আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে খালেদা বিদেশী হস্তক্ষেপ চাইছেন- ওয়াশিংটন টাইমসে লেখা নিবন্ধে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড়
সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে
নির্বাচিত সরকাকে হটাত দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা
জিয়ার বিদেশী হস্তক্ষেপ কামনা করে বিতর্কিত ও অখ্যাত ‘ওয়াশিংটন টাইমসে’
লেখা নিবন্ধ দেশব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ
কামনায় খালেদা জিয়ার দেশাত্মবোধ, গণতন্ত্র ও জনগণের ওপর তাঁর আস্থা-বিশ্বাস
নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সব মহলে। দু’বারের প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে বিরোধী
দলের নেতা হয়েও দেশের জনগণের ওপর আস্থা হারিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি
পুনর্বহালে সরকারকে বাধ্য করতে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ
করতে খালেদা জিয়ার আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ কামনাকে ‘দুঃখজনক’ মন্তব্য করে
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের মানুষের প্রতি অনাস্থা রেখে বিদেশীদের
হস্তক্ষেপ ও অনুকম্পায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার নীতিই বিরোধীদলীয় নেত্রীর
লেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চরম মুসলিমবিদ্বেষী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয়
গ্রেডের একটি পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে খালেদা জিয়ার প্রকাশ্য দেশের অভ্যন্তরীণ
বিষয়ে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ কামনা ‘অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক’ শক্তিকে
উস্কে দেয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। খালেদা জিয়ার এ ধরনের নিবন্ধ
‘রাষ্ট্রদ্রোহীতা, সংসদে নেয়া শপথ ভঙ্গ এবং সংবিধান লঙ্ঘনের’ শামিল।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রায় সকল রাজনৈতিক শক্তিই
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়াশিংটন টাইমস’-এ লেখা নিবন্ধে খালেদা জিয়ার
বক্তব্য ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ শামিল উল্লেখ করে এজন্য প্রকাশ্যে দেশের মানুষের
কাছে তাঁকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছে। জাতীয় সংসদের মহাজোটের প্রবীণ
সদস্যরা খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, গণতান্ত্রিক সকল
সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে গণতন্ত্র রক্ষার নামে বিদেশী হস্তক্ষেপ চেয়ে খালেদা
জিয়া রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ করেছেন, সাংবিধানিক শপথ ভঙ্গ করেছেন। দেশের
মানুষের ওপর আস্থা হারিয়ে খালেদা জিয়ার বিদেশী প্রভুদের কাছে ধরনা দেশ ও
জাতির জন্য লজ্জাজনক। যার মধ্যে ন্যূনতম দেশাত্মবোধ রয়েছে, তিনি এ ধরনের
কাজ করতে পারে না। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা করে
খালেদা জিয়া আবারও প্রমাণ করেছেন জামায়াত-বিএনপি আসলে একটিই দল। খালেদা
জিয়ার লেখা নিবন্ধে স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত খুশি হলেও
প্রবল সমালোচনার মুখে অনেকটাই বেকায়দায় ও অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছে বিএনপি
নেতারা। নিবন্ধটি প্রকাশের প্রক্রিয়া নিয়ে দলটির অনেকের মধ্যে প্রশ্ন
থাকলেও বিএনপির নেতারা অতীত উদাহরণ টেনে খালেদা জিয়ার পক্ষে সাফাই গাওয়ার
চেষ্টা করছেন। বিএনপি নেতাদের দাবি, খালেদা জিয়ার নিবন্ধটি নিয়ে রাজনৈতিক
অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার নিবন্ধে এমন কিছু নেই যা বাংলাদেশের
ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে। খালেদা জিয়ার লেখাটি বর্তমান সরকারের চার বছরের
দুর্নীতি ও দুঃশাসনের একটি আংশিক চিত্র মাত্র।
