বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৮৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। এস এ সিদ্দিকী, বীর প্রতীক অকুতোভয় এক যোদ্ধা
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে এস এ সিদ্দিকীসহ (সামসুল আলম সিদ্দিকী) এক দল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন শেরপুর-সাদিপুরে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে এস এ সিদ্দিকীসহ (সামসুল আলম সিদ্দিকী) এক দল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন শেরপুর-সাদিপুরে।
তাঁরা ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, মুজাহিদ ও আনসার এবং ছাত্র-যুবক সমন্বয়ে। নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মো. আজিজুর রহমান (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল)।
কুশিয়ারা নদীর পাশে শেরপুর-সাদিপুর। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার সংযোগস্থল। সড়কপথে ঢাকা ও অন্যান্য জেলার সঙ্গে ওই চার জেলার যোগাযোগ এর ওপর দিয়ে। নৌপথেও সেখান থেকে বিভিন্ন স্থানে যাওয়া যায়।
৮ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হন। একাংশ সিলেট শহরে, একাংশ খাদিমনগর এবং একাংশ আম্বরখানা ও ওয়্যারলেস স্টেশনে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। তাঁদের আরেকটি অংশ ছিল সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে। তাঁরা বেশির ভাগ ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। এই দলে ছিলেন এস এ সিদ্দিকী।
২৩ এপ্রিল সকাল থেকে এস এ সিদ্দিকীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপক গোলাবর্ষণের মুখে পড়েন। কিন ব্রিজের দক্ষিণ প্রান্তে ছিল তাঁদের দলের একটি এলএমজি পোস্ট। সেখানে পকিস্তানিরা বিরামহীনভাবে গোলাবর্ষণ করে। এলএমজি ম্যান শহীদ হন। ফলে তাঁদের দলগত প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে।
এস এ সিদ্দিকী কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করতে থাকেন। তাঁদের সাহসিকতায় পাকিস্তানি সেনারা অনেকক্ষণ নদী পারাপারে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। যুদ্ধ চলতে থাকে। তাঁর উপদলের অবস্থানের ডান দিকে ছিল তাঁদের দলের আরআর (রিকোয়েললেস রাইফেল) চালনাকারী উপদল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের চাপে ওই দলও অবস্থান ছেড়ে চলে যায়। তখন তাঁরা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়েন।
এতে অবশ্য বিচলিত হননি এস এ সিদ্দিকী। কিন্তু ভারী অস্ত্রের সমর্থন না থাকায় তাঁরা বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা অবস্থান ছেড়ে পেছনে যেতে বাধ্য হন। এ সময় অন্য উপদলের আতঙ্কগ্রস্ত কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁরা জানান, পাকিস্তানি সেনারা একদম কাছে চলে এসেছে। এরপর তাঁর ওই সহযোদ্ধারা পালিয়ে যান। এর পরের ঘটনা সে আরেক কাহিনি।
এস এ সিদ্দিকী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে এ রেজিমেন্টের মূল অবস্থান ছিল জয়দেবপুর রাজবাড়িতে। একটি কোম্পানি (চার্লি [সি]) ছিল ময়মনসিংহে ইপিআর বাহিনীর ২ নম্বর উইং হেডকোয়ার্টার এলাকায়। এ কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন তিনি। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এস এ সিদ্দিকীসহ বাঙালি সৈনিকেরা কোনো দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। ২৭ মার্চ রাতে তাঁরা অবাঙালি ইপিআরদের হাতে আক্রান্ত হন। তাঁদের অধিনায়ক (ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম) তখন ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে সড়ক বিভাগের রেস্টহাউসে ছিলেন।
এ সময় বাঙালি ইপিআর সেনারা বিদ্রোহ করেন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এস এ সিদ্দিকীসহ বেশির ভাগ বাঙালি সেনা তখন বাঙালি ইপিআর সেনাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণে বেশির ভাগ পাকিস্তানি ইপিআর (উইং কমান্ডার কমর আব্বাসসহ) ও দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের পাকিস্তানি সেনা নিহত ও বাকিরা বন্দী হয়।
এস এ সিদ্দিকী প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরের আশ্রমবাড়ি সাব-সেক্টরে, পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। আখাউড়াসহ আরও কয়েকটি স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য এস এ সিদ্দিকীকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৮১। তাঁর প্রকৃত নাম সামসুল আলম সিদ্দিকী।
সামসুল আলম সিদ্দিকী ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন। ২০০৮ সালে মারা গেছেন। তাঁর আদি পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার কালিয়াগ্রামে। বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা বেডডোবা, কালিহাতী পৌরসভা, টাঙ্গাইল। তাঁর বাবার নাম আজিজুর রহমান সিদ্দিকী। মা রহিমা খাতুন। স্ত্রী নূরুন নাহার বেগম। তাঁদের এক মেয়ে, দুই ছেলে। স্ত্রী বেঁচে আছেন। তবে অসুস্থ। আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা নিতে পারছেন না। তিনি বর্তমানে ঢাকার আশকোনার তালতলায় ছেলের সঙ্গে থাকেন।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, নূরুল ইসলাম তালুকদার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩ ও ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
কুশিয়ারা নদীর পাশে শেরপুর-সাদিপুর। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার সংযোগস্থল। সড়কপথে ঢাকা ও অন্যান্য জেলার সঙ্গে ওই চার জেলার যোগাযোগ এর ওপর দিয়ে। নৌপথেও সেখান থেকে বিভিন্ন স্থানে যাওয়া যায়।
৮ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হন। একাংশ সিলেট শহরে, একাংশ খাদিমনগর এবং একাংশ আম্বরখানা ও ওয়্যারলেস স্টেশনে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। তাঁদের আরেকটি অংশ ছিল সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে। তাঁরা বেশির ভাগ ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। এই দলে ছিলেন এস এ সিদ্দিকী।
২৩ এপ্রিল সকাল থেকে এস এ সিদ্দিকীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপক গোলাবর্ষণের মুখে পড়েন। কিন ব্রিজের দক্ষিণ প্রান্তে ছিল তাঁদের দলের একটি এলএমজি পোস্ট। সেখানে পকিস্তানিরা বিরামহীনভাবে গোলাবর্ষণ করে। এলএমজি ম্যান শহীদ হন। ফলে তাঁদের দলগত প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে।
এস এ সিদ্দিকী কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করতে থাকেন। তাঁদের সাহসিকতায় পাকিস্তানি সেনারা অনেকক্ষণ নদী পারাপারে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। যুদ্ধ চলতে থাকে। তাঁর উপদলের অবস্থানের ডান দিকে ছিল তাঁদের দলের আরআর (রিকোয়েললেস রাইফেল) চালনাকারী উপদল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের চাপে ওই দলও অবস্থান ছেড়ে চলে যায়। তখন তাঁরা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়েন।
এতে অবশ্য বিচলিত হননি এস এ সিদ্দিকী। কিন্তু ভারী অস্ত্রের সমর্থন না থাকায় তাঁরা বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা অবস্থান ছেড়ে পেছনে যেতে বাধ্য হন। এ সময় অন্য উপদলের আতঙ্কগ্রস্ত কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁরা জানান, পাকিস্তানি সেনারা একদম কাছে চলে এসেছে। এরপর তাঁর ওই সহযোদ্ধারা পালিয়ে যান। এর পরের ঘটনা সে আরেক কাহিনি।
এস এ সিদ্দিকী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে এ রেজিমেন্টের মূল অবস্থান ছিল জয়দেবপুর রাজবাড়িতে। একটি কোম্পানি (চার্লি [সি]) ছিল ময়মনসিংহে ইপিআর বাহিনীর ২ নম্বর উইং হেডকোয়ার্টার এলাকায়। এ কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন তিনি। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এস এ সিদ্দিকীসহ বাঙালি সৈনিকেরা কোনো দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। ২৭ মার্চ রাতে তাঁরা অবাঙালি ইপিআরদের হাতে আক্রান্ত হন। তাঁদের অধিনায়ক (ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম) তখন ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে সড়ক বিভাগের রেস্টহাউসে ছিলেন।
এ সময় বাঙালি ইপিআর সেনারা বিদ্রোহ করেন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এস এ সিদ্দিকীসহ বেশির ভাগ বাঙালি সেনা তখন বাঙালি ইপিআর সেনাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণে বেশির ভাগ পাকিস্তানি ইপিআর (উইং কমান্ডার কমর আব্বাসসহ) ও দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের পাকিস্তানি সেনা নিহত ও বাকিরা বন্দী হয়।
এস এ সিদ্দিকী প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরের আশ্রমবাড়ি সাব-সেক্টরে, পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। আখাউড়াসহ আরও কয়েকটি স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য এস এ সিদ্দিকীকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৮১। তাঁর প্রকৃত নাম সামসুল আলম সিদ্দিকী।
সামসুল আলম সিদ্দিকী ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন। ২০০৮ সালে মারা গেছেন। তাঁর আদি পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার কালিয়াগ্রামে। বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা বেডডোবা, কালিহাতী পৌরসভা, টাঙ্গাইল। তাঁর বাবার নাম আজিজুর রহমান সিদ্দিকী। মা রহিমা খাতুন। স্ত্রী নূরুন নাহার বেগম। তাঁদের এক মেয়ে, দুই ছেলে। স্ত্রী বেঁচে আছেন। তবে অসুস্থ। আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা নিতে পারছেন না। তিনি বর্তমানে ঢাকার আশকোনার তালতলায় ছেলের সঙ্গে থাকেন।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, নূরুল ইসলাম তালুকদার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩ ও ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
No comments