৩০০ ফুটের জন্য জমি নিয়ে ৬৪ ফুট রাস্তা!-আরো ২০০ ফুট অধিগ্রহণের পরিকল্পনা রাজউকের by অমিতোষ পাল
৩০০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার জন্য সাধারণ মানুষের স্বর্ণতুল্য জমি পানির দামে অধিগ্রহণ করে মাত্র ৬৪ ফুট প্রশস্ত রাস্তা বানাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
শুধু তা-ই নয়, এখন আবার রাজউক বলছে, ওই রাস্তার জন্য দুই পাশে ১০০ ফুট করে আরো ২০০ ফুট জায়গা অধিগ্রহণ করতে হবে পানি নিষ্কাশনকাজে। এমন অবস্থায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে রাজধানীর খিলক্ষেত, ডুমনি, রূপগঞ্জের হাজার হাজার মানুষ। তাদের কথা, 'বিভিন্ন সময় সরকারের প্রয়োজনে জমি দিয়ে নিঃস্ব হয়েছি। এবার জীবন দেব কিন্তু আর জমি দেব না।' এ জন্য তারা একটি প্রতিরোধ কমিটিও গঠন করেছে। সরকারের সঙ্গে দেনদরবারও হয়েছে। কিন্তু নকশা থেকে ২০০ ফুট জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা এখনো বাদ দেওয়া হয়নি। তাই ভুক্তভোগীদের মধ্যে ক্ষোভ আরো দানা বাঁধছে।
জানা গেছে, কুড়িল প্রগতি সরণি থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ৩০০ ফুট চওড়া রাস্তার জন্য ২০ বছর আগে জমি অধিগ্রহণ করে রাজউক। অধিগ্রহণের সময় বলা হয়েছিল, মূল রাস্তা ১০০ ফুট চওড়া হবে। এর উভয় পাশে ৫০ ফুট করে অযান্ত্রিক যানবাহন চলার জন্য রাস্তা থাকবে। তার পাশে আরো ৫০ ফুট করে জায়গা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হবে। কিন্তু ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) বাইরে দুই পাশে আরো ২০০ ফুট জায়গা ওয়াটার বডি হিসেবে রাখা হয়। বলা হয়, নতুন করে ২০০ ফুট জায়গা অধিগ্রহণ করতে হবে। এর পরই এলাকার জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের অভিযোগ, অতীতে ৩০০ ফুট জমি অধিগ্রহণের সময় একবার তারা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। আবারও জমি অধিগ্রহণ করলে নতুন করে তারাই ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তারা জানায়, সরকার নির্ধারিত একটি মূল্য রয়েছে। সেই মূল্য কাঠাপ্রতি এক-দুই লাখ টাকার বেশি নয়। সরকার অধিগ্রহণ করলে এর দেড় গুণ দাম দেয়। প্রথম দফায় অধিগ্রহণের সময় ওই সব জমির প্রতি কাঠার মূল্য ছিল আট-দশ লাখ টাকা। অথচ জামির মালিকদের দেওয়া হয়েছিল এক-দেড় লাখ টাকা। বর্তমানে এসব জায়গায় প্রতি কাঠার মূল্য স্থানভেদে ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। অথচ সরকারি দর সর্বোচ্চ চার লাখ টাকা। কাজেই নতুন করে অধিগ্রহণ করলে তারাই আবার ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে। অনেকে পথেও বসবে।
নকশায় যা ছিল, এখন যা হচ্ছে : রাজউকের নকশায় দেখা গেছে, ৬৪ ফুট রাস্তার মধ্যে ১০ ফুট প্রশস্ত বিভাজক রাখা হয়েছে। সেখানে গাছপালা লাগানো হবে। এ ছাড়া উভয় পাশে ৩৩ ফুট করে মোট ৬৬ ফুট জায়গা রাখা হয়েছে বনায়নের জন্য। ৩৮ ফুট করে ৭৬ ফুট রাখা হয়েছে স্টর্ম স্যুয়ারেজের জন্য। এ ছাড়া এক পাশে ৩৬ ফুট ও অপর পাশে ৪৮ ফুট করে মোট ৮৪ ফুট জায়গা রাখা হয়েছে সিসি ব্লক স্থাপনের জন্য। এতে দেখা যাচ্ছে, ৩০০ ফুট জায়গার মধ্যে কেবল রাস্তার জন্য আছে মাত্র ৬৪ ফুট। আরো যে ২০০ ফুট জায়গা অধিগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে পানি নিষ্কাশনের ওয়াটার বডির জন্য, সেখানেও রাস্তা হবে না। অর্থাৎ মোট ৫০০ ফুট প্রশস্ত জমি অধিগ্রহণ করলেও রাস্তা হচ্ছে সেই ৬৪ ফুটেই।
এ রকম নকশার কথা শুনে স্থানীয় জনগণ ও প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরা তীব্র আপত্তি জানায়। নিজেরাই নতুন নকশা বানিয়ে রাজউককে দেখিয়ে দেয়, ৩০০ ফুটের মধ্যেই প্রগতি সরণি থেকে পূর্বাচলে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করা যায় এবং রাস্তার মাঝের বিভাজকের ওপর দিয়ে একটি এলিভেটেড এঙ্প্রেসওয়ে বা মেট্রো রেলও স্থাপন করা যায়। কিন্তু রাজউক তাতে আগ্রহ দেখায়নি। কয়েক মাস আগে রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা ওই এলাকায় গেলে ঝাড়ুমিছিল বের করে এলাকাবাসী। জমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটির প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, বন ও