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘ওয়াশিংটন টাইমস’ পত্রিকায় লেখা প্রবন্ধের জন্য খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার করা যেতে পারে। বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়ে নিজ দেশের ব্যাপারে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ কামনা করে বেগম জিয়া সুস্পষ্টভাবে সংসদে নেয়া শপথ ভঙ্গ ও সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফও খালেদা জিয়ার নিবন্ধের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত।
জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, কোন গণমাধ্যমে নিবন্ধ লেখার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ হয় না। ভাল করে আইন-কানুন জেনে সবার কথা বলা উচিত। আসলে সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসন নিয়ে খালেদা জিয়া সত্য কথা লেখায় সরকারী দলের আঁতে ঘা লেগেছে। খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দু’বারের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই এ সত্য প্রতিবেদন ছাপিয়েছেন, সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ওয়াশিংটন টাইমসে লেখা বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্য সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বিদেশী হস্তক্ষেপের আহ্বান হিসেবে গণ্য হবে। যা কোনভাবেই রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি, শিষ্টাচার ও প্রচলিত আইনের মধ্যে পড়ে না। তাঁর মন্তব্য অপরাধের চেয়ে মানুষের প্রতি অনাস্থা রেখে বিদেশীদের অনুকম্পায় ক্ষমতায় যাওয়ার অপকৌশল হিসেবে গণ্য হতে পারে। সিনিয়র এ আইনজীবীর মতে, বিষয়টি ব্যাপক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। কারণ কোন স্বাধীন দেশে বিদেশী হস্তক্ষেপ চাওয়া কোনভাবেই দেশপ্রেমিক বা আইন মান্যকারী নাগরিকের কাজ হতে পারে না। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অনিবার্য।
উল্লেখ্য, গত ৩০ জানুয়ারি দ্য ওয়াশিংটন টাইমসের মতামত কলামে খালেদা জিয়ার নামে ‘দ্য থ্যাংকলেস রোল ইন সেভিং ডেমোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এতে বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করে বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্ব সম্প্রদায়কে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় মিথ্যার আশ্রয় ও তথ্য বিকৃত করে খালেদা জিয়া তাঁর এ নিবন্ধে লিখেছেন- ‘গত ডিসেম্বর মাসে ইকোনমিস্টে প্রকাশিত ফাঁস হওয়া ই-মেইল ও ফোনালাপ প্রমাণ করে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে হাসিনা সরকার কী ধরনের কুকর্ম করেছে এবং তারা কীভাবে হাসিনার রাজনৈতিক বিরোধীদের মৃত্যুদ- দেয়ার পাঁয়তারা করছে!’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে পত্রিকায় লেখা নিবন্ধ নিয়ে এত তোলপাড়, সেই দ্য ওয়াশিংটন টাইমস সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দৈনিকটি মোটেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত নয়। প্রচার সংখ্যার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন পোস্ট ষষ্ঠ স্থানে থাকলেও ওয়াশিংটন টাইমসের অবস্থান প্রথম ১০০ দৈনিকের মধ্যেও নেই। বাংলাদেশে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পত্রিকার মতোই যুক্তরাষ্ট্রে এ দৈনিকটির অবস্থান। এছাড়া পত্রিকাটির মতামত পাতায় ১০টি লেখার মধ্যে অনলাইন সংস্করণে বেগম খালেদা জিয়ার লেখাটি ১০ নম্বর স্থানে প্রদর্শিত হয়েছে। অখ্যাত এ দৈনিকটিতেও খালেদা জিয়ার লেখাটি গুরুত্ব পায়নি।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি হচ্ছে ‘কনজারভেটিভ’। ওয়াশিংটন টাইমসের তহবিল যুগিয়ে থাকে ইউনিফিকেশন চার্চ নামে একটি খ্রীস্টান ধর্মীয় আন্দোলন। ১৯৯৮ সালে মিসরীয় দৈনিক আল-আহরাম এই পত্রিকাটি সম্পর্কে সমালোচনা করে লিখেছে, পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি অন্ধভাবে এ্যাটি আরব (আরববিরোধী), এ্যান্টি মুসলিম (মুসলিমবিরোধী) এবং প্রো-ইসরায়েল (ইসরাইলপন্থী। ইসলামের নামে রাজনীতিতে থাকা এবং জামায়াতসহ বিভিন্ন কট্টরপন্থী ইসলামী দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করা দল বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার এমন ইসলাম বিদ্বেষী পত্রিকায় নিবন্ধ লেখা নিয়ে খোদ জোটের শরিকদের মধ্যেও অসন্তোষের কমতি নেই।
