মুক্তিসংগ্রামের কমরেড মণি সিংহ by মনজুরুল আহসান খান
কমরেড মণি সিংহ ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা নেতা। এ দেশের শোষিত-বঞ্চিত-মেহনতি মানুষের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। জেল-জুলুম-হুলিয়া-নির্যাতন, বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ, কোনো কিছুই তাঁকে তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
দেশ ও জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে তিনি ছিলেন এক আপসহীন বিপ্লবী।
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশে চরম ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডব চলতে থাকে। সাম্প্রদায়িক হামলা ও হয়রানি, লাখ লাখ মানুষের দেশত্যাগ এবং মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বৈরশাসন দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরাও অনেকে তখনো পাকিস্তানি ভাবধারায় প্রভাবান্বিত। এঁদের অনেক নেতাই সেদিন মুসলিম লীগের 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন' আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। সেদিন যে সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড হয়েছিল তা 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' হিসেবে পরিচিত। এ অবস্থায় মণি সিংহের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি এককভাবেই সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের বিরুদ্ধে কৃষক ও জনগণকে নিয়ে গণসংগ্রাম গড়ে তোলেন। মণি সিংহের নেতৃত্বে আন্দোলন ও বিদ্রোহ, সিলেটে নানকার আন্দোলন, উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন, ইলা মিত্রের নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ অনেক ক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়। কমিউনিস্ট পার্টির ওপর তীব্র দমননীতি নেমে আসে। অনেকে শহীদ হন, কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং দৈহিক নির্যাতনের শিকার হন। বন্দি অবস্থায় ইলা মিত্রের ওপর নিষ্ঠুর দৈহিক নির্যাতনের কথা সবারই জানা। কমিউনিস্ট পার্টি বস্তুত নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পার্টির উদ্যোগে গঠিত ছাত্র ফেডারেশন দমন-পীড়ন ও নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়। কমরেড মণি সিংহ অদম্য সাহসিকতা নিয়ে আত্মগোপনে থেকে পার্টি এবং আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যান। ছাত্র ফেডারেশন এবং পার্টির যেসব নেতা-কর্মী তখনো আধা প্রকাশ্য অবস্থায় বা প্রকাশ্যে কাজ করতে পারছিলেন, তাঁরা তখন ছাত্রলীগ এবং নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের মাধ্যমেও কাজ করতে থাকেন। 'মুক্তবুদ্ধি' বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা কাজ করতে থাকেন। মণি সিংহ এবং কমিউনিস্টদের প্রচেষ্টায় তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ সেক্যুলার ধারায় 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কদম কদম এগিয়ে চলতে থাকে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে কমরেড মণি সিংহ, খোকা রায়সহ কমিউনিস্ট পার্টি মূল ভূমিকা গ্রহণ করে। একটি সামাজিক সমীক্ষায় প্রকাশ, ভাষা আন্দোলনের নেতা ও সক্রিয় কর্মীদের ৬০ শতাংশের ওপরে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রভাবমুক্ত হয়ে জাতিগত ও গণতান্ত্রিক সেক্যুলার চেতনার উন্মোচন। সেই পথ ধরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং পাকিস্তানি মতাদর্শের হোতা মুসলিম লীগের ভরাডুবি। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠনেও কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগই ছিল বেশি। প্রবল প্রতাপশালী মুসলিম লীগের পরাজয় নিশ্চিত করতে বৃহত্তর ঐক্য নিশ্চিত করে যুক্তফ্রন্টের শরিক দু-একটি দলের আপত্তির কারণে কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্টের বাইরে থেকে যায়, কিন্তু যুক্তফ্রন্টকে এগিয়ে নিতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করে। নেতার ওপরে পার্টির, পার্টির ওপরে আন্দোলন এবং দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় মণি সিংহ এবং কমিউনিস্ট পার্টি।
১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার দাবি পরিত্যাগ করার শর্তে আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা এই বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ভেঙে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠিত হয়। ন্যাপ বাংলাদেশের স্বাধিকারের দাবি এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দাবি নিয়ে সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের মার্শাল ল হাজারো কমিউনিস্ট-বামপন্থী গণতান্ত্রিক নেতার গ্রেপ্তার, সামরিক বাহিনীর বেত্রদণ্ড উপেক্ষা করে গণসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে কমরেড মণি সিংহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
কমরেড মণি সিংহ তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে বাংলাদেশে কৃষক, শ্রমিক ও পেশাজীবী এবং ছাত্র-বুদ্ধিজীবী, নারীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের গণসংগঠন ও আন্দোলন বিকাশে নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস অব্যাহত রাখেন।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে 'মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্ব' তীব্র। পিকিংপন্থীরা ৬ দফাকে সিআইএর মদদপুষ্ট বলে তার বিরোধিতা করেন। কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবিসংবলিত ৬ দফাকে সমর্থন দিয়েও ৬ দফাকে অসম্পূর্ণ বলেন। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর) সেদিন ৬ দফার সঙ্গে আর্থসামাজিক দাবি ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দাবিসহ শ্রমিক-কৃষক-ছাত্রসমাজের দাবি যুক্ত করার কথা বলেন। ১৯৬৯ সালে ৬ দফার সঙ্গে ওই সব দাবি যুক্ত হয়ে ১১ দফা প্রণীত হয়। ৬ দফা আন্দোলন এক পর্যায়ে স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর ১১ দফার ভিত্তিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনে নামে। খুব স্বল্পসময়ের মধ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং গণতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত সংগ্রামে ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। আইয়ুব শাহীর পতন ঘটে। শেখ মুজিব, মণি সিংহসহ রাজনৈতিক নেতারা মুক্তি পান। গণ-অভ্যুত্থানে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু আন্দোলনে তাঁর ও তাঁর দলের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং আন্দোলনে ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেন। এতদসত্ত্বেও মণি সিংহ ও কমিউনিস্ট পার্টি রাজপথে একই লক্ষ্যাভিমুখী সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে যত্নবান হন।
১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরই কমরেড মণি সিংহ পার্টির এক গোপন কর্মিসভায় ঘোষণা করেন, আজ আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের মুখোমুখি। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি তোলা হয়। ১৯৬৮ সালে আত্মগোপনে অনুষ্ঠিত পার্টির চতুর্থ সম্মেলনেই কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষণা করে 'জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পূর্ব বাংলায় পৃথকভাবে সম্পন্ন হবে।'
মুক্তিযুদ্ধের সময় কমরেড মণি সিংহের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সুস্পষ্ট। তিনি স্বাধীনতাকামী সব শক্তি নিয়ে মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানান। তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে মুক্তিযুদ্ধের শত্রু এবং সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে শনাক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদসহ আওয়ামী লীগের অনেকেই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে মোহগ্রস্ত। তারা আমেরিকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে যোগসাজশে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা ও আপস রক্ষা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে এক ধরনের কনফেডারেশনের পক্ষে চক্রান্ত চালায়। তারা প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করে। শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে মুজিববাহিনী তাজউদ্দীন সরকারের অধীনে আসতে অস্বীকার করে। ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল মহল ও মার্কিন লবি তাদের মদদ দেয়। কমরেড মণি সিংহ দৃঢ়তার সঙ্গে এসব ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও প্রগতিশীল বিশ্বকে টেনে আনতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল শক্তির হস্তক্ষেপে মণি সিংহ, মওলানা ভাসানী, মোজাফ্ফর প্রমুখকে নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। মুক্তিবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীতে বাম প্রগতিশীলদের প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় কমরেড মণি সিংহ প্রমুখের প্রচেষ্টায় 'ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের' পৃথক গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর অবদানও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির চক্রান্তের বিরুদ্ধে কমরেড মণি সিংহ তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বিভিন্ন মহলের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতিগুলো বাস্তবায়নে কমরেড মণি সিংহ তাঁর জীবনসায়াহ্নে এসেও আপসহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বৃদ্ধ বয়সে স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁকে জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছিল।
একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, সমাজতন্ত্র ও মানব মুক্তির সংগ্রামে একজন বিপ্লবী, নিবেদিতপ্রাণ, সৎ, নীতিনিষ্ঠ, আত্মত্যাগী ও মেহনতি মানুষের মহান নেতা হিসেবে কিংবদন্তিতুল্য কমরেড মণি সিংহ বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও লেখক
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশে চরম ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডব চলতে থাকে। সাম্প্রদায়িক হামলা ও হয়রানি, লাখ লাখ মানুষের দেশত্যাগ এবং মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বৈরশাসন দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরাও অনেকে তখনো পাকিস্তানি ভাবধারায় প্রভাবান্বিত। এঁদের অনেক নেতাই সেদিন মুসলিম লীগের 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন' আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। সেদিন যে সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড হয়েছিল তা 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' হিসেবে পরিচিত। এ অবস্থায় মণি সিংহের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি এককভাবেই সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের বিরুদ্ধে কৃষক ও জনগণকে নিয়ে গণসংগ্রাম গড়ে তোলেন। মণি সিংহের নেতৃত্বে আন্দোলন ও বিদ্রোহ, সিলেটে নানকার আন্দোলন, উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন, ইলা মিত্রের নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ অনেক ক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়। কমিউনিস্ট পার্টির ওপর তীব্র দমননীতি নেমে আসে। অনেকে শহীদ হন, কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং দৈহিক নির্যাতনের শিকার হন। বন্দি অবস্থায় ইলা মিত্রের ওপর নিষ্ঠুর দৈহিক নির্যাতনের কথা সবারই জানা। কমিউনিস্ট পার্টি বস্তুত নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পার্টির উদ্যোগে গঠিত ছাত্র ফেডারেশন দমন-পীড়ন ও নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়। কমরেড মণি সিংহ অদম্য সাহসিকতা নিয়ে আত্মগোপনে থেকে পার্টি এবং আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যান। ছাত্র ফেডারেশন এবং পার্টির যেসব নেতা-কর্মী তখনো আধা প্রকাশ্য অবস্থায় বা প্রকাশ্যে কাজ করতে পারছিলেন, তাঁরা তখন ছাত্রলীগ এবং নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের মাধ্যমেও কাজ করতে থাকেন। 'মুক্তবুদ্ধি' বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা কাজ করতে থাকেন। মণি সিংহ এবং কমিউনিস্টদের প্রচেষ্টায় তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ সেক্যুলার ধারায় 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কদম কদম এগিয়ে চলতে থাকে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে কমরেড মণি সিংহ, খোকা রায়সহ কমিউনিস্ট পার্টি মূল ভূমিকা গ্রহণ করে। একটি সামাজিক সমীক্ষায় প্রকাশ, ভাষা আন্দোলনের নেতা ও সক্রিয় কর্মীদের ৬০ শতাংশের ওপরে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রভাবমুক্ত হয়ে জাতিগত ও গণতান্ত্রিক সেক্যুলার চেতনার উন্মোচন। সেই পথ ধরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং পাকিস্তানি মতাদর্শের হোতা মুসলিম লীগের ভরাডুবি। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠনেও কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগই ছিল বেশি। প্রবল প্রতাপশালী মুসলিম লীগের পরাজয় নিশ্চিত করতে বৃহত্তর ঐক্য নিশ্চিত করে যুক্তফ্রন্টের শরিক দু-একটি দলের আপত্তির কারণে কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্টের বাইরে থেকে যায়, কিন্তু যুক্তফ্রন্টকে এগিয়ে নিতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করে। নেতার ওপরে পার্টির, পার্টির ওপরে আন্দোলন এবং দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় মণি সিংহ এবং কমিউনিস্ট পার্টি।
১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার দাবি পরিত্যাগ করার শর্তে আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা এই বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ভেঙে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠিত হয়। ন্যাপ বাংলাদেশের স্বাধিকারের দাবি এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দাবি নিয়ে সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের মার্শাল ল হাজারো কমিউনিস্ট-বামপন্থী গণতান্ত্রিক নেতার গ্রেপ্তার, সামরিক বাহিনীর বেত্রদণ্ড উপেক্ষা করে গণসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে কমরেড মণি সিংহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
কমরেড মণি সিংহ তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে বাংলাদেশে কৃষক, শ্রমিক ও পেশাজীবী এবং ছাত্র-বুদ্ধিজীবী, নারীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের গণসংগঠন ও আন্দোলন বিকাশে নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস অব্যাহত রাখেন।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে 'মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্ব' তীব্র। পিকিংপন্থীরা ৬ দফাকে সিআইএর মদদপুষ্ট বলে তার বিরোধিতা করেন। কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবিসংবলিত ৬ দফাকে সমর্থন দিয়েও ৬ দফাকে অসম্পূর্ণ বলেন। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর) সেদিন ৬ দফার সঙ্গে আর্থসামাজিক দাবি ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দাবিসহ শ্রমিক-কৃষক-ছাত্রসমাজের দাবি যুক্ত করার কথা বলেন। ১৯৬৯ সালে ৬ দফার সঙ্গে ওই সব দাবি যুক্ত হয়ে ১১ দফা প্রণীত হয়। ৬ দফা আন্দোলন এক পর্যায়ে স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর ১১ দফার ভিত্তিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনে নামে। খুব স্বল্পসময়ের মধ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং গণতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত সংগ্রামে ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। আইয়ুব শাহীর পতন ঘটে। শেখ মুজিব, মণি সিংহসহ রাজনৈতিক নেতারা মুক্তি পান। গণ-অভ্যুত্থানে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু আন্দোলনে তাঁর ও তাঁর দলের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং আন্দোলনে ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেন। এতদসত্ত্বেও মণি সিংহ ও কমিউনিস্ট পার্টি রাজপথে একই লক্ষ্যাভিমুখী সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে যত্নবান হন।
১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরই কমরেড মণি সিংহ পার্টির এক গোপন কর্মিসভায় ঘোষণা করেন, আজ আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের মুখোমুখি। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি তোলা হয়। ১৯৬৮ সালে আত্মগোপনে অনুষ্ঠিত পার্টির চতুর্থ সম্মেলনেই কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষণা করে 'জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পূর্ব বাংলায় পৃথকভাবে সম্পন্ন হবে।'
মুক্তিযুদ্ধের সময় কমরেড মণি সিংহের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সুস্পষ্ট। তিনি স্বাধীনতাকামী সব শক্তি নিয়ে মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানান। তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে মুক্তিযুদ্ধের শত্রু এবং সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে শনাক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদসহ আওয়ামী লীগের অনেকেই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে মোহগ্রস্ত। তারা আমেরিকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে যোগসাজশে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা ও আপস রক্ষা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে এক ধরনের কনফেডারেশনের পক্ষে চক্রান্ত চালায়। তারা প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করে। শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে মুজিববাহিনী তাজউদ্দীন সরকারের অধীনে আসতে অস্বীকার করে। ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল মহল ও মার্কিন লবি তাদের মদদ দেয়। কমরেড মণি সিংহ দৃঢ়তার সঙ্গে এসব ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও প্রগতিশীল বিশ্বকে টেনে আনতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল শক্তির হস্তক্ষেপে মণি সিংহ, মওলানা ভাসানী, মোজাফ্ফর প্রমুখকে নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। মুক্তিবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীতে বাম প্রগতিশীলদের প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় কমরেড মণি সিংহ প্রমুখের প্রচেষ্টায় 'ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের' পৃথক গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর অবদানও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির চক্রান্তের বিরুদ্ধে কমরেড মণি সিংহ তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বিভিন্ন মহলের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতিগুলো বাস্তবায়নে কমরেড মণি সিংহ তাঁর জীবনসায়াহ্নে এসেও আপসহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বৃদ্ধ বয়সে স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁকে জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছিল।
একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, সমাজতন্ত্র ও মানব মুক্তির সংগ্রামে একজন বিপ্লবী, নিবেদিতপ্রাণ, সৎ, নীতিনিষ্ঠ, আত্মত্যাগী ও মেহনতি মানুষের মহান নেতা হিসেবে কিংবদন্তিতুল্য কমরেড মণি সিংহ বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও লেখক
No comments