পরিবেশমন্ত্রী, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীসহ এসব মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছে লিখিত আবেদন জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে রাজউক চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়। গত ২৭ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সরোজ কুমার নাথ চিঠি দিয়ে রাজউককে ওই সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে বলেন। এর পর অধিগ্রহণের কার্যক্রম স্থগিত থাকলেও ড্যাপ এখনো সংশোধন করা হয়নি। এ কারণে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ রয়েই গেছে।
অন্যদিকে গত ১৭ এপ্রিল স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খানকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন, 'ঢাকা শহরের খিলক্ষেত ও বাড্ডা থানার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিমানবন্দর ও সেনানিবাসের জন্য জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকুঞ্জ এলাকায় বারবার জমি অধিগ্রহণের শিকার হয়েছে। তারা বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে কুড়িল, কুড়াতলী, খিলক্ষেত, বরুয়া, ডুমনি, তলনা, ঢেলনাসহ বহু গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করছে। রাজউক থেকে ৩০০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধন এবং সামান্য কিছু পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্যাপে সংযোগ সড়কের উভয় পাশে আরো ১০০ ফুট প্রশস্ত ওয়াটার বডি রাখা হয়েছে। রাজউক ওই সড়ক ৩০০ ফুট প্রশস্ত ধরেই শুধু জমি অধিগ্রহণ করেছে, যার মধ্যে মাঝখান বরাবর ১০০ ফুট গতিসম্পন্ন গাড়ি ও উভয় পাশে ৫০ ফুট করে ধীরগতি সম্পন্ন গাড়ি চলাচল করার কথা। তার উভয় পাশে ৫০ ফুট করে ওয়াটার বডি থাকার কথা। অথচ চতুরতার সঙ্গে ড্যাপে ওই রাস্তার উভয় পাশে আরো ১০০ ফুট করে চওড়া ওয়াটার বডি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে রাস্তার প্রশস্ততা ৫০০ ফুটে দাঁড়াচ্ছে। অথচ ৩০০ ফুট জায়গাতেই যাবতীয় কিছু করা সম্ভব। অথবা দুই পাশে কালভার্ট নির্মাণ করেও অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের চেয়ে অনেক কম খরচে ডিজাইন করা সমীচীন। তাতে সরকারি অর্থের অপচয়রোধ ও জনগণের বিরাগভাজন থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এতে নিরীহ জনগণ ভূমি অধিগ্রহণের মতো মহাবিপদ থেকে রক্ষা পাবে ও সরকারের ভাবমূর্তি সমুন্নত থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।'
এসব বিষয় উল্লেখ করে সাহারা খাতুন এ সিদ্ধান্ত বন্ধ করার জোর অনুরোধ জানান।
ভুক্তভোগীরা জানায়, ড্যাপে রাজউক সুকৌশলে ৫০০ ফুট জায়গার কথা বলে রেখেছে। কারণ, এটা করা হলে ভুক্তভোগীরা রাজউকের দ্বারস্থ হবে আর রাজউকের কর্মকর্তারা অসাধু বাণিজ্য করতে পারবে।
এলাকাবাসী জানায়, "আমরা রাজউক চেয়ারম্যানকে জানালে তিনি আমাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং দ্রুত ড্যাপ সংশোধনের আশ্বাস দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি রাজউক। বর্তমানে এলাকাবাসীর দৃঢ় মনোভাব, 'জীবন দেব তুব জমি দেব না'।"
রাজউককে দেওয়া স্থানীয় ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটির স্মারকলিপিতে বলা হয়, এখানে ৫০০ ফুট চওড়া রাস্তা বাস্তবায়ন করতে গেলে একদিকে যেমন জনগণের ব্যাপক ক্ষতি হবে, অন্যদিকে সরকারেরও আরো ১০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাবে। কিন্তু তাতে কোনো অতিরিক্ত উপকার পাওয়া যাবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ৩০০ ফুট অধিগ্রহণের সময় ২০০ ফুট জায়গা রাস্তার জন্য রাখা হলেও এখন ৫০০ ফুটের মধ্যে মাত্র ৬৪ ফুট জায়গা রাস্তার জন্য রাখার পরিকল্পনা হয়েছে। এটা করলে জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কেরামত আলী দেওয়ান ক্ষোভ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এর আগে পুলিশের একটি প্রকল্পে আমার এক একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে প্রতি একরের দাম পেয়েছি ৫৭ লাখ টাকা। অথচ ওখানে এক কাঠারই দাম আছে ৫০ লাখ টাকা। আবার যদি ২০০ ফুট করে অধিগ্রহণ করে তাহলে আমার কোনো জমি থাকবে না। তখন আমরা কোথায় যাব?'