প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ করেই খালেদা জিয়া কেন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ কামনা করলেন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, গত চার বছর সরকারবিরোধী আন্দোলন করেও সফলতা না আসায় বিরোধী দলের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছে। রাজপথে আন্দোলনে নেমে ন্যূনতম জনসমর্থন আদায় করতে না পারা, ভঙ্গুর সাংগঠনিক শক্তি এবং জোটের মিত্রদের অস্তিত্ব সঙ্কট নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়তে হয়েছে তাদের। খালেদা জিয়াসহ বিএনপির হাইকমান্ডের বন্ধমূল ধারণা, আন্দোলন করে সরকারের পতন দূরের কথা, ন্যূনতম কোন দাবিও আদায় করা যাবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে এমনিতেই অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে প্রধান শরিক জামায়াত। কারাগারে আটক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় এবং তা কার্যকর হলে আগামী নির্বাচনে আবারও ভরা ডুবির আশঙ্কা রয়েছে।
এসব বিষয় বুঝতে পেরেই বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া আন্তর্জাতিক চাপে সরকারকে সবকিছু মানতে বাধ্য করার মিশনে নেমেছেন। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়া চাইছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ শক্তিধর দেশগুলো সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে বাধ্য করুক। তাঁর ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দাতাগোষ্ঠী ও শক্তিধর দেশগুলো প্রবল চাপ সৃষ্টি করলে শেখ হাসিনার সরকার পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে বাধ্য হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতেও সরকার বাধ্য হবে। আর এমনটা হলে আগামী নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয় নিশ্চিত হবে, অন্যথায় নয়।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, খালেদা জিয়া আশা করছেন- একাত্তরের মতো যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ তাঁদের হাতে তুলে দেবে! প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমদ বলেন, যার মধ্যে ন্যূনতম দেশাত্মবোধ রয়েছে, তিনি (খালেদা জিয়া) এ কাজ করতে পারেন না। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাইরের হস্তক্ষেপ দিয়ে দেশের গণতন্ত্র রক্ষা হয় না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) খালেদা জিয়ার এমন নিবন্ধের কঠোর সমালোচনা করে বলেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশী শক্তিকে টেনে আনার ঘটনা নতুন কিছু না হলেও আমরা খালেদা জিয়ার এ ভূমিকাকে জাতির জন্য লজ্জাজনক বলে মনে করি। তাঁর নিবন্ধের ভাষা থেকে এটা স্পষ্ট, খালেদা জিয়া মার্কিন প্রশাসনকে তুষ্ট করতে গিয়ে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে তোষামোদ করতে গিয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) ইতিহাসকে একেবারে উল্টে দিলেন, শত্রুকে মিত্র বানালেন এবং চার মিথ্যাচারের আশ্রয় নিলেন। বেশ সরাসরিই যুদ্ধাপরাধের জন্য যারা বিচারাধীন রয়েছেন তাদেরও পক্ষ নিয়েছেন। চিহ্নিত পাকিস্তানী দালাল ও গণহত্যাকারীদের বিচারকে তিনি ‘রাজনৈতিক বিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পাঁয়তারা’ বলে উল্লেখ করেছেন। এ ঘটনায় গোটা জাতি আজ ক্ষুব্ধ।
