কালের গর্ভে ২০১২- ০ যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে আবর্তিত ছিল গোটা বছর- ০ সংসদ ছিল নিষ্প্রাণ- ০ সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দল উভয়েই ব্যর্থ by উত্তম চক্রবর্তী
বহুমাত্রিক ও আলোড়ন তোলা নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে মহাকালের পরিক্রমায় বিদায় নিচ্ছে আরও একটি বছর। দিনপঞ্জিকার শেষ পাতাটি উল্টে যাবে আজ। নানা কাজের ফিরিস্তি লেখা নিত্যসঙ্গী হালখাতাটি হয়ে পড়বে সাবেক।
পরমায়ুর বৃক্ষ থেকে ঝরে যাবে একটি পাতা। মহাকাল নামের এক অন্তহীন মরুভূমির বুকে যেন এক ফোঁটা জল। আজ মহাকাল সেভাবেই মুছে দেবে ‘২০১২’কে। ‘যেতে নাহি দিব’ এ চিরন্তন বিলাপধ্বনির ভেতরে আবহমান সূর্য একটি পুরনো দিবসকে আজ কালের স্রোতের উর্মিমালায় বিলীন করে পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাবে। বর্ষবরণের আবাহন রেখে কুয়াশামোড়া পা-ুর সূর্য আজ বিদায় নেবে মহাকালের যাত্রায়। আজ ৩১ ডিসেম্বর সোমবার রক্তিম সূর্য অস্ত যাওয়ার মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাবে ঘটনাবহুল বছরটি। আজ মধ্যরাতের প্রথম প্রহরে সূচিত হবে দীপ্ত আশায় উদ্ভাসিত নতুন বছর ২০১৩।অনেক ঘটন-অঘটন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, চড়াই-উতরাই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে বছরটি। আজ রাতটুকু পেরোলেই কাল পূর্বাকাশে উঠবে নতুন সূর্য। এ সূর্য নতুন বছরের, নতুন দিনের, নতুন স্বপ্নের। নতুন সূর্যালোকিত দিনের প্রতি অসীম প্রতীক্ষা ও প্রত্যাশা মানুষের। উৎসব-আয়োজনের মধ্য দিয়েই সারাদেশের মানুষ স্বাগত জানাবে খ্রিস্টীয় নতুন বছর ২০১৩ সালকে। বিশ্ববাসীও মেতে উঠবে নতুন বছরের আগমনী উল্লাসে।
কালের অনন্তযাত্রায় নতুনের কাছে প্রত্যাশা শিশিরভেজা পত্রপল্লবের মতো চিরদিন মানব হৃদয়ে জেগে থাকে বলেই জীবন নিরন্তর বহমান। এ স্রোতে এগিয়ে যেতে যেতেও পেছন ফিরে বিষণœ বেদনায় দেখে নিতে ইচ্ছে করে চলে গেল যে, তাকে। বিদায় বছরটি প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির দোলাচলে নিয়েছে অনেক কিছু। চিরবিদায় নিয়েছেন দেশের অনেক কৃতীসন্তান। কিন্তু দিয়েছেও কি কম?
রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সমাজ-শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইনশৃঙ্খলা, বিচার বিভাগ, ক্রীড়া, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বছরটি ছিল আলোচিত-সমালোচিত। বছরজুড়েই দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে। আর বছরে সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয়। সরকার হটাতে সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ ক্যু’র চেষ্টাও হয়েছিল এ বছরে। বছরের প্রথম ছয় মাস রাজনৈতিক অঙ্গন ততটা অস্থির না হলেও শেষ সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে উগ্র সাম্প্রদায়িক জামায়াত-শিবিরের চোরাগোপ্তা হামলা, তা-ব আর বিএনপির সমর্থন সবমিলিয়ে টালমাটাল হয় রাজনৈতিক অঙ্গন। যার রেশ এখনও কাটেনি। কিছুটা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়েই শুরু হচ্ছে নতুন বছর।
পরিসংখ্যানের মাপকাঠিতে সেকেন্ড-মিনিট, দিন-মাসের পথ ধরে এক বর্ষ বিদায় নিলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিতই ছিল এ বছরটি। বাংলাদেশের ৪০ বছরের অনেক ইতিহাস বদলে দেয়ার বছর যদি হয় ২০১১, তাহলে ২০১২ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্জাগরণের বছর। বছরটি মিথ্যার কুহেলিকা থেকে দেশকে টেনে তুলে প্রগতি ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ধারায় শামিল করেছে। এ বছরের শুরুতেই সেনাবাহিনীতে একটি ব্যর্থ কু’র চেষ্টা ব্যর্থ করার ঘটনা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ ছাড়া বছরে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর এবং বিশ্বের নানা স্বীকৃতি আদায় ছিল বাংলাদেশের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। তবে বছরের শুরুতেই রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে গ্রেফতারের ঘটনায় সারাদেশেই উল্লাস নেমে এসেছিল।
তবে বছরজুড়েই হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক-ডেসটিনিসহ বড় বড় দুর্নীতি, অনিয়ম, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও সরকারের মধ্যে দীর্ঘ টানাপোড়েন, ছাত্রলীগের বিতর্কিত ভূমিকা, পিটিয়ে নিরীহ দর্জি বিশ্বজিৎ হত্যাকা-, শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের মুক্তি, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম, পরাগ ম-লের অপহরণ, রেলমন্ত্রী থাকাকালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পিএসের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আটক, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকা-, কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরোচিত হামলা ইত্যাদি কয়েকটি ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড়ের সৃষ্টি করে। ক্ষমতাসীন সরকারের এ বছরেও অনেক ক্ষেত্রে বিশাল সাফল্যে অর্জিত হলেও এসব বিতর্কিত ঘটনা সেই সাফল্যকে অনেকাংশেই ম্লান করে দেয়।
২০১২ সালেও রাজনৈতিক দলগুলোর গুণগত কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। সরকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতার চার বছরেও তৃণমূলে দল গোছাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব, বিবাদ বছরজুড়েই ভুগিয়েছে আওয়ামী লীগকে। বছরের শেষভাগে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মাধ্যমে দলকে চাঙ্গা করে তোলা হলেও তৃণমূলে এখনও শুদ্ধি অভিযান চালাতে পারেনি তারা। বছরের শেষ দিকে তৃণমূল সম্মেলনের মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করার টাইম ফ্রেম বেঁধে দেয়া হলেও তা আগের মতোই শম্ভুক গতিতে এগোবে নাকি আগামী দুই মাসের মধ্যে সারাদেশেই সম্মেলনের মাধ্যমে দলকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হবে- এ নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েই গেছে তৃণমূল নেতাদের।
