নির্বাচন যথেষ্ট নয়, তবে নির্বাচন হতে হবে by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র শুধু অসম্ভব নয়, অকল্পনীয়ও। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ দোদুল্যমান থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিয়মিত ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন বা ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত হচ্ছে।
এই প্রতিযোগিতামূলক অনুশীলনে প্রতিদ্বন্দ্বীরা পার্লামেন্টের ভেতরে বা বাইরে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য চেষ্টা করবেন। আইন বা সংবিধানের স্বেচ্ছামতো ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁরা নিজের পাতের দিকে ঝোল টানার চেষ্টা করবেন। তাঁরা নির্বাচনী ইশতেহারে নানা অঙ্গীকারের কথা বলবেন, যা পালন করতে পারবেন কি না সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ না হয়েই। দেশের আইন ও সংবিধান মেনে যে নির্বাচন হবে, তা সবাইকে মেনে নিতে হবে। রাজপথের বিক্ষোভ বা অভ্যুত্থান বা অন্য কোনো অতিশয়-পন্থার আশ্রয় নিয়ে জনগণের সম্মতি ছিনতাই করে করতল করলে দেশে এমন অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে, যার শেষ কোথায়, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। প্রেমে আর যুদ্ধে যেমন, নির্বাচনে কোনো ন্যায়ান্যায় নেই যাঁরা বলেন, তাঁদের নির্বাচনে জিতলে সব ঠিক, না জিতলে সব বেঠিক। যত দিন নির্বাচনে হারার ভয় প্রতিদ্বন্দ্বীরা না জয় করছেন, তত দিন নির্বাচন হবে ব্যয়বহুল ও জবরদস্তিমূলক। 'হারি জিতি নাহি লাজ'- এই ক্রীড়াসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে যেকোনো ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্লেদাক্ত ও পঙ্কিল হতে বাধ্য। প্রতিপক্ষকে যেনতেন প্রকারে ঘায়েল করার চেষ্টায় সাধারণ ভোটাররাও নানাভাবে লাঞ্ছিত হতে পারেন।
আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ হয়েছে- কোনো সময় তা সূক্ষ্ম, আবার কোনো সময় তা স্থূল হিসেবে অভিহিত হয়েছে। 'আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব'- এই স্লোগানের জন্ম নাকি আমাদের দেশে! সেই স্লোগানে বিশ্বাস করে নির্বাচনমুগ্ধ কত বাংলাদেশি প্রতি নির্বাচন শেষে জীবনের সবচেয়ে কত বড় বিপদ যে ডেকে আনে, তা আমরা গত কয়েক নির্বাচন শেষে লক্ষ করেছি। এমন ভয়াবহ উদ্দামতা ও নৃশংসতা জানা থাকলে অ্যাথেনিয়ান গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ তাঁর ফিউন্যারাল ওরেশান, সৎকার ভাষণের নতুন করে মুসাবিদা করতেন। নির্বাচনের নন্দীভৃঙ্গীরা কী ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নির্বাচনের ফলাফলকে বিষময় করে তুলতে পারে।
আজ বিশ্বের বহু দেশে গণতন্ত্রের পরীক্ষা চলছে। আপাতদৃষ্টিতে একাধিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অনুদার গণতন্ত্র হিসেবে অভিহিত হয়েছে। উপনিবেশ-বিমুক্তির সময় বহু দেশে যেসব রাজনৈতিক দল স্বাধীনতা অর্জন করে, তাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ফ্যাসিজম পরিলক্ষিত হয়। দেশবন্দনার ওপরে নেতৃবন্দনা, স্তাবকতা, জঙ্গি তৎপরতা ও ক্যাডার সন্ত্রাস খুদে স্বৈরাচারী সৃষ্টি করে। একটা সফল রাজনৈতিক দল যদি নিজেদের শৃঙ্খলায় না আনতে পারে, তবে তা ফ্যাসিস্ট বা ফ্যাসিস্টসম আকার ধারণ করতে পারে। মাও জা তোং চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সম্বন্ধে একবার বলেছিলেন, পার্টি যদি নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ না করে, তাহলে তা ফ্যাসিস্ট হয়ে যাবে। এটা সব সফল পার্টির ক্ষেত্রেই সত্য। যে একনিষ্ঠ, আনুগত্য ও সংহতি স্বাধীনতা বা মুক্তি আন্দোলনে থাকা উচিত, তা স্বাধীনতা-উত্তরকালেও যদি অন্ধভাবে অনুশীলন করা হয় তাহলে ভিন্নমতের বিকাশ ঘটবে না, ক্ষমতাসীন দল কস্তুরীর মতো নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকবে এবং যেকোনো বিরোধিতাকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য করবে।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি অতিমাত্রায় বিদ্বিষ্ট হলে গণতন্ত্রের জন্য আবহাওয়া দুষ্ট হয়ে ওঠে। যেখানে প্রতিটি দল মৃত নেতার বন্দনায় নিজেরা নিয়োজিত থাকে, সেখানে সামান্য কথা বড় হয়ে দেখা দেয়। জিয়াউর রহমানকে 'অখ্যাত মেজর' যে উক্তি করেন আওয়ামী লীগ নেত্রী, তা বিএনপির পক্ষে গ্রহণ বা সহ্য করা কঠিন। ২৫ মার্চ ২০০৩ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান সমগ্র জাতির সম্পদ', তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর সমান্তরাল করার চেষ্টা হচ্ছে।'
এর আগে ২৯ জুলাই ১৯৯৮ পল্টনের জনসভায় খালেদা জিয়া বলেন, 'আগামী দিনেও পঁচাত্তরের মতো অবস্থা হবে। পঁচাত্তরে যেমন কেউ চোখের পানি ফেলেনি, ইন্না লিল্লাহ পড়েনি, জনগণ বলেছিল নাজাত পেয়েছে, আবারও তা-ই হবে।' ৩ মে ১৯৯৯ জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেন, '১৫ আগস্টের পরিবর্তনে জনগণ কাঁদেনি; বরং হেসেছিল। আবারও অমন ঘটনা ঘটলে জনগণ খুশি হবে।' ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগের কখনোই স্বাভাবিক পতন হয় না। প্রধানমন্ত্রীর পিতারও অস্বাভাবিক পতন হয়েছে। তাঁর একই অবস্থা হবে।'