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘ওয়াশিংটন টাইমস’ পত্রিকায় লেখা প্রবন্ধের জন্য খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার করা যেতে পারে। বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়ে নিজ দেশের ব্যাপারে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ কামনা করে বেগম জিয়া সুস্পষ্টভাবে সংসদে নেয়া শপথ ভঙ্গ ও সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফও খালেদা জিয়ার নিবন্ধের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত।
জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, কোন গণমাধ্যমে নিবন্ধ লেখার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ হয় না। ভাল করে আইন-কানুন জেনে সবার কথা বলা উচিত। আসলে সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসন নিয়ে খালেদা জিয়া সত্য কথা লেখায় সরকারী দলের আঁতে ঘা লেগেছে। খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দু’বারের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই এ সত্য প্রতিবেদন ছাপিয়েছেন, সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ওয়াশিংটন টাইমসে লেখা বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্য সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বিদেশী হস্তক্ষেপের আহ্বান হিসেবে গণ্য হবে। যা কোনভাবেই রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি, শিষ্টাচার ও প্রচলিত আইনের মধ্যে পড়ে না। তাঁর মন্তব্য অপরাধের চেয়ে মানুষের প্রতি অনাস্থা রেখে বিদেশীদের অনুকম্পায় ক্ষমতায় যাওয়ার অপকৌশল হিসেবে গণ্য হতে পারে। সিনিয়র এ আইনজীবীর মতে, বিষয়টি ব্যাপক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। কারণ কোন স্বাধীন দেশে বিদেশী হস্তক্ষেপ চাওয়া কোনভাবেই দেশপ্রেমিক বা আইন মান্যকারী নাগরিকের কাজ হতে পারে না। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অনিবার্য।
উল্লেখ্য, গত ৩০ জানুয়ারি দ্য ওয়াশিংটন টাইমসের মতামত কলামে খালেদা জিয়ার নামে ‘দ্য থ্যাংকলেস রোল ইন সেভিং ডেমোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এতে বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করে বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্ব সম্প্রদায়কে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় মিথ্যার আশ্রয় ও তথ্য বিকৃত করে খালেদা জিয়া তাঁর এ নিবন্ধে লিখেছেন- ‘গত ডিসেম্বর মাসে ইকোনমিস্টে প্রকাশিত ফাঁস হওয়া ই-মেইল ও ফোনালাপ প্রমাণ করে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে হাসিনা সরকার কী ধরনের কুকর্ম করেছে এবং তারা কীভাবে হাসিনার রাজনৈতিক বিরোধীদের মৃত্যুদ- দেয়ার পাঁয়তারা করছে!’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে পত্রিকায় লেখা নিবন্ধ নিয়ে এত তোলপাড়, সেই দ্য ওয়াশিংটন টাইমস সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দৈনিকটি মোটেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত নয়। প্রচার সংখ্যার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন পোস্ট ষষ্ঠ স্থানে থাকলেও ওয়াশিংটন টাইমসের অবস্থান প্রথম ১০০ দৈনিকের মধ্যেও নেই। বাংলাদেশে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পত্রিকার মতোই যুক্তরাষ্ট্রে এ দৈনিকটির অবস্থান। এছাড়া পত্রিকাটির মতামত পাতায় ১০টি লেখার মধ্যে অনলাইন সংস্করণে বেগম খালেদা জিয়ার লেখাটি ১০ নম্বর স্থানে প্রদর্শিত হয়েছে। অখ্যাত এ দৈনিকটিতেও খালেদা জিয়ার লেখাটি গুরুত্ব পায়নি।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি হচ্ছে ‘কনজারভেটিভ’। ওয়াশিংটন টাইমসের তহবিল যুগিয়ে থাকে ইউনিফিকেশন চার্চ নামে একটি খ্রীস্টান ধর্মীয় আন্দোলন। ১৯৯৮ সালে মিসরীয় দৈনিক আল-আহরাম এই পত্রিকাটি সম্পর্কে সমালোচনা করে লিখেছে, পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি অন্ধভাবে এ্যাটি আরব (আরববিরোধী), এ্যান্টি মুসলিম (মুসলিমবিরোধী) এবং প্রো-ইসরায়েল (ইসরাইলপন্থী। ইসলামের নামে রাজনীতিতে থাকা এবং জামায়াতসহ বিভিন্ন কট্টরপন্থী ইসলামী দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করা দল বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার এমন ইসলাম বিদ্বেষী পত্রিকায় নিবন্ধ লেখা নিয়ে খোদ জোটের শরিকদের মধ্যেও অসন্তোষের কমতি নেই।
