ভারত জেগে উঠেছে মানবতার পক্ষে by আম্বা বাত্রা বকশি ও চন্দ্রানী ব্যানার্জি

আমরা দিদির কোনো বদনাম শুনিনি এ পর্যন্ত। তিনি আমাদের পরিবারের গর্ব। যৌন হয়রানির শিকার মেয়েটির দুই ভাই নতুন দিল্লির সফদার জং হাসপাতালের আইসিওর সামনে বসে এভাবেই তাঁদের বোন সম্পর্কে বলছিলেন। এটা মেয়েটিকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক আগের ঘটনা।
ভারতে এমন ঘটনা কতই তো ঘটছে। নিভৃতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এভাবে প্রচারমাধ্যমে আসে না। কিন্তু দিল্লিতে গণধর্ষণের শিকার এই মেয়েটি গোটা ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাঁর আরোগ্য লাভের জন্য শহর-গ্রাম-নির্বিশেষে কোটি মানুষের প্রার্থনা- এই বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মানবতার পক্ষে মানুষের জেগে ওঠার কথাই মনে করিয়ে দেয়। ভারতের শহর-বন্দরে সব পেশা ও মতের মানুষ একাট্টা হয়ে গেছে এই বর্বরতার বিরুদ্ধে। ছাত্র-শিক্ষক সব বয়সের নারী-পুরুষ মধ্যবিত্ত থেকে সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে জাগরণ তৈরি হয়েছে ব্যাপক। তারা মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় প্রতিবাদের ভাষা জোরালো হয়ে উঠছে। আউটলুক ম্যাগাজিন এই গণজাগরণের প্রধান চরিত্রকে জাগ্রুতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। মেয়েটিকে বছরের আলোচিত নারী হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে। বলা হয়েছে তিনি জাতিকে জাগিয়ে দিয়েছেন।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্যাতিত পরিবারগুলোর মধ্যে সহমর্মিতার সুর এক হয়ে দেখা দিয়েছে। গত বছর মুম্বাইয়ে একটি মেয়েকে গণধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন যুবক কিনান। কিনানের বাবা ভ্যালেরিয়ান সন্তোষ বলেন, 'মেয়েটি আমার হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছি যৌন হয়রানি মানুষকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বুঝতে পারি সন্তান হারানোর ব্যথা কতটা। আমার হারানো ছেলের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি এই মেয়েটির মধ্যে। তার এই বিপদে আমার কান্না থামিয়ে রাখতে পারিনি।'
জাগ্রুতি অন্য সব সাধারণ মেয়ের মতোই সেদিন এক বন্ধুসহ সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। সিনেমা দেখে তিনি বন্ধুকে নিয়েই বাড়ি ফিরছিলেন। বাসে আক্রান্ত হলে তাঁর বন্ধুও ধর্ষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী জাগ্রুতি প্রচণ্ড মানসিক শক্তি নিয়ে ধর্ষকদের প্রতিরোধ করার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু ওরা ছিল ছয়জনের একটি সংঘবদ্ধ চক্র।
জাগ্রুতির মতো অসংখ্য মেয়ে প্রতিদিনই ভারতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কিন্তু জাগ্রুতি যেভাবে প্রতিবাদের স্রোত তৈরি করতে পেরেছে সেগুলো তেমনটা করতে পারেনি। ভারতের এমন ঘটনা নিয়ে লেখা সব কলাম ও প্রতিবেদনে এমন তথ্য বেরিয়ে আসছে। জাগ্রুতির এই ঘটনা গোটা ভারতের মধ্যবিত্তদের নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর এই ঘটনা তাদের মনে করিয়ে দিয়েছে আধুনিক ও পুরনো যুগের সংমিশ্রণে যে ভারত এগিয়ে যাচ্ছে, সেই দেশে তাদের মেয়েরা কতটা অসহায়। কতটা নিরাপত্তাহীন অবস্থায় তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন এই সমাজ- তার প্রমাণ পাওয়া যায় জাগ্রুতি নির্যাতিত হওয়ায় গণজাগরণের দিকে তাকানোর পর।
একেবারে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের মধ্যে জাগরণ তৈরি হয় প্রথম। একের পর এক মানুষ রাজপথে নেমে আসে। একাত্মতা ঘোষণা করে তারা। রাজনীতিবিদদের মধ্যে দোদুল্যমান একটা পরিস্থিতি প্রথম অবস্থায় বিরাজ করছিল। তারা মনে করছিল, এটা প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনো মিছিল কিংবা প্রতিবাদ হবে হয়তো। প্রচারমাধ্যমগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসে। তারা ছড়িয়ে পড়ে জাগ্রুতি যেখানে শুয়ে ছিল সেই হাসপাতালের সামনে ও রাজপথে। প্রিন্ট ও টেলিভিশন মিডিয়ার প্রচার দেখে মনে হতে পারে তারাও যেন মিশে গেছে সাধারণ মানুষের কাতারে। গণজাগরণ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের সবাইকেই নাড়া দেয়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্টের স্পিকার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি- সবাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়। সরকার একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ইতিমধ্যে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর পি এন সিং সাংবাদিকদের বলেছেন, দিল্লি পুলিশের ওয়েবসাইটে ধর্ষণকারীদের নাম-ঠিকানা দেওয়া হবে।
