সিডনির মেলব্যাগ- নববর্ষের নতুন আলোর বঙ্গদেশ ও প্রবাসী ভাবনা by অজয় দাশ গুপ্ত
নববর্ষের ঊষালগ্নে সিডনির বিশ্বনন্দিত আলোকসজ্জা, আতশবাজি, নয়নাভিরাম অপেরা হাউস ও ব্রিজ ঘিরে আলোর উৎসব অন্য এক আমেজ তৈরি করে। বছরের পর বছর ধরে এই জৌলুস প্রত্যক্ষ করছি। দেশ-বিদেশের মানুষ ছুটে আসে, তাঁদের মন জুড়ায়, অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়।
কিন্তু ক্লান্তি নামে না। ক্লান্তিহীন বিনোদন ও নিয়মমাফিক আনন্দের ভেতর তফাৎ আছে। সিডনির প্রাক নববর্ষ উদ্যাপন, নতুন বছর বরণের উৎসবে ক্লান্তিহীন তারুণ্যকে দেখে মনে হয় ‘সার্থক জনম’ এদের। মানুষ তো একটি জীবনই যাপন করে। আর সে জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময় যৌবন, কেন? তার উত্তরও আমাদের অজানা নয়। জীবনের এই সময় শরীর ও মন যে ঝুঁকি নিতে পারে, যে উত্তেজনা আবেগ বা সাহস বহন করে তা আর কোন সময়ই সম্ভব হয় না বা নিতে পারে না। পৃথিবীর ইতিহাসই তার উজ্জ্বল প্রমাণ। বাংলাদেশের ইতিহাসও তার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। যৌবনে মানুষ মা জননী দেশ-মাতৃকার জন্য প্রাণ দিতে পারে। সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে পারে। দ্রোহের আগুনে নতুন পৃথিবী নির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সিডনির প্রাক নবর্ষের আলোকসজ্জা, উন্মাদনায় আদর্শ বা ত্যাগের ভূমিকা ব্যাপক কিছু নয়। বরং চারদিকে ছড়িয়ে থাকা পানীয়ের বোতল, বিয়ারের ক্যান বা উন্মাদনা দেখে মনে হবে ভোগ ব্যতীত আর কিছুই জানে না তারা। কথাটা অর্ধসত্য। অর্ধসত্য বলেই একে গ্যারান্টেড বা সম্পূর্ণ কিছু মনে করার ভেতর বিপদ লুকিয়ে আছে। এই তরুণ-তরুণীরা জীবনকে যতটা ভোগ করে তার চেয়ে অধিক করে উপভোগ। ভোগ ও উপভোগের তফাৎ আমাদের অজানা কিছু নয়। ভোগের পর ক্লান্তি অবসান বা পাপবোধ জাগে, জাগতে পারে; অন্যদিকে উপভোগ নির্মল আনন্দের অন্তহীন এক উৎস। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের তারুণ্য যে জীবনে অভ্যস্ত বা যেভাবে জীবন কাটায় তাতে এ জাতীয় একটি দিন না থাকলেও তার উপভোগে কোন যতি পড়বে না। দৈনন্দিন আনন্দ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সুরক্ষিত বলয়ে উল্লাসমুখর জীবনে হত্যা, ধ্বংস বা রাজনীতির করাল থাবা নেই। নেই বলেই ছোটখাটো দুর্ঘটনা আর স্বভাবসুলভ অনিয়ম বা নিয়ম ভাঙ্গার বাইরে দা, চাপাতি নিয়ে দৌড়ায় না তাঁরা। এই যে বিশাল লক্ষাধিক মানুষের রাত্রি উদ্যাপন সস্তায় অবগাহন কোথাও আইন বা শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে না। নাচ, গান, বাজনা বা পানাহারের ঘাটতি নেই। ঘাটতি নেই বন্ধু-বান্ধবীরও। যুগলের আনন্দ সম্মিলনে আকুলতা থাকলেও দিল্লী কায়দায় শরীর ধর্ষণ নেই। গণধর্ষণ ঘটনার কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। দেশ ও সরকার যেখানে সজাগ, বিরোধী দল বা প্রতিপক্ষ যেখানে আইন অনুগামী সে সমাজের মানুষ নিরাপদ থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।