৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি, রেকর্ড রেমিটেন্স নিয়ে পার হলো ২০১২- বিদ্যুত উৎপাদন ৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি by কাওসার রহমান
বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থায় টানা এক দশক ধরে ছয় শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে রেকর্ড রেমিটেন্স ও রিজার্ভ সৃষ্টির মাধ্যমে বিদায়ী বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ে।
এ বছর টানা দুটি মহামন্দার জলোচ্ছ্বাস থেকে দেশের অর্থনীতিকে আগলে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সরকার বেশ দক্ষতার পরিচয় দেয়। তবে অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও বিনিয়োগ খরা বছরজুড়েই অর্থনীতির গতিশীলতায় বাধা সৃষ্টি করে। এর নেপথ্যে ছিল বিদ্যুত ও গ্যাস সঙ্কট। যদিও শেষ পর্যন্ত দুর্মুখদের মুখে ছাই দিয়ে বিদায়ী বছরে বিদ্যুত উৎপাদন ছয় হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়।দেশে প্রথমবারের মতো রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদিত বিদ্যুত স্বস্তি নিয়ে আসে দেশবাসীর মাঝে। তবে শেয়ার বাজারের নেতিবাচক প্রবণতায় সারা বছরই এক ধরনের অস্বস্তিতে ছিলেন অর্থমন্ত্রী। আস্থা সঙ্কটের কারণে শেয়ার বাজার সূচক এ বছর গিয়ে ঠেকে তলানিতে। এছাড়া আর্থিক খাতে এক প্রকার ঘটনাবহুল বছর ছিল ২০১২ সাল। দেশের বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে সারা বছরই বেকায়দায় ছিল সরকার। এ দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বহুপাক্ষিক দাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ সৃষ্টি হয়। যদিও বিশ্বব্যাংক তার দীর্ঘদিনের কনভেনশন পাল্টে বাতিল ঋণ পুনরায় বহাল করে। পদ্মা সেতুতে ঋণ দিতে সম্মত হয়। বছরের শেষের দিকে আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে ডেসটিনি ও সোনালী ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা। আর্থিক খাতে এ সকল দুর্নীতির ঘটনা দেশের বিনিয়োগে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। বছরের শেষ দিকে এসে রাজনৈতিক অস্থিরতাও অর্থনীতিকে হুমকির সম্মুখীন করে তোলে।
গত অর্থ দশক ধরেই বিশ্ব অর্থনীতি দুই দফা মন্দার শিকার হয়। তার সঙ্গে যোগ দেয় ইউরোজোন সঙ্কট। সেই ধাক্কা এখনও সামলে উঠতে পারেনি উন্নত দেশগুলো। এতে ইউরোপ আমেরিকাসহ উন্নত ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়ে। তবে সম্ভাব্য বৈশ্বিক বিপর্যয় থেকে দেশের আর্থিক খাতকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহণ করায়, এ বিপর্যয় থেকে শুধু রক্ষাই পায়নি বাংলাদেশের অর্থনীতি, সেই সঙ্গে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতেও সক্ষম হয়। এতে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও প্রযুক্তিসহ অন্যান্য বেসরকারী খাতের বিকাশ ঘটে। যার দরুন বিদায়ী বছরে কমেছে আমদানি নির্ভরতা, বেড়েছে দেশীয় উৎপাদনের সক্ষমতা ও রফতানির পরিমাণ। সেই সঙ্গে বিদায়ী বছরে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় দেশের মজুদকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং প্রবাসীদের রেমিটেন্স আহরণও সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। আর্থিক খাতে বিরাজমান এসব সুখকর পরিস্থিতি একদিকে যেমন অর্থনৈতিতে স্থিতিশীলতা এনে দেয়, তেমনি ছয় শতাংশের ওপর স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির গতিশীলতাও বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
বিশ্ব অর্থনীতির ক্রান্তিলগ্নেও দেশীয় অর্থনীতির এ গতিশীল প্রবৃদ্ধি বিদায়ী বছরে আন্তর্জাতিক পরিম-লেরও নজর কাড়ে। অর্থনৈতিক পরাশক্তির দেশগুলোর যেখানে ৪ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও দেশীয় নানারকম প্রতিবন্ধকতার মাঝেও গড়ে ৬.৩৫ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে যে পাঁচটি দেশ সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে তার একটি হলো বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতিতে এটি একটি বড় অর্জন।
ফলে বিদায়ী বছরে বিশ্ব অর্থনীতির সাফল্যের গল্পে উঠে আসে বাংলাদেশের নাম। এ সাফল্য শুধু অর্থনীতিতেই নয়, মানব উন্নয়নেও আসন গেড়ে বসেছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তাই দেশের এ অগ্রগতির সাফল্য বিদায়ী বছরে এসে বিদেশীদের চোখেও ধরা পড়ে। গত নবেম্বরে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের চোখে ধরা পড়ে বাংলাদেশের এ অগ্রগতির গল্প। ঠিক তার পরপরই বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আসে এ অগ্রগতির স্বীকৃতি।
