নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করুন by আয়েশা নুসরাত জাহান
কর্মজীবী মা। একমাত্র মেয়েকে বাসায় রেখে প্রায়ই তাকে কাজে যেতে হয়। মেয়ের যখন স্কুল থাকে তখন চিন্তামুক্ত থাকেন। কিন্তু স্কুল না থাকলে দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে। নিরাপত্তার কথা ভেবে পাশের বাসার ভাবির কাছে মেয়েকে রেখে কাজে গেলে কিছুটা স্বস্তিবোধ করেন।
কিন্তু সেই স্বস্তিই যে তার কাল হয়ে দাঁড়াবে_ কে জানত?
মোবাইলে ফোন আসে। মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে বাইরে খেলতে গিয়ে সে ফিরে আসেনি। এক সময় খোঁজ মেলে। ডাস্টবিনে পাওয়া যায় হতভাগ্য মায়ের কন্যারত্নটির বস্তায় ভরা লাশ। পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী ধর্ষণের পর মেয়েটিকে গলাটিপে মেরে লাশ বস্তায় ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। সেদিন থেকে সে মায়ের নাম হয়ে যায় 'ধর্ষিতার মা'। মেয়ের লাশ বুকে নিয়ে মায়ের মনে পড়ে যায় নয় বছর আগের কথা। বিশ্বাস আর ভালোবাসাকে পুঁজি করে হাসানের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছিল। সেদিন সে হয়েছিল ঘর-পালানো মেয়ে। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে দেওয়ার জন্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকের অত্যাচার। সেই সঙ্গে মা-বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। এমন সময় শরীরে নতুন একটা প্রাণের অস্তিত্ব! সয়েছিল 'যৌতুকের জন্য নির্যাতন'। নিজেকে আর পেটের সন্তানকে বাঁচাতে তাই পালানোর সিদ্ধান্ত নিল। জীবনযুদ্ধের ময়দানে বারবার বাধাগ্রস্ত। রাস্তাঘাট, বাজার, কাজ-কর্ম, বাসের লাইন, এমনকি বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়েও হয়েছেন নির্যাতনের শিকার। পুরুষ ছাড়া বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। তাই বাড়িওয়ালাও সুযোগ নিতে ছাড়েনি। হয়েছেন যৌন হয়রানির শিকার। দেখেছেন পুরুষের লালসাসিক্ত নজর। কুপ্রস্তাবে রাজি না হলে ছিল এসিড মেরে ঝলসে দেওয়ার হুমকি। সব বাধা এড়িয়ে মেয়েটিকে নিয়ে শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারলেন কি মেয়েকে বাঁচাতে? মাত্র ৭ বছরের মেয়েটিকে এখন সবাই চিনবে ধর্ষিতা নামে। মায়ের মনে জেগে ওঠে বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহও থমকে যেতে সময় লাগে না, যখন সমাজপতিদের ফতোয়া জারি হয়। ধর্ষিতাকে এলাকায় কবরস্থ করা যাবে না। মহিলা একা থাকে। এই নষ্টা মহিলাকে এলাকা ছাড়তে হবে।
আমাদের সমাজে এ ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। আর সেটার প্রতিনিধিত্ব করছে ইভা, পিংকি, চম্পা, ময়না, রুবির মতো মেয়েরা, নারীরা, গৃহবধূরা, বোনেরা। এ নামগুলো এখনও পুরনো হয়ে যায়নি। শুধু গত বছরের নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান দেখলে শিউরে উঠতে হয়। ২০১২ সালে ৭৭১ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গণধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে ২৬৩ নারী। এসব নির্যাতিতের মধ্যে ২৩৯ জন নারী, ৩৮৪ জন শিশু। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১০৬ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের অপমান মাথায় নিয়ে আত্মহত্যা করেন ২৩০ জন।
প্রতিবারই আমাদের ভাবটা এমন হয়_ যেন এর চেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা আগে ঘটেনি। এবারই প্রথম। আমরা ভুলে গেছি হেনার কথা, যাকে ধর্ষিতা হওয়ার কারণে ১০০ দোররা মারার ফতোয়া দেয় তথাকথিত সমাজপতিরা। ভুলে গেছি পুলিশ হেফাজতে থাকা সেই মেয়েটির কথা, যাকে পুলিশই আবার ধর্ষণ করেছিল। ভুলব না-ইবা কেন? যখন আবার সাড়ে চার বছরের মেয়ে ধর্ষিত হয় আর বরাবরের মতো বিচার পায় না। ধর্ষিতার পরিবার তখন সবকিছু ভুলে গিয়ে শামুকের মতো খোলসে মুখ লুকায়।
এই সমাজ, রাষ্ট্র, আর তরুণ প্রজন্মই পারে সব রকম নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। নিশ্চিত করতে পারে সমাজে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা। বন্ধ করতে পারে সব ধরনের নিপীড়ন। তাই সমাজ, রাষ্ট্র আর তরুণ প্রজন্ম_ প্রত্যেকেরই করণীয় রয়েছে। সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত হতে হবে। পরিবারেই সন্তানকে শেখাতে হবে নারীকে কীভাবে সম্মান করতে হয়। শেখাতে হবে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ না করতে। নারী ও শিশুর অধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকে আন্তরিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে নারী নির্যাতনকারীদের দ্রুত শাস্তির বিধান ও মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। আর তরুণ প্রজন্মকে বিকৃত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসাও জরুরি।
সামাজিক প্রগতি ও অগ্রগতির স্বার্থেই আমাদের নারীর প্রতি উদার ও আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে নারীর জন্য মুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ। দিতে হবে বিশ্ব সভ্যতা বিনির্মাণে নারীর কর্মের স্বীকৃতি। আমাদের জাতীয় কবির ভাষায়_ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
