বিশেষ সাক্ষাৎকার- সংকট নিরসনে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে by কামাল হোসেন
ড. কামাল হোসেনের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২০ এপ্রিল। ১৯৫৭ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি এবং ১৯৫৮ সালে ব্যাচেলর অব সিভিল ল সনদ লাভ করেন।
লিংকনস ইনে বার-অ্যাট-ল অর্জনের পর আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে পিএইচডি করেন ১৯৬৪ সালে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭২ সালে আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপার্টিয়ারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছেন। তিনি গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মহিউদ্দিন ফারুক
প্রথম আলো আপনারা যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, তার মূল লক্ষ্য কী? কীভাবে এই ঐক্য এগিয়ে নিতে চান?
ড. কামাল হোসেন আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত একটি বহুদলীয় টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনের যে মৌলিক বিষয়গুলো আছে, সে ব্যাপারে ব্যাপক মতৈক্য গড়ে তোলা। গণতন্ত্র সংবিধানের চার মূলনীতির একটি। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে এবং অর্থবহ করতে হলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রয়োজন। নির্বাচনের নামে এখন কালোটাকার দৌরাত্ম্য চলছে। একটি নির্বাচনী এলাকায় একজন প্রার্থী পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে জয়ী হন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সীমা বেঁধে দিয়েছে, কেউ ১৫ লাখ টাকার বেশি ব্যবহার করতে পারবেন না। এমনকি পাঁচ কোটির স্থলে যদি এক কোটিও হয়, তাতে তো জনগণের রায়ের প্রতিফলন থাকে না। গণতন্ত্রকে সত্যিকারভাবে অর্থবহ করতে হলে এই কালোটাকার বিরুদ্ধে শক্তভাবে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
প্রথম আলো অর্থাৎ, আপনারা গণতন্ত্রকে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান?
ড. কামাল জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। গণতন্ত্র হলো জনগণের ক্ষমতায়ন। কিন্তু রাষ্ট্র তো সেই নিয়মে চলছে না, গণবিরোধী শক্তি গণতন্ত্রের নামে জনগণের ক্ষমতা কুক্ষিগত করছে, ক্ষমতা আত্মসাৎ করছে অর্থের জোর খাটিয়ে। সাংবিধানিক শাসন মানে ক্ষমতা জনগণের হাতে অর্পণ করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের সেই ক্ষমতা প্রয়োগে ভূমিকা রাখছেন কি না, সেটাই দেখার বিষয়। যাঁরা পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে প্রতিনিধি হয়েছেন, তাঁরা তো জনগণকে ক্ষমতায়িত করবেন না, নিজেরা ক্ষমতায়িত হতে চাইবেন। আমাদের গণতন্ত্রের সংকট এটাই।
আমরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে সংস্কারের কথা বলে এসেছি, সেটি নতুন নয়। ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর পল্টন ময়দানে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলাম। সে সময় আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল এ বিষয়ে একমত হয়ে আন্দোলন করেছিল।
প্রথম আলো ঐক্যের আহ্বান সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবেন কীভাবে?
