জ্বালানি- সস্তায় পাওয়া ‘শেল গ্যাস’ ও জ্বালানি বাজার! by মুশফিকুর রহমান
দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি হ্রাস করে নিজ দেশের জ্বালানি সম্পদ আহরণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন প্রায় ১৯ মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেল ব্যবহার করে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তার বার্ষিক চাহিদা পূরণের তাগিদে ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল আমদানি করে। গত এক দশকজুড়েই জ্বালানি তেলের মূল্য বেশি। ২০০৮ সালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১৪৭ ডলারে উঠেছিল। গত বছর বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেল আমদানিকারক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ৩২৭ বিলিয়ন ডলার তেল আমদানিতে ব্যয় করেছে।
জ্বালানি সরবরাহকারী দেশগুলোর রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশ্বজুড়ে চলমান দীর্ঘ অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণের গতি দ্রুত করার পথে অন্যতম বাধা। এ পটভূমিতে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য বিকল্প জ্বালানির উৎস সন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন প্রযুক্তি খুঁজতে উৎসাহ জুগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘শেল গ্যাস’ ও কানাডার ‘টার স্যান্ড’ তেমনই নতুন খুঁজে পাওয়া দুটি উৎস, যা থেকে বিপুল পরিমাণে ও সুলভে জ্বালানি গ্যাস ও তেল উৎপাদনের প্রযুক্তি করায়ত্ত হয়েছে। প্যারিসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) ১২ নভেম্বর ঘোষণা করেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে এবং সামগ্রিকভাবে উত্তর আমেরিকা জ্বালানি তেল রপ্তানিকারকে উত্তীর্ণ হবে। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর ড্রিলিং ও ভূগর্ভের গ্যাসসমৃদ্ধ কাদাশিলা বা শেলের স্তরে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ও প্রবল চাপে শেলস্তর ভেঙে গ্যাস আহরণের বৈপ্লবিক প্রযুক্তি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অপ্রথাগত উৎসের ‘শেল গ্যাস ও তেল’ উত্তোলন জোরদার করেছে। আইইএ আশাবাদ প্রকাশ করে বলছে, ২০২০ সাল নাগাদ সৌদি আরবকে ডিঙিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর প্রধান তেল ও গ্যাস উৎপাদক দেশে উত্তীর্ণ হবে। স্বল্প মূল্যে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘জ্বালানি স্বাধীনতা’ এখন অর্জনযোগ্য লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর আমেরিকার নির্ভরতা হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ডিটার হেলম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ‘শেল গ্যাস’ বলে কিছু ছিল না। কিন্তু এখন জ্বালানি বাজারের ৩০ শতাংশ শেল গ্যাসের দখলে। জ্বালানি তেল আমদানির বিপুল বোঝা থেকে মুক্ত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অর্জন বাস্তব বলে মনে করছেন। নতুন উৎস নিশ্চিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান হারে জ্বালানি ব্যবহার করলে আগামী ১০০ বছরের গ্যাসের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারবে।
আইইএ অনুমান করেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ সস্তা ও সহজলভ্য গ্যাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান জ্বালানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। একই সঙ্গে শেল গ্যাস উৎপাদনের নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে গ্যাস উৎপাদনের জন্য অব্যাহত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। প্রেসিডেন্ট ওবামা আশা করছেন, বর্তমান দশকের শেষ নাগাদ এ খাতে প্রায় ছয় লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। বিশ্বের প্রধান জ্বালানি তেল আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র আমদানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠলে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ রাজতন্ত্রের দেশগুলোর প্রতি তার কৌশলগত অবস্থান বদলে যাবে। সেই সঙ্গে প্রধানত জ্বালানি তেল ও গ্যাস রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও গুরুত্ব হ্রাস পাবে।