গত নবেম্বরে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংক তার বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৩-এ বলেছে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যে অল্প কয়েকটি দেশ মানব উন্নয়ন সূচকের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ‘ভাল করেছে’ তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশের মানুষ বাড়তি পরিশ্রম করায় এবং চাকরির সুবাদে নারীরা সন্তান লালন-পালনে বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারায় দারিদ্র্য কমেছে। নিজেদের কাজ আরও ভালভাবে করতে করতে শ্রমিকদের দক্ষতা বেড়েছে। বেশি বেশি উৎপাদনমুখী চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়ে কম উৎপাদনমুখী কাজগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতেও দক্ষতা বেড়েছে। কৃষি খাতে আধুনিকায়ন, কম দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিকের কাজের সুযোগ দেয়া শিল্পখাত এবং এগুলোর সমর্থনে নেয়া বিভিন্ন সমাজিক নীতির কারণে এ সফলতা এসেছে। তবে ওয়াশিংটনভিত্তিক এ দাতা সংস্থা বলছে, ২০২১ সাল নাগাদ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
বাংলাদেশ শুধু ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মানবিক উন্নয়ন সূচকও বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এখন সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের। ব্রিকস জোটের দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো যেখানে পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে ছয় শতাংশের ওপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে।
এ প্রসঙ্গে টাইম ম্যাগাজিন বলছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক যে অর্থনৈতিক উত্থান তা মূলত তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর ভর করেই। ২০০৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক শিল্পের চাঙ্গাভাবের কারণেই এ সময়ে বাংলাদেশ ছয় দশমিক তিন শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক রেটিং কোম্পানি গোল্ডম্যান সস বাংলাদেশকে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের পর পরবর্তী ১১ উদীয়মান দেশের একটি হিসেবে উল্লেখ করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরও একটি বড় অবদান রাখছে প্রসাসী আয়। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৯০ লাখ কর্মী বিদেশে কাজ করছে। এই কর্মীদের বেশির ভাগই অবস্থান করছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাজ্যে। বিদেশে অবস্থানরত এই বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী ২০১২ সালে ১৪শ’ কোটি ডলার পাঠিয়েছে দেশে। ফলে বাংলাদেশ দশ হাজার কোটি ডলারের অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে।
এর আগে নবেম্বর মাসের গোড়ার দিকে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের ‘আউট অব বাস্কেট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মডেল। দেশের এই সাফল্য অনেকের জন্যই শিক্ষণীয়। গত ২০ বছরে মানব কল্যাণের প্রায় প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ব্যতিক্রমধর্মী। সময়ের পরীক্ষায় বাংলাদেশ উত্তীর্ণ এবং দেশটি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে, এটা অন্যের জন্য অনুকরণীয়। বাংলাদেশের গড় আয়ু ভারতের চেয়ে চার বছর বেশি। নারী শিক্ষার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক উপরে। নবজাতক, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার ব্যাপকহারে কমেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হওয়ার পরও দেশটি সাফল্য অর্জন করেতে পেরেছে। দেশের মানুষের আয় বাড়ছে পরিমিতভাবে।
এর আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কিছু বাধার পরও দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এদেশের প্রবৃদ্ধির গতি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় গতিশীল। দিন দিন বাড়ছে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা। সেই সঙ্গে বাড়ছে উৎপাদনও। ক্রমান্বয়ে এই বাড়তি উৎপাদন এবং চাহিদাই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। এভাবে প্রতিদশকে অর্থনীতির আকার দ্বিগুণ হচ্ছে। এ অবস্থায় শীঘ্রই ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ক্লাবে জায়গা করে নেয়ার সুযোগ হাতছানি দিয়ে ডাকছে বাংলাদেশকে।
