একটি কবিতাকে নিয়ে গল্প by শেখ আতাউর রহমান
পত্রিকায় একটি কবিতা লিখেছিলাম। কবিতাটি এই :
গোধূলিকে শুনিয়েছিলাম গানIt was fascination I know
Just a passing glance
Just a brief Romance
Fascination turned into Love!
Fascination : Pat Boon.
স্বীকার করি গোধূলি প্রথম দর্শনে সেটা ছিলো মোহ
বুকের মধ্যে উঠেছিলো ঝড় উথালপাথাল
এত মোহনীয় হতে পারে নারী-চোখ গ্রীবা অনুপম শরীর
যেন শরতের মেঘ-হালকা স্নিগ্ধ অতি ধীর
আবারো স্বীকার করি গোধূলি সেটা ছিলো মোহ-বঙ্কিমের রূপোজমোহ
তারপর দিনে দিনে কাছে আসা
একাকী অথবা মানুষের ভিড়ে চোখের নিঃশব্দ ভাষা
দুজনে দুজনকে চিনি
মোহ পরাজিত হয়।-
অতঃপর
পরস্পর
গভীর ভালোবাসি।
গোধূলি মনে পড়ে সেইসব দিন? স্মৃতি যে অমোঘ অবিনাশী!
একদিন।
কলেজের ব্যালকনি
চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদ
ছলকে ওঠে রবি, বলি, ‘সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলেম
আমার সর্বনাশ।’
নিমেষে স্তব্ধ হলো নিস্তব্ধ বিমূঢ় আকাশ।
দুজনে নির্বাক মুখোমুখি বসে থাকা
মুখ নিচু করে সাদাপাতায় তোমার খসখস হিজিবিজি আঁকা
গুনগুন গান গাই
গোধূলি, শুধু তোমাকে শোনাই
প্যাটবুন ঝরে পড়ে কণ্ঠে আমার,
‘ফ্যাসিনেশন টার্নড্ ইন্টু লাভ!’-
তখন তোমার সেকি উচ্চকিত হাসি
চানাচুর ছুড়ে মারা রাশি রাশি
আমার দিকে। জ্বালা করে চোখ
আর তখন তোমার রক্তিম কপট শোক
ঝরে পড়ে, ‘কাঁদছেন?’
-কাঁদাচ্ছো তো-’
ক’এক মুহূর্ত।
এরপর তরতর সিঁড়ি বেয়ে নামা, অনুচ্চকণ্ঠে বলা, না, না-
সেদিন আমার তুমি মানোনিকো কোনো মানা।
তারপর চলে যাওয়া যোজন যোজন দূর
হ্যাঁ গোধূলির বিয়ে
বিসমিল্লাহ্ খাঁ’র শানাইয়ে বেজে ওঠে
বেহাগের সুর।
তোলপাড় শহর
ট্রাফিক জ্যাম করে সারি সারি আনকোরা গাড়ির বহর
আমার বুকের ওপর দিয়ে চলে যায়
একে একে
দূর-বহুদূর।
ব্রহ্মপুত্রের নিকষ কালোজল শুষে নেয় সব আহাজারি সব শোক
যাতনার তীরে বিদ্ধ হয় এক সৌম্যযুবক।
দিন বয়ে যায়। কানে আসে, এ্যাবরশন-
রক্তহীন সাদা শরীর-হাসপাতালের বেডে নিথর পড়ে থাকা,
বন্ধুকে দিয়ে ডাকা,
‘ও যে আপনাকে একবার দেখতে চায়’
না, যাইনি। এটাকি তেইশ বছর বয়সের প্রচ- অভিমান?-
জানি না।
গল্পতো আরো আছে আজ থাক
জীবন যেমন বয়ে চলেছে নদীর মতো আঁকাবাঁকা
যাক বয়ে যাক।
*
এ-কবিতাটি প্রকাশের এক সপ্তাহের মাথায় এক হেমন্তসন্ধ্যায় আমার টেলিফোন বেজে ওঠে,
-হ্যাঁ বলুন?
তখন ও-প্রান্ত থেকে এক অচেনা তন্বীকণ্ঠে আমার নামটি উচ্চারিত হয়।
-এটা কি তাঁর বাসা?
-হ্যাঁ।
-আমি তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
-হ্যাঁ বলছি। বলুন।
-স্যার আপনিতো এক সময় ময়মনসিংহে পড়াশোনা করতেন। তাই না?
-হ্যাঁ কেন বলুনতো?
-স্যার, আপনি আমার সঙ্গে আপনি আপনি করছেন কেন। আমিতো আপনার ছাত্রীতুল্যা।
-ছাত্রীতুল্যা?-ছাত্রী নও?
-না স্যার, ছাত্রীতুল্যা-আপনার কন্যার মতো-
-বেশ বেশ। আমি হেসে বলি, কিন্তু এখনো যে তোমার নামটি শোনা হয়নি আমার।
-তাইতো। কণ্ঠে যেন একটু দ্বিধা।
আমি তখন একটু কাব্য করে বলি, তোমার নামটি তোমার কণ্ঠে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর শোনায়?
এর উত্তরে ও-প্রান্ত থেকে হাল্কা হাসি ভেসে আসে, আমার নাম পুতুল।
-পুতুল? চমৎকার নাম। পুতুল নিশ্চয়ই পুতুলের মতো সুন্দর দেখতে?
আবারো হাল্কা হাসি।
-এবার বল পুতুল কোত্থেকে বলছো তুমি?
-ময়মনসিংহ থেকে।
-তুমি কি ময়মনসিংহে থাকো?
-না, আমি এখন আমেরিকায় থাকি-নিউইয়র্কে। মাস তিনেকের জন্য ময়মনসিংহ এসেছি।
-বেশ বেশ।
-স্যার, আপনিতো এক সময়ে গান গাইতেন।
আমি হেসে বলি, ওয়ান্স আপন এ টাইম ডিয়ার-
-লিখতেন-সুরও দিতেন-
-তুমি এত্তোসব জানলে কি করে?-
-স্যার, সে সময় আপনার হাতে সারাক্ষণ একটা পুরনো স্প্যানিশ গিটার থাকতো। কোত্থেকে যোগাড় করেছিলেন ওটা? আবারো হাল্কা হাসি।
আমিও না হেসে পারি না, ও-কথা কি আর এখন মনে আছে কন্যা। সেতো অনেকদিনের কথা-
-আপনি তখন প্যাটবুন জিমরিভস্ এদের গান গাইতেন। বিশেষ করে প্যাটবুনের ‘ফ্যাসিনেশন’ গানটি চমৎকার গাইতেন আপনি। Ñআপনার কবিতাতেও তার উল্লেখ আছে।
-হ্যাঁ, একসময় প্যাটবুনের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ছিলো আমেরিকায়। আমাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো। এখন কেমন জানি না।
-ঠিক, একদম ঠিক কথা। আমেরিকায় এসে দেখছি শুধু টিনএজাররা ছাড়া প্যাটবুন জিমরিভস্ জোয়ানবয়েজ এদের গান খুবই জনপ্রিয় এখানে-বিশেষ করে মধ্যবয়সীদের কাছে।
-তাই না? আমাদের দেশেও কি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পুরনো হবে কখনো?
-ঠিক ঠিক। এরপর পুতুলের বিনয়ের হাসি, আপনাকে বিরক্ত করছি না তো?-
-না না, তুমি বল। পুরনো দিনের কথা শুনতে বেশ লাগছে-
-আপনারা একবার বিটিভিতে বর্ষার ওপর একটি গীতিবিচিত্রা করেছিলেন-নাম ছিলো ‘মেঘদূত’-তাই না স্যার?
-হ্যাঁ, মনে আছে।
-নামটি চমৎকার-‘মেঘদূত’।
-হ্যাঁ চমৎকার। তবে নামটি আমার দেয়া নয় পুতুল। আমার দেয়া নামটি বদলে ‘মেঘদূত’ নাম দিয়েছিলেন কবি শহীদ কাদরী। তিনি তখন বিটিভি’র প্রডিউসার।
-তাই?-জানতাম না। সেই বিচিত্রায় আপনার সঙ্গে আজকের বিখ্যাত গায়িকা মিতালি মুখার্জীও গেয়েছিলো-ঠিক বলছি তো স্যার?-
-হ্যাঁ, ঠিক বলছো।
-মিতালি তখন এত্তটুকু মেয়ে-
-হ্যাঁ, সবইতো ঠিক বলছো। এবার সত্যি করে বল তো মেয়ে এতকথা তুমি জানলে কি করে? তোমার তো তখন জন্মই হয়নি।
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন-আমার তখন জন্মই হয়নি।
-তাহলে?-
-ও কথা থাক। এখন যে কারণে আপনাকে ফোন করেছি সেটা বলি।
-বল, পুতুল বল-
-গোধূলিকে নিয়ে আপনি যে কবিতাটি লিখেছেন ও মেয়ের নামতো গোধূলি নয় এ নামটা আপনার বানানো-
এবার আমার হাতের রিসিভার একটু কেঁপে ওঠে। বলি, এ তুমি কি বলছো পুতুল?-
-হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। কবিতার নায়িকা গোধূলি আপনার বানানো নাম। আসল নাম দিয়া।
আমার হাতের রিসিভার দ্বিতীয়বার কেঁপে ওঠে। বলি, এতকথা তুমি জানলে কি করে?-তুমি কে?-
কিন্তু ও-প্রান্ত থেকে এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আসে না। আমি ফের জিজ্ঞেস করি, বল পুতুল বল-তুমি কে? তবু কোনো উত্তর নেই। আমি অধীর অপেক্ষা করি। অবশেষে ও-প্রান্ত থেকে প্রগাঢ় বিষণœ কণ্ঠে একটি মাত্র বাক্য ভেসে আসে, স্যার, দিয়া আমার মা।
মুহূর্তে আমার বুকের মধ্যে ধস নামে। সবকিছু উথালপাথাল মনে হয়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে থাকি। ওপারেও কোনো সাড়া নেই। কাটে কিছুক্ষণ। তারপর এক সময় বলি, পুতুল, তোমার মা-মানে দিয়া কেমন আছে?
আবারো ও-প্রান্তের নীরবতা। কেবল সুদূর ঝাউবনের শো শো শব্দের মতো একটা মেটালিক সাউন্ড ভেসে আসে রিসিভারে। আমি বলি, পুতুল কথা বল-চুপ করে আছো কেন?-দিয়া কেমন আছে?-
ও-প্রান্ত তবুও চুপ। কেবল ঝাউবনের শো শো শব্দ কানে বাজে। আমি অধীর অপেক্ষা করি। রিসিভার ছাড়ি না-ধরে রাখি কানে-দম বন্ধ করে। অবশেষে আমার সকল ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়ে ও-প্রান্ত থেকে রিসিভার রেখে দেবার কট্ করে একটা শব্দ হয়। ধক্ করে ওঠে বুক। কি নিষ্ঠুর এই শব্দ! আমি অসহায়ের মতো চোখ রাখি খোলা জানালায়। যেন ওখানেই আমার উজ্জ্বল উদ্ধার! বাইরে তখন হেমন্তসন্ধ্যার হিমেল কুয়াশা শীতল পারদের মতো গলে পড়ছে।
No comments