যুক্তরাষ্ট্র সাধারণভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও নারী অধিকারের প্রবল সমর্থক হলেও মধ্যপ্রাচ্যের উল্টো ধারার রক্ষণশীল রাজতন্ত্রের সঙ্গে তার দীর্ঘ সখ্য জ্বালানি তেলের বাধাহীন সরবরাহ নিশ্চিত করার তাগিদেই। আশা করা হচ্ছে, আমদানি তেলের জন্য নির্ভরতা না থাকলে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন আঙ্গিকে গড়ে উঠবে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আশাবাদী হয়ে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মোতায়েন করা পঞ্চম নৌবহরকে পারস্য উপসাগরের টহল গুটিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া খুব দূরবর্তী সম্ভাবনা নয়। কেননা, নিজ দেশের জ্বালানির প্রাচুর্য তাকে উপসাগরের ব্যয়বহুল ও কৌশলগত পাহারাদারের দায়িত্ব থেকে গুটিয়ে আনতে সহায়তা করবে। অপর দিকে, তেল রপ্তানিকারক মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাজার ‘হারানোর’ প্রভাব ব্যাপক হওয়ার কথা। অবশ্য জ্বালানির জন্য উন্মুখ চীন ও ভারত তার বিপুল চাহিদা পূরণে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প ক্রেতা হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তেল রপ্তানি বন্ধ হলে তেল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নয়, অন্যতম প্রধান তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক হিসেবে রাশিয়ার ওপর তার প্রভাবও হবে ব্যাপক। বিশ্ববাজারে তেলের উচ্চ মূল্য রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। পুতিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়ায় অর্থনীতি বহুমুখীকরণের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা হলেও ইউরোপে তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকেই এখনো রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার মূল জোগান আসে। রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চলে ব্যারেন্ট সাগরের তলদেশে আবিষ্কৃত পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ‘স্টোকমান গ্যাসফিল্ড’ উন্নয়ন করার উদ্যোগ থেকে সম্প্রতি পুতিন সরকার পিছিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস উৎপাদন রাশিয়ার উৎপাদনকে ছাড়িয়ে গেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তেল ও গ্যাসের চাহিদা কমে আসায় এবং ইউরোপের বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহ বাড়ায় তেল ও গ্যাসের একচেটিয়া বাজারমূল্য ধরে রাখার রুশ উদ্যোগ হুমকির মুখে পড়েছে। ইউরোপীয় বাজারের কর্তৃত্ব সংকুচিত হওয়ায় মস্কোর নীতিনির্ধারকেরা শঙ্কিত। বিশ্বের বৃহত্তম তেল ও গ্যাস কোম্পানি রাশিয়ার গাজপ্রম ২০১২ সালের প্রথমার্ধে কোম্পানির নিট লাভ ৩৪ শতাংশ কমেছে বলে ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শেল গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে বিশ্ববাজারে জীবাশ্ম জ্বালানির সরবরাহ বাড়িয়েছে। গাজপ্রমের প্রধান রপ্তানিবাজার ইউরোপের ক্রেতা কোম্পানিগুলো তাই রাশিয়ার ওপর একক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে বিকল্প উৎস থেকে তেল ও গ্যাস সংগ্রহের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া জ্বালানি সম্পদ যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে কীভাবে কাজে লাগায় এবং বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো প্রাপ্ত সুযোগকে কীভাবে ব্যবহার করে, এখন মনোযোগ দিয়ে তা দেখার বিষয়।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
জ্বালানি সরবরাহকারী দেশগুলোর রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশ্বজুড়ে চলমান দীর্ঘ অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণের গতি দ্রুত করার পথে অন্যতম বাধা। এ পটভূমিতে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য বিকল্প জ্বালানির উৎস সন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন প্রযুক্তি খুঁজতে উৎসাহ জুগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘শেল গ্যাস’ ও কানাডার ‘টার স্যান্ড’ তেমনই নতুন খুঁজে পাওয়া দুটি উৎস, যা থেকে বিপুল পরিমাণে ও সুলভে জ্বালানি গ্যাস ও তেল উৎপাদনের প্রযুক্তি করায়ত্ত হয়েছে। প্যারিসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) ১২ নভেম্বর ঘোষণা করেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে এবং সামগ্রিকভাবে উত্তর আমেরিকা জ্বালানি তেল রপ্তানিকারকে উত্তীর্ণ হবে। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর ড্রিলিং ও ভূগর্ভের গ্যাসসমৃদ্ধ কাদাশিলা বা শেলের স্তরে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ও প্রবল চাপে শেলস্তর ভেঙে গ্যাস আহরণের বৈপ্লবিক প্রযুক্তি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অপ্রথাগত উৎসের ‘শেল গ্যাস ও তেল’ উত্তোলন জোরদার করেছে। আইইএ আশাবাদ প্রকাশ করে বলছে, ২০২০ সাল নাগাদ সৌদি আরবকে ডিঙিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর প্রধান তেল ও গ্যাস উৎপাদক দেশে উত্তীর্ণ হবে। স্বল্প মূল্যে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘জ্বালানি স্বাধীনতা’ এখন অর্জনযোগ্য লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর আমেরিকার নির্ভরতা হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ডিটার হেলম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ‘শেল গ্যাস’ বলে কিছু ছিল না। কিন্তু এখন জ্বালানি বাজারের ৩০ শতাংশ শেল গ্যাসের দখলে। জ্বালানি তেল আমদানির বিপুল বোঝা থেকে মুক্ত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অর্জন বাস্তব বলে মনে করছেন। নতুন উৎস নিশ্চিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান হারে জ্বালানি ব্যবহার করলে আগামী ১০০ বছরের গ্যাসের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারবে।
