বিদায় ২০১২ ॥ পেছনে তাকানো এবং সামনের স্বপ্ন by নিয়ামত হোসেন
রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতায় পৃথিবীর উদ্দেশে বলেছেন: ‘জীবপালিনী, আমাদের পুষেছ তোমার খ-কালের ছোটো ছোটো পিঞ্জরে।’ সেই খ-কালের আরও খণ্ডিত, অতি ছোট অংশ একেকটি বছর। এই একেকটি বছরকে ঘিরে দেশে দেশে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং ব্যক্তিজীবনে মানুষের অনেক হিসাবনিকাশ।
অনেক পরিকল্পনা। অনেক প্রত্যাশা। অনেক আনন্দ-বেদনা, আশা-ভরসা নিয়ে আসে একেকটি বছর। আমরা পুরনো বছরকে বিদায় করে নতুন আশা নিয়ে স্বাগত জানাই নতুন বছরকে। নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর রীতি বহু জাতিরই রয়েছে। ইংরেজী নতুন বছরকে আমাদের দেশেও স্বাগত জানানো হয়। ইংরেজী বছর আমাদের নিজেদের নয়। তার পরও অনেকদিন থেকে ঐ বছরটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণে ঐ বছরকেও বিদায় এবং বরণের রীতি আমাদের রয়েছে।নতুন বছরের সূচনায় আগামীর সম্ভাবনার কথা ভাবি। আমরা প্রত্যাশা করি আমাদের দেশের কল্যাণ। মানুষের কল্যাণ। দেশের উন্নয়নের জন্য যেমন প্রয়োজন অর্থনীতিকে জোরদার করা, তেমনি প্রয়োজন সাংস্কৃতিক চর্চাকেও ব্যাপকতর করা। জগতে বার বার অসংস্কৃত ধনবানের আস্ফালন দেখা গেছে। এখনও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বৈষয়িক সম্পদের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পদ যুক্ত হলে এই দুইয়ের সম্মিলনে মানবীয় ক্ষমতাই জোরদার হয়। যত সম্পদই থাক, সংস্কৃতিহীনতা জন্ম দেয় দানবীয়তার। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের গরবের ধন। এই সংস্কৃতি আমাদের ঐক্য এনে দিয়েছে। নতুন বছরে আমাদের প্রতিজ্ঞা হবে পূর্বসূরিরা সহস্র প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে আমাদের জন্য অবাধ সংস্কৃতি চর্চার যে সুযোগ সৃষ্টি করে গেছেন, সে সংস্কৃতিকে আমরা রক্ষা করব, সমৃদ্ধ করব, তার চর্চা ব্যাপক করব। এটাই আমাদের মর্যাদা গ্যারান্টি। সত্যিকার সামগ্রিক উন্নয়নের গ্যারান্টি। সব ধরনের অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ রোধ করারও গ্যারান্টি।
নববর্ষে আমরা যেমন নিজেদের কল্যাণে কাজ করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করি তেমনি কল্যাণ কামনা করি জগতের মানুষের। কারণ আমরা বিশ্বমানবতারই অংশ। জগতকে বাদ দিয়ে একা একা চলা যায় না। জগতের কল্যাণ-অকল্যাণের প্রভাব কিছু না কিছু পড়ে সব দেশের আবহ-পরিম-লে। আজকে এই দিনে পিছনের দিকে তাকিয়ে হতাশার চিত্র দেখতে পাই; যা আমাদের ব্যথিত করে, উদ্বিগ্ন করে। আমরা দেখতে পাই ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধ’।
২০১২ সালটি পৌঁছে গেছে সর্বশেষ প্রান্তে। কেমন ছিল সালটি? এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ তথ্যউপাত্ত, হিসাবনিকাশ পাওয়া যাবে না। হাতের কাছে। সেভাবে হিসাবনিকাশ করা হয় না। কিন্তু সাধারণ সাদামাটা হিসাবে দেখা যাবে, হাজারো সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া এ সমাজে আর পাঁচটা বছরের হিসাবে এ বছরটিও কোন ব্যক্তিক্রম নয়। হাজারো সমস্যার আবর্তে সমাজের এসব সমস্যায় জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন। সমস্যার চাপে যুগ-যুগের হতাশা, অগণিত মানুষের জীবনের মুহূর্তগুলো নিরানন্দ। যুগ যুগ ধরে এটাই হয়ে আসছে। উন্নত শিক্ষিত দেশগুলোর মানুষও তাদের নিজেদের ‘নিউ ইয়ারে’র উৎসব পালন করে আনন্দের সঙ্গে, আগামীর স্বপ্নও দেখে তারা। তাদের সে আশা কমবেশি পূরণও হয়। তাদের সমস্যার সঙ্গে আমাদের শতাব্দীপ্রাচীন সমস্যার অধিকাংশেরই মিল নেই। আমাদের মতো প্রকট অশিক্ষা তথা শিক্ষাহীনতা, কর্মহীনতা, দারিদ্র্য, রোগব্যাধি জর্জরিত সমাজ তাদের নয়। সন্ত্রাস আমাদের সমাজের একটি সমস্যা, সন্ত্রাসের রূপও এখানে নানারকম। এসবের মধ্যে যাদের বাস তারা কেমন থাকবে? সমাজের তথা মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সমস্যাগুলোর সমাধান ছাড়া সমাজেরও উন্নতি নেই।
আমাদের সমাজের আরেকটি অশুভ দিক দিন দিন সামাজিক মূল্যবোধগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়া। আদর্শহীনতার মধ্যে বড় হতে হচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে। কোন সমস্যাই আলাদাভাবে গজিয়েওঠা সমস্যা নয়, সবগুলোর শিকড় একই জায়গায়, আদি শিকড় তথা সমস্যাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। তরুণরা যদি দেখে, তাদের অগ্রজরাই উন্নত চিরন্তন আদর্শ ও মূল্যবোধগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে, তারা যদি দেখে সমাজে একশ্রেণীর মানুষ অবৈধ উপায়ে রাতারাতি বিপুল সম্পদের মালিক হচ্ছে, তারা সৎপথের ধার ধানে না, যদি দেখে কেউ অন্যায় করে, অপরাধ করে, দুর্নীতি করে এবং সমাজে তাদেরই দাপট যদি তরুণরা দেখে, তাহলে তারা তো ঐসব দুর্নীতিগ্রস্ত, অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনকারীদের পথের দিকেই আকৃষ্ট হবে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার অন্যায় অথচ সহজতম পথটিই খুঁজবে তারা। তখন ঐ দুর্নীতিগ্রস্তদের মতো তাদের অনেকের মনে নৈতিকতা, মানবতা, আদর্শবাদিতা কিংবা যুগ যুগের মূল্যবোধগুলোকে খেলো এবং অসারই মনে হবে।
আদর্শ, নৈতিকতা বা মূল্যবোধগুলোকে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার একমাত্র পথ হচ্ছে ঐসব মূল্যবোধ বা নৈতিকতাকে মূল্যহীন করে তোলার ধারাটাকে ঠেকানো। কঠোর হস্তে সন্ত্রাস বন্ধ করা, দুর্নীতি রোধ করা, সত্যিকার শিক্ষার ব্যাপকতম প্রসারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা। দেশে অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্য যে অর্জিত হয়েছে এবং আরও অনেক সাফল্য অর্জিত হতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট। কৃষিতে এসেছে বড় ধরনের সাফল্য। সাফল্য এসেছে শিক্ষায় বহু ছেলেমেয়ে এখন শিক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করছে। সম্প্রতি ছোটদের পরীক্ষায় যে ফল বেরিয়েছে তাকে ছোটদের বড় ধরনের সাফল্য বলা যায়; এ সাফল্য শিক্ষাক্ষেত্র অগ্রগতিরই প্রমাণ দেয়। ছোটদের হাতে স্কুলে স্কুলে নতুন বই তুলে দেয়া হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। এবারও সেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামীকাল নতুন বছর নতুন বছরের প্রথম দিনে ছেলেমেয়েরা হাতে পাবে নতুন বই এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এমনি নানাক্ষেত্রে সাফল্য দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে অনেকক্ষেত্রে সাফল্যের সম্ভবনা। নতুন বছরে এই সম্ভাবনাগুলো আরও স্পষ্ট হবে, বাস্তবায়িত হবে এটাই সবার প্রত্যাশা।
আজ ২০১২ সালের শেষদিন। আজ পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে এই বছরটির সাফল্য-অসাফল্য। এ বছর অনেক কিছু অনেকে পেয়েছেন। অনেকে অনেক কিছু হারিয়েছেন। এটা ব্যক্তিগত পর্যায়েও সত্য। আমরা বিগত বছর জাতীয় পর্যায়ে হারিয়েছি অনেক বিশিষ্ট্য ব্যক্তিকে। সবার কথা মানুষ মনে রাখবে।
সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ বছর আমরা যাদের হারিয়েছি তাঁদের মধ্যে রয়েছে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে। অগণিত ভক্ত তার। তাঁকে মনে রাখবে দেশবাসী। সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে গেলেন সঙ্গীতগুরু সোহরাব হোসেন। তাঁর সুরেলা কণ্ঠ, শুদ্ধ উচ্চারণ ও শুদ্ধভাবে নজরুলের গান গাওয়ার স্মৃতি কেউ ভুলতে পারবে না। এ বছরই আমরা হারিয়েছি সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ লেখক খান সরওয়ার মুরশিদকে। হারিয়েছি নাটক ও চলচ্চিত্র জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হুমায়ূন ফরীদিকে। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সফল উদ্যমী ব্যক্তিত্ব স্যামসন এইচ চৌধুরীকেও।
এ বছরই হারিয়েছি এদেশের বন্ধু সেতারশিল্পী রবি শংকরকে। ১৯৭১-এ তিনি বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে কনসার্ট করেছিলেন।
বিদায় ইংরেজী ২০১২ সাল। আজকের এই দিনকে বিদায় করার সঙ্গে সঙ্গে বিদায় জানাবো ২০১২ সালটিকেও। আগামীকাল শুরু হচ্ছে নতুন দিন। ২০১৩ সালের প্রথমদিন। নতুন ভবিষ্যতের দিকে তাকাব আমরা।
কবি নজরুলের ভাষায়:
‘আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি
পচা অতীত
গিরিগুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে
গাহিব গীত,
সৃজিব নতুন ভবিষ্যৎ’।
সেই নতুন ভবিষ্যতের আশায় আমরা।
No comments