আন্তর্জাতিক রেটিংকারী সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড এন্ড পুওর’সও (এসএন্ডপি) বাংলাদেশের জন্য বার্ষিক রেটিং পর্যালোচনা করে পরপর দ্বিতীয়বারের মতো রেটিংয়ে বাংলাদেশকে একটি স্থিতিশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে (বিবি মাইনাস) স্বীকৃতি দিয়েছে। ওই রেটিংয়ের অবস্থান অনুযায়ী ভারতের পরই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা বি প্লাস ও পাকিস্তানের বি মাইনাস চেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
সর্বশেষ স্বীকৃতিটি আসে গত ১৮ ডিসেম্বর ব্রিটেনের জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান থেকে। দৈনিকটির ইকোনমিকস এডিটর ল্যারি এলিয়টের ‘নিউ-ওয়েভ ইকোনমিস গোয়িং ফর গ্রোথ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ।
সম্ভাব্য বৈশ্বিক বিপর্যয় থেকে দেশের আর্থিক খাতকে রক্ষায় সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে সতর্কতামূলক কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল। একদিকে মুদ্রানীতি শিথিল করা হয়েছিল। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক একযোগে খাতভিত্তিক প্রণোদনা কর্মসূচী হাতে নিয়েছিল। এতে দেশের রফতানি খাতগুলো চাঙ্গা হয়। রফতানি বহুমুখীকরণ হয়। সরকারের উদারনীতি ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাহিদাযোগ্য পণ্য হিসাবে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।
রিজার্ভ রেমিটেন্সে রেকর্ড সর্বকালের ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, আমদানি বাণিজ্যের বকেয়া পরিশোধে প্রতি দুই মাস অন্তর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) গড়ে ১শ’ কোটি ডলার হাতছাড়া করার পরও বিদায়ী বছরে গত কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ১২ শ’ কোটি ডলারে ওঠানামা করছে। গত ২৬ ডিসেম্বর এ রিজার্ভ নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে ১২ দশমিক ৭২ বিলিয়ন (এক হাজার ২৭২ কোটি) ডলারে উন্নীত হয়, যা দিয়ে প্রায় পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তবে দুই মাস অন্তর অন্তর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের পাওনা পরিশোধের পরও এ রিজার্ভ যাতে ১২শ’ কোটি ডলারের নিচে না নামে সে পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহের সারাবছরই উর্ধমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। গত ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশের অর্জিত রেমিটেন্স প্রবাহ সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে প্রায় ১২ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। বিদায়ী ক্যালেন্ডার বছর ২০১২ সাল শেষেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ১৪শ’ কোটি ডলারে পৌঁছবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর।
বিদ্যুত নিয়ে স্বস্তি ॥ বিদায়ী ২০১২ সালে বিদ্যুত নিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেশবাসী। বছরের শুরুতে কিছুটা সমস্যা হলেও শেষভাগে এসে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে সরকার। এ বছর রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে চুক্তি হয়েছে একের পর এক। সরকার আশা করছে, ২০১৬ সালের মধ্যেই দেশে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুত উৎপাদন হবে।
বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৬০টি বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি করা হয়েছে, যাদের উৎপাদন ক্ষমতা আট হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। এরমধ্যে রেন্টাল ৩টি, কুইক রেন্টাল ১৭টি, আইপিপি ১৯টি এবং সরকারী মালিকানাধীন ২১টি কেন্দ্র রয়েছে।
বর্তমান সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের সময় বিদ্যুত কেন্দ্রের স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯২৪ মেগাওয়াট। ২০১২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে আট হাজার ২৭৫ মেগাওয়াটে। এ সময়ে দেশে ৫১টি নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র চালু হয়েছে।
বিদায়ী বছর সর্বোচ্চ ছয় হাজার ৬৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হয়েছে। যা এক দিনের বিদ্যুত উৎপাদনে রেকর্ড। দেশে এখন বিদ্যুত চাহিদা রয়েছে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু জ্বালানি স্বল্পতার কারণে দেশে চার হাজার ৬০০ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা হচ্ছে। কারণ গ্যাস সঙ্কটে চট্টগ্রামের বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো বছরের অধিকাংশ সময় অচল থাকে।
শেয়ার বাজার নিয়ে অস্বস্তি ॥ বিদায়ী বছরেও দেশের পুঁজিবাজারের ক্রান্তিকাল কাটেনি। উল্টো দিন যতই গড়াচ্ছে বিনিয়োগকারীদের ক্ষত ততটা গভীর হচ্ছে। ২০১০ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দরপতনের পরে ২০১১ সালের নাজুক পরিস্থিতি ২০১২ সালে আরও বেড়েছে। বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সরকারের কোন উদ্যোগই কাজে আসেনি। উল্টো সূচকের পতনের মাত্রা আরও বেড়েছে।
তবে বাজারে নেতিবাচক প্রবণতা এবং সূচকের পতনের মাঝেও শেয়ার সরবরাহ অব্যাহত ছিল। গত এক বছরে পুঁজিবাজারে ১০টি কোম্পানি নতুন করে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এরপরেও একবছরে ডিএসই বাজার মূলধন কমেছে ২৯ হাজার কোটি টাকা। আর সাধারণ সূচক কমেছে ১১শ’ পয়েন্টের বেশি।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘বছরের বেশিরভাগ সময় সূচক নিম্নমুখী থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে, পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অনুপস্থিতি। কর্তাব্যক্তিরা যদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তবে বাজার একটি সুবর্ণ সময় পার করতে পারত।’
গত বছরে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন। প্রায় ১৬ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীকে চিহ্নিত করা হলেও ক্ষতিপূরণ কেউ পায়নি।
কাটছেনা বিনিয়োগ খরা ॥ দেশের বিনিয়োগ খরা কাটছে না। নানামুখী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিদায়ী বছরেও দেশে শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসেনি বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। আর উচ্চ সুদের কারণে এখন দেশীয় উদ্যোক্তারাও হাত গুটিয়ে বসে আসে। ফলে কাক্সিক্ষত গতি আসছে না অর্থনীতিতে। আর বিনিয়োগ খরার কারণেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত এক দশক ধরে ছয় শতাংশের ঘরে আটকে আছে। আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের মতো অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি হলেও যথেষ্ট বিনিয়োগ না আসায় ভাংছে না প্রবৃদ্ধির বেড়াজাল।
তবে বিদায়ী বছরে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। সর্বশেষ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে (এফডিআই) ৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি। গত বছর জুলাই-আগস্ট সময়ে এফডিআই এসেছিল ২৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। তবে ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা ছিল এক বছরে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে শক্তিশালী অবস্থা ॥ সবমিলিয়ে বিদায়ী ২০১২ সালে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শক্তিশালী হয়েছে। এযাবতকালের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ, স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি, রেকর্ড পরিমাণ সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং রফতানি স্থিতি ও রাজস্ব সম্পদের দক্ষ ব্যবস্থাপনার ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির এই অগ্রগতি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে রেমিটেন্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১১ কোটি ডলার। একই সময়ে রফতানি আয় হয়েছে ১ হাজার ১৩ কোটি ডলার, যা জিডিপি’র ৪.৩৬ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার ফলে বিদায়ী বছরে রাজস্ব আয় ১৪.৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সামষ্টিক অর্থনেতিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে ১৫০টি দেশের তালিকায় শীর্ষ ৩৫টির মধ্যে স্থান দিয়েছে এবং আশা করা হচ্ছে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বেশি হবে। চলতি অর্থবছরের জন্য পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশ, নেপালের ৩.৬ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ৪.৭ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৫.৯ শতাংশ, ভারতের ৬ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ৬.৭ শতাংশ হবে বলে প্রদর্শিত হয়েছে।
No comments