনের তালিকায় যুক্তিসঙ্গত কারণে ভারতের প্রতিরামন্ত্রী জগজ্জীবন রামের নাম আছে, কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং এবং অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবনের নাম নেই। কোন বিবেচনায় তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরিকে প্রথম তালিকায় রাখা হয়নি এর জবাব তাঁর নিশ্চয়ই জানা আছে।
ক্যাপ্টেন তাজ জানতে না পারেন আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার কিংবা অন্য সেক্টর কমান্ডাররা নিশ্চয়ই একবাক্যে বলবেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল সরকারের বিশাল অবদানের কথা। আবদুর রাজ্জাকরা বলতে পারবেন জেনারেল উবানের অবদানের কথা। সেই সময় ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডে যারা ছিলেন তাদের কথা আমাদের সেক্টর কমান্ডাররা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। এদের কয়েকজনের সাক্ষাতকার আমি গ্রহণ করেছিলাম আজ থেকে ১৪-১৫ বছর আগে। এদের ভেতর জেনারেল জ্যাকব, জেনারেল থাপান, জেনারেল লছমন সিংয়ের কথা আমরা ভুলে যেতে পারি না। ভুলতে পারি না জেনারেল সগৎ সিং ও জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার কথা। আমাদের দুই মন্ত্রী মতিয়া আপা ও নাহিদ ভাই জানেন মুক্তিযুদ্ধে সিপিআইয়ের নেতাদের অবদানের কথা। রণেন মিত্র, ইলা মিত্র, নিখিল চক্রবর্তী, গীতা মুখার্জী, শান্তিময় রায়, বিশ্বনাথ মুখার্জী ও স্বাধীন গুহর মতো সিপিআই নেতারা কার্যত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গিয়েছিলেন। মহাজোটের অন্যতম নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন নিশ্চয়ই জানেন সিপিএমের জ্যোতি বসু ও একে গোপালনের কথা। ভারতের কথাশিল্পী দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক আখ্যায়িত করেছিলেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।
মাত্র দেড় মাস আগে কলকাতার মৃন্ময়ী বোসের কাছে জেনেছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কিংবদন্তির কণ্ঠশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর, মান্না দে, সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরী ও চিত্রনির্মাতা বিমল রায়ের অবদানের কথা। কবি কাইফী আজমী, শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন ও অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমানের অবদানের কথা আমি অনেক আগে লিখেছি। কলকাতার মৈত্রেয়ী দেবী, জাস্টিস মাসুদ, উৎপলা মিশ্র, জন হেস্টিংস, সুকুমার বোস, সমর গুহ, ড. ত্রিগুণা সেন, বহরমপুরের ইপ্সিতা গুহ, ত্রিপুরার অনিল ভট্টচার্য_কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ঋত্বিক ঘটক, এস শুকদেব ও গীতা মেহতার অসাধারণ প্রামাণ্যচিত্রের কথা কি কখনও ভোলা যাবে? কিশোর পারেখের আলোকচিত্র এখনও ছাপা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে। এমন কোন মুক্তিযোদ্ধা কি আছেন_ অংশুমান রায়ের 'শোন একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে' কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের 'মাগো ভাবনা কেন' অথবা ভূপেন হাজারিকার 'জয় জয় জয় জয় বাংলাদেশ' শুনে উদ্দীপ্ত হননি? শিল্পী বাঁধন দাস তুলি ফেলে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন। চিত্র সমালোচক প্রণব রায় এবং তাঁর শিল্পী বন্ধুরা ছবি বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য। আকাশবাণীর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণবেশ সেন আর উপেন তরফদারের অবদান ভুলে যাওয়া চরম অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক হবে। তারা শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায় থেকে আরম্ভ করে ভারতের বরেণ্য লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের অবদানের কথা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলা যায়।
অর্থমন্ত্রী মুহিত ভাই নিশ্চয়ই বলতে পারবেন আমেরিকায় রিচার্ড টেইলরদের অবরোধের কথা। তাঁরা কীভাবে পাকিস্তানী যুদ্ধজাহাজকে শিকাগো বন্দর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কীভাবে মার্কিন প্রশাসনের বাংলাদেশবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন জনমত সংগঠিত করেছেন এ নিয়ে 'ব্লকেড' নামে একটি বইও লেখা হয়েছে যেটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সুযোগ্য পুত্র মেসবাহউদ্দিন মুনতাসীর। ক্যাপ্টেন তাজকে যারা তালিকা সরবরাহ করেছেন তারা কীভাবে ফরাসী মনীষী ও রাজনীতিবিদ আঁদ্রে মালরোর নামটি ভুলে গেলেন? জার্মানীর চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ কিংবা মন্ত্রী পিটার শোরের অবদানের কথা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে বেশি কেউ না জানলেও আমরা যারা ইতিহাস নাড়াচাড়া করেছি তারা তো কিছুটা হলেও জানি।