৩ নভেম্বর ১৯৯৯ গোলাম আযম বলেন, 'শেখ হাসিনা জোর করে শেখ মুজিবকে জাতির পিতা বানাতে চাচ্ছেন। যাঁর মৃত্যুতে দেশের মানুষ চোখের পানি ফেলেনি, তাঁকে জাতির পিতা বলা যায় না। এর জন্য গণভোট হতে হবে।'
আমাদের দেশে বিরোধী দল যেভাবে সংসদ বয়কট করে, তাতে দেশে গণতন্ত্রবৃক্ষের অকালে মৃত্যু ঘটবে। বিরোধীদলীয় নেত্রী সরকারদলীয় নেত্রীর সমকক্ষ হতে চান প্রতি পদক্ষেপে এবং প্রতিটি প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরীক্ষায় জয়লাভ করতে চান। ভিন্ন সম্ভাবনা থাকলে তাঁরা সংসদে যাবেন না। ১৪ জানুয়ারি ২০০২ বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন, 'সংসদে যাওয়ার পরিবেশ নেই। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ সংসদে গিয়েই বা কী করবে?'
আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ উপনেতা অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ ১৭ জানুয়ারি ২০০২ বলেন, 'দুই নেত্রীর সুসম্পর্ক না হলে গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত হবে। আওয়ামী লীগ ১৯৭৩-এ, বিএনপি ১৯৭৯-তে এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৯৮৮-তে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়েছিল; কিন্তু তাদের সরকার কত দিন স্থায়ী হয়েছিল? সুতরাং জোট সরকারের বাক-বাকুম করার কোনো কারণ নেই।' ৫ জুলাই ২০০২ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি বলেন, 'শুধু চেহারা দেখাতে থাকতে পারি না।' নির্বাচনে তাঁকে ভোটে জয়যুক্ত করা হয় যেন তিনি নিয়মিত সংসদে চেহারা দেখাবেন এবং দেশের সমস্যার কথা বলবেন।
নির্বাচনের দিন ও তার কিছু আগে-পরে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে আমাদের এক দলের বিশেষ আবেদন থাকে। ১২ সেপ্টেম্বর ২০০১ রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ যথার্থই বলেন, 'সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে কয়েকটি রাজনৈতিক দল অতি উৎসাহী হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক কাজ পুলিশের। প্রতিরক্ষা বাহিনী হলো সর্বশেষ অবলম্বন। এই প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস কিংবা বিতর্কিত করবে এমন কিছুই করা উচিত নয়।'
সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখন শিবিরের ভাষায় একটা রাজনৈতিক দলকে 'গেট লস্ট' বলে খেদিয়ে দেয়, তখন লোকে একটা বার্তা পায় যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কোন দলের পক্ষ টেনে কথা বলছে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচন এক মরণ-বাঁচন পরীক্ষা নয়, বরং প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করা জনগণকে সেবা করার, সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা আত্মসেবা করারও সুযোগ পাবে তা নির্ণয় করা; কিন্তু যেখানে পার্টি স্বর্গঃ, পার্টি ধর্মঃ, পার্টি হি পরমং তপঃ, যেমন- গণতন্ত্রে পার্টির, পার্টির দ্বারা এবং পার্টির জন্য সেখানে নির্বাচন একটা মরণ-বাঁচন অগ্নিপরীক্ষা। আপনি যে দলের সমর্থক- সে দল হেরে গেলে যদি আপনার ছাত্রাবাস থেকে বিতাড়িত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে, আপনি যদি সরকারি চাকুরে হন, তবে চাকরি হারাতে পারেন বা নিদেনপক্ষে ওএসডি হয়ে যেতে পারেন, আপনি সরকারি কর্মের জন্য পরীক্ষা দিয়ে মৌখিক নম্বর ২০০ বৃদ্ধি করায় মাচকাফেরে পড়তে পারেন, আপনি যদি ক্রিকেট বা ফুটবল একাদশের মধ্যে থাকেন, তবে সেখান থেকে বাদ পড়তে পারেন, আপনার সম্পত্তির বা সুন্দরী কন্যা ও সুন্দরী বউয়ের জন্য অযথা নানা ধরনের ঝুটঝামেলায় পড়তে পারেন এবং যেকোনো ধরনের নিয়োগ বা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আপনাকে বিচিত্র প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, আপনি আদালতে যে মামলা করেছিলেন, তা নির্বাহী ক্ষমতাবলে 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' বলে প্রত্যাহৃত হতে পারে এবং কপাল মন্দ হলে আপনার ঘরে আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কৃত হয়ে বা অন্য যেকোনো উদ্ভাবনযোগ্য অভিযোগে আপনি কারারুদ্ধ হতে পারেন। আমাদের দেশে তাই নির্বাচনের সময় বেশ ভোট পড়ে। নির্বাচন তো শুধু ভোট দেওয়া নয়, এ এমন এক ভাগ্যপরীক্ষা, যা আপনার জন্য জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।
