সমকালীন প্রসঙ্গ-শিক্ষায় বিনিয়োগ সুফল দিচ্ছে by রাশেদা কে চৌধুরী
পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। পাসের হার পঞ্চম শ্রেণীতে ৯৭ শতাংশেরও বেশি। অষ্টম শ্রেণীতেও রেকর্ড। আমাদের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের এ এক বড় অর্জন।
আর এতেই ভরসা মেলে_ শিক্ষার মান আরও বাড়িয়ে চলার যে চ্যালেঞ্জ সামনে, তাতেও জয়ী হতে পারব।
শিক্ষায় যে এগিয়ে চলেছি তার পেছনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, বিনিয়োগ এবং শিক্ষার প্রতি সব শ্রেণী-পেশার নারী ও পুরুষের আগ্রহ কাজ করছে। কোন পরিবেশে আমাদের বেশিরভাগ শিশু পড়াশোনা করছে সেটা মনে রাখতে হবে। অনেক স্কুল ভবন জরাজীর্ণ, কোথাও-বা সামান্য বৃষ্টিতেই পানি পড়ে। কেউবা বলবেন, তাদের স্কুল ভবনই তো নেই, পানি পড়ারও প্রশ্ন নেই। ক্লাস বসে খোলা আকাশের নিচে কিংবা গাছের ছায়ায়। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে। শিক্ষা খাতে সরকারের বরাদ্দ বছর বছর বাড়ছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি হারে যেন বেড়ে চলেছে শিক্ষার্থী সংখ্যা। সঙ্গত কারণেই মাথাপিছু ব্যয় কমছে। সরকার বিনামূল্যে বই দিচ্ছে, কিন্তু বস্তিবাসীদের পড়ার ঘর কোথায়?
পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষার ফল কেন বড় অর্জন সে প্রশ্নে আসছি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর 'অদম্য মেধাবীদের' নিয়ে প্রতিবেদন দেখে আমরা অভ্যস্ত। এখন এ দুটি পরীক্ষায় সেরা ফল করছে যেসব ছাত্রছাত্রী তাদের নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। রিকশাচালক, পোশাকশিল্পের কর্মী, দিনমজুর এবং বাড়িতে বাড়িতে কাজ করা গৃহকর্মীর সন্তানরা স্কুলে যায়, জিপিএ ৫ পায়। সমাজে মাথা উঁচু করে চলে। শিক্ষার প্রতি আগ্রহই শুধু বাড়ছে না, ভালো করার জন্যও তারা সচেষ্ট। আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার বিবেচনায় এ এক নতুন বাংলাদেশ বৈকি। পড়াশোনা করে কী লাভ, সে কথা কেউ আর বলছে না। বরং হতদরিদ্র পরিবারের মা-বাবাও বলবেন, সন্তানকে পড়াতে চাই। বেসরকারি সংগঠন-এনজিও, সিভিল সোসাইটি এবং সর্বোপরি সরকার_ সবার ভূমিকা রয়েছে এর পেছনে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষার আয়োজন তারই ধারাবাহিকতা। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষার আবার গুরুত্ব কী। কিন্তু মাঠে যারা কাজ করি তারা বুঝতে পারি এর গুরুত্ব। বহু বছর ধরে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে সরকারি বৃত্তি পরীক্ষা চালু রয়েছে। দেখা গেছে, শিক্ষকরা হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী বাছাই করে তাদের জন্য বিশেষ কোচিংয়ের আয়োজন করতেন। বাড়িতেও চলত কোচিং। এখন সবাই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে এবং তাদের মধ্য থেকে যারা ভালো করছে তাদের বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। ফলে ভালো করার প্রতি সাধারণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। মেয়েদের অংশগ্রহণও বাড়ছে।
শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের পেছনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, সেটা শুরুতেই বলেছি। বাংলাদেশে সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক পরিকল্পনা ও প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায় কিংবা সাইডলাইনে ফেলে রাখা হয়। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় যে, নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। তারা ছেলেদের মতোই বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। অঙ্গীকার রয়েছে স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ানোর। বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী উপবৃত্তি পাচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেক বিষয়ে গুরুতর মতপার্থক্য দেখছি। কিন্তু একটি বিষয়ে সবাই একমত_ নারী শিক্ষার প্রসার। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের যাত্রার শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই এ ইতিবাচক প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি। এর সুফলও মিলতে শুরু করেছে। মা ও শিশুদের মৃত্যুর হার অনেক কমে এসেছে এবং উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমাদের অর্জন বিশেষ উল্লেখযোগ্য হিসেবে স্বীকৃত। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশ সফল। এখন ঘরে ঘরে উপলব্ধি এসেছে_ নারী শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ যথার্থই লাভজনক।
পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হচ্ছে তাদের একটি অংশ এসএসসি পর্যন্ত পড়ছে না, এ চিত্র উদ্বেগের। ছেলে ও মেয়ে সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। এক পর্যায়ে মেয়েরা আরও পিছিয়ে পড়তে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রীর সংখ্যা মোটামুটি সমান থাকে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত চলে এ প্রবণতা। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে মেয়েরা পিছিয়ে পড়ে। উচ্চতর পর্যায়ে পিছিয়ে পড়ার হার আরও বেশি। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন দেখি এ চিত্রে। অভিভাবকরা তখন মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়। ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আইন আমাদের সবার চোখের সামনেই উপেক্ষিত হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্র তা অসহায়ভাবে অবলোকন করে।
এ চিত্র যথেষ্ট হতাশার। তবে আশার দিকটিকে খাটো করে দেখার দলে আমি নেই। সিলেট মেডিকেল কলেজে ১৯৬ জন শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০৫ জন ছাত্রী। কী ব্যাখ্যা দেবেন এর? চিকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে পড়ার জন্য ভর্তিচ্ছুদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কমবেশি একই চিত্র। এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীরা যোগ্যতার বলেই স্থান করে নিচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এ এক নীরব বিপ্লব। শিক্ষার ব্যয় বাড়ছে। মেয়েদের এক একটি স্তর পার হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। 'ও তো মেয়ে'_ এ কথা শুনতে হয় পদে পদে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে এবং এ কারণে অভিভাবকরা সেখানে মেয়েদের পাঠাতে উৎসাহী থাকে। স্কুল পর্যায়েও এ সমতা বিধান জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাথমিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও এটা অনুসরণ করা আবশ্যক। কারিগরি ও বৃত্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোর কথাও সরকারসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী সংখ্যা নগণ্য। শিক্ষকদের মধ্যেও নারী কার্যত অনুপস্থিত।
শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও কিন্তু রয়ে গেছে। প্রাথমিকে প্রায় শতকরা ১০০ ভাগ নাম লেখাচ্ছে; কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ আসতে পারে না। এর একটি কারণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। এ বাধা অতিক্রম করতেই হবে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ শিক্ষার মান বাড়ানো। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি পর্যায়েই তা করতে হবে। আমাদের নবীন প্রজন্ম সৃজনশীল নয়, এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না। দেশের বাইরে যারা পড়তে যায় তাদের অনেকে দারুণ ফল করছে। দেশেও এটা হচ্ছে। শহর ও গ্রামের বৈষম্যের বিষয়টির প্রতিও মনোযোগ দিতে হবে। পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষার ফল মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে গ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠান ভালো করছে। কিন্তু অষ্টম শ্রেণীতে বৈষম্য বেশি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে আরও বেশি। এসব পরীক্ষার ফলে কদাচিৎ গ্রামের স্কুল-কলেজের নাম দেখা যায়। প্রাথমিকে গ্রামের স্কুলগুলোর শিক্ষকরা সিলেবাস অনুযায়ী ঠিকঠাক পড়াতে সমস্যায় পড়েন না। কিন্তু যতই ওপরের ক্লাস, ততই যোগ্য শিক্ষকের চাহিদা বাড়তে থাকে। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বাড়ি কিংবা কোচিং সেন্টারে যেতে বাধ্য হয়। কারণ ক্লাসে যা পড়ানো হয় তাতে চাহিদার সবটা পূরণ হয় না। তাই যারা কোচিং সেন্টারের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না তারা পিছিয়ে পড়ে। নিরাপত্তাজনিত কারণেই মেয়েরা পড়ে বাড়তি সমস্যায়। কোচিং সেন্টারের রমরমা ব্যবসা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নেতিবাচক দিক। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত স্কুলে স্কুলে ভালো পড়াশোনার ব্যবস্থা করা না যাবে, ততদিন এ থেকে নিষ্কৃতি মেলা কঠিন হবে। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন যে, যারা অর্থ ব্যয় করতে পারবে তারা ভালো শিখবে এবং পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। এ প্রবণতা কেবল যে বাংলাদেশে তা নয়, গোটা বিশ্বেই কমবেশি দেখা যায়। তবে সরকার যদি সঠিক নীতি ও কৌশল অনুসরণ করে চলে তাহলে সমস্যার ক্রমে সমাধান মেলে। স্থানীয় সরকারের হাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দিয়েও সুফল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এখন পর্যন্ত শিক্ষার বিপুল কর্মকাণ্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করা হচ্ছে না। এটা করা গেলে মনিটরিং বাড়বে, নিজেদের প্রতিষ্ঠানটিকে সেরা করার জন্য তারা মনোযোগ দেবেন।
নানা ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলাও বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সঠিকভাবে তথ্য দিতে পারি। কিন্তু কিন্ডারগার্টেন সম্পর্কে তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নেই। এর দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নয়, বরং 'ইংরেজি মাধ্যম' হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোরই। সরকারকে তথ্য দিতে তাদের অনেকেরই অনাগ্রহ। কওমি মাদ্রাসাগুলোও রয়ে যাচ্ছে হিসাবের বাইরে। কে কোন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা বেছে নেবে সে বিষয়ে স্বাধীনতা সবার থাকা উচিত। কিন্তু কী ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়, শিক্ষার্থীরা কী পাঠ্যসূচি অনুসরণ করছে এবং কারাই-বা পড়াচ্ছেন সে বিষয়ে সরকারের কাছে সব তথ্য থাকা বাঞ্ছনীয়। জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রতি সব শিক্ষার্থীর আনুগত্যও অপরিহার্য বিষয় হতে হবে।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা অবশ্যই সফল হবো, সে বিষয়ে আমি আশাবাদী। শিক্ষা প্রসারের সুফল আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ ইতিমধ্যে ভোগ করতে শুরু করেছে। শিক্ষার আলোকে আলোকিত হওয়ার কারণেই দলে দলে মেয়েরা পোশাকশিল্পে শ্রমদানে এগিয়ে আসে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পেয়ে যায় কিছুটা দক্ষ শ্রমিক। ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে ১৩ হাজারের মতো নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের অনেকেই স্কুলে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন এবং এর প্রভাব দেখা গেছে তাদের কর্মকাণ্ডে। নারীর নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের জন্য এর গুরুত্ব অস্বীকারের উপায় নেই। ক্ষুদ্রঋণ থেকেও শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত নারীরা বাড়তি সুফল এনে দিচ্ছে। মাঠ পর্যায় থেকে আমরা এ তথ্য পাচ্ছি যে, পরিবেশ ও জলবায়ু বিপর্যয় যথাযথভাবে মোকাবেলার জন্য ঘরে ঘরে শিক্ষিত নারী চাই-ই।
এটা ঠিক যে, দারিদ্র্য বিমোচন যেমন রাতারাতি হয় না, তেমনি শিক্ষার মান বাড়ানোর চ্যালেঞ্জেও রাতারাতি জয়লাভ সম্ভব নয়। শিক্ষার প্রতি আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রশংসনীয়। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে তাদের আরও মনোযোগী হতেই হবে। এটা করা সম্ভব হলে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করার জন্য বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো যাবে, শিক্ষার্থীরা পাবে পড়াশোনার জন্য আরও ভালো পরিবেশ ও উপকরণ। আমরা নতুন দিন চাইছি এবং শিক্ষার প্রসার ও মান অব্যাহতভাবে বাড়িয়ে চলা তা নিশ্চিত করার অপরিহার্য শর্ত।