স্থানীয় বাসিন্দা ওমর আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা এটা নিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপির কাছে গিয়েছিলাম। তাঁরা সেটা বন্ধ করে রেখেছিলেন। আবার রাজউক অধিগ্রহণ করতে চাইলে জনগণ হতে দেবে না। দফায় দফায় অধিগ্রহণের ফলে জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আর না।'
ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়টি জানিয়েছি। তাঁরা একমত হয়েছেন। কিন্তু অধিগ্রহণ না করার বিষয়টি নিশ্চিত করছে না। ফলে ওই জমিতে কেউ কোনো অবকাঠামোও করতে পারছে না। আশা করব সরকার দ্রুতই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে। আর না নিলে জনগণ গাজীপুর উপশহর প্রকল্পের মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।'
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ইতিমধ্যে বালু ফেলে রাস্তার অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সড়কের জন্য ৬৪ ফুট নির্ধারিত হলেও বাস্তবে মনে হয়েছে তা আরো কম। অনুমান করে মনে হয়, ওই সড়ক ৫০ ফুটের বেশি প্রশস্ত হবে না। একজন নিরাপত্তাকর্মী জানায়, আপাতত এ রকম রাস্তাই হবে। পরবর্তী সময়ে হয়তো বাড়ানোও হতে পারে।
এসব প্রসঙ্গে রাজউকের চেয়ারম্যান নুরুল হুদার বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। তবে রাজউক বোর্ড সভার সদস্য (পরিকল্পনা) শেখ আবদুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আপাতত নতুন করে অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তটি স্থগিত আছে। ২০০ ফুট জায়গা তো কম না। আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি আর অধিগ্রহণের প্রয়োজন আছে কি না। বিদ্যমান জায়গাতেই সব কিছু করা সম্ভব কি না। যদি হয়, তাহলে আর অধিগ্রহণ করা হবে না। রিভিউ করার সময় ড্যাপেও সেটা সংশোধন করে দেওয়া হবে।'
জানা গেছে, কুড়িল প্রগতি সরণি থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ৩০০ ফুট চওড়া রাস্তার জন্য ২০ বছর আগে জমি অধিগ্রহণ করে রাজউক। অধিগ্রহণের সময় বলা হয়েছিল, মূল রাস্তা ১০০ ফুট চওড়া হবে। এর উভয় পাশে ৫০ ফুট করে অযান্ত্রিক যানবাহন চলার জন্য রাস্তা থাকবে। তার পাশে আরো ৫০ ফুট করে জায়গা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হবে। কিন্তু ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) বাইরে দুই পাশে আরো ২০০ ফুট জায়গা ওয়াটার বডি হিসেবে রাখা হয়। বলা হয়, নতুন করে ২০০ ফুট জায়গা অধিগ্রহণ করতে হবে। এর পরই এলাকার জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের অভিযোগ, অতীতে ৩০০ ফুট জমি অধিগ্রহণের সময় একবার তারা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। আবারও জমি অধিগ্রহণ করলে নতুন করে তারাই ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তারা জানায়, সরকার নির্ধারিত একটি মূল্য রয়েছে। সেই মূল্য কাঠাপ্রতি এক-দুই লাখ টাকার বেশি নয়। সরকার অধিগ্রহণ করলে এর দেড় গুণ দাম দেয়। প্রথম দফায় অধিগ্রহণের সময় ওই সব জমির প্রতি কাঠার মূল্য ছিল আট-দশ লাখ টাকা। অথচ জামির মালিকদের দেওয়া হয়েছিল এক-দেড় লাখ টাকা। বর্তমানে এসব জায়গায় প্রতি কাঠার মূল্য স্থানভেদে ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। অথচ সরকারি দর সর্বোচ্চ চার লাখ টাকা। কাজেই নতুন করে অধিগ্রহণ করলে তারাই আবার ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে। অনেকে পথেও বসবে।