আর যদি আপনার সমর্থিত দল জয়লাভ করে, তবে আপনার সুদিন ফিরতে পারে। যেসব ব্যবসায় সরকারের অনুমতি বা অনুমোদন লাগে, সেখানে আপনি সুবিধা করতে পারবেন। সংসদ সদস্য হতে হবে না। দলের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে আপনি ব্যাংক, বীমা, বিশ্ববিদ্যালয়, কোস্টাল শিপিং ইত্যাদি নানা উদ্যোগে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবেন। একটু বুদ্ধিশুদ্ধি খাটিয়ে চাঁদাবাজি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকেও ফায়দা তুলতে পারবেন। আর যদি সৌভাগ্যবান হন, তবে রাজউকের প্লট পেতে পারেন এবং নেতাদের সফরসঙ্গী হিসেবে দেশ-বিদেশে ঘোরাফেরাও করতে পারেন। আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ যদি দণ্ডিত হন, তবে তাঁর দণ্ডের জন্য আপনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমাপ্রাপ্তির চেষ্টা করতে পারবেন। আপনার চেষ্টা কামিয়াব হলে আপনার স্বজন দেশে ফিরে আদালতে হাজির না হয়েও মাফ পেয়ে যাবেন। নির্বাচন সত্যিই আমাদের এক মরণ-বাঁচন পরীক্ষা।
গণতন্ত্রের আরেক অপরিহার্য আবশ্যকীয়তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচার ক্ষমতা যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব। ঢাল নেই, তরোয়াল নেই- এমন বিচার বিভাগ নিঃসহায় জেনে সংবিধানে লেখা রয়েছে, প্রশাসনের প্রত্যেক বিভাগ বিচার বিভাগের সহায়তায় কাজ করবে। যাঁরা দুর্ভাবনায় ছিলেন এবং যাঁদের পরামর্শে বিচার বিভাগকে পৃথক করলে বা ম্যাজিস্ট্রেসিকে স্বীয় বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করতে দিলে সরকার টালমাটাল অবস্থায় পড়বে, তাঁদের শাসনকাল স্থায়ী হয়নি। বিচার বিভাগকে এমন সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে যে এ ব্যাপারে সংবিধানের সর্বাধিক সংখ্যক সংশোধনী পাস করা হয়েছে। বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় আঘাত আসে নির্বাচিত সরকারের আমলে। যুক্তফ্রন্টে নেতাদের ২১ দফায় বিচার বিভাগ পৃথক করার কথা ছিল। কথার খেলাপ না করে আইন পাস করা হয়; কিন্তু মুনাফেকি করে সে আইন জারি করা হয়নি। বিচার বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত কিছু নির্দেশ দিলে সব নির্বাচিত সরকার নির্লজ্জের মতো বারবার সময় নিয়ে কালক্ষেপণ করেছে। এ ব্যাপারে সব আইনমন্ত্রী সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তাঁরা আইনকে কোনো দিন নিজের গতিতে চলতে দেননি, বরং তাঁদের সমস্ত অন্যথা ওই বাচনভঙ্গির পক্ষপুটে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছেন। অবশেষে এক অনির্বাচিত সরকারের সময় সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথম কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আর অভিমানে এক নির্বাহী অফিসার অনশন করার হুমকি দেন। এখন সর্বশেষ জেলা প্রশাসকদের মামলায় আবদার করা হয়েছে যে তাঁদের আদালত অবমাননার জন্য যেন কোর্টে হাজির না হতে হয়। পৃথিবীর কোন কোন দেশে এমনতর আবদার করেছেন নির্বাহী অফিসাররা, আমি সঠিক জানি না।
ব্রিটিশরা স্থানীয় সরকারের জন্য কিছু কুঁড়েঘর বানিয়েছিল। আমাদের মূল সংবিধানে দুটি পাকাপোক্তা বিধান ছিল। চতুর্থ সংশোধনীতে সেগুলো বিলোপ করা হয়। ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর দ্বারা দুটি বিধানই পুনঃস্থাপিত হয়; কিন্তু স্থানীয় সরকারের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসক বা নায়েব-গোমস্তা দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। স্থানীয় সরকারকে গণতন্ত্রের সূতিকাগার ভেবে সেই প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক দেশে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া। আমরা সেই সূতিকাগারের চাল ভেঙে বেড়া খুলে ফেলেছি। রাজধানীতে বসে যে সংসদ সদস্যের আইন প্রণয়নে ব্যস্ত থাকার কথা, তাঁরা মুনশিদের হাতে সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে অ-আইন প্রণয়নে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। আমি একাধিকবার বলেছি, বাংলাদেশের যদি সাম্রাজ্য থাকত, তবে সে জাহান্নাম থেকে কোনো দেশ পরিত্রাণ পেত না।
আমাদের দেশে প্রথম স্থানীয় নির্বাচন হয় ১৮৭১ সালে। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছরে ১৪টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি গণভোট, তিনটি রাষ্ট্রপতি এবং ৯টি সংসদ নির্বাচন। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে, তেমনি ভোট চুরি, কারচুপি ও সহিংস নির্বাচনও হয়েছে। কারচুপি দুই প্রকার, সূক্ষ্ম এবং স্থূল। ভোট চুরি ছাড়াও ভোট ডাকাতি হয়েছে। পাতানো নির্বাচন বা নির্বাচনের ট্র্যাজেডির নিদর্শন রয়েছে। তবে নির্বাচনের ফলাফল সেসব ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ফলত প্রভাবান্বিত হয়নি।
গ্রিক ভাষা থেকে উদ্ভূত ডেমোক্রেসির মানে জনগণের শাসন। জাতির বা জনগণের নেতা নির্বাচন করা এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বটে। স্বাভাবিকভাবেই এহেন ঘটনায় মানুষের আকর্ষণ ও কৌতূহল রয়েছে। যদিও বেশির ভাগ দেশে নির্বাচন এক দিন কা তামাশায় পর্যবসিত হলেও এর গুরুত্ব কম নয়। যেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়া দুষ্ট সেখানে নেতৃত্ব বৈধতা অর্জন করে না এবং দেশে অস্থিরতা বৃদ্ধি করে। রাজনৈতিক ক্ষমতা সীমিত করার জন্য নির্বাচন দরকার। স্বৈরশাসকরা অবশ্য এই ব্যবস্থার তেমন সমঝদার নয়, যদিও সাদাসাপ্টা গণভোটে তাদের উৎসাহ দেখা যায়। গণতন্ত্রে সরকারের ক্ষমতা প্রথমত সময় দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে নির্বাচনের দ্বারা তার পরিবর্তন ঘটানো হয়। কোনো কোনো দেশে সংবিধান দ্বারা মেয়াদ সীমাবদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যত বড়ই দক্ষ ও জনপ্রিয় হোক না কেন, তিনি দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। অনুরূপ মেয়াদসীমা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন করা হয়েছে। যেমন গুয়াতেমালায় শাভেজের ক্ষেত্রে। আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমাবদ্ধ করা হয়নি।
গণতন্ত্রে নির্বাচনই হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা যে দেশে উন্নত ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয় সে দেশে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ভালো। এখন বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতার বিভাজন কেবল নির্বাহী, আইন প্রণয়নকারী ও বিচার বিভাগের ঐতিহ্য নির্দেশিত হরাইজেন্টাল বা পৃথক্করণে সীমাবদ্ধ নয়। ওই অনুভূমিক ক্ষমতার বিভাজন যথেষ্ট নয় ভেবে অনেকে আজ বলছেন ক্ষমতার বিভাজন ভার্টিক্যাল বা উল্লম্বও হতে হবে। শীর্ষে কেন্দ্রীয় সরকার ও নিম্নে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের বিভিন্ন এককসমূহের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিভাজনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
জগৎসভায় আমরা অপাঙ্ক্তেয় হয়ে থাকতে পারি না। রাষ্ট্র নামের যোগ্য হতে হলে রাষ্ট্রকে একটা অপরিহার্য ব্যবস্থার সৃষ্টি করতে হবে, জনগণ যেন তাদের মতামত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ পায় পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে। ১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ঘোষণার ২১(ক) ধারায় বলা হয়- 'প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের সরকারে অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।' ওই ধারার উপধারা (গ)তে বলা হয়েছে : 'জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি। এই ইচ্ছা সর্বজনীন ও সমান ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ও প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্ত হবে। গোপন ব্যালট বা এ ধরনের অবাধ ভোটদান পদ্ধতিতে এরূপ অনুষ্ঠিত হবে।' একই কথা আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সনদ, ১৯৬৬-এর ২৫ ধারায় পুনরুল্লেখ করে বলা হয়েছে : 'প্রত্যেক নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার ও সুযোগ থাকবে এবং সে ব্যাপারে কোনো বৈষম্য বা অন্যায্য বাধা থাকবে না। নির্বাচকদের মুক্ত ইচ্ছা প্রকাশের নিরাপত্তা বিধানের জন্য এমন ব্যবস্থা থাকবে যে প্রত্যেক নাগরিক তার সর্বজনীন ও সমতাভিত্তিক ভোটাধিকারের বলে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমিকভাবে অনুষ্ঠিত প্রকৃত নির্বাচনে ভোট দিতে এবং ভোট দ্বারা নিজেকে নির্বাচিত করতে পারবে।'
চৌকস আমলা, ইতিহাসবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সম্প্রতি বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য চার রকমের ফর্মুলা দিয়েছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান অন্তর্বর্র্তী সরকারের বিষয়ে চারটি প্রস্তাব দেন। এক প্রস্তাবে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ বিএনপির ৩৬ জন আইনপ্রণেতার মধ্য থেকে পাঁচজনকে বাছাই করতে পারে। আর বিএনপি প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের ২৭৪ জন সংসদ সদস্যের মধ্য থেকে পাঁচজনকে বাছাই করতে পারে। তাঁদের নিয়ে অন্তর্বর্র্তী সরকারের মন্ত্রিসভা গঠিত হতে পারে।
তাঁর দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিল, রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুপ্রিম কোর্টকে পরামর্শ দিতে পারেন, যেমনটা ১৯৯৬ সালে করা হয়েছিল। তৃতীয় প্রস্তাবটি ছিল, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ১০ জন নিরপেক্ষ লোকের নাম দিতে পারে। এরপর তাদের দেওয়া নামগুলো থেকে জাতীয় সংসদ পাঁচজনকে নির্বাচন করতে পারে। তাঁরা সবাই মিলে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করতে পারেন, অথবা লটারির মাধ্যমেও প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হতে পারেন।
চতুর্থ প্রস্তাবটি ছিল, আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিএনপি একটি পরিকল্পনা দিতে পারে। এর পর বিএনপির ওই প্রস্তাবের ওপর গণভোট হতে পারে।
