বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন by ড. এম আফজাল হোসেন

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে দীর্ঘ ৯ মাস কারা নির্যাতন ভোগ করে স্বপ্নের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে পা রাখেন আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক, জাতির পিতা ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তাই বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এ দিনটি অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুদৃঢ় ও দূরদর্শী নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম ও যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে আমরা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রিয় স্বাধীনতা। তাঁরই অসীম সাহস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৪১তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তাঁর বিদেহি আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
বড় বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিল মধুমতী ও বাঘিয়া তীরের নিভৃত পল্লীর ছায়াঢাকা টুঙ্গিপাড়া গ্রামের অতি আদরের খোকা নামের শিশুটি উত্তরকালে যাঁকে আমরা বঙ্গবন্ধু হিসেবে পেয়েছি। বাংলার সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার সংগ্রাম, নীলচাষ বিদ্রোহ ও প্রজা আন্দোলনের ধারা, সুভাষ চন্দ্রের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল দর্শন। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের অসাম্প্র্রদায়িকতা, শেরেবাংলা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। তাঁর বিচিত্র বর্ণাঢ্যজীবন সম্পূর্ণরূপে লিখে কখনো শেষ করা সম্ভব নয়। কারণ একটি- 'তোমার কীর্তির চেয়ে, তুমি যে মহৎ।'
১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করলেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের হাতে অর্থাৎ পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। বঙ্গবন্ধু দেশে নিরাপদে ফিরে না আসা পর্যন্ত বিজয় অসম্পূর্ণ বলে মনে করেছেন সমগ্র বাঙালি জাতি ও বিশ্ববাসী। অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিজয় পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। স্বদেশবাসীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আবেগাপ্লুত হন বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামের এই মহানায়ক। তিনি স্বাধীনতাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার উদাত্ত আহ্বান করে বলেন, 'আজ থেকে আমার হুকুম প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, ভাই হিসেবে তোমরা আমার ভাই, আমি তোমাদের ভাই। আমাদের এ স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, মা-বোন কাপড় না পায়, যুবকরা কাজ না পায়।' তিনি মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ ও সর্বস্তরের কর্মীকে মোবারকবাদ জানিয়ে বলেন, 'তোমরা লড়েছো, গেরিলা হয়েছো, রক্ত দিয়েছো- রক্তদান বৃথা যায় না। দেশকে স্বাধীন করেছ। আজ থেকে বাংলায় যেন চুরি ডাকাতি না হয়।'
বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শুরু হয় মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অন্যায় ও অবিচার থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু লড়াই করেছেন নিরন্তর। মানুষকে বাঁচার মতো বাঁচতে দেওয়াই ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। স্বাধীনতার পর এক ধ্বংসস্তূপ থেকে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। অনেকে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলেও অভিহিত করেছেন। কোনো অবকাঠামো, অর্থনৈতিক সুকাঠামো এমনকি ছিল না পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমন এক সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার জন্য তাঁর মনপ্রাণ অস্থির থাকত। সে সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের পর দেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার প্রাথমিক দায়িত্ব নেয় ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী এক কোটি মানুষকে পুনর্বাসিত করার। স্বাধীন বাংলাদেশের বিধ্বস্ত কাঠামোকে পুনর্গঠনের অগ্রাধিকার দেয়। প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হচ্ছে এর মধ্যে অন্যতম। বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দ্রুত সচল করার কাজে বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। আন্তর্জাতিক লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য পুনঃস্থাপন ও ত্বরান্বিত করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। বঙ্গবন্ধু শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কম্পানি রাষ্ট্রীয়করণ করেন এবং ভূমি ও মূলধন বাজেয়াপ্ত করে ভূমি পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে কৃষকদের সাহায্য করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা, স্যানিটেশন, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করে দেশের অর্থনৈতিক সংকট এবং দুর্ভিক্ষ রোধ করতে সক্ষম হন। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত পাঁচ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনায় কৃষি, গ্রামীণ অবকাঠামো ও কুটির শিল্পে রাষ্ট্রীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিধ্বস্ত প্রায় পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন করা, সেনাবাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে নিয়োজিত করা, মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ করা, চোরাচালান বন্ধ করা, বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করা, অভ্যন্তরীণ নাশকতামূলক, প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপ রোধসহ অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার উদ্দেশ্যে যে যাত্রা শুরু করে, তা স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রি মহলের ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে থমকে দেওয়া হয়। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মানুষের অধিকারকে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কারণে আমরা আজ বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছি। তাঁকে হত্যা করা না হলে অনেক বছর আগেই একটি উন্নত, অসাম্প্রদায়িক, সুখী সুন্দর গণতান্ত্রিক আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গড়ে উঠত বলে আমি বিশ্বাস করি। তাঁকে হত্যা করে যে ক্ষতি হয়েছে, বাঙালি জাতির জন্য সে ক্ষতিপূরণ দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশ গড়ার যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তা অব্যাহত থাকবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার বঙ্গবন্ধুর দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত একটি আধুনিক ও আলোকিত বাংলাদেশ উপহার দিতে সক্ষম হবে। তাই বাঙালি জাতিকে ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে একাত্তরের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে জেগে উঠতে হবে এবং বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনার বাস্তবায়নের জন্য নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সফলতার মুখ দেখবে।

লেখক : অধ্যাপক, সাবেক উপাচার্য হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
mafzal07@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.