ড. কামাল প্রথমত জনগণের কাছে এটা নিয়ে যেতে হবে। গণসংযোগ ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা মানুষের কাছে নিয়ে যাব এবং তাদের বোঝাব, জাতীয় মতৈক্য ছাড়া যে সাংবিধানিক শাসন সবাই আশা করছে, তা পূরণ হবে না। যেমন, আইনের শাসনের কথা বলি, কিন্তু যখনই দলীয়ভাবে সেই আইনের প্রয়োগ করা হয়, তখন আর আইনের শাসন থাকে না। আইনের চোখে সবাই সমান।
প্রথম আলো যে দুর্নীতি ও অপশক্তির বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছেন, সেই অপশক্তি তো দুই প্রধান দলেই আছে। এবং তারাই দেশের অধিকাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে।
ড. কামাল প্রধান দুই দলের মধ্যে আছে, আবার এর বাইরেও আছে। কিন্তু যাঁরা দুর্নীতি করেছেন, অন্যায় করেছেন, তাঁদের ব্যাপারে আইনের কার্যকর প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি না। যেমন, শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির ব্যাপারে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বাধীন কমিটি কিছু প্রস্তাব করেছিল। অনিয়মকারীদের চিহ্নিত করে বলেছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে আরও গভীরভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
প্রথম আলো সরকারের দাবি, ডেসটিনি, হল-মার্কসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে।
ড. কামাল চতুর্থ বর্ষে এসে দেখছি, সরকার কিছু কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে। এটি করতে তারা বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর ব্যাপারে পুরোনো কাগজপত্র বের করে দেখুন, তারা কতবার বলেছে দুর্নীতি হয়নি। এমনকি বিশ্বব্যাংককে পাল্টা আক্রমণ করে বলেছে, বিশ্বব্যাংক নিজের দুর্নীতি ঢাকতেই সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের কথামতোই দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে। তাহলে তখন অস্বীকার করা হলো কেন?
প্রথম আলো কিন্তু এর আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারা তো দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। সে সময়ও জ্বালানি, বিদ্যুৎ নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।
ড. কামাল তারা করেনি বলে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায়ের দুই বছর পর যখন নির্বাচন হলো, মানুষ তাদের যেভাবে প্রত্যাখ্যান করল, সেটাকেও বিচার বলা যায়। বর্তমান সরকারও কি তাদের মতো বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে চায়? নির্বাচন তো সামনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে তারা যদি একটা নির্বাচন করে প্রমাণ করতে পারে, মানুষ তাদের মেনে নিচ্ছে, তাহলে বুঝব, খুব ভালো কাজ করেছে। সেই পরীক্ষায় তাদের যাওয়া উচিত। কিন্তু সেই পরীক্ষা তারা এড়াতে চাইছে কেন?
প্রথম আলো গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় বৃত্তের বাইরে রাখা এবং স্বাধীনমতো চলতে দেওয়া উচিত নয় কি?
ড. কামাল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনের যেখানে ঘাটতি আছে, আদালতের নির্দেশনা আছে সেগুলো পূরণ করার। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষিত। যেমন, বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন করার জন্য অনেক আগেই আদালত বলেছিলেন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না।
দ্বিতীয় কথা হলো, সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিরপেক্ষতা অপরিহার্য। যাঁদের সেখানে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাঁদের যোগ্যতা ও সততা থাকতে হবে প্রশ্নাতীত। এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইন সংস্কারের একটা খসড়া সরকারকে দিয়েছিল। আমিও একটি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়েছি।
প্রথম আলো দেশে আইনের শাসন কতটা কার্যকর আছে বলে মনে করেন?
ড. কামাল আইনের শাসনের মৌলিক কথা হলো আইনের নিরপেক্ষ ও কার্যকর প্রয়োগ। সেখানে আমরা দেখছি, সেটা অনেকটাই অনুপস্থিত। অতিসম্প্রতি ভয়াবহ অগ্নিসংযোগ হলো পোশাকশিল্প কারখানায়। ফ্যাক্টরিগুলো পরিচালনার জন্য আইন আছে, আইন আছে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্যও। সে আইন প্রয়োগ হলে দুর্ঘটনা ঘটত না। সাভারে স্পেকট্রাম কারখানায় দুর্ঘটনার পর আদালত থেকে বলা হয়েছিল, আইনের বিধানগুলো যেন ঠিকভাবে মেনে চলা হয়। কিন্তু তাজরীন ফ্যাশনসের দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কীভাবে আইন অমান্য করা হয়েছে। রাস্তাঘাটেও দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে—এখানেও তো আইন অমান্য হচ্ছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রেও আইন মানা হচ্ছে না। একই কারণে লঞ্চ দুর্ঘটনাও ঘটছে।
তারপর আসি হল-মার্কের ঘটনায়। ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি এটি।
প্রথম আলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিয়ে শুরু থেকেই বেশ টানাপোড়েন চলছে। বিএনপির সরকার একে কার্যকর করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে করেছে, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। এই সরকার শেষ মুহূর্তে এসে তৎপর হয়েছে। পুরো বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ড. কামাল দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের দাবি ছিল সর্ব মহলের। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হতো। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হলে এ বিধান তুলে নেওয়া এবং সংস্থাটিকে আরও স্বাধীনভাবে তদন্ত করার ক্ষমতা দেওয়ার কথা। কিন্তু দুই ব্যাপারেই ঘাটতি রয়েছে।
প্রথম আলো দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা প্রত্যাহারের এখতিয়ার সরকারের হাতে নেওয়ার কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
ড. কামাল এটা খুবই আপত্তিকর। এতে নখদন্তহীন দুদকের যেটুকু কার্যকারিতা আছে, তাও থাকবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্যোগের বিরুদ্ধে সবাইকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
প্রথম আলো আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশে একটা রাজনৈতিক সংকট চলছে বলেই অনেকের ধারণা। সরকার বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে, বিরোধী দল বলছে এটা ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। এর সমাধান কী?