নকশায় যা ছিল, এখন যা হচ্ছে : রাজউকের নকশায় দেখা গেছে, ৬৪ ফুট রাস্তার মধ্যে ১০ ফুট প্রশস্ত বিভাজক রাখা হয়েছে। সেখানে গাছপালা লাগানো হবে। এ ছাড়া উভয় পাশে ৩৩ ফুট করে মোট ৬৬ ফুট জায়গা রাখা হয়েছে বনায়নের জন্য। ৩৮ ফুট করে ৭৬ ফুট রাখা হয়েছে স্টর্ম স্যুয়ারেজের জন্য। এ ছাড়া এক পাশে ৩৬ ফুট ও অপর পাশে ৪৮ ফুট করে মোট ৮৪ ফুট জায়গা রাখা হয়েছে সিসি ব্লক স্থাপনের জন্য। এতে দেখা যাচ্ছে, ৩০০ ফুট জায়গার মধ্যে কেবল রাস্তার জন্য আছে মাত্র ৬৪ ফুট। আরো যে ২০০ ফুট জায়গা অধিগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে পানি নিষ্কাশনের ওয়াটার বডির জন্য, সেখানেও রাস্তা হবে না। অর্থাৎ মোট ৫০০ ফুট প্রশস্ত জমি অধিগ্রহণ করলেও রাস্তা হচ্ছে সেই ৬৪ ফুটেই।
এ রকম নকশার কথা শুনে স্থানীয় জনগণ ও প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরা তীব্র আপত্তি জানায়। নিজেরাই নতুন নকশা বানিয়ে রাজউককে দেখিয়ে দেয়, ৩০০ ফুটের মধ্যেই প্রগতি সরণি থেকে পূর্বাচলে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করা যায় এবং রাস্তার মাঝের বিভাজকের ওপর দিয়ে একটি এলিভেটেড এঙ্প্রেসওয়ে বা মেট্রো রেলও স্থাপন করা যায়। কিন্তু রাজউক তাতে আগ্রহ দেখায়নি। কয়েক মাস আগে রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা ওই এলাকায় গেলে ঝাড়ুমিছিল বের করে এলাকাবাসী। জমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটির প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, বন ও পরিবেশমন্ত্রী, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীসহ এসব মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছে লিখিত আবেদন জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে রাজউক চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়। গত ২৭ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সরোজ কুমার নাথ চিঠি দিয়ে রাজউককে ওই সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে বলেন। এর পর অধিগ্রহণের কার্যক্রম স্থগিত থাকলেও ড্যাপ এখনো সংশোধন করা হয়নি। এ কারণে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ রয়েই গেছে।
অন্যদিকে গত ১৭ এপ্রিল স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খানকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন, 'ঢাকা শহরের খিলক্ষেত ও বাড্ডা থানার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিমানবন্দর ও সেনানিবাসের জন্য জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকুঞ্জ এলাকায় বারবার জমি অধিগ্রহণের শিকার হয়েছে। তারা বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে কুড়িল, কুড়াতলী, খিলক্ষেত, বরুয়া, ডুমনি, তলনা, ঢেলনাসহ বহু গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করছে। রাজউক থেকে ৩০০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধন এবং সামান্য কিছু পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্যাপে সংযোগ সড়কের উভয় পাশে আরো ১০০ ফুট প্রশস্ত ওয়াটার বডি রাখা হয়েছে। রাজউক ওই সড়ক ৩০০ ফুট প্রশস্ত ধরেই শুধু জমি অধিগ্রহণ করেছে, যার মধ্যে মাঝখান বরাবর ১০০ ফুট গতিসম্পন্ন গাড়ি ও উভয় পাশে ৫০ ফুট করে ধীরগতি সম্পন্ন গাড়ি চলাচল করার কথা। তার উভয় পাশে ৫০ ফুট করে ওয়াটার বডি থাকার কথা। অথচ চতুরতার সঙ্গে ড্যাপে ওই রাস্তার উভয় পাশে আরো ১০০ ফুট করে চওড়া ওয়াটার বডি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে রাস্তার প্রশস্ততা ৫০০ ফুটে দাঁড়াচ্ছে। অথচ ৩০০ ফুট জায়গাতেই যাবতীয় কিছু করা সম্ভব। অথবা দুই পাশে কালভার্ট নির্মাণ করেও অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের চেয়ে অনেক কম খরচে ডিজাইন করা সমীচীন। তাতে সরকারি অর্থের অপচয়রোধ ও জনগণের বিরাগভাজন থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এতে নিরীহ জনগণ ভূমি অধিগ্রহণের মতো মহাবিপদ থেকে রক্ষা পাবে ও সরকারের ভাবমূর্তি সমুন্নত থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।'
