সরকারের ৪ বছর: জ্বালানি খাত- দৈন্য কাটেনি by অরুণ কর্মকার
গত চার বছরে সরকার জ্বালানি খাতের উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। গ্যাস উত্তোলন দৈনিক ৫৫ কোটি ঘনফুটের বেশি বেড়েছে। নতুন জ্বালানি উৎসের সন্ধানও জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু এখনো গ্যাস ও আমদানি করা তেলের ওপর নির্ভরতা বলবৎ থাকায় জ্বালানি খাতের দৈন্যদশা কাটেনি।
চার বছর আগের মতোই এখনো বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়ালে সার কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। সার কারখানা চালু করলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। সিএনজি স্টেশনে রেশনিং চলছে। নতুন গ্যাস-সংযোগ বন্ধ রাখা হলেও গ্যাসের ব্যবহার কমেনি। আবাসিক গ্রাহকের জন্য সহনীয় দামে এলপিজির সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। নির্ভরযোগ্য বিকল্প জ্বালানি উৎস—কয়লা খাতের উন্নয়নে সামান্যতম পদক্ষেপ নিতেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতা দেশের কয়লা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেমন, আমদানি করে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তেমনি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রণীত কয়লানীতি চূড়ান্ত করতে না পারাও একটি বড় ব্যর্থতা।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ (সোলার হোম সিস্টেম) ব্যবহার বেড়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্য কোনো ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
এ অবস্থার মধ্যেও চলছে জ্বালানির ব্যাপক অপচয় ও চুরি। বিদ্যুৎ ও সার কারখানায় অপচয়ের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। শিল্পে অপচয়ের পাশাপাশি চুরিও চলছে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, তাদের বিতরণ এলাকায় শিল্পে যে পরিমাণ গ্যাসের অপচয় হচ্ছে, তা সারা দেশের আবাসিক গ্রাহকদের মোট ব্যবহারের সমান। আবাসিক খাতে গ্যাসের অবৈধ ব্যবহার অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি।
বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও ব্যবসায়ী সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, জ্বালানিস্বল্পতার কারণে প্রতিবছর যে পরিমাণ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, তার অর্থনৈতিক মূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২ শতাংশের সমান। সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলোর ব্যাখ্যায়, এর অর্থ হলো—জ্বালানি খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের অনেক সুযোগ আছে।
গ্যাস: এখন পর্যন্ত দেশের প্রধান বাণিজ্যিক জ্বালানি সম্পদ—প্রাকৃতিক গ্যাস। এর আবিষ্কৃত মজুত (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মিলে) প্রায় ২১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এর মধ্যে নয় টিসিএফের বেশি তোলা হয়েছে।
ছোট-বড় ২৫টি গ্যাসক্ষেত্রের ৮১টি কূপ থেকে বর্তমানে দৈনিক উত্তোলনের পরিমাণ প্রায় ২২৫ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ঘাটতি দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুটের মতো।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময়ও সরবরাহ ঘাটতি ছিল ৫০ কোটি ঘনফুট। ২০১০ সাল থেকে সংযোগ বন্ধ রেখে উৎপাদন ৫০ কোটি ঘনফুট বাড়ানোর পরও একই পরিমাণ ঘাটতি কীভাবে রয়ে গেল, তা এক বড় প্রশ্ন। প্রধানত, অবৈধ সংযোগের কারণেই এ অবস্থা হয়েছে। কিন্তু সরকার তা স্বীকার করে না।
সরকার গ্যাস খাতের চাহিদা বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস প্রণয়ন করেছে, সে অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে (২০১২-১৩) চাহিদা ১০৬১ দশমিক ৫ বিসিএফ। ২০১৩-১৪ সালে চাহিদা হবে ১২২২ দশমিক ৪ বিসিএফ।
এ বর্ধিত চাহিদা মেটানোর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১২ সালের মধ্যে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য আসার কথা ছিল। কিন্তু আসেনি। ২০১৩ সালে প্রবৃদ্ধিসহ বাড়তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর প্রথম আলোকে বলেন।
রাষ্ট্রীয় অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্স এবং পিএসসির অধীনে শেভরন, টাল্লো ও স্যান্টোস নিজ নিজ ক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোর কার্যক্রম চালাচ্ছে। একই সঙ্গে গ্যাস সঞ্চালনের বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা দূর করারও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
বাপেক্সকে শক্তিশালী করার বহুমুখী কার্যক্রম সরকার নিয়েছে। কোম্পানিটির জন্য দুটি নতুন খননযন্ত্র (রিগ) কেনা হয়েছে। আরও একটি কেনার জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ দল পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ দলের কাজের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। ফলে এ কাজে সাফল্যও এসেছে।
বাপেক্স স্থলভাগে পাঁচ বছরের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে কাজ চালাচ্ছে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কনোকো-ফিলিপস কাজ করছে। আরও কাজের জন্য ১৭ ডিসেম্বর নতুন উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) সই করার জন্য দরপ্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছে।
কয়লা ও কয়লানীতি: দেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পাঁচটি কয়লাক্ষেত্রে মোট মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি মেট্রিক টন উন্নত মানের বিটুমিনাস কয়লা। এ কয়লা দিয়ে ৫০ বছর ধরে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু এ সম্পদ উত্তোলন করে উন্নয়নের কাজে লাগানোর লাগসই পরিকল্পনা সরকারের নেই।
দেশের একমাত্র কয়লাক্ষেত্র বড়পুকুরিয়া থেকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা তুলে ২৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হচ্ছে। কিন্তু পরিচালন পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় ক্ষেত্রটির অবস্থা খারাপ। সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান পদ্ধতি বহাল রাখলে বড়পুকুরিয়া থেকে মোট মজুতের ১৫ শতাংশ কয়লা তোলাও সম্ভব হবে না। এই ১৫ শতাংশ কয়লা তোলার পর বাকি কয়লা তোলার আর কোনো উপায়ও থাকবে না।
সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনায় ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হবে বলে সরকারি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। কিন্তু আমদানির কোনো উৎসও এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট করা যায়নি।
দেশীয় কয়লা তোলার জন্য সরকার ‘জাতীয় কয়লানীতি’ প্রণয়নের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এ নীতিটি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই চূড়ান্ত করে রাখা হয়েছিল। সেটি গত চার বছরেও সরকার অনুমোদনের পর্যায়ে নিতে পারেনি।
এলএনজি: গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে বিশেষ করে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের, সরকার এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুটের সমান এলএনজি আমদানির প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারিত আছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে এ জন্য একটি টার্মিনাল (স্থায়ী কিংবা ভাসমান অস্থায়ী) স্থাপনের জায়গাও নির্ধারণ করা হয়েছে। কাতার থেকে এলএনজি পাওয়া যাবে বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে।
কিন্তু এলএনজি সরবরাহ করতে আগ্রহী কোম্পাগুিলোর প্রাকেযাগ্যতা যাচাই করার জন্য বিডিং রাউন্ড শুরু করেও শেষ করা যায়নি। সরকারের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১২ সালের মধ্যে এলএনজি আমদানি শুরু করার কথা ছিল। একপর্যায়ে প্রকল্পটি বাতিলের খাতায় উঠেছিল। এখন আবার নতুন করে সেটি বাস্তবায়নের আয়োজন করা হচ্ছে। তবে কবে নাগাদ তা সম্ভব, হবে তা কারও কাছে পরিষ্কার নয়।
জ্বালানি তেল: বাণিজ্যিক জ্বালানি হিসেবে আমদানি করা তেলের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। কৃষি, শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন প্রভৃতি ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের ব্যবহার দীর্ঘদিনের। বর্তমান সরকার প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করায় তেলনির্ভরতা আরও বেড়েছে। এ বছর (২০১২-১৩ সাল) নানা ধরনের জ্বালানি তেল মিলে মোট আমদানির পরিমাণ হবে প্রায় ৬০ লাখ মেট্রিক টন। তেলের ব্যবহার বৃদ্ধি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দামের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থা থেকে শিগগির মুক্তির সম্ভাবনা নেই।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি: গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখনো জ্বালানি চাহিদা মেটায় কাঠ, খড়কুটা প্রভৃতি (বায়োমাস) ব্যবহার করে। সরকার পরিকল্পনা করেছে, এ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের। তার অংশ হিসেবে গ্রামাঞ্চলে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। একই সঙ্গে চলছে সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ। তবে এ উদ্যোগ দেশের বর্তমান প্রয়োজন মেটাতে কবে নাগাদ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে, তা-ও নিশ্চিত নয়।