প্রতিবছর ইংরেজী নববর্ষের প্রাকলগ্নে আমাদের দেশের বড় বড় শহরে এমনকি ছোট শহরেরও আরেক ধরনের উন্মাদনা বা উত্তেজনার খবর পাওয়া যায়। বড় অদ্ভুত দেশ আমাদের। ধর্মের নামে এত হৈ হৈ, সংস্কার আর গলাবাজির পরও সারাক্ষণ অন্যায় অনাচার চুরি ডাকাতি খুন-জখম চলছে। হাল আমলে যোগ হয়েছে নানা অজুহাতে যৌন উন্মাদনার অতল আহ্বান। ইংরেজী নববর্ষ উদ্যাপন আমাদের যৌবনেও অপরিচিত কিছু ছিল না। আনন্দের প্রাচীন ধারা ভেঙ্গে তারুণ্যের সর্বনাশে যোগ হওয়া মাদক নেশা বা নারী পাশ্চাত্যের অবদান নয়। এ ধারা যোগ হয়েছে চলছে আমাদের অন্তর্গত দুর্বলতা আর হীনতার ভেতর থেকে। সমাজে দৃশ্যমান অন্যান্য দুর্ঘটনা বা উৎপাতগুলোর মতো এই প্রবণতাও সামাজিক অবক্ষয় আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফল। যে কারণে সিডনি, ইউরোপ বা আমেরিকার নববর্ষ উদ্যাপনে সহিংসতা, যৌনতা কিংবা বল্গাহীনতা থাকে না। থাকলেও নিয়ম ভেঙ্গে খান খান করতে পারে না। আজকাল ঢাকার কথিত অভিজাত এলাকায় থার্টিফার্স্টের নামে যে ব্যভিচার তা নৈতিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রায় নাকের ডগায় জায়গা করে নিয়েছে। বলছিলাম প্রাক নববর্ষে সিডনির আনন্দময় অভিজ্ঞতা ও তরুণ-তরুণীদের কথা। আমাদের দেশটি স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও তারুণ্য তো বটেই, কারও জন্য কোন আনন্দ নির্বিঘ্ন করতে পারেনি। পারেনি মানুষের জীবনের মতো অমূল্য সম্পদের সুরক্ষা দিতে। সরকার বদলে যায়, প্রত্যাশা বদলায়, আশা মোড় নেয়; কিন্তু দুর্ভাবনা যায় না, সমস্যা ঘোচে না।
শুধু উৎসব, আনন্দের বিপদ বা ন্যায়-অন্যায় নয়, আজ আরও অনেক প্রশ্ন হাজির হয়েছে। আমাদের বিবেকের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো কঠিন বাস্তবতা। আছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের ওপর প্রতিবেশীর বদ নজর। আছে মস্তানতন্ত্র আর জেহাদের জঙ্গী উন্মাদনা। যেসব দেশে এ জাতীয় মৌলিক সমস্যা নেই; মানুষ রাজনীতি ও জীবনকে আলাদা মর্যাদা ও স্থান দিতে পেরেছে তারাই আনন্দে বাস করছে। বছর শুরুর আগে প্রতিবার নতুন বছরে নতুন আনন্দের ধারা সাক্ষী রেখে ঘুমাতে যায় তারা। শপথ করে আরও ভালও জীবন, আরও প্রাণময় উচ্ছল ভবিষ্যত উদ্যাপনের। আমরা পারি না। আমাদের চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় সাগর-রুনী, রক্তাক্ত শার্টের বিশ্বজিৎ। বিশ্বজিতের করুণ আর্তি, ঘাতকের চাপাতি, নানা ধরনের জঙ্গী উৎপাত আর যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন বাঁচিয়ে জেগে উঠুক নতুন স্বদেশ। এ দেশের তারুণ্য, নিষ্পাপ যৌবন কোন অন্যায় করেনি। তাঁদের সুভবিষ্যৎ আর নিরাপদ জীবনের গ্যারান্টি দেয়ার ভেতরই উত্তর, অন্য কিছুতে নয়।
dasguptaajoy@hotmail.com
No comments