ড. কামাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। এতে সংকট সৃষ্টি হবে। এত বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, যাওয়ার পথে তারা এ ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে কেন? আদালতের যে রায়ের ভিত্তিতে তারা বিধানটি বাতিল করেছে, সেই রায়ে তো আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা ছিল। বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আমি মনে করি, আদালতের রায়ে যে দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছে, সেটি বহাল রাখা হোক। সরকারের কাছে একটা জবাবদিহি তো আমরা দাবি করতে পারি।
প্রথম আলো প্রধানমন্ত্রী একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, সব দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে।
ড. কামাল তিনি সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী করে ওটা করে দিন। সবার মতামত নিয়েই সংশোধনী করা উচিত। পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য অনেকের মতামত নেওয়া হলেও তা অগ্রাহ্য করা হয়েছে। কমিটিতে আইনজীবীসহ যাঁরা মতামত দিয়েছিলেন, তা প্রকাশ করা হোক। এটা গোপন থাকতে পারে না।
প্রথম আলো এখন সমাধান কী?
ড. কামাল রায় পাওয়ার আগেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। বিস্তারিত রায় এসেছে ১৬ মাস পর। রায়ে দেখা যায়, চারজন বিচারকই বলেছেন, আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। বাকি তিনজন এটাকে অসাংবিধানিক বলে মনে করেছেন। দেশের বিভিন্ন মহলও এ ব্যাপারে মতামত দিয়েছে। সেগুলো বিবেচনা করে সংসদ খুব সহজে সমাধান করতে পারে। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তার অর্থ দাঁড়ায়, তিনিও মনে করছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী পুনর্বিবেচনার যোগ্য।
প্রথম আলো তিনি বলেছেন, সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার হতে পারে সংবিধানের আওতায়। এর বাইরে সমাধানের প্রস্তাব কি বিবেচনাযোগ্য?
ড. কামাল সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। কেননা সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছাড়া কেউ আইন পাস করতে পারবে না।
প্রথম আলো একজন রাজনীতিক ও আইনজ্ঞ হিসেবে আপনি কি মনে করেন, সংসদেই এর সমাধান, রাজপথে নয়?
ড. কামাল রাজপথ সাহায্য করতে পারে। রাজপথে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণ যে মতামত দেবে, তা বিবেচনায় নিতে তো ক্ষতি নেই।
প্রথম আলো আগে যেভাবে হতো হরতাল, ঘেরাও, অবরোধ; তার পুনরাবৃত্তি কি হবে?
ড. কামাল ধ্বংসাত্মক কিছু পরিহার করা উচিত। কিন্তু জনমত গঠনের জন্য গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন অবশ্যই করা যেতে পারে—শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন।
প্রথম আলো রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের ব্যাপারে আপনি সব সময়ই বলে আসছেন, এটা খুবই জরুরি। ফরমালিনমুক্ত রাজনীতির কথা বলে আসছেন, সেটা কীভাবে সম্ভব?