গত ৩১ ডিসেম্বর সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা এক নতুন ফর্মুলা দিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সব নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে দিলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসবে। এই নির্বাচন সবাই মেনে নেবে। এ ব্যাপারে বিরোধী দল কোনো প্রস্তাব এখনো দেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ফর্মুলা দেওয়া হোক না, পরের সওয়াল হবে কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দেবেন- সে হবে আরেক লাখ টাকার প্রশ্ন।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'আগামী নির্বাচনে জনগণের রায় মেনে নেব।' লাখ কথার এক কথা। আমরা এখনো ভালো করে হার মানতে শিখিনি। এই হার মেনে নেওয়ার সবক আমাদের নেওয়া একান্ত দরকার। এর জন্য আমি এখনো মনে করি, দলীয় সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। একাধিকবার হারতে-জিততে নির্বাচনের ফলাফল গা-সহা হয়ে আমাদের রপ্ত হবে। নিজেদের আত্মমর্যাদা সম্পর্কে অযথা সন্দিহান হয়ে আমরা নির্দলীয় গোপাল রাজার অন্বেষণ করছি। তালগাছটা আমার হোক বা না-হোক আমি নির্বাচনে প্রদত্ত জনগণের রায় মাথা পেতে নেব- এই বিশ্বাসে এ বছর আমাদের কাজ করে যেতে হবে।
লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা
আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ হয়েছে- কোনো সময় তা সূক্ষ্ম, আবার কোনো সময় তা স্থূল হিসেবে অভিহিত হয়েছে। 'আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব'- এই স্লোগানের জন্ম নাকি আমাদের দেশে! সেই স্লোগানে বিশ্বাস করে নির্বাচনমুগ্ধ কত বাংলাদেশি প্রতি নির্বাচন শেষে জীবনের সবচেয়ে কত বড় বিপদ যে ডেকে আনে, তা আমরা গত কয়েক নির্বাচন শেষে লক্ষ করেছি। এমন ভয়াবহ উদ্দামতা ও নৃশংসতা জানা থাকলে অ্যাথেনিয়ান গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ তাঁর ফিউন্যারাল ওরেশান, সৎকার ভাষণের নতুন করে মুসাবিদা করতেন। নির্বাচনের নন্দীভৃঙ্গীরা কী ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নির্বাচনের ফলাফলকে বিষময় করে তুলতে পারে।
আজ বিশ্বের বহু দেশে গণতন্ত্রের পরীক্ষা চলছে। আপাতদৃষ্টিতে একাধিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অনুদার গণতন্ত্র হিসেবে অভিহিত হয়েছে। উপনিবেশ-বিমুক্তির সময় বহু দেশে যেসব রাজনৈতিক দল স্বাধীনতা অর্জন করে, তাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ফ্যাসিজম পরিলক্ষিত হয়। দেশবন্দনার ওপরে নেতৃবন্দনা, স্তাবকতা, জঙ্গি তৎপরতা ও ক্যাডার সন্ত্রাস খুদে স্বৈরাচারী সৃষ্টি করে। একটা সফল রাজনৈতিক দল যদি নিজেদের শৃঙ্খলায় না আনতে পারে, তবে তা ফ্যাসিস্ট বা ফ্যাসিস্টসম আকার ধারণ করতে পারে। মাও জা তোং চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সম্বন্ধে একবার বলেছিলেন, পার্টি যদি নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ না করে, তাহলে তা ফ্যাসিস্ট হয়ে যাবে। এটা সব সফল পার্টির ক্ষেত্রেই সত্য। যে একনিষ্ঠ, আনুগত্য ও সংহতি স্বাধীনতা বা মুক্তি আন্দোলনে থাকা উচিত, তা স্বাধীনতা-উত্তরকালেও যদি অন্ধভাবে অনুশীলন করা হয় তাহলে ভিন্নমতের বিকাশ ঘটবে না, ক্ষমতাসীন দল কস্তুরীর মতো নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকবে এবং যেকোনো বিরোধিতাকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য করবে।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি অতিমাত্রায় বিদ্বিষ্ট হলে গণতন্ত্রের জন্য আবহাওয়া দুষ্ট হয়ে ওঠে। যেখানে প্রতিটি দল মৃত নেতার বন্দনায় নিজেরা নিয়োজিত থাকে, সেখানে সামান্য কথা বড় হয়ে দেখা দেয়। জিয়াউর রহমানকে 'অখ্যাত মেজর' যে উক্তি করেন আওয়ামী লীগ নেত্রী, তা বিএনপির পক্ষে গ্রহণ বা সহ্য করা কঠিন। ২৫ মার্চ ২০০৩ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান সমগ্র জাতির সম্পদ', তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর সমান্তরাল করার চেষ্টা হচ্ছে।'
এর আগে ২৯ জুলাই ১৯৯৮ পল্টনের জনসভায় খালেদা জিয়া বলেন, 'আগামী দিনেও পঁচাত্তরের মতো অবস্থা হবে। পঁচাত্তরে যেমন কেউ চোখের পানি ফেলেনি, ইন্না লিল্লাহ পড়েনি, জনগণ বলেছিল নাজাত পেয়েছে, আবারও তা-ই হবে।' ৩ মে ১৯৯৯ জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেন, '১৫ আগস্টের পরিবর্তনে জনগণ কাঁদেনি; বরং হেসেছিল। আবারও অমন ঘটনা ঘটলে জনগণ খুশি হবে।' ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগের কখনোই স্বাভাবিক পতন হয় না। প্রধানমন্ত্রীর পিতারও অস্বাভাবিক পতন হয়েছে। তাঁর একই অবস্থা হবে।'
৩ নভেম্বর ১৯৯৯ গোলাম আযম বলেন, 'শেখ হাসিনা জোর করে শেখ মুজিবকে জাতির পিতা বানাতে চাচ্ছেন। যাঁর মৃত্যুতে দেশের মানুষ চোখের পানি ফেলেনি, তাঁকে জাতির পিতা বলা যায় না। এর জন্য গণভোট হতে হবে।'
আমাদের দেশে বিরোধী দল যেভাবে সংসদ বয়কট করে, তাতে দেশে গণতন্ত্রবৃক্ষের অকালে মৃত্যু ঘটবে। বিরোধীদলীয় নেত্রী সরকারদলীয় নেত্রীর সমকক্ষ হতে চান প্রতি পদক্ষেপে এবং প্রতিটি প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরীক্ষায় জয়লাভ করতে চান। ভিন্ন সম্ভাবনা থাকলে তাঁরা সংসদে যাবেন না। ১৪ জানুয়ারি ২০০২ বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন, 'সংসদে যাওয়ার পরিবেশ নেই। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ সংসদে গিয়েই বা কী করবে?'
আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ উপনেতা অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ ১৭ জানুয়ারি ২০০২ বলেন, 'দুই নেত্রীর সুসম্পর্ক না হলে গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত হবে। আওয়ামী লীগ ১৯৭৩-এ, বিএনপি ১৯৭৯-তে এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৯৮৮-তে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়েছিল; কিন্তু তাদের সরকার কত দিন স্থায়ী হয়েছিল? সুতরাং জোট সরকারের বাক-বাকুম করার কোনো কারণ নেই।' ৫ জুলাই ২০০২ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি বলেন, 'শুধু চেহারা দেখাতে থাকতে পারি না।' নির্বাচনে তাঁকে ভোটে জয়যুক্ত করা হয় যেন তিনি নিয়মিত সংসদে চেহারা দেখাবেন এবং দেশের সমস্যার কথা বলবেন।
নির্বাচনের দিন ও তার কিছু আগে-পরে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে আমাদের এক দলের বিশেষ আবেদন থাকে। ১২ সেপ্টেম্বর ২০০১ রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ যথার্থই বলেন, 'সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে কয়েকটি রাজনৈতিক দল অতি উৎসাহী হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক কাজ পুলিশের। প্রতিরক্ষা বাহিনী হলো সর্বশেষ অবলম্বন। এই প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস কিংবা বিতর্কিত করবে এমন কিছুই করা উচিত নয়।'
সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখন শিবিরের ভাষায় একটা রাজনৈতিক দলকে 'গেট লস্ট' বলে খেদিয়ে দেয়, তখন লোকে একটা বার্তা পায় যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কোন দলের পক্ষ টেনে কথা বলছে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচন এক মরণ-বাঁচন পরীক্ষা নয়, বরং প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করা জনগণকে সেবা করার, সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা আত্মসেবা করারও সুযোগ পাবে তা নির্ণয় করা; কিন্তু যেখানে পার্টি স্বর্গঃ, পার্টি ধর্মঃ, পার্টি হি পরমং তপঃ, যেমন- গণতন্ত্রে পার্টির, পার্টির দ্বারা এবং পার্টির জন্য সেখানে নির্বাচন একটা মরণ-বাঁচন অগ্নিপরীক্ষা। আপনি যে দলের সমর্থক- সে দল হেরে গেলে যদি আপনার ছাত্রাবাস থেকে বিতাড়িত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে, আপনি যদি সরকারি চাকুরে হন, তবে চাকরি হারাতে পারেন বা নিদেনপক্ষে ওএসডি হয়ে যেতে পারেন, আপনি সরকারি কর্মের জন্য পরীক্ষা দিয়ে মৌখিক নম্বর ২০০ বৃদ্ধি করায় মাচকাফেরে পড়তে পারেন, আপনি যদি ক্রিকেট বা ফুটবল একাদশের মধ্যে থাকেন, তবে সেখান থেকে বাদ পড়তে পারেন, আপনার সম্পত্তির বা সুন্দরী কন্যা ও সুন্দরী বউয়ের জন্য অযথা নানা ধরনের ঝুটঝামেলায় পড়তে পারেন এবং যেকোনো ধরনের নিয়োগ বা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আপনাকে বিচিত্র প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, আপনি আদালতে যে মামলা করেছিলেন, তা নির্বাহী ক্ষমতাবলে 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' বলে প্রত্যাহৃত হতে পারে এবং কপাল মন্দ হলে আপনার ঘরে আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কৃত হয়ে বা অন্য যেকোনো উদ্ভাবনযোগ্য অভিযোগে আপনি কারারুদ্ধ হতে পারেন। আমাদের দেশে তাই নির্বাচনের সময় বেশ ভোট পড়ে। নির্বাচন তো শুধু ভোট দেওয়া নয়, এ এমন এক ভাগ্যপরীক্ষা, যা আপনার জন্য জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।
আর যদি আপনার সমর্থিত দল জয়লাভ করে, তবে আপনার সুদিন ফিরতে পারে। যেসব ব্যবসায় সরকারের অনুমতি বা অনুমোদন লাগে, সেখানে আপনি সুবিধা করতে পারবেন। সংসদ সদস্য হতে হবে না। দলের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে আপনি ব্যাংক, বীমা, বিশ্ববিদ্যালয়, কোস্টাল শিপিং ইত্যাদি নানা উদ্যোগে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবেন। একটু বুদ্ধিশুদ্ধি খাটিয়ে চাঁদাবাজি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকেও ফায়দা তুলতে পারবেন। আর যদি সৌভাগ্যবান হন, তবে রাজউকের প্লট পেতে পারেন এবং নেতাদের সফরসঙ্গী হিসেবে দেশ-বিদেশে ঘোরাফেরাও করতে পারেন। আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ যদি দণ্ডিত হন, তবে তাঁর দণ্ডের জন্য আপনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমাপ্রাপ্তির চেষ্টা করতে পারবেন। আপনার চেষ্টা কামিয়াব হলে আপনার স্বজন দেশে ফিরে আদালতে হাজির না হয়েও মাফ পেয়ে যাবেন। নির্বাচন সত্যিই আমাদের এক মরণ-বাঁচন পরীক্ষা।
গণতন্ত্রের আরেক অপরিহার্য আবশ্যকীয়তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচার ক্ষমতা যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব। ঢাল নেই, তরোয়াল নেই- এমন বিচার বিভাগ নিঃসহায় জেনে সংবিধানে লেখা রয়েছে, প্রশাসনের প্রত্যেক বিভাগ বিচার বিভাগের সহায়তায় কাজ করবে। যাঁরা দুর্ভাবনায় ছিলেন এবং যাঁদের পরামর্শে বিচার বিভাগকে পৃথক করলে বা ম্যাজিস্ট্রেসিকে স্বীয় বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করতে দিলে সরকার টালমাটাল অবস্থায় পড়বে, তাঁদের শাসনকাল স্থায়ী হয়নি। বিচার বিভাগকে এমন সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে যে এ ব্যাপারে সংবিধানের সর্বাধিক সংখ্যক সংশোধনী পাস করা হয়েছে। বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় আঘাত আসে নির্বাচিত সরকারের আমলে। যুক্তফ্রন্টে নেতাদের ২১ দফায় বিচার বিভাগ পৃথক করার কথা ছিল। কথার খেলাপ না করে আইন পাস করা হয়; কিন্তু মুনাফেকি করে সে আইন জারি করা হয়নি। বিচার বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত কিছু নির্দেশ দিলে সব নির্বাচিত সরকার নির্লজ্জের মতো বারবার সময় নিয়ে কালক্ষেপণ করেছে। এ ব্যাপারে সব আইনমন্ত্রী সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তাঁরা আইনকে কোনো দিন নিজের গতিতে চলতে দেননি, বরং তাঁদের সমস্ত অন্যথা ওই বাচনভঙ্গির পক্ষপুটে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছেন। অবশেষে এক অনির্বাচিত সরকারের সময় সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথম কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আর অভিমানে এক নির্বাহী অফিসার অনশন করার হুমকি দেন। এখন সর্বশেষ জেলা প্রশাসকদের মামলায় আবদার করা হয়েছে যে তাঁদের আদালত অবমাননার জন্য যেন কোর্টে হাজির না হতে হয়। পৃথিবীর কোন কোন দেশে এমনতর আবদার করেছেন নির্বাহী অফিসাররা, আমি সঠিক জানি না।
ব্রিটিশরা স্থানীয় সরকারের জন্য কিছু কুঁড়েঘর বানিয়েছিল। আমাদের মূল সংবিধানে দুটি পাকাপোক্তা বিধান ছিল। চতুর্থ সংশোধনীতে সেগুলো বিলোপ করা হয়। ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর দ্বারা দুটি বিধানই পুনঃস্থাপিত হয়; কিন্তু স্থানীয় সরকারের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসক বা নায়েব-গোমস্তা দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। স্থানীয় সরকারকে গণতন্ত্রের সূতিকাগার ভেবে সেই প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক দেশে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া। আমরা সেই সূতিকাগারের চাল ভেঙে বেড়া খুলে ফেলেছি। রাজধানীতে বসে যে সংসদ সদস্যের আইন প্রণয়নে ব্যস্ত থাকার কথা, তাঁরা মুনশিদের হাতে সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে অ-আইন প্রণয়নে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। আমি একাধিকবার বলেছি, বাংলাদেশের যদি সাম্রাজ্য থাকত, তবে সে জাহান্নাম থেকে কোনো দেশ পরিত্রাণ পেত না।
আমাদের দেশে প্রথম স্থানীয় নির্বাচন হয় ১৮৭১ সালে। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছরে ১৪টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি গণভোট, তিনটি রাষ্ট্রপতি এবং ৯টি সংসদ নির্বাচন। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে, তেমনি ভোট চুরি, কারচুপি ও সহিংস নির্বাচনও হয়েছে। কারচুপি দুই প্রকার, সূক্ষ্ম এবং স্থূল। ভোট চুরি ছাড়াও ভোট ডাকাতি হয়েছে। পাতানো নির্বাচন বা নির্বাচনের ট্র্যাজেডির নিদর্শন রয়েছে। তবে নির্বাচনের ফলাফল সেসব ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ফলত প্রভাবান্বিত হয়নি।
গ্রিক ভাষা থেকে উদ্ভূত ডেমোক্রেসির মানে জনগণের শাসন। জাতির বা জনগণের নেতা নির্বাচন করা এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বটে। স্বাভাবিকভাবেই এহেন ঘটনায় মানুষের আকর্ষণ ও কৌতূহল রয়েছে। যদিও বেশির ভাগ দেশে নির্বাচন এক দিন কা তামাশায় পর্যবসিত হলেও এর গুরুত্ব কম নয়। যেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়া দুষ্ট সেখানে নেতৃত্ব বৈধতা অর্জন করে না এবং দেশে অস্থিরতা বৃদ্ধি করে। রাজনৈতিক ক্ষমতা সীমিত করার জন্য নির্বাচন দরকার। স্বৈরশাসকরা অবশ্য এই ব্যবস্থার তেমন সমঝদার নয়, যদিও সাদাসাপ্টা গণভোটে তাদের উৎসাহ দেখা যায়। গণতন্ত্রে সরকারের ক্ষমতা প্রথমত সময় দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে নির্বাচনের দ্বারা তার পরিবর্তন ঘটানো হয়। কোনো কোনো দেশে সংবিধান দ্বারা মেয়াদ সীমাবদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যত বড়ই দক্ষ ও জনপ্রিয় হোক না কেন, তিনি দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। অনুরূপ মেয়াদসীমা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন করা হয়েছে। যেমন গুয়াতেমালায় শাভেজের ক্ষেত্রে। আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমাবদ্ধ করা হয়নি।
গণতন্ত্রে নির্বাচনই হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা যে দেশে উন্নত ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয় সে দেশে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ভালো। এখন বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতার বিভাজন কেবল নির্বাহী, আইন প্রণয়নকারী ও বিচার বিভাগের ঐতিহ্য নির্দেশিত হরাইজেন্টাল বা পৃথক্করণে সীমাবদ্ধ নয়। ওই অনুভূমিক ক্ষমতার বিভাজন যথেষ্ট নয় ভেবে অনেকে আজ বলছেন ক্ষমতার বিভাজন ভার্টিক্যাল বা উল্লম্বও হতে হবে। শীর্ষে কেন্দ্রীয় সরকার ও নিম্নে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের বিভিন্ন এককসমূহের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিভাজনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
জগৎসভায় আমরা অপাঙ্ক্তেয় হয়ে থাকতে পারি না। রাষ্ট্র নামের যোগ্য হতে হলে রাষ্ট্রকে একটা অপরিহার্য ব্যবস্থার সৃষ্টি করতে হবে, জনগণ যেন তাদের মতামত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ পায় পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে। ১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ঘোষণার ২১(ক) ধারায় বলা হয়- 'প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের সরকারে অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।' ওই ধারার উপধারা (গ)তে বলা হয়েছে : 'জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি। এই ইচ্ছা সর্বজনীন ও সমান ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ও প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্ত হবে। গোপন ব্যালট বা এ ধরনের অবাধ ভোটদান পদ্ধতিতে এরূপ অনুষ্ঠিত হবে।' একই কথা আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সনদ, ১৯৬৬-এর ২৫ ধারায় পুনরুল্লেখ করে বলা হয়েছে : 'প্রত্যেক নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার ও সুযোগ থাকবে এবং সে ব্যাপারে কোনো বৈষম্য বা অন্যায্য বাধা থাকবে না। নির্বাচকদের মুক্ত ইচ্ছা প্রকাশের নিরাপত্তা বিধানের জন্য এমন ব্যবস্থা থাকবে যে প্রত্যেক নাগরিক তার সর্বজনীন ও সমতাভিত্তিক ভোটাধিকারের বলে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমিকভাবে অনুষ্ঠিত প্রকৃত নির্বাচনে ভোট দিতে এবং ভোট দ্বারা নিজেকে নির্বাচিত করতে পারবে।'
চৌকস আমলা, ইতিহাসবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সম্প্রতি বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য চার রকমের ফর্মুলা দিয়েছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান অন্তর্বর্র্তী সরকারের বিষয়ে চারটি প্রস্তাব দেন। এক প্রস্তাবে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ বিএনপির ৩৬ জন আইনপ্রণেতার মধ্য থেকে পাঁচজনকে বাছাই করতে পারে। আর বিএনপি প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের ২৭৪ জন সংসদ সদস্যের মধ্য থেকে পাঁচজনকে বাছাই করতে পারে। তাঁদের নিয়ে অন্তর্বর্র্তী সরকারের মন্ত্রিসভা গঠিত হতে পারে।
তাঁর দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিল, রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুপ্রিম কোর্টকে পরামর্শ দিতে পারেন, যেমনটা ১৯৯৬ সালে করা হয়েছিল। তৃতীয় প্রস্তাবটি ছিল, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ১০ জন নিরপেক্ষ লোকের নাম দিতে পারে। এরপর তাদের দেওয়া নামগুলো থেকে জাতীয় সংসদ পাঁচজনকে নির্বাচন করতে পারে। তাঁরা সবাই মিলে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করতে পারেন, অথবা লটারির মাধ্যমেও প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হতে পারেন।
চতুর্থ প্রস্তাবটি ছিল, আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিএনপি একটি পরিকল্পনা দিতে পারে। এর পর বিএনপির ওই প্রস্তাবের ওপর গণভোট হতে পারে।
গত ৩১ ডিসেম্বর সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা এক নতুন ফর্মুলা দিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সব নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে দিলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসবে। এই নির্বাচন সবাই মেনে নেবে। এ ব্যাপারে বিরোধী দল কোনো প্রস্তাব এখনো দেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ফর্মুলা দেওয়া হোক না, পরের সওয়াল হবে কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দেবেন- সে হবে আরেক লাখ টাকার প্রশ্ন।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'আগামী নির্বাচনে জনগণের রায় মেনে নেব।' লাখ কথার এক কথা। আমরা এখনো ভালো করে হার মানতে শিখিনি। এই হার মেনে নেওয়ার সবক আমাদের নেওয়া একান্ত দরকার। এর জন্য আমি এখনো মনে করি, দলীয় সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। একাধিকবার হারতে-জিততে নির্বাচনের ফলাফল গা-সহা হয়ে আমাদের রপ্ত হবে। নিজেদের আত্মমর্যাদা সম্পর্কে অযথা সন্দিহান হয়ে আমরা নির্দলীয় গোপাল রাজার অন্বেষণ করছি। তালগাছটা আমার হোক বা না-হোক আমি নির্বাচনে প্রদত্ত জনগণের রায় মাথা পেতে নেব- এই বিশ্বাসে এ বছর আমাদের কাজ করে যেতে হবে।
লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা
No comments