রাশেদা কে চৌধুরী : গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
শিক্ষায় যে এগিয়ে চলেছি তার পেছনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, বিনিয়োগ এবং শিক্ষার প্রতি সব শ্রেণী-পেশার নারী ও পুরুষের আগ্রহ কাজ করছে। কোন পরিবেশে আমাদের বেশিরভাগ শিশু পড়াশোনা করছে সেটা মনে রাখতে হবে। অনেক স্কুল ভবন জরাজীর্ণ, কোথাও-বা সামান্য বৃষ্টিতেই পানি পড়ে। কেউবা বলবেন, তাদের স্কুল ভবনই তো নেই, পানি পড়ারও প্রশ্ন নেই। ক্লাস বসে খোলা আকাশের নিচে কিংবা গাছের ছায়ায়। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে। শিক্ষা খাতে সরকারের বরাদ্দ বছর বছর বাড়ছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি হারে যেন বেড়ে চলেছে শিক্ষার্থী সংখ্যা। সঙ্গত কারণেই মাথাপিছু ব্যয় কমছে। সরকার বিনামূল্যে বই দিচ্ছে, কিন্তু বস্তিবাসীদের পড়ার ঘর কোথায়?
পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষার ফল কেন বড় অর্জন সে প্রশ্নে আসছি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর 'অদম্য মেধাবীদের' নিয়ে প্রতিবেদন দেখে আমরা অভ্যস্ত। এখন এ দুটি পরীক্ষায় সেরা ফল করছে যেসব ছাত্রছাত্রী তাদের নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। রিকশাচালক, পোশাকশিল্পের কর্মী, দিনমজুর এবং বাড়িতে বাড়িতে কাজ করা গৃহকর্মীর সন্তানরা স্কুলে যায়, জিপিএ ৫ পায়। সমাজে মাথা উঁচু করে চলে। শিক্ষার প্রতি আগ্রহই শুধু বাড়ছে না, ভালো করার জন্যও তারা সচেষ্ট। আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার বিবেচনায় এ এক নতুন বাংলাদেশ বৈকি। পড়াশোনা করে কী লাভ, সে কথা কেউ আর বলছে না। বরং হতদরিদ্র পরিবারের মা-বাবাও বলবেন, সন্তানকে পড়াতে চাই। বেসরকারি সংগঠন-এনজিও, সিভিল সোসাইটি এবং সর্বোপরি সরকার_ সবার ভূমিকা রয়েছে এর পেছনে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষার আয়োজন তারই ধারাবাহিকতা। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষার আবার গুরুত্ব কী। কিন্তু মাঠে যারা কাজ করি তারা বুঝতে পারি এর গুরুত্ব। বহু বছর ধরে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে সরকারি বৃত্তি পরীক্ষা চালু রয়েছে। দেখা গেছে, শিক্ষকরা হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী বাছাই করে তাদের জন্য বিশেষ কোচিংয়ের আয়োজন করতেন। বাড়িতেও চলত কোচিং। এখন সবাই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে এবং তাদের মধ্য থেকে যারা ভালো করছে তাদের বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। ফলে ভালো করার প্রতি সাধারণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। মেয়েদের অংশগ্রহণও বাড়ছে।
শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের পেছনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, সেটা শুরুতেই বলেছি। বাংলাদেশে সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক পরিকল্পনা ও প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায় কিংবা সাইডলাইনে ফেলে রাখা হয়। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় যে, নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। তারা ছেলেদের মতোই বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। অঙ্গীকার রয়েছে স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ানোর। বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী উপবৃত্তি পাচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেক বিষয়ে গুরুতর মতপার্থক্য দেখছি। কিন্তু একটি বিষয়ে সবাই একমত_ নারী শিক্ষার প্রসার। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের যাত্রার শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই এ ইতিবাচক প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি। এর সুফলও মিলতে শুরু করেছে। মা ও শিশুদের মৃত্যুর হার অনেক কমে এসেছে এবং উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমাদের অর্জন বিশেষ উল্লেখযোগ্য হিসেবে স্বীকৃত। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশ সফল। এখন ঘরে ঘরে উপলব্ধি এসেছে_ নারী শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ যথার্থই লাভজনক।
পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হচ্ছে তাদের একটি অংশ এসএসসি পর্যন্ত পড়ছে না, এ চিত্র উদ্বেগের। ছেলে ও মেয়ে সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। এক পর্যায়ে মেয়েরা আরও পিছিয়ে পড়তে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রীর সংখ্যা মোটামুটি সমান থাকে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত চলে এ প্রবণতা। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে মেয়েরা পিছিয়ে পড়ে। উচ্চতর পর্যায়ে পিছিয়ে পড়ার হার আরও বেশি। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন দেখি এ চিত্রে। অভিভাবকরা তখন মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়। ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আইন আমাদের সবার চোখের সামনেই উপেক্ষিত হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্র তা অসহায়ভাবে অবলোকন করে।
এ চিত্র যথেষ্ট হতাশার। তবে আশার দিকটিকে খাটো করে দেখার দলে আমি নেই। সিলেট মেডিকেল কলেজে ১৯৬ জন শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০৫ জন ছাত্রী। কী ব্যাখ্যা দেবেন এর? চিকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে পড়ার জন্য ভর্তিচ্ছুদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কমবেশি একই চিত্র। এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীরা যোগ্যতার বলেই স্থান করে নিচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এ এক নীরব বিপ্লব। শিক্ষার ব্যয় বাড়ছে। মেয়েদের এক একটি স্তর পার হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। 'ও তো মেয়ে'_ এ কথা শুনতে হয় পদে পদে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে এবং এ কারণে অভিভাবকরা সেখানে মেয়েদের পাঠাতে উৎসাহী থাকে। স্কুল পর্যায়েও এ সমতা বিধান জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাথমিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও এটা অনুসরণ করা আবশ্যক। কারিগরি ও বৃত্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোর কথাও সরকারসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী সংখ্যা নগণ্য। শিক্ষকদের মধ্যেও নারী কার্যত অনুপস্থিত।
শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও কিন্তু রয়ে গেছে। প্রাথমিকে প্রায় শতকরা ১০০ ভাগ নাম লেখাচ্ছে; কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ আসতে পারে না। এর একটি কারণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। এ বাধা অতিক্রম করতেই হবে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ শিক্ষার মান বাড়ানো। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি পর্যায়েই তা করতে হবে। আমাদের নবীন প্রজন্ম সৃজনশীল নয়, এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না। দেশের বাইরে যারা পড়তে যায় তাদের অনেকে দারুণ ফল করছে। দেশেও এটা হচ্ছে। শহর ও গ্রামের বৈষম্যের বিষয়টির প্রতিও মনোযোগ দিতে হবে। পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষার ফল মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে গ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠান ভালো করছে। কিন্তু অষ্টম শ্রেণীতে বৈষম্য বেশি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে আরও বেশি। এসব পরীক্ষার ফলে কদাচিৎ গ্রামের স্কুল-কলেজের নাম দেখা যায়। প্রাথমিকে গ্রামের স্কুলগুলোর শিক্ষকরা সিলেবাস অনুযায়ী ঠিকঠাক পড়াতে সমস্যায় পড়েন না। কিন্তু যতই ওপরের ক্লাস, ততই যোগ্য শিক্ষকের চাহিদা বাড়তে থাকে। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বাড়ি কিংবা কোচিং সেন্টারে যেতে বাধ্য হয়। কারণ ক্লাসে যা পড়ানো হয় তাতে চাহিদার সবটা পূরণ হয় না। তাই যারা কোচিং সেন্টারের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না তারা পিছিয়ে পড়ে। নিরাপত্তাজনিত কারণেই মেয়েরা পড়ে বাড়তি সমস্যায়। কোচিং সেন্টারের রমরমা ব্যবসা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নেতিবাচক দিক। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত স্কুলে স্কুলে ভালো পড়াশোনার ব্যবস্থা করা না যাবে, ততদিন এ থেকে নিষ্কৃতি মেলা কঠিন হবে। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন যে, যারা অর্থ ব্যয় করতে পারবে তারা ভালো শিখবে এবং পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। এ প্রবণতা কেবল যে বাংলাদেশে তা নয়, গোটা বিশ্বেই কমবেশি দেখা যায়। তবে সরকার যদি সঠিক নীতি ও কৌশল অনুসরণ করে চলে তাহলে সমস্যার ক্রমে সমাধান মেলে। স্থানীয় সরকারের হাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দিয়েও সুফল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এখন পর্যন্ত শিক্ষার বিপুল কর্মকাণ্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করা হচ্ছে না। এটা করা গেলে মনিটরিং বাড়বে, নিজেদের প্রতিষ্ঠানটিকে সেরা করার জন্য তারা মনোযোগ দেবেন।
নানা ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলাও বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সঠিকভাবে তথ্য দিতে পারি। কিন্তু কিন্ডারগার্টেন সম্পর্কে তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নেই। এর দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নয়, বরং 'ইংরেজি মাধ্যম' হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোরই। সরকারকে তথ্য দিতে তাদের অনেকেরই অনাগ্রহ। কওমি মাদ্রাসাগুলোও রয়ে যাচ্ছে হিসাবের বাইরে। কে কোন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা বেছে নেবে সে বিষয়ে স্বাধীনতা সবার থাকা উচিত। কিন্তু কী ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়, শিক্ষার্থীরা কী পাঠ্যসূচি অনুসরণ করছে এবং কারাই-বা পড়াচ্ছেন সে বিষয়ে সরকারের কাছে সব তথ্য থাকা বাঞ্ছনীয়। জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রতি সব শিক্ষার্থীর আনুগত্যও অপরিহার্য বিষয় হতে হবে।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা অবশ্যই সফল হবো, সে বিষয়ে আমি আশাবাদী। শিক্ষা প্রসারের সুফল আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ ইতিমধ্যে ভোগ করতে শুরু করেছে। শিক্ষার আলোকে আলোকিত হওয়ার কারণেই দলে দলে মেয়েরা পোশাকশিল্পে শ্রমদানে এগিয়ে আসে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পেয়ে যায় কিছুটা দক্ষ শ্রমিক। ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে ১৩ হাজারের মতো নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের অনেকেই স্কুলে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন এবং এর প্রভাব দেখা গেছে তাদের কর্মকাণ্ডে। নারীর নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের জন্য এর গুরুত্ব অস্বীকারের উপায় নেই। ক্ষুদ্রঋণ থেকেও শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত নারীরা বাড়তি সুফল এনে দিচ্ছে। মাঠ পর্যায় থেকে আমরা এ তথ্য পাচ্ছি যে, পরিবেশ ও জলবায়ু বিপর্যয় যথাযথভাবে মোকাবেলার জন্য ঘরে ঘরে শিক্ষিত নারী চাই-ই।
এটা ঠিক যে, দারিদ্র্য বিমোচন যেমন রাতারাতি হয় না, তেমনি শিক্ষার মান বাড়ানোর চ্যালেঞ্জেও রাতারাতি জয়লাভ সম্ভব নয়। শিক্ষার প্রতি আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রশংসনীয়। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে তাদের আরও মনোযোগী হতেই হবে। এটা করা সম্ভব হলে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করার জন্য বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো যাবে, শিক্ষার্থীরা পাবে পড়াশোনার জন্য আরও ভালো পরিবেশ ও উপকরণ। আমরা নতুন দিন চাইছি এবং শিক্ষার প্রসার ও মান অব্যাহতভাবে বাড়িয়ে চলা তা নিশ্চিত করার অপরিহার্য শর্ত।
রাশেদা কে চৌধুরী : গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments