মেয়েটি মরে গেল...-জাগিয়ে গেল ভারতীয় উপমহাদেশ
'ছেলেটি মরে গেল/মা তার কাঁদে'_ বাংলাদেশের পপ গায়ক আজম খানের গানের রোরুদ্যমান সেই পঙ্ক্তির অনুসরণে বললে বলা যায়, মেয়েটি মরে গেল/ মা তার কাঁদে। শুধু প্রিয় মা বা পরিবার নয়, শতকোটি মানুষকে কাঁদিয়ে চলে গেল দিলি্লর ধর্ষিত সেই মেয়েটি।
বছরের শেষ দিনগুলোতে ভারতজুড়ে এখন কান্নার রোল, শোকের মাতম আর প্রতিবাদের রক্তচক্ষু ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ছে না। রাজনীতির শীর্ষ নেতা, মুম্বাইয়ের সুপারস্টার থেকে শুরু করে আমআদমি সবাইকে স্পর্শ করেছে মুখর রাজপথে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ। ১৩ দিন ধরে সমানে চলছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, দিলি্লর মেয়েরা নেমে এসেছেন রাস্তায়, ভাইয়েরাও যোগ দিয়েছেন বোনদের সঙ্গে। জলকামান, ১৪৪ ধারা কিছুতেই বাধ মানছে না প্রতিরোধ। আর অন্যদিকে ধর্ষিত মেয়েটি মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়েছে ১৩টি দীর্ঘদিন। ধর্ষকরা তাকে বাঁচতে দিতে চায়নি, তবু তার বাঁচার লড়াই সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল পর্যন্ত ১৩ দিন অব্যাহত ছিল। অবশেষে শনিবার আর কোনো ব্যবস্থাই কাজে লাগল না। চলে গেল মেয়েটি। মেয়েটির নাম আমরা জানি না, তাকে বলা হয়েছে আমানত, নির্ভয়া, দামিনী। তাকে বলা হয়েছে ভারতকন্যা। সিঙ্গাপুর থেকে মরদেহ এনে রোববারই কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। নামহীন ধর্ষিত সেই সাধারণ মেয়েটি আজ ভারতের হয়ে কথা বলছে। তার বেদনা সকল ভারতীয়ের বেদনা হয়ে উঠছে। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লাখো কণ্ঠে আওয়াজ উঠছে। রাজনীতিকরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেছেন মানুষের এই প্রতিক্রিয়ায়। ধর্ষণ আগেও অনেক হয়েছে, অহরহই কলকাতা, দিলি্ল, গৌহাটি, মুম্বাইয়ের মেয়েদের বিরুদ্ধে নেমে আসে ধর্ষক পুরুষের হাত। কিন্তু সেসব ঘটনা সাময়িক আলোড়ন তুলেই আবার মিইয়ে যায়। একটি ধর্ষণের খবরের নিচে চাপা পড়ে আরেকটি ধর্ষণের খবর। এবারই ব্যতিক্রম হলো। ভারতের নাগরিক সমাজ জাগল সমস্বরে। এভাবে আর চলবে না জানিয়ে দিল তারা। আর তাতেই মেয়েটির বেদনা সকলের বেদনা হয়ে উঠল। অবশেষে জানা গেল, মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধই পারে মানুষকে জাগাতে। ভারত আজ উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথযাত্রী। মেয়েরা সেখানে বিপুল সংখ্যায় বেরিয়ে এসেছে ঘরের বাইরে। কিন্তু সমাজ যদি থাকে পশ্চাৎপদ, পুরুষ যদি হয় নির্যাতক, তবে ঘরের বাইরে মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় কিছুতে। আজ তাই নারীর নিরাপত্তার প্রশ্ন ভারতের অগ্রগতির প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে অন্দরে-বাহিরে নারীর নিরাপত্তার দাবিতে ভারত জেগেছে। মেয়েটির পরিবার দাবি করেছে, তাদের সন্তানের মৃত্যু যেন সকল ভারতীয় নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এমন চাওয়াও কি পূরণ হবে না? মেয়েটি জাগিয়ে গেছে ভারতকে। কিন্তু আমাদের জাগাবে কে? ভারতের মতো কত শত ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন অহরহ ঘটছে বাংলাদেশেও। ধর্ষণের ভয়াবহতাও কম নয়। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনাগুলো কি এখানে জাগাতে পারছে নাগরিকদের? এখানে একটি নৃশংসতার আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে আরেকটি নৃশংসতা। রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে নাগরিক সমাজ ধর্ষণের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে প্রতিবাদ করছে কি? রাজনৈতিক হানাহানির নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে ধর্ষণের মতো অসংখ্য ঘটনা। নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ বন্ধ করার জন্য ভারত যেভাবে জাগল তার খবর রাখাই কি যথেষ্ট? এমন ঘটনায় নাগরিক, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, সরকারের কর্তব্য কী হওয়া উচিত সে শিক্ষাও কি ভারতের সেই মেয়েটি আমাদের দিয়ে যেতে পারে না। নামহীন সেই মেয়েটির মৃত্যু ভারতের মতো বাংলাদেশকেও জাগিয়ে তুলুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
No comments