ধর নির্ভয় গান-ক্রিকেট, ক্রিকেট by আলী যাকের

এবার ক্রিকেটের বিশ্বকাপ আমাদের ঘরেই শোভা পাচ্ছে। আমরা এটিকে প্রায় ছুঁতেই পারি_ এ-ইবা কম কিসের? বাংলাদেশের ক্রিকেটের বিজয় তো এখানেই।
পরের বারে ওই কাপটি আমরা ঘরে তুলব_ এ প্রত্যয় আমার আছে
অবশেষে বিশ্বকাপ বাংলাদেশকে খুঁজে পেল। এ আমাদেরই কৃতিত্ব। কৃতিত্ব বাংলাদেশবাসীর। কৃতিত্ব ক্রিকেট প্রশাসকদের। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব বোধহয় বাংলাদেশের দামাল ছেলেদের, যারা এই মহাঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলেছে। তাদেরই একাগ্রতাবলে এবং এখন-তখন পা হড়কে গেলেও ক্রিকেট খেলায় ক্রমোন্নতিতে বিশ্ব ক্রিকেটের ধারক-বাহকরা অবশেষে নজর দিতে বাধ্য হয়েছেন বাংলাদেশের দিকে। একটা সময় ছিল, তখন আমরা তরুণ, নিয়মিত ক্রিকেট খেলছি, ঢাকার মাঠে মাঠে এবং শেষ পর্যন্ত সিনিয়র ডিভিশনে। তখন উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হওয়া সত্ত্বেও ওয়েসলি হল, রে লিন্ডওয়াল, টাইফুন টাইসন এবং পরে ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার, এন্ডি রবার্টস_ এসব দ্রুতগতির বোলারের নাম বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিত। যা হোক, ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে সময় নষ্ট করার কোনো অর্থ হয় না। তবুও এ কথাগুলো উল্লেখ করলাম এ কারণে যে আজকে আমাদের বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটাররা অবলীলায় সব বাঘা বাঘা ফাস্ট বোলার এবং স্পিনের ঘূর্ণিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। এভাবে চলতে থাকলে অবশ্যই একদিন আমরা বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে পারব বলে আমার বিশ্বাস। কিছু মানুষ ক্রিকেট পছন্দ করেন না। তারা মনে করেন, ক্রিকেট মানে সময়ের অপচয়। আমি এর কোনো অর্থ দেখি না; বিশেষ করে আমাদের দেশে, যেখানে একটি সরকারি অফিসের এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে একটি নথি পেঁৗছতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগে। নিত্যদিনই আমরা অতি জরুরি রাষ্ট্রীয় কাজে সময়ের অপচয় করে চলেছি অবলীলায়, অথচ ক্রিকেট খেললেই আমাদের গায়ে জ্বালা ধরে। ক্রিকেট আমার কাছে এক ধরনের অতি সুস্থ উন্মাদনা। প্রায় প্রেমের উন্মাদনার সঙ্গেই তুল্যমূল্য। আমি আগেই বলেছি, আমি একসময় সিনিয়র ডিভিশনে ক্রিকেট খেলেছিলাম। তবে সেটা নিতান্তই শখের বশে। পেশাদার ক্রিকেট তখনও শুরু হয়নি। তাছাড়া কেবলই ক্রিকেট খেলব যখন ভাবছি, তখন আমার বাবা চোখ রাঙিয়ে তর্জনী তুলে বললেন, 'কেবল খেলা নিয়ে পড়ে থাকলে আখেরে ভাত পাবি না।' বাবার কথাটি রূঢ় হলেও সত্য ছিল নিঃসন্দেহে। কেননা পরবর্তী সময়ে করাচিতে দেখেছি, গরিব ঘরের টেস্টখেলুড়ে ক্রিকেটাররা পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাসে ঝুলতে ঝুলতে মাঠে আসতেন প্র্যাকটিসের জন্য। দ্বিপ্রাহরিক ভোজে তাদের জন্য বরাদ্দ থাকত একটি পরোটা এবং দু'টুকরো মাংস। প্র্যাকটিস শেষে আবার বাসে ঝুলতে ঝুলতে তারা বাড়ি চলে যেতেন। আমার তো স্পষ্ট মনে আছে, অনেক ম্যাচে দু'পায়ে প্যাড পরার মতো যথেষ্টসংখ্যক প্যাড ছিল না। অতএব, ডানহাতি ব্যাটসম্যানরা বাঁ পায়ে প্যাড পরে অন্য পায়ে প্যাডহীন দিব্যি খেলে যেতেন। মাথায় হেলমেট পরা তখনও চালু হয়নি। আমাদের সময় আলতাফ, দৌলত এবং সোহরাব_ এরা দ্রুতগতির বোলার ছিল। ওদের একেকটা বাউন্সার যখন গোলার মতো মাথার দিকে ছুটে আসত তখন অনেকবার হুক কিংবা পুল করতে গিয়ে সরাসরি মাথায় বল আঘাত করেছে। এর থেকে অনেক মহাবিপদ ঘটে যেতে পারত। আমাদের সৌভাগ্য যে তেমন কিছু ঘটেনি।