ড. কামাল ইলিশ, কই মাছ সবাই পছন্দ করি। কিন্তু এতে ফরমালিন ঢুকে গেলে অখাদ্য হয়ে যায়। সুস্থ রাজনীতি ছাড়া কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনা করা অসম্ভব। একটু ব্যাখ্যা করি।
পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে যদি কেউ নির্বাচন করেন, সেটি হলো বড় রকমের ফরমালিন। দুই নম্বর হচ্ছে মনোনয়ন-বাণিজ্য। টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনা হয়। ব্যক্তির খেয়ালখুশিমতো প্রার্থিতা চাপিয়ে দেওয়া হয়, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মতামত গুরুত্ব পায় না। প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, শিক্ষাঙ্গন—সব ক্ষেত্রেও ফরমালিন ঢুকে গেছে।
প্রথম আলো দণ্ডিত আসামিদের পাইকারিভাবে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, দণ্ড মওকুফ করা হচ্ছে, বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ড. কামাল এটা আইনের শাসনের পরিপন্থী। বিশেষ ক্ষেত্রে মওকুফ পেতে পারে। যেখানে দেখা যাবে বিচার-প্রক্রিয়ায় সমস্যা ছিল, সেটা মিথ্যা সাক্ষ্য ছিল অথবা অন্য কোনো সংগত কারণ বিবেচনা করে একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যে এগুলো করার কথা, ঢালাওভাবে নয়।
প্রথম আলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। আবার জামায়াত-শিবির এর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে, পুলিশের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
ড. কামাল দেরিতে হলেও বিচার হচ্ছে। আমরা স্বাগত জানিয়েছি। বিচার দ্রুত সম্পন্ন হোক, সেটা জাতীয় দাবি। কোনো ঘাটতির কারণে যাতে বিচার-প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়, সেদিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।
পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। আইনেই আপত্তি করার বিধান আছে। তারা তা করতে পারে। আদালত আছেন, সেখানে যেতে পারে, প্রতিকার চাইতে পারে। কিন্তু কোনো অজুহাতেই সহিংস কার্যকলাপ চালানো উচিত নয়।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. কামাল ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মহিউদ্দিন ফারুক
প্রথম আলো আপনারা যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, তার মূল লক্ষ্য কী? কীভাবে এই ঐক্য এগিয়ে নিতে চান?
ড. কামাল হোসেন আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত একটি বহুদলীয় টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনের যে মৌলিক বিষয়গুলো আছে, সে ব্যাপারে ব্যাপক মতৈক্য গড়ে তোলা। গণতন্ত্র সংবিধানের চার মূলনীতির একটি। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে এবং অর্থবহ করতে হলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রয়োজন। নির্বাচনের নামে এখন কালোটাকার দৌরাত্ম্য চলছে। একটি নির্বাচনী এলাকায় একজন প্রার্থী পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে জয়ী হন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সীমা বেঁধে দিয়েছে, কেউ ১৫ লাখ টাকার বেশি ব্যবহার করতে পারবেন না। এমনকি পাঁচ কোটির স্থলে যদি এক কোটিও হয়, তাতে তো জনগণের রায়ের প্রতিফলন থাকে না। গণতন্ত্রকে সত্যিকারভাবে অর্থবহ করতে হলে এই কালোটাকার বিরুদ্ধে শক্তভাবে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
প্রথম আলো অর্থাৎ, আপনারা গণতন্ত্রকে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান?
ড. কামাল জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। গণতন্ত্র হলো জনগণের ক্ষমতায়ন। কিন্তু রাষ্ট্র তো সেই নিয়মে চলছে না, গণবিরোধী শক্তি গণতন্ত্রের নামে জনগণের ক্ষমতা কুক্ষিগত করছে, ক্ষমতা আত্মসাৎ করছে অর্থের জোর খাটিয়ে। সাংবিধানিক শাসন মানে ক্ষমতা জনগণের হাতে অর্পণ করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের সেই ক্ষমতা প্রয়োগে ভূমিকা রাখছেন কি না, সেটাই দেখার বিষয়। যাঁরা পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে প্রতিনিধি হয়েছেন, তাঁরা তো জনগণকে ক্ষমতায়িত করবেন না, নিজেরা ক্ষমতায়িত হতে চাইবেন। আমাদের গণতন্ত্রের সংকট এটাই।
আমরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে সংস্কারের কথা বলে এসেছি, সেটি নতুন নয়। ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর পল্টন ময়দানে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলাম। সে সময় আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল এ বিষয়ে একমত হয়ে আন্দোলন করেছিল।
প্রথম আলো ঐক্যের আহ্বান সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবেন কীভাবে?
ড. কামাল প্রথমত জনগণের কাছে এটা নিয়ে যেতে হবে। গণসংযোগ ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা মানুষের কাছে নিয়ে যাব এবং তাদের বোঝাব, জাতীয় মতৈক্য ছাড়া যে সাংবিধানিক শাসন সবাই আশা করছে, তা পূরণ হবে না। যেমন, আইনের শাসনের কথা বলি, কিন্তু যখনই দলীয়ভাবে সেই আইনের প্রয়োগ করা হয়, তখন আর আইনের শাসন থাকে না। আইনের চোখে সবাই সমান।
প্রথম আলো যে দুর্নীতি ও অপশক্তির বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছেন, সেই অপশক্তি তো দুই প্রধান দলেই আছে। এবং তারাই দেশের অধিকাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে।
ড. কামাল প্রধান দুই দলের মধ্যে আছে, আবার এর বাইরেও আছে। কিন্তু যাঁরা দুর্নীতি করেছেন, অন্যায় করেছেন, তাঁদের ব্যাপারে আইনের কার্যকর প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি না। যেমন, শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির ব্যাপারে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বাধীন কমিটি কিছু প্রস্তাব করেছিল। অনিয়মকারীদের চিহ্নিত করে বলেছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে আরও গভীরভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
প্রথম আলো সরকারের দাবি, ডেসটিনি, হল-মার্কসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে।
ড. কামাল চতুর্থ বর্ষে এসে দেখছি, সরকার কিছু কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে। এটি করতে তারা বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর ব্যাপারে পুরোনো কাগজপত্র বের করে দেখুন, তারা কতবার বলেছে দুর্নীতি হয়নি। এমনকি বিশ্বব্যাংককে পাল্টা আক্রমণ করে বলেছে, বিশ্বব্যাংক নিজের দুর্নীতি ঢাকতেই সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের কথামতোই দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে। তাহলে তখন অস্বীকার করা হলো কেন?
প্রথম আলো কিন্তু এর আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারা তো দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। সে সময়ও জ্বালানি, বিদ্যুৎ নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।
ড. কামাল তারা করেনি বলে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায়ের দুই বছর পর যখন নির্বাচন হলো, মানুষ তাদের যেভাবে প্রত্যাখ্যান করল, সেটাকেও বিচার বলা যায়। বর্তমান সরকারও কি তাদের মতো বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে চায়? নির্বাচন তো সামনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে তারা যদি একটা নির্বাচন করে প্রমাণ করতে পারে, মানুষ তাদের মেনে নিচ্ছে, তাহলে বুঝব, খুব ভালো কাজ করেছে। সেই পরীক্ষায় তাদের যাওয়া উচিত। কিন্তু সেই পরীক্ষা তারা এড়াতে চাইছে কেন?
প্রথম আলো গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় বৃত্তের বাইরে রাখা এবং স্বাধীনমতো চলতে দেওয়া উচিত নয় কি?
ড. কামাল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনের যেখানে ঘাটতি আছে, আদালতের নির্দেশনা আছে সেগুলো পূরণ করার। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষিত। যেমন, বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন করার জন্য অনেক আগেই আদালত বলেছিলেন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না।
দ্বিতীয় কথা হলো, সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিরপেক্ষতা অপরিহার্য। যাঁদের সেখানে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাঁদের যোগ্যতা ও সততা থাকতে হবে প্রশ্নাতীত। এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইন সংস্কারের একটা খসড়া সরকারকে দিয়েছিল। আমিও একটি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়েছি।
প্রথম আলো দেশে আইনের শাসন কতটা কার্যকর আছে বলে মনে করেন?
ড. কামাল আইনের শাসনের মৌলিক কথা হলো আইনের নিরপেক্ষ ও কার্যকর প্রয়োগ। সেখানে আমরা দেখছি, সেটা অনেকটাই অনুপস্থিত। অতিসম্প্রতি ভয়াবহ অগ্নিসংযোগ হলো পোশাকশিল্প কারখানায়। ফ্যাক্টরিগুলো পরিচালনার জন্য আইন আছে, আইন আছে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্যও। সে আইন প্রয়োগ হলে দুর্ঘটনা ঘটত না। সাভারে স্পেকট্রাম কারখানায় দুর্ঘটনার পর আদালত থেকে বলা হয়েছিল, আইনের বিধানগুলো যেন ঠিকভাবে মেনে চলা হয়। কিন্তু তাজরীন ফ্যাশনসের দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কীভাবে আইন অমান্য করা হয়েছে। রাস্তাঘাটেও দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে—এখানেও তো আইন অমান্য হচ্ছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রেও আইন মানা হচ্ছে না। একই কারণে লঞ্চ দুর্ঘটনাও ঘটছে।
তারপর আসি হল-মার্কের ঘটনায়। ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি এটি।
প্রথম আলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিয়ে শুরু থেকেই বেশ টানাপোড়েন চলছে। বিএনপির সরকার একে কার্যকর করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে করেছে, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। এই সরকার শেষ মুহূর্তে এসে তৎপর হয়েছে। পুরো বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ড. কামাল দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের দাবি ছিল সর্ব মহলের। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হতো। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হলে এ বিধান তুলে নেওয়া এবং সংস্থাটিকে আরও স্বাধীনভাবে তদন্ত করার ক্ষমতা দেওয়ার কথা। কিন্তু দুই ব্যাপারেই ঘাটতি রয়েছে।
প্রথম আলো দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা প্রত্যাহারের এখতিয়ার সরকারের হাতে নেওয়ার কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
ড. কামাল এটা খুবই আপত্তিকর। এতে নখদন্তহীন দুদকের যেটুকু কার্যকারিতা আছে, তাও থাকবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্যোগের বিরুদ্ধে সবাইকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
প্রথম আলো আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশে একটা রাজনৈতিক সংকট চলছে বলেই অনেকের ধারণা। সরকার বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে, বিরোধী দল বলছে এটা ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। এর সমাধান কী?
ড. কামাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। এতে সংকট সৃষ্টি হবে। এত বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, যাওয়ার পথে তারা এ ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে কেন? আদালতের যে রায়ের ভিত্তিতে তারা বিধানটি বাতিল করেছে, সেই রায়ে তো আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা ছিল। বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আমি মনে করি, আদালতের রায়ে যে দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছে, সেটি বহাল রাখা হোক। সরকারের কাছে একটা জবাবদিহি তো আমরা দাবি করতে পারি।
প্রথম আলো প্রধানমন্ত্রী একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, সব দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে।
ড. কামাল তিনি সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী করে ওটা করে দিন। সবার মতামত নিয়েই সংশোধনী করা উচিত। পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য অনেকের মতামত নেওয়া হলেও তা অগ্রাহ্য করা হয়েছে। কমিটিতে আইনজীবীসহ যাঁরা মতামত দিয়েছিলেন, তা প্রকাশ করা হোক। এটা গোপন থাকতে পারে না।
প্রথম আলো এখন সমাধান কী?