আইইএ অনুমান করেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ সস্তা ও সহজলভ্য গ্যাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান জ্বালানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। একই সঙ্গে শেল গ্যাস উৎপাদনের নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে গ্যাস উৎপাদনের জন্য অব্যাহত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। প্রেসিডেন্ট ওবামা আশা করছেন, বর্তমান দশকের শেষ নাগাদ এ খাতে প্রায় ছয় লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। বিশ্বের প্রধান জ্বালানি তেল আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র আমদানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠলে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ রাজতন্ত্রের দেশগুলোর প্রতি তার কৌশলগত অবস্থান বদলে যাবে। সেই সঙ্গে প্রধানত জ্বালানি তেল ও গ্যাস রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও গুরুত্ব হ্রাস পাবে।
যুক্তরাষ্ট্র সাধারণভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও নারী অধিকারের প্রবল সমর্থক হলেও মধ্যপ্রাচ্যের উল্টো ধারার রক্ষণশীল রাজতন্ত্রের সঙ্গে তার দীর্ঘ সখ্য জ্বালানি তেলের বাধাহীন সরবরাহ নিশ্চিত করার তাগিদেই। আশা করা হচ্ছে, আমদানি তেলের জন্য নির্ভরতা না থাকলে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন আঙ্গিকে গড়ে উঠবে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আশাবাদী হয়ে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মোতায়েন করা পঞ্চম নৌবহরকে পারস্য উপসাগরের টহল গুটিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া খুব দূরবর্তী সম্ভাবনা নয়। কেননা, নিজ দেশের জ্বালানির প্রাচুর্য তাকে উপসাগরের ব্যয়বহুল ও কৌশলগত পাহারাদারের দায়িত্ব থেকে গুটিয়ে আনতে সহায়তা করবে। অপর দিকে, তেল রপ্তানিকারক মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাজার ‘হারানোর’ প্রভাব ব্যাপক হওয়ার কথা। অবশ্য জ্বালানির জন্য উন্মুখ চীন ও ভারত তার বিপুল চাহিদা পূরণে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প ক্রেতা হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তেল রপ্তানি বন্ধ হলে তেল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নয়, অন্যতম প্রধান তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক হিসেবে রাশিয়ার ওপর তার প্রভাবও হবে ব্যাপক। বিশ্ববাজারে তেলের উচ্চ মূল্য রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। পুতিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়ায় অর্থনীতি বহুমুখীকরণের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা হলেও ইউরোপে তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকেই এখনো রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার মূল জোগান আসে। রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চলে ব্যারেন্ট সাগরের তলদেশে আবিষ্কৃত পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ‘স্টোকমান গ্যাসফিল্ড’ উন্নয়ন করার উদ্যোগ থেকে সম্প্রতি পুতিন সরকার পিছিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস উৎপাদন রাশিয়ার উৎপাদনকে ছাড়িয়ে গেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তেল ও গ্যাসের চাহিদা কমে আসায় এবং ইউরোপের বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহ বাড়ায় তেল ও গ্যাসের একচেটিয়া বাজারমূল্য ধরে রাখার রুশ উদ্যোগ হুমকির মুখে পড়েছে। ইউরোপীয় বাজারের কর্তৃত্ব সংকুচিত হওয়ায় মস্কোর নীতিনির্ধারকেরা শঙ্কিত। বিশ্বের বৃহত্তম তেল ও গ্যাস কোম্পানি রাশিয়ার গাজপ্রম ২০১২ সালের প্রথমার্ধে কোম্পানির নিট লাভ ৩৪ শতাংশ কমেছে বলে ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শেল গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে বিশ্ববাজারে জীবাশ্ম জ্বালানির সরবরাহ বাড়িয়েছে। গাজপ্রমের প্রধান রপ্তানিবাজার ইউরোপের ক্রেতা কোম্পানিগুলো তাই রাশিয়ার ওপর একক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে বিকল্প উৎস থেকে তেল ও গ্যাস সংগ্রহের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া জ্বালানি সম্পদ যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে কীভাবে কাজে লাগায় এবং বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো প্রাপ্ত সুযোগকে কীভাবে ব্যবহার করে, এখন মনোযোগ দিয়ে তা দেখার বিষয়।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments