সিডিএর সাড়ে ১৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প- ১২ প্রকল্পে ৭ পরিচালক সবাই দুদকের আসামি by একরামুল হক
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অধিকাংশ বড় উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালকেরা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার আসামি। অভিযোগপত্রভুক্ত সাতজন প্রকৌশলী প্রায় সাড়ে ১৩০০ কোটি টাকার ১২টি উন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্বে আছেন।
সিডিএ ও আদালত সূত্র জানায়, প্রকল্প পরিচালক এসব প্রকৌশলী একটি থেকে সর্বোচ্চ ১২টি পর্যন্ত মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে তাঁদের বিচার চলছে। এসব মামলায় এ প্রকৌশলীদের সঙ্গে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক আসামি আছেন, তাঁদের অন্তত পাঁচজন আবার এই ১২ প্রকল্পের পাঁচটির ঠিকাদার।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের কৌঁসুলি (পিপি) মাহমুদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সিডিএর দুর্নীতিসংক্রান্ত ২২টি মামলা আদালতে বিচারাধীন। এসব মামলায় ১৫ প্রকৌশলীকে আসামি করেছে দুদক। তাঁদের সঙ্গে একাধিক ঠিকাদারও আসামি। সব কটি মামলার শুনানিতে আসামিরা আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন।
মাহমুদুল হক আরও জানান, চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত সড়কের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নকাজ ২২টি ভাগে (লট) বাস্তবায়ন করা হয়। সড়কের সব কটি ভাগের কাজ ছিল নিম্নমানের। দুদক কর্মকর্তারা ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ২০১০ সালেই এ-সংক্রান্ত ২২টি মামলা করেন। চলতি বছরের বিভিন্ন সময় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এরপর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচারকাজ শুরু করেন।
সিডিএ সূত্র জানায়, বর্তমানে সংস্থাটি দুই হাজার ৫৫৮ কোটি টাকার ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে ১২টি প্রকল্প সাত প্রকৌশলীর হাতে। দুদকের মামলার আসামি এই সাত প্রকৌশলী হলেন: এ এ এম হাবিবুর রহমান, মো. মাহফুজুর রহমান, মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীন খালেদ, মো. নূরুল আমিন ভূঁইয়া, রাজীব দাশ, আহম্মদ মঈনুদ্দীন ও মোহাম্মদ হাসান।
তাঁদের মধ্যে হাবিবুর রহমান ছিলেন বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক প্রকল্পের পরিচালক। গত ২৪ নভেম্বর এই উড়ালসড়কের গার্ডার ধসে ১২ জন নিহত হলে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গত জুনেও একবার এই উড়ালসড়কের গার্ডার ধসে একাধিক ব্যক্তি আহত হন। তখন কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বর্তমানে সিডিএতে দুজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নয়জন নির্বাহী প্রকৌশলী (দুই অথরাইজেশন কর্মকর্তাসহ) ও ১৫ জন সহকারী প্রকৌশলীসহ ২৬ জন প্রকৌশলী রয়েছেন, যাঁরা প্রকল্প পরিচালক হওয়ার যোগ্য। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) কামালউদ্দিন আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কর্মচারী বিধিমালা (শৃঙ্খলা ও আপিল) অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় আসামি হলে তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) থাকবেন। সিডিএর কোনো প্রকৌশলী দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হলে তা ফৌজদারি অপরাধের শামিল। তাই তাঁদের স্বপদে বহাল রাখা কোনোভাবে সমীচীন নয়।
জানতে চাইলে সিডিএ বোর্ডসভার সদস্য ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘অভিযোগপত্রভুক্ত এমন প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার সিডিএর চেয়ারম্যান এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের। উনারা কেবল যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেন।’
তবে সিডিএর চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, ‘আমি বা গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিবের কোনো এখতিয়ার নেই। এটা আদালতের বিষয়। তাঁরা তো এখনো আদালতে সাজা পাননি। বিচারকাজ শুরু হয়েছে কেবল। সাজা হলেই প্রচলিত আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
এ এ এম হাবিবুর রহমান: সিডিএর এই নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ১২টি মামলা চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন। এসব মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে সহযোগীদের নিয়ে প্রায় ৬৫ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনেছে দুদক।
১২ মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হাবিবুর রহমান ১০৬ কোটি ১৬ লাখ টাকার বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক ও ৯০ কোটি ১০ লাখ টাকার কাপাসগোলা সড়কের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন নামে দুটি প্রকল্পের পরিচালক। পর পর দুবার গার্ডার ধস ও ১২ জনের মৃত্যুর কারণে এই প্রকল্পটি এখন আলোচনার কেন্দ্রে আছে।
১২ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার পরও এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সিডিএ কর্তৃপক্ষ। তবে গত ২৪ নভেম্বরের গার্ডার ধসে প্রাণহানির পর তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
হাবিবুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। এক সপ্তাহ ধরে তাঁকে সিডিএ কার্যালয়েও দেখা যায়নি।
মো. মাহফুজুর রহমান: ৪৬২ কোটি ২৯ লাখ টাকার মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট ও জিইসি মোড় উড়ালসড়ক নির্মাণ এবং ৯৫ কোটি টাকার ঢাকা-ট্রাংক রোডের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান। তিনি সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী। তাঁর বিরুদ্ধে কালুরঘাট-বহদ্দারহাট সড়ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কাজের অনিয়মের একটি মামলায় গত ২৩ মে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, বর্তমান সরকারের সময় ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর করা এই মামলায় মাহফুজুর রহমানসহ অভিযোগপত্রভুক্ত ১১ আসামির বিরুদ্ধে ৪৬ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৭ টাকার আর্থিক ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
জানতে চাইলে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘দুদক গণহারে সবাইকে আসামি করেছে। এভাবে সবাই আসামি হলে কাজ করার তো মানুষ পাওয়া যাবে না। আর আমি কেন আসামি হয়েছি, সেটা আশ্চর্যের বিষয়।’
মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীন খালেদ: ২৮৪ কোটি ৬১ লাখ টাকার অনন্যা আবাসিক এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প এবং ৬১ কোটি ৯১ লাখ টাকার হাটহাজারী সংযোগ সড়কের মুরাদপুর থেকে অলিখাঁ পর্যন্ত সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক শাহাবুদ্দীন খালেদ। তিনিও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী।
শাহাবুদ্দীন খালেদের বিরুদ্ধে দুদক তিনটি মামলা করেছে। তার মধ্যে একটি মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পান। বাকি দুটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে ২১ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়মের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে দাবি করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।
জানতে চাইলে মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীন খালেদ বলেন, ‘আমি তো দুদকের ভুয়া মামলার আসামি। ভুয়া অভিযোগের ভিত্তিতে আমাকে জড়ানো হয়েছে।’
মো. নূরুল আমিন ভূঁইয়া: তিনিও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী। দুদকের করা আটটি মামলার আসামি তিনি। সব কটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে পৃথক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় তিনিসহ তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৪৯ লাখ ৯২ হাজার টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়।
নূরুল আমিন ভূঁইয়া ৪৪ কোটি ৩১ লাখ টাকার কাজীর দেউড়ি কাঁচাবাজার ও অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্প পরিচালক।
নূরুল আমিন ভূঁইয়া বলেন, ‘দুদক সবাইকে জড়িয়ে মামলা দিয়েছে। আমিও বাদ পড়িনি। অপরাধ করেছি কি না, তা আদালতেই প্রমাণিত হবে।’
রাজীব দাশ: এই সহকারী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। একটি থেকে অব্যাহতি পেলেও অন্যটিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সহযোগীদের নিয়ে ১০ লাখ ৫৮ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়।
রাজীব দাশ মেহেদীবাগ আবাসিক এলাকায় সিডিএ অফিসার্স কোয়ার্টার নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন।
জানতে চাইলে রাজীব দাশ বলেন, ‘আমি এক সপ্তাহ কাজ করেছি কালুরঘাট সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পে। অথচ আমাকেও মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
আহম্মদ মঈনুদ্দীন: সিডিএর এই নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে একটি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এতে ৪৬ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৭ টাকার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগপত্র দেওয়া হয় গত ২৩ মে।
আহম্মদ মঈনুদ্দীন এখন সিডিএর তিনটি প্রকল্পের পরিচালক। প্রকল্পগুলো হলো: ৫৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকার কদমতলী উড়ালসড়ক, ৪৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকার চট্টগ্রাম বিপণিবিতানের দ্বিতীয় ব্লকের বহুতল বাণিজ্যিক ভবন ও ৩৩ কোটি ৮১ লাখ টাকায় বিপণিবিতানের এ ব্লকের আধুনিকায়ন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোসংক্রান্ত প্রকল্প।
মামলার বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে আহম্মদ মঈনুদ্দীন মুঠোফোনের সংযোগ কেটে তা বন্ধ করে দেন।
মোহাম্মদ হাসান: সিডিএর এই সহকারী পরিচালক ৪০ কোটি ৩৮ লাখ টাকার পাঠানটুলী সড়কের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক। তিনি দুদকের তিনটি মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। কালুরঘাট-বহদ্দারহাট সড়কের উন্নয়ন ও সংস্কারকাজে তিনটি ভাগের কাজে অনিয়মের অভিযোগে এই তিনটি মামলা হয়।
মোহাম্মদ হাসান বলেন, ‘এই অনিয়মের সঙ্গে আমার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। অথচ দুদক আমাকে আসামি করেছে।’
