আলোচিত ১০ ঘটনা by নাজনীন আখতার
নানা ঘটনায় আলোচনায়, সমালোচনায়, পর্যালোচনায় শেষ হচ্ছে একটি বছর। কোন কোন ঘটনা যেমন আশার আলো ছড়িয়েছে, তেমনি কোন কোন ঘটনায় হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।
কিছু ঘটনা প্রতারণা ও কেলেঙ্কারির স্পষ্ট স্বাক্ষর হলেও বিচার প্রক্রিয়ার কারণে আগামীতে ওই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে অনুৎসাহিত করেছে। সব মিলিয়ে বছরের ১০টি ঘটনাকে জনকণ্ঠের বিশ্লেষণে শীর্ষে তুলে ধরা হয়েছে। সেই সব ঘটনায় আশা, নিরাশা, অর্জন, ব্যর্থতা, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও দাবির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।ঝুলন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্প ॥ বছরব্যাপী আলোচনায় ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প। নিভু নিভু আলো আবারও জ্বলে উঠেছিল নতুন আশায়। তবে বছরের শেষ দিন পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিয়ে জোর গলায় বলার মতো কিছু ছিল না। আশা-নিরাশার মাঝে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে স্বপ্নের এ সেতু নির্মাণ। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত জুন মাসে বিশ্বব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে। এরপর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেও অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাতে থাকেন। ২৯০ কোটি ডলারে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল। গত বছরের সেপ্টেম্ব^রে দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর চারটি শর্ত সরকারকে দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। তা পালন হয়নি বলে অভিযোগ জানিয়ে গত ২৯ জুন অর্থায়ন বাতিল করে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে দীর্ঘ ছুটিতে পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে। যোগাযোগমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সৈয়দ আবুল হোসেনকে। পরবর্তীতে নানা দেনদরবারের পর সংস্থাটির দেয়া চার শর্ত মেনে নেয় সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন। এতে করে ২০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। শর্তানুযায়ী ৫ অক্টোবর পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির তদন্ত পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল ঘোষণা করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দল দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান কাজ পর্যবেক্ষণ করতে ১৪ অক্টোবর ঢাকায় আসে। দুদকের সঙ্গে ১৪ ও ১৫ তারিখ দুই দফা বৈঠক করে ১৬ তারিখ ঢাকা ত্যাগ করেন তাঁরা। দ্বিতীয় দফায় গত ১ ডিসেম্বর আবারও ঢাকায় আসেন প্যানেল প্রতিনিধিরা। তাঁদের প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় দুদকে। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে অভিযুক্ত থাকলেও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানকে বাদ দিয়ে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। ২৬ ডিসেম্বর প্রধান আসামি সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়া ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী ফেরদাউসকে গ্রেফতার করে দুদক।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি ॥ বছরের সেরা কেলেঙ্কারিতে পরিণত হয় সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপের ঋণ নেয়ার ঘটনাটি। প্রায় ২৬শ’ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলে হলমার্কের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা মোদাচ্ছের আলী গ্রুপের মালিকের পূর্ব পরিচিত হওয়ায় এবং ঋণ নেয়ার বিষয়ে তিনি প্রভাব ফেলেছেন এমন অভিযোগ ওঠায় তাঁকেও এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ করে কমিশন।
অভিযোগ ওঠে, ভুয়া এলসির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ইনল্যান্ড বিল পার্সেজের মাধ্যমে এক হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা আত্মসাত করেছে হলমার্ক গ্রুপ। নন-ফান্ডেড আরও এক হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগ করে তা অনুসন্ধানে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ২৭ জনের বিরুদ্ধে ৪ অক্টোবর ১১টি মামলা করেছে দুদক। এতে হলমার্ক গ্রুপের ৭ এবং সোনালী ব্যাংকের ২০ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। গত ৭ অক্টোবর হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়। এরপর হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামকে ১৮ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয়।
ডেসটিনি প্রতারণা ॥ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে প্রায় ৩ হাজার তিন শ’ কোটি টাকা আত্মাসাৎ করার অভিযোগ ওঠে ডেসটিনি গ্রুপের বিরুদ্ধে। মানিলন্ডারিং আইনে দুর্নীতি দমন কমিশন দুটি মামলায় ৩২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল হারুন-উর-রশিদ, কোম্পানির চেয়ারম্যান রফিকুল আমিনসহ ২২ জন। আদালতে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হলে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী আত্মসাত করা টাকার দ্বিগুণ ফেরত দিতে হবে। একই সঙ্গে আসামিদের প্রত্যেকের ১২ বছর করে সাজা হবে। আদালতে আত্মসমর্পণ করতে গেলে গ্রুপটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রফিকুল আমিন, প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হোসাইন, শীর্ষ কর্মকর্তা সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশীদকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীতে জেনারেল হারুনকে শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেয়া হলেও ডেসটিনির অপর গ্রেফতারকৃত আসামিরা কারাগারে রয়েছেন।
রেলের কেলেঙ্কারি ॥ ২০১২ সালে দেশের অন্যতম আলোচিত ছিল রেল কেলেঙ্কারির ঘটনাটি। আর এ ঘটনায় বাজেভাবে ফেঁসে যান ৫৫ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হওয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও তিনি রেলমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। এখন রয়েছেন দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে। ঘটনার তদন্তকালীন পুরো এক মাস তিনি সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকা- থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সহকারী ওমর ফারুক তালুকদার, রেলের পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা এবং রেলের নিরাপত্তা কমান্ডেন্ট এনামুল হককে নিয়ে ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল রাতে এপিএসের ব্যক্তিগত গাড়িচালক আলী আজম খান গাড়িটি হঠাৎ বিজিবি সদর দফতরের ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। গাড়ি ঢোকানোর পর গাড়িচালক গাড়িতে বস্তাভর্তি টাকা (৭০ লাখ টাকা) আছে বলে চিৎকার শুরু করেন। চালক দাবি করেন টাকা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। একই সময়ে সুরঞ্জিত পুত্র সৌমেন সেনগুপ্ত বিটিআরসি থেকে ‘আইসিএক্স’ (ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ) লাইসেন্সের অনুমোদন পান। কথা ওঠে বাবা সেনগুপ্তের দুর্নীতির টাকায় ছেলে আইসিএক্সের লাইসেন্স নিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত দুনীতি দমন কমিশন ও রেল মন্ত্রণালয়ের তদন্তে সুরঞ্জিত ও পুত্র সৌমেন নির্দোষ প্রমাণিত হন। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ফারুক, মৃধা এবং এনামুলের অনিয়মের আলামত ধরা পড়ে। ওই অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের তিনজনের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করে সংস্থাটি। এর মধ্যে ফারুক কারাগারে আছেন। অপর দুই আসামি পলাতক রয়েছেন।
সাগর-রুনী হত্যা ॥ বিদায়ী বছর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যা, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম এবং বিরোধী দলের অবরোধ চলাকালে নিরীহ দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে ছাত্রলীগ কর্মীদের কুপিয়ে হত্যার নৃশংস ঘটনা সবচেয়ে আলোচনার জন্ম দেয়। এর মধ্যে সাগর-রুনী হত্যা ও ইলিয়াস আলী গুমের কোন কূলকিনারা না হওয়ায় সরকার তীব্র সমালোচনার মধ্যে পড়ে।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে পশ্চিম রাজাবাজারের রশিদ লজের ৫৮/এ/২ নম্বর বাড়ির ৫ম তলার ফ্ল্যাটে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক গোলাম মোস্তফা সরোয়ার (সাগর সরোয়ার) ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনী খুন হন। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকা-ের মামলাটি তদন্তে ডিবি পুলিশের ব্যর্থতার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সাগর-রুনী হত্যা মামলার তদন্তের কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। সাংবাদিক দম্পতির খুনীদের গ্রেফতারে অব্যাহত আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন সাংবাদিকরা। এর মাঝে এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের এক মন্তব্য সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। গত ৩০ মে লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বলেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী পরকীয়ার বলি। তবে সাংবাদিকদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত মাহফুজুর রহমান সেসব বক্তব্য দেয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
ইলিয়াস আলী গুম ॥ বিদায়ী বছরের ১৭ এপ্রিল বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী রাজধানীর বনানী থানাধীন মহাখালীর আমতলীর কাছে ২/১ নম্বর বনানী সড়কের সাউথ পয়েন্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজের কাছ থেকে গভীররাতে চালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া চালকসহ ইলিয়াস আলীকে র্যাব অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ করেন। যদিও র্যাবের তরফ থেকে বরাবরই তা অস্বীকার করা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট চালকসহ ইলিয়াস আলীকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধারের দবিতে হরতালসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছে।
প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎ হত্যা ॥ সব হত্যাকা-ই মর্মান্তিক। তবে সেই সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হয় না বলে সেই বেদনা অনেক সময় উপলব্ধির বাইরেই থাকে। তাই টিভিতে যখন বিশ্বজিৎকে হত্যার দৃশ্য সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করল তখন একই সঙ্গে বিস্ময়, ঘৃণা, কষ্ট তাদের নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। গত ৯ ডিসেম্বর বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে পুরনো ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে বিশ্বজিৎ দাসের (২৩) ওপর ধারালো ছুরি, লাঠিসোটা ও রড দিয়ে হামলার ঘটনা ঘটে। মারাত্মক আহত অবস্থায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে তার মৃত্যু হয়। প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎ খুনের ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। উচ্চ আদালত বিশ্বজিৎ দাসের খুনীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়। বিশ্বজিৎ দাস খুনের ঘটনায় পত্রপত্রিকায় এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ঘাতকদের ছবি প্রকাশিত হতে থাকে। তাদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্রলীগ কর্মী। ছবি দেখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৯ ছাত্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। বর্তমানে আসামিরা কারাগারে আটক রয়েছে।
টিআইবির প্রতিবেদন ॥ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির দুর্নীতি বিষয়ক প্রতিবেদনগুলো বিতর্ক সৃষ্টি করে। তবে ঢালাওভাবে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে একটি জরিপ প্রতিবেদন দেয়ার কারণে জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যরা টিআইবিকে দেশ থেকে বের করে দেয়া এবং এর হেড অফিসে নালিশ করার দাবি জানান। ‘৯৭ শতাংশ সংসদ সদস্য দুর্নীতি, অনিয়ম, হত্যার সঙ্গে জড়িত’ উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) দেয়া প্রতিবেদন নিয়ে বছরের সব শেষ ১৫তম অধিবেশনে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন সংসদ সদস্যরা। গত ১৯ নবেম্বর সংসদ সদস্যরা টিআইবির প্রতিবেদনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, সংসদের বিশেষ অধিকার কমিটিতে টিআইবিকে ডাকা হোক। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হোক-কিসের ভিত্তিতে তারা ঢালাওভাবে এ ধরনের অভিযোগ দায়ের করে। এছাড়া টিআইবির কার্যক্রম বাংলাদেশে বন্ধের পাশাপাশি তাদের দেশ থেকে বের করে দেয়ার দাবি জানানো হয়। এ বিষয়ে স্পীকারের রুলিং চাওয়া হলে তিনি সিনিয়র সংসদ সদস্যদের পরামর্শ নিয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানান।
সমুদ্র জয় ॥ বিদায়ী বছরে সাফল্য আর অর্জন কিছু কম ছিল না। বাংলাদেশের কৃষিতে সাফল্য, পোশাক শিল্প আর নগর উন্নয়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা মিডিয়ায় ভূয়সী প্রশংসা করে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। বাংলাদেশকে সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক উদীয়মান দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তবে সেইসব সাফল্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করছে সমুদ্র জয়ের উল্লাস। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের বিজয় হয়েছে। জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সি’ (আইটিএলওএস) গত ১৪ মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশের ‘ন্যায্যতা’ (ইকুয়িটি) ভিত্তিতে নির্ধারণের দাবির পক্ষে রায় ঘোষণা করে। এ রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘ ৩৮ বছরের এই অমীমাংসিত ইস্যুটি সমাধানের পথ খুঁজে পায়। টানা তিন বছরের আইনী লড়াইয়ের পর এ রায় বাংলাদেশের জন্য একাধারে গৌরব ও ইতিহাস সৃষ্টি করে। এ রায়ের ফলে বঙ্গোপসাগরের জলরাশি এবং তলদেশের সম্পদরাজিতে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর খোদ জাতিসংঘের সমুদ্র আইন বিষয়ক আদালত আইটিএলওএস বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক এলাকায় এবং তদুর্ধ মহীসোপান এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ অধিকারের আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ॥ যে কোন সময় কাক্সিক্ষত রায়- বিদায়ী বছরের শেষ দিকে এমনই উত্তেজনা ছিল স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির। এক বুক আশা নিয়ে কোটি মানুষ চেয়ে আছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতবিরোধী অপরাধের অভিযুক্তদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দিকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিকামী বাঙালীর রক্ত ঝরিয়ে ছিল পাকিস্তানী বর্বর জল্লাদের দল। সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করেছিল তারা। আর এদের সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামস। স্বাধীন বাংলাদেশে একাত্তরে স্বজন হারানো আর স্বজন হারাননি কিন্তু দেশমাতৃকার জন্য বিবেক সদা জাগ্রত এমন মানুষদের একটিই চাওয়া ছিল রাজাকার-আলবদর-আলশামসের বিচার। জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার দায়িত্ব মাথায় নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। বছরের শেষে ঘাতকদের কয়েকজনের শাস্তি যে কোন মুহূর্তে হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছিল। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকেই এর কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে আন্তর্জাতিক অঙ্গন, যুদ্ধপরাধী দল জামায়াত এবং জামায়াতকে সমর্থন দেয়া প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নানান চাপ ছিল। বছরজুড়েও তাদের অব্যাহত চাপ ছিল। বছরের শেষ দিকে দুটি ঘটনা ট্রাইব্যুনালের চলার পথকে অমসৃণ করার চেষ্টা করে। ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের ব্যক্তিগত কম্পিউটার ও ই-মেইল হ্যাকিং করা হয়। প্রবাসী এক আইনজীবীর সঙ্গে তাঁর স্কাইপে-সংলাপ নিয়ে জলঘোলা করার চেষ্টা করে বিরোধীপক্ষ। ওই ঘটনায় তিনি পদত্যাগ করেন। আর সর্বশেষ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট গোলাম আযমসহ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির হুকুম না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লূর রহমানকে চিঠি দিলে এবং বিচার প্রক্রিয়া দেখতে তুরস্কের কট্টরপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা পরিচয় গোপন রেখে অন এ্যারাইভল ভিসার সুযোগ নিয়ে ঢাকায় বিভিন্ন বৈঠক করে গেলে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
No comments