তালিকায় জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেনের নাম দেখে ভাল লেগেছে। কোন বিবেচনায় জাতিসংঘে সোভিয়েত প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক কিংবা প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকোর নাম বাদ যাবে? পাকিস্তানে আসগর খানের পাশাপাশি অতি অবশ্যই ওয়ালি খানের কথা বলতে হবে। পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির শামিম আশরাফ মালিক, বাজী নাসিম, আফসান্দিয়া খটক কিংবা পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের নেতা মাস্টার খান গুলের কথা ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে যে পাকিস্তানী নাগরিক প্রথম বাংলাদেশ সফর করেন তিনি পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক 'ডন' এর নির্বাহী সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক মাজহার আলী খান। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার ওপর ধারাবাহিকভাবে ডন-এ লিখে চাকরি হারিয়েছিলেন তিনি। '৭১-এ ঢাকায় কমিশনার ছিলেন আলমদার রাজা যিনি পরে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গণহত্যার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলেন। তার 'ঢাকায় ডিবাকল' গ্রন্থেও এই গণহত্যার হৃদয়বিদারক কিছু বিবরণ দিয়েছেন, যিনি আমাদের আমন্ত্রণে ২০০১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় সম্মেলনে এসেছিলেন। আলমদার রাজা এখন মৃ্ত্যুশয্যায়, আসমা জাহাঙ্গীরের আগে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া উচিত। আমরা কেন ভুলে যাচ্ছি পাকিস্তানের সাহসী সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসকারানহাসের কথা!
গত বছর কাঠমন্ডু নেপালের রাষ্ট্রপতি ডা. রামবরণ যাদবের সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা বলেছেন। নেপালের পার্লামেন্টের প্রাক্তন স্পিকার দামান ধুঙ্গানা কিংবা নেপাল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের অবদানের কথা আমরা জানি। বাংলাদেশকে প্রথম কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদানকারী রাষ্ট্র ভুটানের রাজাকে সম্মান জানাতে কেন আমাদের কার্পণ্য থাকবে? কেন প্রথম তালিকায় একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত বিদেশী মুক্তিযোদ্ধা অস্ট্রেলিয়ার ডব্লুএএস ওডারল্যান্ড বীরপ্রতীকের নাম থাকবে না? ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পর বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে পোল্যান্ডের কথা উল্লেখ করেছিলেন। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন তাজ কি জানবার চেষ্টা করেছেন পোল্যান্ডের সরকারপ্রধান তখন কে ছিলেন? ১৪ জন নোবেল বিজয়ী '৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা করে যে অসাধারণ বিবৃতি দিয়েছিলেন তাঁদের খুঁজে বের করা কঠিন কোন কাজ নয়। হানা পাপানাক ও গুস্তাভ পাপানাকের অবদানের কথা তখনকার মার্কিন সংবাদপত্রেও পাওয়া যাবে।
শুরুতেই বলেছি মহাজোট সরকারের অনেক সাধু উদ্যোগ অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে উদ্যোক্তাদের অজ্ঞতার কারণে। মন্ত্রী হলেই সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হবে এমন কথা কেউ বলছে না। তবে যিনি যে কাজটি করবেন সে বিষয়ে তাঁর সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। অভিজ্ঞতা না থাকলে অভিজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মহান বিদেশী বন্ধুদের সংবর্ধনা নিঃসন্দেহে মহৎ উদ্যোগ। ভাল হয় স্বাধীনতার ৪০তম বার্ষিকীতে অন্ততপক্ষে শীর্ষস্থানীয় ১০০ জন বন্ধু বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যদি ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। এতে বহির্বিশ্বে আমাদের মর্যাদা যেমন বাড়বে_দুঃসময়ের বন্ধুদেরও উপযুক্ত সম্মান জানানো হবে। তবে প্রথম ১০০ জনের তালিকায় কারা থাকবেন এটা মহাজোটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং অভিজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেই ঠিক করতে হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের এই অভিজ্ঞতার অভাব কখনও কখনও সমূহ উদ্বেগ ও আতঙ্কের কারণ হচ্ছে। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে ট্রাইবু্যনালের সম্ভাব্য তদন্ত কর্মকর্তা বা আইনজীবী হিসেবে যাদের নাম দেখছি_তাতে সংশ্লিষ্ট যে কারও মনে হবে বিচারের নামে বুঝি কোন প্রহসন হতে যাচ্ছে। আমরা বার বার বলছি তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের দক্ষতা, সততা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের ওপর নির্ভর করছে এই মামলার সাফল্য। এ ক্ষেত্রে কোন রকম গোঁজামিল, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বা অহেতুক কালপেণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রহসনে পরিণত করবে।
১৫ মার্চ ২০১০
No comments