বই পরিচিতি শহরের বদলে যাওয়া নারী by ইকবাল আজিজ
নিছক গল্প কবিতা উপন্যাস ও সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধের বাইরেও এক ধরনের বই আছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা বিষয়ের প্রকৃত অবস্থা, উন্নয়ন, অনুন্নয়ন ও পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরে।
এছাড়া এসব বইয়ের অনুসন্ধান ও গবেষণার মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উন্মোচিত হয় পাঠকের চেতনায়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে হলে এ ধরনের বই বড় বেশি প্রয়োজনীয়। এমনই একটি দরকারি বই লিখেছেন তরুণ গবেষক ও শিক্ষাবিদ কান্তি অনন্ত নুজহাত। তিনি ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রভাষক; বর্তমানে পিএইচডি গবেষক হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার মনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাঁর বইয়ের নাম ‘দি নিউ আরবান ওমেন ইন বাংলাদেশ।’ বাংলাদেশের নগরজীবনে প্রতিনিয়ত নারীদের জীবন ও জীবিকার সে পরিবর্তন ঘটে চলেছে সেই বিষয়ে ইংরেজীতে এই গবেষণামূলক বইটি লিখেছেন কান্তি নুজহাত। ইংরেজীতে লেখার কারণে বাংলাদেশের মননশীল পাঠকদের পাশাপাশি বিদেশী পাঠকরাও বইটি পড়ে বাংলাদেশের শহুরে নারীদের বিষয়ে জানতে পারবেন। তারা বাংলাদেশে বাঙালী নারীদের ক্ষমতায়নের প্রকৃত চিত্রও এই বইয়ের মাধ্যমে জানতে পারবেন।বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে দ্রুত নগরায়ন ঘটেছে। প্রতি বছর গ্রাম থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ শহরে এসে বসতি স্থাপন করছে; এদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ নারী। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন শ্রেণীর এই নারীরা বাংলাদেশের নগরজীবনের অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহ চালু রাখতে যে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন তা আমরা জানতে পারছি কান্তি অনন্ত নুজহাতের বইটি থেকে। বর্তমানে সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারী অন্যতম চালিকাশক্তি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সুস্পষ্ট।
এখানকার নগরজীবনে নারীদের বিষয়ে আগে যা ভাবা যেত না, তাই এখন সত্য বলে পরিগণিত হয়েছে। নব্বুইয়ের দশকে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে এখানে নারী শিক্ষা বিশেষভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে যে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, ইতোমধ্যে তার ফলাফল দেখা যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের সব শহরের মোট জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশ নারী। এক সময় শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, ক্ষুদে দোকানদার প্রমুখ নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ সাধারণত স্ত্রী পুত্র কন্যাদের গাঁয়ে রেখে আসত। কিন্তু এখন তারা অনেকেই শহরের বস্তি এলাকায় থাকে। অধিকাংশের স্ত্রী বা কন্যা কিছু একটা কাজ করে, তারাও সুনির্দিষ্টভাবে আয়ের সঙ্গে জড়িত। ছোটখাটো ব্যবসায়ী, মুদির দোকান এবং নানা ধরনের শ্রমজীবী শহরের প্রান্তিক নারীদের মধ্যে এখন এমন নারীর সংখ্যাই বেশি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নগরীর নারী শ্রমিকদের সংখ্যা গত এক দশকে আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। পোশাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী। আগে যেসব নারী বেকার কিংবা গৃববধূ ছিল, অথবা ‘কাজের মেয়ে’ হিসেবে অন্য বাড়িতে কাজ করত তারা অনেকেই এখন পোশাকশিল্প বা অন্য কোন কারখানায় কর্মরত। নারীর জীবনের এই পরিবর্তন তার অর্থনৈতিক অবস্থাকেও প্রভাবিত করেছে; এর ফলে তাদের জীবনযাত্রা ও পারিবারিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। নগরীর কর্মজীবী নারী এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই নিজেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। এর ফলে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীর সম্মান অনেক বেড়েছে। স্বামী বা বাবার সংসারে তাদের অনেককেই এখন আর গলগ্রহ হয়ে থাকতে হয় না।
গত দু’তিন দশক ধরে বাংলাদেশে যে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প বিশেষভাবে সাফল্য অর্জন করেছে তার মূলেও রয়েছে নারী। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত শহুরে নারীদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলা, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, পুলিশ, কর্মকর্তা, শিক্ষক, ব্যবসায়ী হিসাবে কর্মরত আছেন বেশ কিছু নারী। তেমনই সাধারণ শ্রমজীবীদের মধ্যে মেডিক্যাল সাজ সরঞ্জাম তৈরি, শাড়িতে কারচুপির কাজ, দোকানদারি, টুপি তৈরি, পিঠা বিক্রি প্রভৃতি কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন অর্ধশিক্ষিত প্রান্তিক নারীরা। এরা অনেকেই ব্যবসায়ে ভাল লাভ করছেন; নতুন নতুন ব্যবসা-প্রকল্প শুরু করছেন। ফলে প্রতিমুহূর্তে বদলে যাচ্ছে শহুরে নারীদের জীবন। কান্তি অনন্ত নুজহাতের ‘দি নিউ আরবান ওমেন ইন বাংলাদেশ’ বইটি পড়ে শহুরে নারীদের জীবনের পরিবর্তন ও বিবর্তন বিষয়ে সহজেই একটি ধারণা পাওয়া যায়। নগরজীবনে নারীদের এই বদলে যাওয়ার চিত্রটি বাস্তবিকই উজ্জীবিত হওয়ার মতো।
কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক নারী স্বাবলম্বী হওয়ার পর দেশে নারী নির্যাতন এতটুকু কমেনি। এর কারণ কী? এখনও গণধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে নারীকে। আনেকক্ষেত্রে ধর্ষিত হওয়ার পরও গ্রামীণ মাতব্বর কিংবা ফতোয়াবাজরা পুনরায় নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করছে। কখনো বা দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাবানরা কেউ কেউ ধর্ষক পুরুষের পক্ষে। সামাজিকভাবে নারী এখনও বৈষম্যের শিকার। তবু এতকিছুর পরও শিক্ষা, শিল্প, ব্যবসা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে চলেছে। নারীরা নিজেরাও বদলাচ্ছে, নগর জীবনকেও বদলে দিচ্ছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ রচনার জন্য কান্তি অনন্ত নুজহাতকে অভিনন্দন।
No comments