সরকারের পরিকল্পনা আছে ২০২১ সালের মধ্যে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে করার। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটি সরকারের একটি অসম্ভব পরিকল্পনা।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি খাতের দৈন্যদশা সহসা কাটারও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কারণ, এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নেই। দেশের জ্বালানি সম্পদ ব্যবহারের পদক্ষেপ নেই। ফলে সবগুলো খাতেই জ্বালানির সংকট চলছে।
ম তামিম বলেন, এ মুহূর্তে পাঁচ টিসিএফ গ্যাস আবিষ্কৃত হলেও তা দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানিসংকটের সমাধান দিতে পারবে না। আর আমদানি করা তেলনির্ভরতায় অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে পড়বে। এর বিকল্প হচ্ছে কয়লা। তাই কয়লা আমদানির পাশাপাশি দেশের কয়লার ব্যবহার বাড়াতে হবে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ (সোলার হোম সিস্টেম) ব্যবহার বেড়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্য কোনো ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
এ অবস্থার মধ্যেও চলছে জ্বালানির ব্যাপক অপচয় ও চুরি। বিদ্যুৎ ও সার কারখানায় অপচয়ের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। শিল্পে অপচয়ের পাশাপাশি চুরিও চলছে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, তাদের বিতরণ এলাকায় শিল্পে যে পরিমাণ গ্যাসের অপচয় হচ্ছে, তা সারা দেশের আবাসিক গ্রাহকদের মোট ব্যবহারের সমান। আবাসিক খাতে গ্যাসের অবৈধ ব্যবহার অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি।
বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও ব্যবসায়ী সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, জ্বালানিস্বল্পতার কারণে প্রতিবছর যে পরিমাণ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, তার অর্থনৈতিক মূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২ শতাংশের সমান। সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলোর ব্যাখ্যায়, এর অর্থ হলো—জ্বালানি খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের অনেক সুযোগ আছে।
গ্যাস: এখন পর্যন্ত দেশের প্রধান বাণিজ্যিক জ্বালানি সম্পদ—প্রাকৃতিক গ্যাস। এর আবিষ্কৃত মজুত (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মিলে) প্রায় ২১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এর মধ্যে নয় টিসিএফের বেশি তোলা হয়েছে।
ছোট-বড় ২৫টি গ্যাসক্ষেত্রের ৮১টি কূপ থেকে বর্তমানে দৈনিক উত্তোলনের পরিমাণ প্রায় ২২৫ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ঘাটতি দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুটের মতো।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময়ও সরবরাহ ঘাটতি ছিল ৫০ কোটি ঘনফুট। ২০১০ সাল থেকে সংযোগ বন্ধ রেখে উৎপাদন ৫০ কোটি ঘনফুট বাড়ানোর পরও একই পরিমাণ ঘাটতি কীভাবে রয়ে গেল, তা এক বড় প্রশ্ন। প্রধানত, অবৈধ সংযোগের কারণেই এ অবস্থা হয়েছে। কিন্তু সরকার তা স্বীকার করে না।
সরকার গ্যাস খাতের চাহিদা বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস প্রণয়ন করেছে, সে অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে (২০১২-১৩) চাহিদা ১০৬১ দশমিক ৫ বিসিএফ। ২০১৩-১৪ সালে চাহিদা হবে ১২২২ দশমিক ৪ বিসিএফ।
এ বর্ধিত চাহিদা মেটানোর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১২ সালের মধ্যে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য আসার কথা ছিল। কিন্তু আসেনি। ২০১৩ সালে প্রবৃদ্ধিসহ বাড়তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর প্রথম আলোকে বলেন।
রাষ্ট্রীয় অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্স এবং পিএসসির অধীনে শেভরন, টাল্লো ও স্যান্টোস নিজ নিজ ক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোর কার্যক্রম চালাচ্ছে। একই সঙ্গে গ্যাস সঞ্চালনের বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা দূর করারও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
বাপেক্সকে শক্তিশালী করার বহুমুখী কার্যক্রম সরকার নিয়েছে। কোম্পানিটির জন্য দুটি নতুন খননযন্ত্র (রিগ) কেনা হয়েছে। আরও একটি কেনার জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ দল পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ দলের কাজের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। ফলে এ কাজে সাফল্যও এসেছে।
বাপেক্স স্থলভাগে পাঁচ বছরের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে কাজ চালাচ্ছে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কনোকো-ফিলিপস কাজ করছে। আরও কাজের জন্য ১৭ ডিসেম্বর নতুন উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) সই করার জন্য দরপ্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছে।
