বিদায় ২০১২
দেখতে দেখতে চলে গেল একটা বছর। দু’হাজার বারো সালের শেষ দিন আজ। আজ সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর রাত্রি শেষে যে নতুন সূর্যোদয় হবে সেই ভোরের আলোর পথ বেয়ে আসবে নতুন একটা দিন, নতুন একটা বছর, দু’হাজার তেরো সাল। এর সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে একটি যুগও।
পুরনো বছরের শেষ দিন আজ। একটি গোটা বছরের দিনগুলো যে এত দ্রুত শেষ হয়ে যাবে সেটা অনেকেই ধারণা করেননি। সাধারণভাবে অনেকের ধারণা থাকে এই রকম : এই তো মাত্র শুরু হলো জানুয়ারি, এখনও গোটা একটি বছর পড়ে আছে সামনে। কিন্তু জানুয়ারি এগোতে থাকে। এগোতে এগোতে কখন যে বারোটি মাস ফুরিয়ে যায় খেয়ালও থাকে না কর্মব্যস্ত মানুষের।এবারও ঠিক তাই হয়েছে। মানুষ এখন সকলেই কমবেশি কর্মব্যস্ত। তাই বোঝা যায়নি কি করে ফুরিয়ে গেল ২০১২ সাল। মনে হতে পারে এই তো ক’দিন আগে দু’হাজার এগারো সাল ছিল। আবার এ-ও মনে পড়তে পারে কিছুকাল আগেও ছিল উনিশ শ’ সালের বছরগুলো, দু’হাজার সাল এই তো সেদিন শুরু হলো, এরই মধ্যে চলে গেল দু’হাজার সালের বারোটা বছর! আসলে শুধু একটি বছরই গেল না, গেল দু’হাজার সালের প্রথম যুগটিও।
কথায় বলে সময় এবং স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সতত এগিয়েই চলে। মানুষেরও তেমনি সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলা উচিত। নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। গোটা মানবজাতি এগোচ্ছে। এগোচ্ছে মানুষের চিন্তাভাবনার গণ্ডিও। দৃষ্টি প্রসারিত হচ্ছে মানুষের। মানুষের আবাস এই বিশ্ব বড্ড ছোট হয়ে গেছে। মানুষের চোখ এখন অনেক বেশি প্রসারিত অনন্ত নীল আকাশের দিকে। মানুষ এগিয়েছে সমাজে, সংসারে, রাষ্ট্রীয় জীবনধারায়।
অনেক উথাল-পাথাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও আমাদের দেশে পুনরায় চালু হয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। মহাজোট সরকার দায়িত্বভার পেয়েছে দেশ শাসনের। তাদের অনেক কর্মসূচী, অনেক অঙ্গীকার, দেশবাসী চায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও পন্থায় এসব উদ্যোগ ও অঙ্গীকার পূরণ হলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে যে সমস্যাগুলো জনজীবনে রয়ে গেছে জগদ্দল পাথরের মতো, রয়ে গেছে অনেকদিন ধরে। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বে বলেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্য সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখবে বলেছে। বলেছে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কথাও। কাজগুলো করার প্রধান দায়িত্ব সরকারের হলেও সকল রাজনৈতিক দলের বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের সহযোগিতা বহু ক্ষেত্রেই জরুরী। আমাদের খুব বড় ভরসার একটা জায়গা সংসদ। দুঃখের বিষয়, আমাদের সংসদটি পূর্ণরূপে কার্যকর হতে পারেনি। আগামী বছর এভাবে যাবে না মানুষ এই প্রত্যাশা করবে। গত বছর অনেক কিছু হয়েছে আবার অনেক কিছু হয়নি। সামগ্রিক ফিরিস্তি না দিয়েও বলা যায়, সরকারের কয়েকটি অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়েছে ও হওয়ার পথে।
‘পুরাতন বছরের অবসান’ হতে যাচ্ছে। বিগত বছরের দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে ভুলত্রুটির শিক্ষা নিয়ে এগোতে হবে আমাদের সামনের দিকে। এটাই সময়ের দাবি। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কথায় বলতে হবে : ‘আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত/গিরিগুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত/সৃজিব নূতন ভবিষ্যৎ।’ নতুন ভবিষ্যত গড়ার প্রেরণা নিয়ে আসুক আগামী বছরটি।
এ কেমন নিষ্ঠুরতা!