এ ধরনের ঘটনার পরিসংখ্যান খুবই হতাশাজনক। উত্তর প্রদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী তরুণ রাজনীতিবিদ অখিলেশ যাদব নতুন এবং উপযোগী আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর ১০ মাসের শাসনামলে অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালিকাকে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩৫টি, যাদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছে ধর্ষণকারীদের হাতে। ২০১১ সালে রাজ্যে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৮৯৫টি। রাজ্যের অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিচালক অরুণ কুমার স্বীকার করেছেন, মানুষ নারীর প্রতি নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে দিনের পর দিন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, নারী নির্যাতনের ৬১ হাজার অভিযোগ পাওয়া গেছে মাত্র এক মাসের মধ্যে।
মহারাষ্ট্র কমিশন ফর উইমেন এর প্রধান নেই চার বছর ধরে। এমন কমিশনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই তাই প্রশ্ন উঠেছে। কমিশনের সাবেক এক চেয়ারপারসন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, নারীর নিরাপত্তা নিয়ে যে কেউ কথা বলবে- এমন কেউ নেই। রেড ব্রিগেড নামের একটি সংগঠনের জন্ম হয়েছে লক্ষ্নৌতে। সদস্যদের বেশির ভাগের বয়স ১৭ থেকে ২৫ বছর। তারা লাল কোর্তা আর কালো সালোয়ার পরে। নির্যাতিতদের সহযোগিতা করে তারা। আদালত কিংবা সামাজিকভাবে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার কারণে তাদের সুনামও আছে।
কলকাতায়ও এ ঘটনার রেশ ধরে মানুষ ফুঁসে উঠেছে। সমাজবিজ্ঞানী ভোলা ভদ্র বলেছেন, এটা সাময়িক উত্তেজনার প্রতিফলন। কিন্তু এমন বর্বরতাকে রাতারাতি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। এই বর্বরতা থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে সামাজিক পরিবর্তন অপরিহার্য। আমাদের পাঠ্য বই থেকে শুরু করে অনেক জায়গায়ই নারীর অমর্যাদাকর অবস্থান চিহ্নিত। এসব ঘটনার পেছনে এগুলোও কাজ করছে।
জাগ্রুতি আধুনিক ভারতের নাগরিক। তিনি শিক্ষিত সমাজের একজন। তিনি পশ্চিমের ধাঁচে পোশাক পরিধান করতে পারেন। কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধগুলো কি তাঁর সঙ্গে এগিয়ে যেতে পেরেছে? আজকে বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে এটিও।
জাগ্রুতি দেরাদুনের একটি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ থেকে চার বছরের ফিজিওথেরাপি কোর্স সম্পন্ন করেছেন। একটি বিমান কম্পানিতে চাকরি করেন তাঁর বাবা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর জন্য তিনি উত্তর প্রদেশে তাঁর পৈতৃক জমিজিরেত বিক্রি করেছেন। নিজের সন্তানদের লেখাপড়ায় এগিয়ে নিতে পেরে তিনি নিজেকে গর্বিত মনে করছেন। প্যারামেডিক হিসেবে পেশা শুরু করার পূর্ব মুহূর্তে তাঁর মেয়ে ইন্টার্নি করছিলেন। অনেক আশা ছিল বাবার মনে।
জাগ্রুতিকে প্রথম হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি নিজের অসুবিধার কথাগুলো বলছিলেন। এক সময় তিনি কাগজে লিখে দিয়েছিলেন, তাঁর গলায় ব্যথা হচ্ছে। গলা পরিষ্কার করার জন্য চিকিৎসককে তিনি অনুরোধও জানিয়েছিলেন। সফদার জং হাসপাতালে স্থানান্তরের পর তাঁর অবস্থা নাজুক পর্যায়ে চলে যায়। এক পর্যায়ে রাত পেরিয়ে যাবে কি না এমন সন্দেহও তৈরি হয়। সবশেষে সিঙ্গাপুর নিতে হলো তাঁকে।
(সংক্ষিপ্ত)
লেখকদ্বয় : ভারতীয় সাংবাদিক
আউটলুক থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.