কয়লা ও কয়লানীতি: দেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পাঁচটি কয়লাক্ষেত্রে মোট মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি মেট্রিক টন উন্নত মানের বিটুমিনাস কয়লা। এ কয়লা দিয়ে ৫০ বছর ধরে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু এ সম্পদ উত্তোলন করে উন্নয়নের কাজে লাগানোর লাগসই পরিকল্পনা সরকারের নেই।
দেশের একমাত্র কয়লাক্ষেত্র বড়পুকুরিয়া থেকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা তুলে ২৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হচ্ছে। কিন্তু পরিচালন পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় ক্ষেত্রটির অবস্থা খারাপ। সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান পদ্ধতি বহাল রাখলে বড়পুকুরিয়া থেকে মোট মজুতের ১৫ শতাংশ কয়লা তোলাও সম্ভব হবে না। এই ১৫ শতাংশ কয়লা তোলার পর বাকি কয়লা তোলার আর কোনো উপায়ও থাকবে না।
সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনায় ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হবে বলে সরকারি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। কিন্তু আমদানির কোনো উৎসও এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট করা যায়নি।
দেশীয় কয়লা তোলার জন্য সরকার ‘জাতীয় কয়লানীতি’ প্রণয়নের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এ নীতিটি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই চূড়ান্ত করে রাখা হয়েছিল। সেটি গত চার বছরেও সরকার অনুমোদনের পর্যায়ে নিতে পারেনি।
এলএনজি: গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে বিশেষ করে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের, সরকার এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুটের সমান এলএনজি আমদানির প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারিত আছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে এ জন্য একটি টার্মিনাল (স্থায়ী কিংবা ভাসমান অস্থায়ী) স্থাপনের জায়গাও নির্ধারণ করা হয়েছে। কাতার থেকে এলএনজি পাওয়া যাবে বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে।
কিন্তু এলএনজি সরবরাহ করতে আগ্রহী কোম্পাগুিলোর প্রাকেযাগ্যতা যাচাই করার জন্য বিডিং রাউন্ড শুরু করেও শেষ করা যায়নি। সরকারের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১২ সালের মধ্যে এলএনজি আমদানি শুরু করার কথা ছিল। একপর্যায়ে প্রকল্পটি বাতিলের খাতায় উঠেছিল। এখন আবার নতুন করে সেটি বাস্তবায়নের আয়োজন করা হচ্ছে। তবে কবে নাগাদ তা সম্ভব, হবে তা কারও কাছে পরিষ্কার নয়।
জ্বালানি তেল: বাণিজ্যিক জ্বালানি হিসেবে আমদানি করা তেলের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। কৃষি, শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন প্রভৃতি ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের ব্যবহার দীর্ঘদিনের। বর্তমান সরকার প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করায় তেলনির্ভরতা আরও বেড়েছে। এ বছর (২০১২-১৩ সাল) নানা ধরনের জ্বালানি তেল মিলে মোট আমদানির পরিমাণ হবে প্রায় ৬০ লাখ মেট্রিক টন। তেলের ব্যবহার বৃদ্ধি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দামের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থা থেকে শিগগির মুক্তির সম্ভাবনা নেই।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি: গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখনো জ্বালানি চাহিদা মেটায় কাঠ, খড়কুটা প্রভৃতি (বায়োমাস) ব্যবহার করে। সরকার পরিকল্পনা করেছে, এ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের। তার অংশ হিসেবে গ্রামাঞ্চলে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। একই সঙ্গে চলছে সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ। তবে এ উদ্যোগ দেশের বর্তমান প্রয়োজন মেটাতে কবে নাগাদ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে, তা-ও নিশ্চিত নয়।
সরকারের পরিকল্পনা আছে ২০২১ সালের মধ্যে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে করার। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটি সরকারের একটি অসম্ভব পরিকল্পনা।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি খাতের দৈন্যদশা সহসা কাটারও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কারণ, এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নেই। দেশের জ্বালানি সম্পদ ব্যবহারের পদক্ষেপ নেই। ফলে সবগুলো খাতেই জ্বালানির সংকট চলছে।
ম তামিম বলেন, এ মুহূর্তে পাঁচ টিসিএফ গ্যাস আবিষ্কৃত হলেও তা দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানিসংকটের সমাধান দিতে পারবে না। আর আমদানি করা তেলনির্ভরতায় অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে পড়বে। এর বিকল্প হচ্ছে কয়লা। তাই কয়লা আমদানির পাশাপাশি দেশের কয়লার ব্যবহার বাড়াতে হবে।
No comments