অভিযোগপত্র দেওয়ার পরও কেন এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব খোন্দকার শওকত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার কারণে কারাগারে গেলে বরখাস্ত বাধ্যতামূলক। আর জামিন পেলে বরখাস্ত করা এবং না করা—দুই রকম নজিরই আছে।
তবে জানতে চাইলে জনপ্রশাসনসচিব আবদুস সোবহান সিকদার বলেন, কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হলে বিধি অনুযায়ী তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের কৌঁসুলি (পিপি) মাহমুদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সিডিএর দুর্নীতিসংক্রান্ত ২২টি মামলা আদালতে বিচারাধীন। এসব মামলায় ১৫ প্রকৌশলীকে আসামি করেছে দুদক। তাঁদের সঙ্গে একাধিক ঠিকাদারও আসামি। সব কটি মামলার শুনানিতে আসামিরা আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন।
মাহমুদুল হক আরও জানান, চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত সড়কের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নকাজ ২২টি ভাগে (লট) বাস্তবায়ন করা হয়। সড়কের সব কটি ভাগের কাজ ছিল নিম্নমানের। দুদক কর্মকর্তারা ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ২০১০ সালেই এ-সংক্রান্ত ২২টি মামলা করেন। চলতি বছরের বিভিন্ন সময় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এরপর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচারকাজ শুরু করেন।
সিডিএ সূত্র জানায়, বর্তমানে সংস্থাটি দুই হাজার ৫৫৮ কোটি টাকার ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে ১২টি প্রকল্প সাত প্রকৌশলীর হাতে। দুদকের মামলার আসামি এই সাত প্রকৌশলী হলেন: এ এ এম হাবিবুর রহমান, মো. মাহফুজুর রহমান, মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীন খালেদ, মো. নূরুল আমিন ভূঁইয়া, রাজীব দাশ, আহম্মদ মঈনুদ্দীন ও মোহাম্মদ হাসান।
তাঁদের মধ্যে হাবিবুর রহমান ছিলেন বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক প্রকল্পের পরিচালক। গত ২৪ নভেম্বর এই উড়ালসড়কের গার্ডার ধসে ১২ জন নিহত হলে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গত জুনেও একবার এই উড়ালসড়কের গার্ডার ধসে একাধিক ব্যক্তি আহত হন। তখন কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বর্তমানে সিডিএতে দুজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নয়জন নির্বাহী প্রকৌশলী (দুই অথরাইজেশন কর্মকর্তাসহ) ও ১৫ জন সহকারী প্রকৌশলীসহ ২৬ জন প্রকৌশলী রয়েছেন, যাঁরা প্রকল্প পরিচালক হওয়ার যোগ্য। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) কামালউদ্দিন আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কর্মচারী বিধিমালা (শৃঙ্খলা ও আপিল) অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় আসামি হলে তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) থাকবেন। সিডিএর কোনো প্রকৌশলী দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হলে তা ফৌজদারি অপরাধের শামিল। তাই তাঁদের স্বপদে বহাল রাখা কোনোভাবে সমীচীন নয়।
জানতে চাইলে সিডিএ বোর্ডসভার সদস্য ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘অভিযোগপত্রভুক্ত এমন প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার সিডিএর চেয়ারম্যান এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের। উনারা কেবল যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেন।’
তবে সিডিএর চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, ‘আমি বা গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিবের কোনো এখতিয়ার নেই। এটা আদালতের বিষয়। তাঁরা তো এখনো আদালতে সাজা পাননি। বিচারকাজ শুরু হয়েছে কেবল। সাজা হলেই প্রচলিত আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
এ এ এম হাবিবুর রহমান: সিডিএর এই নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ১২টি মামলা চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন। এসব মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে সহযোগীদের নিয়ে প্রায় ৬৫ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনেছে দুদক।
১২ মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হাবিবুর রহমান ১০৬ কোটি ১৬ লাখ টাকার বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক ও ৯০ কোটি ১০ লাখ টাকার কাপাসগোলা সড়কের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন নামে দুটি প্রকল্পের পরিচালক। পর পর দুবার গার্ডার ধস ও ১২ জনের মৃত্যুর কারণে এই প্রকল্পটি এখন আলোচনার কেন্দ্রে আছে।
১২ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার পরও এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সিডিএ কর্তৃপক্ষ। তবে গত ২৪ নভেম্বরের গার্ডার ধসে প্রাণহানির পর তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
হাবিবুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। এক সপ্তাহ ধরে তাঁকে সিডিএ কার্যালয়েও দেখা যায়নি।