ড. কামাল রায় পাওয়ার আগেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। বিস্তারিত রায় এসেছে ১৬ মাস পর। রায়ে দেখা যায়, চারজন বিচারকই বলেছেন, আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। বাকি তিনজন এটাকে অসাংবিধানিক বলে মনে করেছেন। দেশের বিভিন্ন মহলও এ ব্যাপারে মতামত দিয়েছে। সেগুলো বিবেচনা করে সংসদ খুব সহজে সমাধান করতে পারে। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তার অর্থ দাঁড়ায়, তিনিও মনে করছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী পুনর্বিবেচনার যোগ্য।
প্রথম আলো তিনি বলেছেন, সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার হতে পারে সংবিধানের আওতায়। এর বাইরে সমাধানের প্রস্তাব কি বিবেচনাযোগ্য?
ড. কামাল সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। কেননা সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছাড়া কেউ আইন পাস করতে পারবে না।
প্রথম আলো একজন রাজনীতিক ও আইনজ্ঞ হিসেবে আপনি কি মনে করেন, সংসদেই এর সমাধান, রাজপথে নয়?
ড. কামাল রাজপথ সাহায্য করতে পারে। রাজপথে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণ যে মতামত দেবে, তা বিবেচনায় নিতে তো ক্ষতি নেই।
প্রথম আলো আগে যেভাবে হতো হরতাল, ঘেরাও, অবরোধ; তার পুনরাবৃত্তি কি হবে?
ড. কামাল ধ্বংসাত্মক কিছু পরিহার করা উচিত। কিন্তু জনমত গঠনের জন্য গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন অবশ্যই করা যেতে পারে—শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন।
প্রথম আলো রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের ব্যাপারে আপনি সব সময়ই বলে আসছেন, এটা খুবই জরুরি। ফরমালিনমুক্ত রাজনীতির কথা বলে আসছেন, সেটা কীভাবে সম্ভব?
ড. কামাল ইলিশ, কই মাছ সবাই পছন্দ করি। কিন্তু এতে ফরমালিন ঢুকে গেলে অখাদ্য হয়ে যায়। সুস্থ রাজনীতি ছাড়া কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনা করা অসম্ভব। একটু ব্যাখ্যা করি।
পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে যদি কেউ নির্বাচন করেন, সেটি হলো বড় রকমের ফরমালিন। দুই নম্বর হচ্ছে মনোনয়ন-বাণিজ্য। টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনা হয়। ব্যক্তির খেয়ালখুশিমতো প্রার্থিতা চাপিয়ে দেওয়া হয়, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মতামত গুরুত্ব পায় না। প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, শিক্ষাঙ্গন—সব ক্ষেত্রেও ফরমালিন ঢুকে গেছে।
প্রথম আলো দণ্ডিত আসামিদের পাইকারিভাবে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, দণ্ড মওকুফ করা হচ্ছে, বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ড. কামাল এটা আইনের শাসনের পরিপন্থী। বিশেষ ক্ষেত্রে মওকুফ পেতে পারে। যেখানে দেখা যাবে বিচার-প্রক্রিয়ায় সমস্যা ছিল, সেটা মিথ্যা সাক্ষ্য ছিল অথবা অন্য কোনো সংগত কারণ বিবেচনা করে একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যে এগুলো করার কথা, ঢালাওভাবে নয়।
প্রথম আলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। আবার জামায়াত-শিবির এর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে, পুলিশের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
ড. কামাল দেরিতে হলেও বিচার হচ্ছে। আমরা স্বাগত জানিয়েছি। বিচার দ্রুত সম্পন্ন হোক, সেটা জাতীয় দাবি। কোনো ঘাটতির কারণে যাতে বিচার-প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়, সেদিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।
পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। আইনেই আপত্তি করার বিধান আছে। তারা তা করতে পারে। আদালত আছেন, সেখানে যেতে পারে, প্রতিকার চাইতে পারে। কিন্তু কোনো অজুহাতেই সহিংস কার্যকলাপ চালানো উচিত নয়।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. কামাল ধন্যবাদ।
No comments