এসব বিষয় উল্লেখ করে সাহারা খাতুন এ সিদ্ধান্ত বন্ধ করার জোর অনুরোধ জানান।
ভুক্তভোগীরা জানায়, ড্যাপে রাজউক সুকৌশলে ৫০০ ফুট জায়গার কথা বলে রেখেছে। কারণ, এটা করা হলে ভুক্তভোগীরা রাজউকের দ্বারস্থ হবে আর রাজউকের কর্মকর্তারা অসাধু বাণিজ্য করতে পারবে।
এলাকাবাসী জানায়, "আমরা রাজউক চেয়ারম্যানকে জানালে তিনি আমাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং দ্রুত ড্যাপ সংশোধনের আশ্বাস দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি রাজউক। বর্তমানে এলাকাবাসীর দৃঢ় মনোভাব, 'জীবন দেব তুব জমি দেব না'।"
রাজউককে দেওয়া স্থানীয় ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটির স্মারকলিপিতে বলা হয়, এখানে ৫০০ ফুট চওড়া রাস্তা বাস্তবায়ন করতে গেলে একদিকে যেমন জনগণের ব্যাপক ক্ষতি হবে, অন্যদিকে সরকারেরও আরো ১০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাবে। কিন্তু তাতে কোনো অতিরিক্ত উপকার পাওয়া যাবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ৩০০ ফুট অধিগ্রহণের সময় ২০০ ফুট জায়গা রাস্তার জন্য রাখা হলেও এখন ৫০০ ফুটের মধ্যে মাত্র ৬৪ ফুট জায়গা রাস্তার জন্য রাখার পরিকল্পনা হয়েছে। এটা করলে জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কেরামত আলী দেওয়ান ক্ষোভ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এর আগে পুলিশের একটি প্রকল্পে আমার এক একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে প্রতি একরের দাম পেয়েছি ৫৭ লাখ টাকা। অথচ ওখানে এক কাঠারই দাম আছে ৫০ লাখ টাকা। আবার যদি ২০০ ফুট করে অধিগ্রহণ করে তাহলে আমার কোনো জমি থাকবে না। তখন আমরা কোথায় যাব?'
স্থানীয় বাসিন্দা ওমর আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা এটা নিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপির কাছে গিয়েছিলাম। তাঁরা সেটা বন্ধ করে রেখেছিলেন। আবার রাজউক অধিগ্রহণ করতে চাইলে জনগণ হতে দেবে না। দফায় দফায় অধিগ্রহণের ফলে জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আর না।'
ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়টি জানিয়েছি। তাঁরা একমত হয়েছেন। কিন্তু অধিগ্রহণ না করার বিষয়টি নিশ্চিত করছে না। ফলে ওই জমিতে কেউ কোনো অবকাঠামোও করতে পারছে না। আশা করব সরকার দ্রুতই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে। আর না নিলে জনগণ গাজীপুর উপশহর প্রকল্পের মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।'
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ইতিমধ্যে বালু ফেলে রাস্তার অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সড়কের জন্য ৬৪ ফুট নির্ধারিত হলেও বাস্তবে মনে হয়েছে তা আরো কম। অনুমান করে মনে হয়, ওই সড়ক ৫০ ফুটের বেশি প্রশস্ত হবে না। একজন নিরাপত্তাকর্মী জানায়, আপাতত এ রকম রাস্তাই হবে। পরবর্তী সময়ে হয়তো বাড়ানোও হতে পারে।
এসব প্রসঙ্গে রাজউকের চেয়ারম্যান নুরুল হুদার বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। তবে রাজউক বোর্ড সভার সদস্য (পরিকল্পনা) শেখ আবদুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আপাতত নতুন করে অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তটি স্থগিত আছে। ২০০ ফুট জায়গা তো কম না। আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি আর অধিগ্রহণের প্রয়োজন আছে কি না। বিদ্যমান জায়গাতেই সব কিছু করা সম্ভব কি না। যদি হয়, তাহলে আর অধিগ্রহণ করা হবে না। রিভিউ করার সময় ড্যাপেও সেটা সংশোধন করে দেওয়া হবে।'
No comments