কচি হাতে রংতুলি, গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ ॥ হাসি-কান্নার ইতিহাস- জাতীয় জাদুঘরে শিশু কিশোর চিত্র প্রদর্শনী by মোরসালিন মিজান
সকলেই কচিকাঁচা। কেউ মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তবে অল্প অল্প করে জানছে ইতিহাস। অনুধাবন করার চেষ্টা করছে। সে চেষ্টাটি সম্পর্কে জানতে হলে এখনই একবার ঘুরে আসা চাই জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারি।
গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে এখানে চলছে ক্ষুদে শিল্পীদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছবির প্রদর্শনী। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীরা নিজের মতো করে এঁকেছে মুক্তিযুদ্ধকে। এর আগে পরের ইতিহাস, বাঙালীর গৌরব, হাসি-কান্না চমৎকারভাবে তুলে ধরেছে তারা। দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
শিল্পীদের সকলেই স্কুলপড়ুয়া। শিশু থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত ‘ক’ বিভাগ। এ বিভাগের প্রতিযোগীরা এঁকেছেন নিজের পছন্দমত। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ‘খ’ বিভাগের প্রতিযোগী। তাঁদের ছবি আঁকার বিষয় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল কিশোর মুক্তিযোদ্ধা, একাত্তরের রণাঙ্গনে, কৃষক মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু, ২৫ মার্চের কালরাত্রী ও নৌপথে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ। ‘গ’ বিভাগের প্রতিযোগীরা ছিল ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তাদের আঁকার বিষয় ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা, সাঁওতাল মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ক্যাম্প ও নারী মুক্তিযোদ্ধা। নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ছিল ‘ঘ’ বিভাগের প্রতিযোগী। তাদের আঁকার বিষয় ছিল বিজয় উল্লাস, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, বঙ্গন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং মুক্তিযুদ্ধে সংস্কৃতিকর্মীদের অবদান। হ্যাঁ, নানা বিষয়। তবে একই সূত্রে গাঁথা। গৌরবের মুক্তিযুদ্ধকেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে ছোট ছেলেমেয়েরা। জনযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব ব্যাখ্যা করতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটিকে বেছে নিয়েছে অনেকেই। চমৎকার এঁকেছে ‘গ’ বিভাগের প্রতিযোগী মেহেনাজ আহমেদ মম। এতটুকুন শিল্পী। তবে ছবি দেখে সেটি বোঝার উপায় নেই। বরং রেসকোর্সের উত্তাল জনসমুদ্রের কথা মনে পড়ে যায়। একই বিষয় রওনক জাহানের ছবিতে। এখানে তর্জনী উঁচিয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন বাঙালীর মহান নেতা। ৭ মার্চ এঁকেছে মাইশা মালিহা সিদ্দিকীসহ আরও কয়েকজন। বিষয় এক হলেও শিল্পীদের ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপনা যেকারও ভাল লাগবে। পাকবাহিনীর বর্বরতার ইতিহাসটিও নিজেদের মতো করে তুলে ধরেছে ক্ষুদে শিল্পীরা। একাধিক ক্যানভাসে গণহত্যার চিত্র। বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের ছবি এঁকেছে রংপুরের প্রতিযোগী অন্তরা ইসলাম। তাঁর ছবিতে শিলালিপি সম্পাদক সেলিনা পারভীন। হ্যাঁ, সেই বীভৎস ছবি। ক্ষতবিক্ষত দেহ। চোখ বাঁধা। নিথর দেহটি পড়ে আছে রায়েরবাজারের এঁদোডোবায়। ছবিটি আরও একবার যেন স্মরণ করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার জন্য বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে বাংলার নারীদের। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণগুলোও দিব্যি এঁকেছে কচিকাঁচা হাতগুলো। এলমা মাহবুবের আঁকা একটি ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য। এ আক্রমণে যারপরনাই নাস্তানাবুদ পাকিস্তানী বাহিনী। দুঃসাহসী আক্রমণ চালাতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন বহু মুক্তিযোদ্ধা। আহতও হয়েছেন অসংখ্য। আহতদের বিভিন্ন সেবা ক্যাম্পে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। সেইসব সেবা ক্যাম্পের ছবি এঁকেছে ক্ষুদে শিল্পীরা। এমন বেশ কয়েকটি ছবি আছে প্রদর্শনীতে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আসে বিজয়। নাকে খদ দেয় পাকিস্তানী বাহিনী। ঐতিহাসিক এই মুহূর্তটি সুন্দর এঁকেছে মৌলভীবাজারের অভিজিৎ দেব রাতুল। মায়ের জন্য স্বাধীন পতাকা হাতে ফেরা মুক্তিযোদ্ধার মুখটি এঁকেছে স্বাক্ষর দাস। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ অবধি তুলে ধরার চেষ্টা করেছে ছোট আঁকিয়েরা।
প্রদর্শনীটি নতুন বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি পর্যন্ত সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
No comments