ধর্ষণ ও পুরুষশাসিত সমাজ সুহাসিনী আলী অনুবাদ : by এনামুল হক
দিল্লীর চলন্ত বাসে গণধর্ষণের ঘটনাটি মেয়েদের নিরাপত্তার মতো ইস্যুতে গোটা দেশকে জাগ্রত করে তুলেছে। মনে হয়েছিল এবং আশা করা গিয়েছিল এক্ষেত্রে এ জাতীয় কিছু হবে না। কিন্তু নিতান্তই দুর্ভাগ্যের কথা, ঠিক সেটাই হয়েছে।
মানুষের রুদ্ররোষের সেই সার্বিক বহির্প্রকাশের সময় তাদের, ক্ষোভ, দুঃখ, বেদনা, যন্ত্রণার বিস্ফোরণের মুহূর্তটিতে সেই বিধ্বংসী অথচ পরিচিত মন্তব্যটাই করা হলো। দিল্লীর বাসে তরুণী ধর্ষণের প্রতিবাদে বিক্ষোভরত নারী-পুরুষের অসংখ্য দলের কোন একটির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা জনৈক পুলিশকে বলতে শোনা গেল, ‘মেয়েটি নিশ্চয়ই তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে এমনকিছু করছিল যা দেখে ওই তরুণরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।’
যৌন সহিংসতা ও হামলার মতো অপরাধের দায়দায়িত্ব হামলাকারী পুরুষের কাঁধ থেকে সরিয়ে হামলার যিনি শিকার সেই নারীর কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপারটাকে মেয়েদের বিরুদ্ধে বিরামহীন ও ক্রমবর্ধমান সহিংসতার দুষ্টচক্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
পুরুষ শাসিত সমাজের এই নিন্দনীয় দিকটি সেই সামাজিক সাপেক্ষতা ও পরিস্থিতি তৈরি করতে ও সেটাকে পাকাপোক্ত করতে সাহায্য করে যার জন্য গর্ভধারণের সময় থেকে শুরু করে প্রায়শ অস্বাভাবিক ও নৃশংস মৃত্যুবরণের আগ পর্যন্ত নারীদের নানান বিভীষিকার সম্মুখীন হতে হয়। এই সামাজিক সাপেক্ষতা সকল পর্যায়ের চেতনার জগতে পরিব্যাপ্ত। মন্ত্রী, রাজনীতিক, প্রশাসক, পুলিশ এবং বিচার বিভাগের সদস্যবর্গ সবাই কমবেশি এমন সাপেক্ষতার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এই সামাজিক সাপেক্ষতার পেছনে অনেক সময় যুগ-পুরাতন অথচ দৃঢ়ভাবে গ্রথিত সনাতন ধ্যানধারণা, সামন্ততান্ত্রিক ও সেকেলে দৃষ্টিভঙ্গী কারণ হিসেবে কাজ করে। দুর্ভাগ্যবশত আজ যেটা সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী বিচারকের ভূমিকায় আবির্ভূত সেই বাজার তার মুনাফা অনির্বাণ তৃষ্ণা চরিতার্থ করার জন্য মহিলা ও তরুণীদেরকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ও অজস্র উপায়ে অবমূল্যায়িত করে পণ্যসামগ্রীতে পরিণত করে। প্রতারণার আশ্রয়ে আপন শক্তি বৃদ্ধি করে এবং অতি পশ্চাৎমুখী পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবগুলোকে নতুন মোড়কে আবৃত করে এই বাজার তার লোলুপ ও হিংস্র পরিবৃত্তি সুনিশ্চিত করার প্রয়োজনে মহিলাদের অধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ করে ফেলে।
সম্প্রতি তেহেলকা ম্যাগাজিনে বেশ কিছু সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। ম্যাগাজিনের সংবাদদাতারা জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের কতিপয় এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের এই সাক্ষাৎকার নেন। দুই সম্মানজনক ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া তাদের প্রত্যেকেই বলেছেন যে, ধর্ষণের এজাহার দায়েরকারী বেশিরভাগ মহিলা ও মেয়ে হয় দুশ্চরিত্রা নয়ত উচ্ছৃঙ্খল কিংবা ব্ল্যাকমেইলার বা বেশ্যা। এই জাতীয় রাজধানী অঞ্চল আজ ধর্ষণের জাতীয় রাজধানী অঞ্চল হওয়ার কুখ্যাতি অর্জন করেছে।
শুধু এ বছরেই (২০১২) এ অঞ্চলে ৬ শতাধিক ধর্ষণের মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। বাসে গণধর্ষণের যে ঘটনার ভয়াবহতায় জাতির সিংহভাগ জনগোষ্ঠী মানবিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে তার পরে মাত্র চারদিনের মধ্যে দুটি গ্যাংরেপ মেট্রো স্টেশনে জনৈক মহিলার ওপর অল্পবয়সী ছেলেদের শারীরিক হামলা এবং মাদকাসক্ত পিতার হাতে নিজের ছয় বছরের কন্যা ধর্ষিত হবার খবর পাওয়া গেছে।
এই এলাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে নাবালিকারা, দিনমজুর গরিব মহিলারা এবং গৃহপরিচারিকারা। এসব ঘটনার কোনটাই সেইসব ব্যক্তির ওপর সামান্যতম প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয় না। যাদের দায়িত্ব হচ্ছে মহিলা ও শিশুদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা এবং হিংসাত্মক হামলা রোধ করতে ব্যর্থ হলে যাদের ওপর বাড়তি দায়িত্ব এসে পড়ে অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসা। তারা অবশ্য পক্ষপাতদুষ্ট এই ধারণা আঁকড়ে ধরে চলে যে, মহিলারা যে ধরনের সহিংসতার শিকার হয় তার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী।
এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে আশু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচারব্যবস্থার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে চাইলে শুরুতেই এ ক্ষেত্রে আরও কঠোরভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। নতুন আইন প্রণয়ন করার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। যৌন হামলা সম্পর্কিত বিল প্রণয়ন করা এখনও বাকি আছে। কর্মস্থলে যৌন সহিংসতাবিরোধী বিলটি মোটেও সন্তোষজনক নয়। রাজ্য সভায় পাস হওয়ার আগে সেটি অবশ্যই সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। ধর্ষণ সম্পর্কিত প্রচলিত আইন সংশোধন করা দরকার, যাতে পরে সেগুলো ধর্ষিতের প্রয়োজনসমূহের প্রতি অধিক সংবেদনশীল হয় এবং অপরাধীর সাজা সুনিশ্চিত করা যায়। একই সঙ্গে এ মুহূর্তে করার মতো অনেক কিছু আছে এবং করা প্রয়োজনও। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগকে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার হিসেবে গণ্য করতে হবে। যারা ক্ষমতা ও দায়িত্বের উচ্চ পদে আছেন তাদের সবাইকে এর নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। ঘরবাড়ি ও প্রকাশ্য স্থানগুলো মেয়েদের জন্য নিরাপদ রাখতে সম্ভাব্য যা যা করা যেতে পারে তা সুনিশ্চিত করতে হবে এবং তার জন্য আইন পক্ষপাতহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
পুলিশী নিরাপত্তার মানোন্নয়নের মধ্য দিয়ে এ কাজের সূচনা করতে হবে। দিল্লীতে পুলিশ ও জনসংখ্যার অনুপাত হচ্ছে প্রতি এক লাখ লোকের জন্য ৫শ’ পুলিশ। প্রতিবেশী ইউপিতে এই অনুপাত ১ লাখে মাত্র ১৭০ জন। বলাবাহুল্য এই ইউপির বেশ কিছু জেলা জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের অন্তর্গত। দিল্লীতে পুলিশের সংখ্যা বাহ্যত সন্তোষজনক মনে হলেও এটাও সত্য যে, এদের মধ্যে কেরানিসহ পুলিশবাহিনীর সচল লোক অন্তর্গত এবং তাদের প্রত্যেকের ডিউটি হচ্ছে মাত্র ৮ ঘণ্টা। এদের মধ্যে ১০ শতাংশেরও বেশি ভিআইপি ডিউটিতে নিয়োজিত এবং এসব ভিআইপির প্রতি হুমকির আশঙ্কা বেড়ে গেলে এমন ডিউটিতে পুলিশের সংখ্যাও বাড়িয়ে দেয়া হয়। প্রকাশ্য স্থানগুলো মেয়েদের জন্য নিরাপদ রাখার কাজটিকে কম অগ্রাধিকার দেয়ার ফলে এসব সমস্যা আরও জটিল রূপ ধারণ করে। সে জন্যই বাসে গণধর্ষণের ঘটনার দু’দিন পর জনৈক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাতে বাসে চেপে যাওয়ার সময় রাস্তায় কোন পুলিশ দেখতে পাননি।
পুলিশ বাহিনীর এসব সমস্যার মোকাবেলা করা এবং মেয়েদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার কাজটিকে অগ্রাধিকার দেয়া হলে এফআইএ’র আশু নিবন্ধন, দ্রুত গ্রেফতার ও চার্জশীট দাখিল সুনিশ্চিত করা যাবে। এরপর অবশ্যই দৈনিক ভিত্তিতে আদালতে মামলার শুনানি হতে হবে যাতে অনধিক ছয় মাসের মধ্যে অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করে কঠোর সাজা দেয়া যায়। আমাদের দেশে ধর্ষণ মামলার বিচার যে প্রক্রিয়ায় চলে তাতে ধর্ষিতকে যে ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হয় তার চেয়ে ভয়াবহ শাস্তি আর হতে পারে না। বছরের পর বছর ধর্ষিতকে এই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা সর্বক্ষণ যেভাবে স্মরণ করতে হয় এবং অনেক সময় দায়ী ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে যেভাবে স্মরণ করতে হয় সেটা বিচার বিলম্বিত হওয়া এবং বিচার না হওয়া উভয়েরই অসহনীয় চড়া মাসুল।
বাসে গণধর্ষণের শিকার তরুণীটি এক সাহসী মেয়ে। সে তার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে লড়েছে। শেষ পর্যন্ত সে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হেরে গেছে। এক টুকরো কাগজে সে কয়েকটি শব্দ লিখে জানতে চেয়েছিল : ‘ওরা কি ধরা পড়েছে ?’
[লেখক : অল ইন্ডিয়া ডেমোক্র্যাটিক উইমেনস এ্যাসোসিয়েশনের সভানেত্রী]
সূত্র : দ্য হিন্দু
No comments