মো. মাহফুজুর রহমান: ৪৬২ কোটি ২৯ লাখ টাকার মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট ও জিইসি মোড় উড়ালসড়ক নির্মাণ এবং ৯৫ কোটি টাকার ঢাকা-ট্রাংক রোডের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান। তিনি সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী। তাঁর বিরুদ্ধে কালুরঘাট-বহদ্দারহাট সড়ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কাজের অনিয়মের একটি মামলায় গত ২৩ মে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, বর্তমান সরকারের সময় ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর করা এই মামলায় মাহফুজুর রহমানসহ অভিযোগপত্রভুক্ত ১১ আসামির বিরুদ্ধে ৪৬ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৭ টাকার আর্থিক ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
জানতে চাইলে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘দুদক গণহারে সবাইকে আসামি করেছে। এভাবে সবাই আসামি হলে কাজ করার তো মানুষ পাওয়া যাবে না। আর আমি কেন আসামি হয়েছি, সেটা আশ্চর্যের বিষয়।’
মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীন খালেদ: ২৮৪ কোটি ৬১ লাখ টাকার অনন্যা আবাসিক এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প এবং ৬১ কোটি ৯১ লাখ টাকার হাটহাজারী সংযোগ সড়কের মুরাদপুর থেকে অলিখাঁ পর্যন্ত সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক শাহাবুদ্দীন খালেদ। তিনিও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী।
শাহাবুদ্দীন খালেদের বিরুদ্ধে দুদক তিনটি মামলা করেছে। তার মধ্যে একটি মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পান। বাকি দুটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে ২১ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়মের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে দাবি করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।
জানতে চাইলে মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীন খালেদ বলেন, ‘আমি তো দুদকের ভুয়া মামলার আসামি। ভুয়া অভিযোগের ভিত্তিতে আমাকে জড়ানো হয়েছে।’
মো. নূরুল আমিন ভূঁইয়া: তিনিও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী। দুদকের করা আটটি মামলার আসামি তিনি। সব কটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে পৃথক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় তিনিসহ তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৪৯ লাখ ৯২ হাজার টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়।
নূরুল আমিন ভূঁইয়া ৪৪ কোটি ৩১ লাখ টাকার কাজীর দেউড়ি কাঁচাবাজার ও অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্প পরিচালক।
নূরুল আমিন ভূঁইয়া বলেন, ‘দুদক সবাইকে জড়িয়ে মামলা দিয়েছে। আমিও বাদ পড়িনি। অপরাধ করেছি কি না, তা আদালতেই প্রমাণিত হবে।’
রাজীব দাশ: এই সহকারী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। একটি থেকে অব্যাহতি পেলেও অন্যটিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সহযোগীদের নিয়ে ১০ লাখ ৫৮ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়।
রাজীব দাশ মেহেদীবাগ আবাসিক এলাকায় সিডিএ অফিসার্স কোয়ার্টার নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন।
জানতে চাইলে রাজীব দাশ বলেন, ‘আমি এক সপ্তাহ কাজ করেছি কালুরঘাট সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পে। অথচ আমাকেও মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
আহম্মদ মঈনুদ্দীন: সিডিএর এই নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে একটি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এতে ৪৬ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৭ টাকার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগপত্র দেওয়া হয় গত ২৩ মে।
আহম্মদ মঈনুদ্দীন এখন সিডিএর তিনটি প্রকল্পের পরিচালক। প্রকল্পগুলো হলো: ৫৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকার কদমতলী উড়ালসড়ক, ৪৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকার চট্টগ্রাম বিপণিবিতানের দ্বিতীয় ব্লকের বহুতল বাণিজ্যিক ভবন ও ৩৩ কোটি ৮১ লাখ টাকায় বিপণিবিতানের এ ব্লকের আধুনিকায়ন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোসংক্রান্ত প্রকল্প।
মামলার বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে আহম্মদ মঈনুদ্দীন মুঠোফোনের সংযোগ কেটে তা বন্ধ করে দেন।
মোহাম্মদ হাসান: সিডিএর এই সহকারী পরিচালক ৪০ কোটি ৩৮ লাখ টাকার পাঠানটুলী সড়কের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক। তিনি দুদকের তিনটি মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। কালুরঘাট-বহদ্দারহাট সড়কের উন্নয়ন ও সংস্কারকাজে তিনটি ভাগের কাজে অনিয়মের অভিযোগে এই তিনটি মামলা হয়।
মোহাম্মদ হাসান বলেন, ‘এই অনিয়মের সঙ্গে আমার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। অথচ দুদক আমাকে আসামি করেছে।’
অভিযোগপত্র দেওয়ার পরও কেন এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব খোন্দকার শওকত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার কারণে কারাগারে গেলে বরখাস্ত বাধ্যতামূলক। আর জামিন পেলে বরখাস্ত করা এবং না করা—দুই রকম নজিরই আছে।
তবে জানতে চাইলে জনপ্রশাসনসচিব আবদুস সোবহান সিকদার বলেন, কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হলে বিধি অনুযায়ী তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে।
No comments