আমার পক্ষে শেষ পর্যন্ত যখন ক্রিকেট খেলা সম্ভব হলো না, তখন আমি ভাবলাম ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমি আমাদের গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা ময়দানে একটি বইকে মুড়ে গোল করে মাইকের মতো করে মুখের সামনে ধরে অনর্গল ধারাভাষ্য দিয়ে যেতাম। তখন রোববার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ওইদিন কালে-ভদ্রে কোনো গুরুত্বপূর্ণ খেলা থাকলে লাউড স্পিকার লাগানো হতো। সেদিন আমার চাহিদা খুব বেড়ে যেত। আমি ওই দিনগুলোর অপেক্ষায় থাকতাম। সকাল থেকে কয়েক মিনিট বাংলায় আর কয়েক মিনিট ইংরেজিতে ধারাভাষ্য দিতাম। তখন পাকিস্তানের দু'জন বিখ্যাত ইংরেজি ধারাভাষ্যকার ছিলেন, ওমর কোরেশি এবং জামশেদ মার্কার। তাদের অনুকরণে ইংরেজি বলতাম আর আকাশবাণী কলকাতার বাংলা ধারাভাষ্যকারদের অনুকরণে বাংলা বলার চেষ্টা করতাম। লাউডস্পিকারে ক্রিকেটের কমেন্ট্রি করার পেছনে আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল, পাড়ার তাবৎ যুবতীদের ইমপ্রেস করা। এ রকম করতে করতে একসময় পড়াশোনার চাপে এবং পরবর্তী সময়ে পেশার কারণে কমেন্ট্রি ছাড়তে বাধ্য হলাম। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে ধূপখোলা মাঠের সেই চৌকস ধারাভাষ্যকে মনে রাখা এক টেলিভিশন প্রযোজক আমায় খুঁজে বের করলেন ঢাকার মাঠ থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি ধারাভাষ্য দেওয়ার জন্য। এটি করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, ধারাভাষ্যকে যতটা সহজ বলে মনে হয় কাজটা আসলে ততটা সহজ নয়। যদিও আমি মোটামুটি বাংলা ভাষা সঠিক উচ্চারণে বলা রপ্ত করেছিলাম এবং উইজডেনের কল্যাণে ক্রিকেটের ইতিহাস সম্পর্কে প্রতিনিয়ত কিছু জ্ঞান আহরণ করেছি, তবুও মাইক হাতে টেলিভিশন দর্শকদের জন্য কমেন্ট্রি করা অতি সহজ ব্যাপার ছিল না। যথাসাধ্য চেষ্টা করেও আমার নিজের ধারণায় আমি ধারাবিবরণীর এ শিল্পটি যথাযথ আয়ত্ত করতে পারিনি। এখন বুঝি যে খেলার ধারাবিবরণী যারা দেন তাদের প্রায় বিশেষজ্ঞ হতে হয়। খেলাটি ক্রিকেট হোক কিংবা হাডুডু। আমার অভিজ্ঞতায় আমি এটাও শিখেছিলাম যে, ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় অপ্রয়োজনীয় কথা এবং বেশি কথা অবশ্য পরিহারযোগ্য। বেশি কথা বললে অনেক সময় অর্থহীন কথা বলতে হয়; যার কোনো মানেই থাকে না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা যথাযথ হয় না। অথচ একবার বললে সেই কথাটি তো আর ফেরত নেওয়ার কোনো উপায় নেই। মহাত্মা গান্ধী এ কথাটি আমাদের বলে গেছেন। তিনি বলেছেন, কথিত কথন কখনও ফেরত নেওয়া যায় না।
আজকাল যখন ক্রিকেটে ধারাভাষ্য শুনি রেডিও কিংবা টেলিভিশনে, তখন মাঝে মধ্যে ভাবি_ কী অবলীলায় অর্থহীন কথাবার্তা বলে যান আমাদের ধারাভাষ্যকাররা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, 'এ যেন অর্থহারা ভাবে ভরা ভাষা।' বাংলায় ক্রিকেটজাত শব্দগুলোর উচ্চারণ কখনোই প্রায় শুদ্ধ হয় না। ক্রিকেটের 'স্টাম্প' হয়ে যায় পোস্টাল 'স্ট্যাম্প'। কভার ড্রাইভ মারলে স্কয়ার লেগ দিয়ে বল কীভাবে বের হয় আমার এখনও জানা নেই। অতি চমৎকার শট খেলে মানুষ কীভাবে বোল্ড আউট হয় সেটাও আমার বোধগম্য নয়। কিছু ধারাভাষ্যকার আছেন, যেমন_ ভারতের নভজোৎ সিং সিধু, যিনি অতিকথন বিশেষজ্ঞ। কথা বেশি বললে কথা গিলতেই হয়। তারও দশা অনেক সময় এরকমই ঘটে। কিন্তু তিনি পিছপা হওয়ার নন। তিনি আরও অর্থহীন কথার দ্বারা নিজের ভুলকে ঢাকার চেষ্টা করেন। আমরা কিন্তু তার বোকামি ধরে ফেলি। বিশ্বকাপের শুরুতেই, আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ দলের কথা এলে এই বিশেষজ্ঞরা ক্ষুরধার মন্তব্যে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। আমরা জানি বাংলাদেশ দল নগণ্য নয়। তারা এমন একটি জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে আজ যে, সুযোগ পেলে তারা অনেক বড় দলকে ধরাশায়ী করতে পারে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে যখন বাংলাদেশ হারল তখন আমাদের তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় এমন মনে হলো যেন তারা ধরেই নিয়েছিলেন বাংলাদেশ অনায়াসে ভারতকে হারিয়ে দেবে। তারা বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন, এবার অনেকেই ভাবছেন যে ভারত বিশ্বকাপজয়ী হবে। যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছিল সেদিন, তা হলো টসে জিতে সাকিবের ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া। অনেকের লেখায় এমনও মনে হয়েছে যে, এটি যেন সাকিবেরই একক সিদ্ধান্ত ছিল। একটি ইংরেজি দৈনিকে একজন তো বলেই বসলেন, এরপরে যখনই টসে জিতবে, ব্যাটিং নেবে। এমন অর্বাচীন উপদেশ এর আগে আমি কখনও শুনেছি বলে আমার মনে পড়ে না। টসে জেতার পর যে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়, তা টসের অনেক আগেই পিচ, আবহাওয়া (দিনে এবং রাতে), প্রতিপক্ষের শক্তি এবং দুর্বলতা এ সবকিছু পর্যালোচনা করার পর টিম ম্যানেজমেন্ট, কোচ এবং অধিনায়ক মিলে যৌথভাবে নিয়ে থাকেন। এখানে অধিনায়কের একার কিছুই করার নেই। একটি কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের সদ্য ক্রিকেট শক্তিতে পরিণত হওয়া একটি তরুণ দল যদি সবার উপদেশ নিয়ে খেলতে যায় তাহলে বিপদ অনিবার্য। আমি স্বীকার করি যে, আমাদের দলের অভিজ্ঞতার অভাব আছে। তবে এ অভিজ্ঞতাটি সঞ্চয় করার জন্য তাদের আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন।
সারাদেশে ক্রিকেট উন্মাদনা শুরু হয়েছে। আমরা কম কথা বলে আসুন এ উন্মাদনা সৃষ্ট নির্যাসে নিজেদের আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখে ক্রিকেটের স্বাদ তারিয়ে তারিয়ে গ্রহণ করি। এবার ক্রিকেটের বিশ্বকাপ আমাদের ঘরেই শোভা পাচ্ছে। আমরা এটিকে প্রায় ছুঁতেই পারি_ এ-ইবা কম কিসের? বাংলাদেশের ক্রিকেটের বিজয় তো এখানেই। পরের বারে ওই কাপটি আমরা ঘরে তুলব_ এ প্রত্যয় আমার আছে। এই মুহূর্তে আসুন আমরা দায়িত্বশীলের মতো কথা বলি এবং খেলার রাজা ক্রিকেটকে অন্তর দিয়ে উপভোগ করার চেষ্টা করি। জয় হোক ক্রিকেটের।


আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.