বিরোধী দল হিসেবেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ বিএনপি। পুরো বছরে অনেক জ্বলন্ত ইস্যু হাতে পেলেও তা কাজে লাগাতে পারেনি তারা। বরং অতিরিক্ত জামায়াত নির্ভরতা, একের পর এক হরতাল, পদযাত্রা, মানববন্ধন, লংমার্চ, অবরোধসহ অনেক আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামলেও হালে পানি পায়নি বিএনপি। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়ে কারাবন্দী একাত্তরের ঘাতকদের মুক্তির দাবি আর জামায়াত-শিবিরকে সঙ্গে নিয়ে কর্মসূচীর নামে সারাদেশে তা-ব, সহিংসতা, আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা খালেদা জিয়া কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েন। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার এ ইস্যুতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বোমাবাজি, বোমায় ও আগুন দিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যার ঘটনায় উল্টো বেকায়দায় পড়তে হয়েছে বিএনপিকে। এ ছাড়া এ বছরের মার্চে পাকিস্তানের আদালতের বরাত দিয়ে বিএনপিকে জেতাতে ’৯১ সালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে খালেদা জিয়ার ৫০ কোটি রুপী গ্রহণের খবর প্রকাশিত হলে চরম বেকায়দায় পড়তে হয় দলটিকে।
২০১২-কে জাতীয় রাজনীতিতে টার্নিং পয়েন্টের বছর হিসেবেও দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির বিভাজনও স্পষ্ট হয়েছে এ বছরে। বিগত বছরগুলোতে ঘৃণিত স্বাধীনতাবিরোধী ও একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে পথ চললেও এবার প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। প্রকাশ্য যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবি, ট্রাইব্যুনাল বাতিলসহ তাদের বাঁচাতে নানা ষড়যন্ত্র, হরতালসহ গুপ্ত হামলা বিএনপির স্বরূপ জাতির সামনে প্রকাশ পেয়েছে। জন্মলগ্ন থেকে মুক্তিযোদ্ধার দল বলে দাবি করলেও এ বছরে বিএনপি যে মূলত স্বাধীনতাবিরোধীদেরই দল এ নিয়ে দেশের মানুষের মনে আর কোন দ্বিধা নেই।
ব্যর্থ ক্যু’র চেষ্টা ॥ বছরটা শুরুই হয়েছিল বড় ধরনের একটা ব্যর্থ ক্যুর চেষ্টার মধ্য দিয়ে। জানুয়ারিতে সরকার হটাতে সেনাবাহিনীতে একটি ব্যর্থ ক্যু’র চেষ্টা দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীই ব্যর্থ করে দেয়ার ঘটনা সারাদেশে আলোচনার ঝড় ওঠে। এ নিয়ে উত্তেজনাও ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ব্যর্থ এ ক্যু’র ঘটনায় ১৬ জড়িত ছিলেন, যাঁদের মধ্যে ১৫ জনই ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। এঁদের মধ্যে ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হলেও মূল নায়ক ইশরাক আহমেদ ও মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এখনও পলাতক।
গত ১৯ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে সেনাবাহিনীই এই ব্যর্থ চেষ্টার কথা দেশবাসীকে অবহিত করেন। সেনা সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে করে বলা হয়, দেশে সেনাঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালানোর চেষ্টা হয়েছিল। উগ্র-ধর্মান্ধ কতিপয় চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর ঘৃণ্য চেষ্টা করেছিল। তা প্রতিহত করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত দু’জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের সম্পর্কে তদন্ত চলছে। পুরো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ১৪ থেকে ১৬ জন চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া গেছে।
আরও বলা হয়, গত ৮ জানুয়ারি নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্রীরের তরফ থেকে পলাতক মেজর জিয়ার ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া বার্তাটিকে ভিত্তি করে দেশব্যাপী উস্কানিকমূলক লিফলেট ছড়িয়ে দেয়। ১০ ও ১১ জানুয়ারি পলাতক মেজর জিয়া কর্তৃক বিভিন্ন ফরমেশন ও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও অধ্যয়নরত সমমনা এবং দলভুক্তদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে। সেনাঅভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্রীরের যোগাযোগ থাকার বিষয়ে তথ্য থাকার বিষয়টিও জানানো হয়। সরকারের হাইকমান্ড থেকে কঠোরহস্তে যে কোন অপচেষ্টা দমনের হুঁশিয়ারির পর দেশবাসীর মনে সৃষ্ট শঙ্কা দূর হয়।
বড় অর্জন সমুদ্র বিজয় ॥ ২০১২ সালে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে ঐতিহাসিক সমুদ্র বিজয়। গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের সমপরিমাণ আরেকটি বাংলাদেশ অর্জন। এ বছরের ১৪ মার্চ ট্রাইব্যুনাল ইটলসের (ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর টি ‘ল অফ টি সি) রায়ে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ বিশাল সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ জয়ের ফলে বাংলাদেশের বিস্তৃত ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ দেশের জন্য অসীম সম্ভাবনার দুয়ার উšে§াচিত হয়।
স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো এ সমুদ্র জয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার কূটনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে ইটলস রায়ে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকায় (যা দেশের স্থল ভাগের ৭১ শতাংশ অর্থাৎ চার ভাগের তিন ভাগ) বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পিতা ও কন্যার এমন অর্জন বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
বড় কেলেঙ্কারির ঘটনায় তোলপাড় ॥ তবে বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, পুঁজিবাজার ধস, বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ঋণ স্থগিতসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে সরকারকে চাপের মধ্যে থাকতে হয়েছে। বিশেষ করে হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ, পিএসের অর্থ কেলেঙ্কারিতে এক মন্ত্রীকে অপসারণ, ইলিয়াস আলী গুম ও ছাত্রলীগের হাতে বিশ্বজিৎ হত্যাকা-সহ কয়েকটি ঘটনা এ বছর ছিল সবচাইতে আলোচিত বিষয়। ব্যর্থতার চেয়ে সফলতার পাল্লা ভারি হলেও ওইসব ইস্যুতে সরকারের অনেক অর্জনগুলোই ম্লান হয়ে গেছে।
জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপের সোনালী ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ তসরুফের ঘটনা ছিল এ বছরে সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়। যার রেশ এখনও কাটেনি। হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদকে সামনে রেখে সুবিধাভোগী বিভিন্ন গোষ্ঠীর কর্তৃক অবৈধ ও বিচিত্র উপায়ে প্রায় ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা শুধু ব্যাংকিং খাতকেই নয়, সমগ্র দেশজুড়ে এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তোলপাড় সৃষ্টি করে।
শক্তহাতে সরকার এই কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করলেও এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে প্রতিদিনই। এ ঘটনায় দুদক সরকারের এক উপদেষ্টাসহ মোট ৭৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মোট ১১টি মামলা দায়ের করে। তানভীর মাহমুদসহ হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তারা এখন কারাগারে বন্দী। তবে হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে শুধু বিরোধী দলই নয়, সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী-নেতারাও প্রতিবাদের ঝড় তোলেন। পরে অবশ্য অর্থমন্ত্রী তাঁর করা মন্তব্য ফিরিয়ে নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তবে ৭ মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত ব্যাংক থেকে লোপাট যাওয়া বিপুল পরিমাণ এই অর্থ উদ্ধার করতে পারেনি সরকার।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কম ভুগতে হয়নি বর্তমান সরকারকে। বছরে আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছিল এই ঘটনা। সরকার বিশ্বব্যাংকে এই পদ্মা সেতু নির্মাণে রাজি করালেও তাদের বেশকিছু শর্তপূরণ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে মানুষের বহুল আকাক্সিক্ষত এই সেতুটি নির্মাণ কাজের। অভিযোগ ওঠার পর সরকার তার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দিলেও বিষয়টির সুরাহা হয়নি।
অবশেষে বছরের শেষভাগে এসে সেতুর পরামর্শক যাচাই প্রক্রিয়ার দুর্নীতির ষড়যন্ত্রকারী সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হাসান চৌধুরীকে রাখা হয়েছে সন্দেহভাজ আসামির তালিকায়। সরকার পক্ষ আশা করছে, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে টানাপোড়েন খুব শীঘ্রই সুরাহা হবে। বিশ্বব্যাংকের নিযুক্ত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের রিপোর্টের পরই অর্থায়নে এগিয়ে আসবে বিশ্বব্যাংক।
বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট চালকসহ ইলিয়াস আলীকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধারের দবিতে হরতালসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছে। টানা কয়েকদিন হরতাল করতে গিয়ে ঢাকায় এক ঘুমন্ত গাড়িচালককে পুড়িয়ে হত্যা এবং সিলেটে সংঘর্ষ চলাকালে ৩ জনের প্রাণহানীর ঘটনাও ঘটে। খালেদা জিয়া ইলিয়াস আলীকে জীবিত ফেরত পাওয়া এবং আন্দোলন কর্মসূচীতে গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে অনশন করেন। ইলিয়াস আলীকে জীবিত উদ্ধারে তাঁর স্ত্রী তাহসীনা রুশদী লুনা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেন। কিন্তু আজও ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ ঘটনার রহস্যের জট খোলেনি।
সবশেষে বছরের শেষভাবে বিএনপির অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে শিবির ক্যাডার সন্দেহে পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে নৃশংসভাবে একজন সাধারণ দর্জি বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকা- দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় তোলে। সরকারী তরফে জড়িতরা ছাত্রলীগের নয়, ছাত্রলীগ নামধারী দাবি করা হলেও বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বেসরকারী টেলিভিশনে প্রচারিত এই লোমহর্ষক হত্যাকা-ে নিন্দা প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তবে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশে ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে ইতোমধ্যে ৭/৮ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ঘটনায় কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে সরকারের উচ্চ মহল থেকে।
নিষ্প্রাণ সংসদ ॥ এ বছরে জাতীয় সংসদ অধিবেশন চলেছে অনেকটা বিরোধী দল ছাড়াই, নিষ্প্রাণ। এক বছরে ৮৪ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ সদস্যপদ রক্ষায় মাত্র ৪ দিন উপস্থিত ছিল বিরোধী দল। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদ বর্জনে ইতিহাসও সৃষ্টি করেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল। তবে বিরোধী দল না গেলেও বেশ কিছু ইস্যুতে কিছুটা সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেছিল জাতীয় সংসদ।
গত ৫ জুন সংসদে দেয়া স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের একটি মন্তব্য নিয়ে হাইকোর্টে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক একটি রুলের নিষ্পত্তি করতে গিয়ে স্পীকারের ওই মন্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দেন এবং স্পীকারকে বেশকিছু মন্তব্য করেন। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সরকারের শীর্ষ নেতারাসহ মহাজোটের সিনিয়র নেতারা ওই বিচারপতিকে অপসারণে সুপ্রীম জুডিয়াশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানান।
এ নিয়ে ১৮ জুন স্পীকার তাঁর রুলিংয়ে বিষয়টির বিচারের ভার প্রধান বিচারপতির ওপর অর্পণ করে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। পরে ৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ স্পীকারের রুলিংকে এখতিয়ার বহির্ভূত বলে রায় দিলে আবারও সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ॥ এ বছরে সবচেয়ে সমালোচিত ঘটনা ছিল কক্সবাজারের রামুসহ উখিয়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ভয়াল হামলার ঘটনা। এ ঘটনা শুধু দেশেই নয়, বৌদ্ধ অধ্যুষিত বিশ্বের নানা দেশই উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। গত ৩১ সেপ্টেম্বর রামুতে এক রাতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধদের অর্ধ শতাধিক বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। একাত্তরের মতোই গানপাউডার দিলে বৌদ্ধ বিহারগুলো জ্বালিয়ে অঙ্গার করে দেয় দুর্বৃত্তরা। নির্বিচারে মন্দিরের দামী দামী সব জিনিষগুলোও লুটে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।
এ ঘটনায় সরকার ও বিরোধী দল একে অপরকে দায়ী করলেও তদন্তে বেরিয়ে এসেছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের তথ্য। জামায়াত ও বিএনপির চিহ্নিত নেতাদের মদদে বিভিন্ন স্থান থেকে সশস্ত্র ক্যাডারদের গাড়ি দিয়ে নিয়ে এসে জড়ো করার পর পরিকল্পিত হামলার ঘটনা ইতোমধ্যে স্বীকার করেছে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত গ্রেফতার হওয়ায় বেশ ক’জন রাজনৈতিক ক্যাডাররা। প্রধানমন্ত্রী ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা ছাড়াও কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বৌদ্ধ বিহারগুলো পুনর্নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও ওই এলাকায় সংখ্যালঘুদের মনে এখনও ওই ভয়াল ও ধ্বংসাত্মক হামলার ঘটনার শঙ্কা কাটেনি।
No comments