১৬ ডিসেম্বর রাতে দিল্লীর এক মেডিক্যাল ছাত্রী চলন্ত বাসের মধ্যে ছয় নরপশু কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন এবং গুরুতর আহত অবস্থায় দীর্ঘ তেরো দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত পৌনে তিনটায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
জানা যায়, তেইশ বছর বয়সী এই মেডিক্যাল ছাত্রী তার বাবা-মায়ের তিন সন্তানের একজন। বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় একখ- জমি বিক্রি করে তিনি তার মেধাবী মেয়েটির ডাক্তারী পড়ার খরচ যোগাচ্ছিলেন; তার অন্য দুটি সন্তানও লেখাপড়া করছে। মেডিক্যাল শিক্ষার্থী এই সম্ভাবনাময় মেয়েটির ওপর সংঘটিত বর্বর পাশবিক নির্যাতন ও তার ফলে তার করুণ মৃত্যুর ঘটনায় সভ্য মানুষ মাত্রেরই বিবেক ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে; তাদের সমগ্র সত্তা জুড়ে হচ্ছে অবিরাম রক্তক্ষরণ। এই ঘটনার পরপরই ভারতজুড়ে শিক্ষার্থী, নারী সমাজ এবং নারী সংগঠনগুলোসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ প্রচ- ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
এমনি এক পরিস্থিতিতে নির্যাতিত মেয়েটির জীবনাবসান মানুষের মানবিকতা ও দীর্ঘদিনের লালিত শ্রেয়োবোধকে প্রবলভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। নারী-নিগ্রহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমন সর্বব্যাপী আলোড়ন, ব্যথিত বিবেকের এমন উজ্জীবন এবং সহিংস বিক্ষোভ এর আগে দেশটিতে আর দেখা যায়নি। এই ঘটনায় ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস সভানেত্রী গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন; এমনকি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী নিহত তরুণীর লাশ গ্রহণের জন্য দিল্লী বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। অন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বিক্ষোভ ও ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি তুলেছেন। নির্যাতিত তরুণীর জবানবন্দি অনুযায়ী ইতোমধ্যেই ছয় ধর্ষণকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, আগামী ৩ জানুয়ারি তাদের বিচার কাজ শুরু হবে।
ভারতের এক মেডিক্যাল ছাত্রীর এই মর্মান্তিক পরিণতি এই বার্তাই আজ বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে যে, নারীরা আজও অনিরাপদ; আজও তারা নানা প্রকার পীড়ন, বৈষম্য আর লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার। যতই তারা শিক্ষিত, আলোকিত বা প্রাগ্রসর হোন না কেন, নির্যাতিত হওয়াই যেন তাদের বিধিলিপি; অলঙ্ঘনীয় নিয়তি। এর যেন কোনো দেশ-কাল-পাত্র বা নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা নেই; তবে দেশে দেশে এর মাত্রার হয়ত হেরফের আছে। কিন্তু উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে সব নারীর নিয়তিই প্রায় একই সূত্রে বাঁধা। এই বর্বর, অন্ধ বিধিলিপির কি অবসান নেই? মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত সমৃদ্ধ, তবুও তারা এত পাষ-, এত নির্লজ্জ আর পাশবিক হয় কি করে? এসব প্রশ্নের জবাব এখনই খুঁজতে হবে এবং সবাইকে তার প্রতিকারে জরুরী ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি বিশেষ কোন দেশের একক সমস্যা নয়; মানব জাতির সমস্যা; সভ্যতার এক ভয়াবহ সংকটের অশনি-সংকেত। বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিকভাবে নারীর ওপর সর্বপ্রকার নির্যাতন, হত্যা ইত্যাদি প্রতিরোধে সমন্বিত ও জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘসহ সকল আঞ্চলিক সংস্থা ও স্ব-স্ব দেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই সবার প্রত্যাশা।
No comments