প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ করেই খালেদা জিয়া কেন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ কামনা করলেন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, গত চার বছর সরকারবিরোধী আন্দোলন করেও সফলতা না আসায় বিরোধী দলের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছে। রাজপথে আন্দোলনে নেমে ন্যূনতম জনসমর্থন আদায় করতে না পারা, ভঙ্গুর সাংগঠনিক শক্তি এবং জোটের মিত্রদের অস্তিত্ব সঙ্কট নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়তে হয়েছে তাদের। খালেদা জিয়াসহ বিএনপির হাইকমান্ডের বন্ধমূল ধারণা, আন্দোলন করে সরকারের পতন দূরের কথা, ন্যূনতম কোন দাবিও আদায় করা যাবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে এমনিতেই অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে প্রধান শরিক জামায়াত। কারাগারে আটক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় এবং তা কার্যকর হলে আগামী নির্বাচনে আবারও ভরা ডুবির আশঙ্কা রয়েছে।
এসব বিষয় বুঝতে পেরেই বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া আন্তর্জাতিক চাপে সরকারকে সবকিছু মানতে বাধ্য করার মিশনে নেমেছেন। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়া চাইছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ শক্তিধর দেশগুলো সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে বাধ্য করুক। তাঁর ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দাতাগোষ্ঠী ও শক্তিধর দেশগুলো প্রবল চাপ সৃষ্টি করলে শেখ হাসিনার সরকার পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে বাধ্য হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতেও সরকার বাধ্য হবে। আর এমনটা হলে আগামী নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয় নিশ্চিত হবে, অন্যথায় নয়।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, খালেদা জিয়া আশা করছেন- একাত্তরের মতো যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ তাঁদের হাতে তুলে দেবে! প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমদ বলেন, যার মধ্যে ন্যূনতম দেশাত্মবোধ রয়েছে, তিনি (খালেদা জিয়া) এ কাজ করতে পারেন না। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাইরের হস্তক্ষেপ দিয়ে দেশের গণতন্ত্র রক্ষা হয় না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) খালেদা জিয়ার এমন নিবন্ধের কঠোর সমালোচনা করে বলেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশী শক্তিকে টেনে আনার ঘটনা নতুন কিছু না হলেও আমরা খালেদা জিয়ার এ ভূমিকাকে জাতির জন্য লজ্জাজনক বলে মনে করি। তাঁর নিবন্ধের ভাষা থেকে এটা স্পষ্ট, খালেদা জিয়া মার্কিন প্রশাসনকে তুষ্ট করতে গিয়ে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে তোষামোদ করতে গিয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) ইতিহাসকে একেবারে উল্টে দিলেন, শত্রুকে মিত্র বানালেন এবং চার মিথ্যাচারের আশ্রয় নিলেন। বেশ সরাসরিই যুদ্ধাপরাধের জন্য যারা বিচারাধীন রয়েছেন তাদেরও পক্ষ নিয়েছেন। চিহ্নিত পাকিস্তানী দালাল ও গণহত্যাকারীদের বিচারকে তিনি ‘রাজনৈতিক বিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পাঁয়তারা’ বলে উল্লেখ করেছেন। এ ঘটনায় গোটা জাতি আজ ক্ষুব্ধ।
No comments