য়আয়েশা নুসরাত জাহান :শিক্ষার্থী লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইলে ফোন আসে। মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে বাইরে খেলতে গিয়ে সে ফিরে আসেনি। এক সময় খোঁজ মেলে। ডাস্টবিনে পাওয়া যায় হতভাগ্য মায়ের কন্যারত্নটির বস্তায় ভরা লাশ। পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী ধর্ষণের পর মেয়েটিকে গলাটিপে মেরে লাশ বস্তায় ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। সেদিন থেকে সে মায়ের নাম হয়ে যায় 'ধর্ষিতার মা'। মেয়ের লাশ বুকে নিয়ে মায়ের মনে পড়ে যায় নয় বছর আগের কথা। বিশ্বাস আর ভালোবাসাকে পুঁজি করে হাসানের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছিল। সেদিন সে হয়েছিল ঘর-পালানো মেয়ে। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে দেওয়ার জন্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকের অত্যাচার। সেই সঙ্গে মা-বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। এমন সময় শরীরে নতুন একটা প্রাণের অস্তিত্ব! সয়েছিল 'যৌতুকের জন্য নির্যাতন'। নিজেকে আর পেটের সন্তানকে বাঁচাতে তাই পালানোর সিদ্ধান্ত নিল। জীবনযুদ্ধের ময়দানে বারবার বাধাগ্রস্ত। রাস্তাঘাট, বাজার, কাজ-কর্ম, বাসের লাইন, এমনকি বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়েও হয়েছেন নির্যাতনের শিকার। পুরুষ ছাড়া বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। তাই বাড়িওয়ালাও সুযোগ নিতে ছাড়েনি। হয়েছেন যৌন হয়রানির শিকার। দেখেছেন পুরুষের লালসাসিক্ত নজর। কুপ্রস্তাবে রাজি না হলে ছিল এসিড মেরে ঝলসে দেওয়ার হুমকি। সব বাধা এড়িয়ে মেয়েটিকে নিয়ে শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারলেন কি মেয়েকে বাঁচাতে? মাত্র ৭ বছরের মেয়েটিকে এখন সবাই চিনবে ধর্ষিতা নামে। মায়ের মনে জেগে ওঠে বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহও থমকে যেতে সময় লাগে না, যখন সমাজপতিদের ফতোয়া জারি হয়। ধর্ষিতাকে এলাকায় কবরস্থ করা যাবে না। মহিলা একা থাকে। এই নষ্টা মহিলাকে এলাকা ছাড়তে হবে।
আমাদের সমাজে এ ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। আর সেটার প্রতিনিধিত্ব করছে ইভা, পিংকি, চম্পা, ময়না, রুবির মতো মেয়েরা, নারীরা, গৃহবধূরা, বোনেরা। এ নামগুলো এখনও পুরনো হয়ে যায়নি। শুধু গত বছরের নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান দেখলে শিউরে উঠতে হয়। ২০১২ সালে ৭৭১ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গণধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে ২৬৩ নারী। এসব নির্যাতিতের মধ্যে ২৩৯ জন নারী, ৩৮৪ জন শিশু। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১০৬ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের অপমান মাথায় নিয়ে আত্মহত্যা করেন ২৩০ জন।
প্রতিবারই আমাদের ভাবটা এমন হয়_ যেন এর চেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা আগে ঘটেনি। এবারই প্রথম। আমরা ভুলে গেছি হেনার কথা, যাকে ধর্ষিতা হওয়ার কারণে ১০০ দোররা মারার ফতোয়া দেয় তথাকথিত সমাজপতিরা। ভুলে গেছি পুলিশ হেফাজতে থাকা সেই মেয়েটির কথা, যাকে পুলিশই আবার ধর্ষণ করেছিল। ভুলব না-ইবা কেন? যখন আবার সাড়ে চার বছরের মেয়ে ধর্ষিত হয় আর বরাবরের মতো বিচার পায় না। ধর্ষিতার পরিবার তখন সবকিছু ভুলে গিয়ে শামুকের মতো খোলসে মুখ লুকায়।
এই সমাজ, রাষ্ট্র, আর তরুণ প্রজন্মই পারে সব রকম নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। নিশ্চিত করতে পারে সমাজে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা। বন্ধ করতে পারে সব ধরনের নিপীড়ন। তাই সমাজ, রাষ্ট্র আর তরুণ প্রজন্ম_ প্রত্যেকেরই করণীয় রয়েছে। সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত হতে হবে। পরিবারেই সন্তানকে শেখাতে হবে নারীকে কীভাবে সম্মান করতে হয়। শেখাতে হবে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ না করতে। নারী ও শিশুর অধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকে আন্তরিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে নারী নির্যাতনকারীদের দ্রুত শাস্তির বিধান ও মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। আর তরুণ প্রজন্মকে বিকৃত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসাও জরুরি।
সামাজিক প্রগতি ও অগ্রগতির স্বার্থেই আমাদের নারীর প্রতি উদার ও আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে নারীর জন্য মুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ। দিতে হবে বিশ্ব সভ্যতা বিনির্মাণে নারীর কর্মের স্বীকৃতি। আমাদের জাতীয় কবির ভাষায়_ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
য়আয়েশা নুসরাত জাহান :শিক্ষার্থী লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments