আসন্ন বোরো ধান চাষের ক্ষেত্রে যে আশঙ্কা by এ এম এম শওকত আলী
পত্রিকান্তরে জানা যায়, আসন্ন বোরো মৌসুমে সেচযন্ত্রের জন্য কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে না। বিগত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি মেটানো এখনো সম্ভব হয়নি, যদিও সরকারের তরফ থেকে কোনো চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।
খবরে প্রকাশ, প্রায় ২৭ হাজার কৃষক নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আবেদন করেছে। তারা কোনো সংযোগ পাবে না। ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে আসন্ন মৌসুমে বোরো চাষ ব্যাহত হবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১০ লাখের অধিক বিভিন্ন ধরনের সেচযন্ত্র কৃষকরা ব্যবহার করেন। এ ব্যবহার মূলত বোরো চাষের জন্য। তবে এসব যন্ত্র ডিজেল দিয়েও চালানো হয়। বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রের সংখ্যা সর্বমোট সেচযন্ত্রের প্রায় ২০ শতাংশ। অর্থাৎ বেশির ভাগ সেচযন্ত্রই ডিজেলচালিত। নতুন সংযোগ না পেলে কৃষকরা বসে থাকবেন না। তাঁরা ডিজেলই ব্যবহার করে জমিতে সেচ দেবেন।
তবে কিছু আশঙ্কার বিষয় একেবারেই অগ্রাহ্য করা যায় না। যদি বিদ্যুৎ ঘাটতি বৃদ্ধি পায়, তাহলে ইতিমধ্যে সংযোগকৃত বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট কৃষকরা ডিজেলই ব্যবহার করে সেচের ব্যবস্থা করবেন। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি যত যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, কৃষকরা যে নিরাশ হবেন সে বিষয়টিও স্পষ্ট। জানা মতে, সেচযন্ত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহে সময় সময় ঘাটতি হলেও ডিজেল সরবরাহে কোনো ঘাটতি হয়নি। এ কারণে এখনো বেশির ভাগ কৃষক ডিজেল ব্যবহারে আগ্রহী। অতীতে দুই বছর কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের জন্য সরকার ডিজেলে ভর্তুকি দিয়েছিল। গত বছর দেওয়া হয়নি। এ বছর কী হবে তা অনিশ্চিত। ২৭ হাজার কৃষক নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের আবেদন কেন করেছে? বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য। জানা যায়, বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য প্রাথমিক খরচ ডিজেলের তুলনায় বেশি হলেও পরিচালনব্যয় বেশি হয় না। এ কারণে হয়তো অপেক্ষাকৃত সচ্ছল কৃষকরা বিদ্যুৎ ব্যবহার পছন্দ করেন। আসন্ন বোরো মৌসুমে যাতে বিদ্যমান বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক থাকে, সে বিষয়টি নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রয়োজন। ১৪ নভেম্বরের এক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনসহ সংস্থা পর্যায়েও কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ জাতীয় কৃষিনীতি (১৯৯৯) মোতাবেক কেন্দ্রীয় ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। এসব কমিটি সক্রিয় রাখাই হবে প্রধান দায়িত্ব।
বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশেরও বেশি জমিতে ধান চাষ হয়- আউশ, আমন ও বোরো। প্রথম দুটি বৃষ্টিনির্ভর। একমাত্র বোরোই সেচনির্ভর। কারণ এ ধানের চাষ শুকনো মৌসুমে হয়, যখন বৃষ্টির পানি আশা করা যায় না। তবে আমন ধানের জন্য কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে খরাপ্রবণ এলাকায় সম্পূরক চাষের প্রয়োজন হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দেশের প্রায় ২.৮ মিলিয়ন জমি খরাপ্রবণ এলাকায়। ওই সময় সম্পূরক সেচ দেওয়া সম্ভব হলে আমন ধানের ফলন প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ কারণে ১৯৯৮-৯৯ সময়কার সরকার সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করেছিল। তবে এর ফল সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ এর কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট কৃষিবিদদের ধারণা যে ফল ভালো হয়েছিল। এ ধরনের সম্পূরক সেচ আউশ ধানের জন্য ও এলাকাভেদে প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষ করে বৃষ্টির পরিমাণ যদি হ্রাস পায়। জলবায়ু পরিবর্তনের দৃষ্টিকোণে বলা যায় যে বৃষ্টি কম হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
তিন ধরনের ধানের মধ্যে ফলন ও এলাকা অনুযায়ী বোরো ধানই সর্বাধিক। এ কারণে যান্ত্রিক সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণের ফলে বোরো চাষের দিকেই কৃষকরা অধিকতর আগ্রহী। সাম্প্রতিককালে বিএআরসি জোনভিত্তিক শস্য চাষের একটি গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, আউশ ও আমন চাষ উপযোগী এলাকা বোরো চাষের আওতাধীন। কৃষকদের বোরো চাষে অধিক আগ্রহের আরো দুটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। এক. উচ্চ ফলনশীল বীজ বোরো ধানের জন্য সর্বাধিক। আউশ ও আমন ধানে তুলনামূলক কম। দুই. শুকনো মৌসুমে বন্যা হয় না। এ জন্য বোরো চাষ অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিহীন।
তবে সেচের ভবিষ্যৎ প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেচের পানি প্রধানত দুই উৎসে। এক. ভূ-উপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ। এই দুই উৎসের পানি সরবরাহের ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। বিষয়টি এখন প্রায় সর্বজনবিদিত। অন্তত প্রথম উৎস যে বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে তা প্রশ্নাতীত। দ্বিতীয় উৎস, অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ পানিও এখন সহজে পাওয়া সম্ভব নয়। ১৯৮২ সাল থেকেই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় এ আশঙ্কা দৃশ্যমান হয়। ওই সময় দেখা যায়, বহুসংখ্যক অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। কারণ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে গেছে। কৃষকরা তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও ওই সময় নিয়েছিলেন। তাঁরা গর্ত করে সেচযন্ত্র তিন থেকে পাঁচ ফুট নিচে বসিয়ে কিছু সেচের ব্যবস্থা করেছিলেন।
ক্রমশ এ সমস্যা গভীর নলকূপেও দেখা দেয়। এ নিয়ে অনেক বিতর্কও হয়েছে। তবে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা একমত যে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার সীমিত না করলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে কৃষি মন্ত্রণালয় খসড়া জাতীয় কৃষিনীতিতে ভূ-উপরিস্থ সেচের এলাকা বৃদ্ধির কৌশলের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। একই সঙ্গে বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমনের চাষ বৃদ্ধি করার কৌশল চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ যেসব এলাকা এই দুই ধরনের ধান চাষের উপযোগী অথচ যেখানে বোরো চাষ করা হয়, সেসব এলাকায় আউশ ও আমন ধান চাষ করার কৌশল অবলম্বনের নীতি গ্রহণ করেছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও এ কৌশলের প্রতিফলন দেখা যায়। তবে এটা বলা যত সহজ, বাস্তবায়ন তত সহজ হবে না বলে অনেকেই মনে করেন।
এ কৌশল বাস্তবায়নের জন্য কিছু প্রযুক্তিসহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। এর মধ্যে একটি হলো- খরাসহিষ্ণু এবং অপেক্ষাকৃত কম সময়ের প্রয়োজন হয় এমন উচ্চ ফলনশীল আমন ধানবীজের ব্যবস্থা। ইরির সহযোগিতায় ব্রি এ ধরনের দুটি বীজ উদ্ভাবন করেছে। নাম ব্রি ধান-৫৬ ও ৫৭। অনুরূপ আমন বীজ অন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও উদ্ভাবন করেছে। নাম বিইউ-৪। এসব বীজ বৃহত্তর রংপুর জেলায় কৃষকরা ব্যবহার করছেন মর্মে জানা গেছে।
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণসহিষ্ণু আমন বীজেরও প্রচলন হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্য একটি প্রযুক্তিও এ অঞ্চলে ব্যবহার করা হয়। প্রচলিত নাম গুটি ইউরিয়া। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে হেক্টরপ্রতি ১৫-২০ শতাংশ অধিক ফলন হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন- টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, কুমিল্লা ও যশোর। এ প্রযুক্তির অন্য সুফলও রয়েছে। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে প্রচলিত প্রথায় যে পরিমাণ ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়, তার তুলনায় কম ইউরিয়া ব্যবহার করা সম্ভব। এ প্রযুক্তির ব্যবহার পরিবেশদূষণ রোধে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। অপেক্ষাকৃত কম ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে সরকার প্রদত্ত ভর্তুকি ব্যয়ও হ্রাস পায়। সার্বিক দৃষ্টিকোণে বিচার করলে বলা যায়, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে যেসব অঞ্চলের জমিতে বিদ্যমান প্রযুক্তি ব্যবহার সম্ভব হয়, সেসব অঞ্চলে উলি্লখিত প্রযুক্তি ব্যবহার সম্প্রসারণ করা হলে তা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সুফল বয়ে আনবে।
সেচব্যবস্থার ক্ষেত্রেও কম পানি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনের ক্ষতি হয় না। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে ধান চাষে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রেও পানি ব্যবহারে যথাযথ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপচয় হ্রাস করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মতপ্রকাশ করেছেন। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিটি পালাক্রমে পানি ব্যবহার বলে পরিচিত। ইংরেজি নাম Alternate Water and Drying (AWD)। চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অধিক খাদ্য উৎপাদনের কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। AWD প্রযুক্তির ব্যবহার এখনো সীমিত। মাঠ পর্যায়ে এর ব্যবহার পরীক্ষার ভিত্তিতে এ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
বিদ্যুৎ-পরিচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহারের জন্য আসন্ন বোরো মৌসুমে ২৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন। এ চাহিদা পূরণে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র থেকে চড়া দামে পিডিবিকে বিদ্যুৎ ক্রয় করতে হবে। এতে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ১৯ নভেম্বর প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত এ খাতে বেসরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া পাওনা ১৯০০ কোটি টাকা। এ অর্থ পিডিবি সরকারকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। অন্যদিকে গ্যাস সরবরাহ ঘাটতির কারণে অন্তত ৭০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন উৎপাদন বন্ধ করেছে। এরা এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করত বলে জানা যায়। সব মিলিয়ে বলা যায়, বিদ্যমান সেচযন্ত্রে নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে কি না, সেটাই ভাবার বিষয়।
সাম্প্রতিককালে সরকার উপলব্ধি করেছে, ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ বৃদ্ধি সাময়িকভাবে সম্ভব হলেও এর ব্যয় মেটানো বেশি দিন সম্ভব নয়। বকেয়া মেটালেও ভবিষ্যতের জন্য ক্রমাগত এ বিশাল ব্যয়ভার বহন করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব। মার্চ থেকে মে-জুন পর্যন্ত দেশে তাপমাত্রা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে সেচের পানির চাহিদাও বাড়বে। শহরাঞ্চলেও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাবে। তখন কী হবে? লোডশেডিং বৃদ্ধি পাবে।
নভেম্বর, ২০১২
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
তবে কিছু আশঙ্কার বিষয় একেবারেই অগ্রাহ্য করা যায় না। যদি বিদ্যুৎ ঘাটতি বৃদ্ধি পায়, তাহলে ইতিমধ্যে সংযোগকৃত বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট কৃষকরা ডিজেলই ব্যবহার করে সেচের ব্যবস্থা করবেন। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি যত যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, কৃষকরা যে নিরাশ হবেন সে বিষয়টিও স্পষ্ট। জানা মতে, সেচযন্ত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহে সময় সময় ঘাটতি হলেও ডিজেল সরবরাহে কোনো ঘাটতি হয়নি। এ কারণে এখনো বেশির ভাগ কৃষক ডিজেল ব্যবহারে আগ্রহী। অতীতে দুই বছর কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের জন্য সরকার ডিজেলে ভর্তুকি দিয়েছিল। গত বছর দেওয়া হয়নি। এ বছর কী হবে তা অনিশ্চিত। ২৭ হাজার কৃষক নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের আবেদন কেন করেছে? বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য। জানা যায়, বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য প্রাথমিক খরচ ডিজেলের তুলনায় বেশি হলেও পরিচালনব্যয় বেশি হয় না। এ কারণে হয়তো অপেক্ষাকৃত সচ্ছল কৃষকরা বিদ্যুৎ ব্যবহার পছন্দ করেন। আসন্ন বোরো মৌসুমে যাতে বিদ্যমান বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক থাকে, সে বিষয়টি নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রয়োজন। ১৪ নভেম্বরের এক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনসহ সংস্থা পর্যায়েও কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ জাতীয় কৃষিনীতি (১৯৯৯) মোতাবেক কেন্দ্রীয় ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। এসব কমিটি সক্রিয় রাখাই হবে প্রধান দায়িত্ব।
বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশেরও বেশি জমিতে ধান চাষ হয়- আউশ, আমন ও বোরো। প্রথম দুটি বৃষ্টিনির্ভর। একমাত্র বোরোই সেচনির্ভর। কারণ এ ধানের চাষ শুকনো মৌসুমে হয়, যখন বৃষ্টির পানি আশা করা যায় না। তবে আমন ধানের জন্য কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে খরাপ্রবণ এলাকায় সম্পূরক চাষের প্রয়োজন হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দেশের প্রায় ২.৮ মিলিয়ন জমি খরাপ্রবণ এলাকায়। ওই সময় সম্পূরক সেচ দেওয়া সম্ভব হলে আমন ধানের ফলন প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ কারণে ১৯৯৮-৯৯ সময়কার সরকার সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করেছিল। তবে এর ফল সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ এর কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট কৃষিবিদদের ধারণা যে ফল ভালো হয়েছিল। এ ধরনের সম্পূরক সেচ আউশ ধানের জন্য ও এলাকাভেদে প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষ করে বৃষ্টির পরিমাণ যদি হ্রাস পায়। জলবায়ু পরিবর্তনের দৃষ্টিকোণে বলা যায় যে বৃষ্টি কম হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
তিন ধরনের ধানের মধ্যে ফলন ও এলাকা অনুযায়ী বোরো ধানই সর্বাধিক। এ কারণে যান্ত্রিক সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণের ফলে বোরো চাষের দিকেই কৃষকরা অধিকতর আগ্রহী। সাম্প্রতিককালে বিএআরসি জোনভিত্তিক শস্য চাষের একটি গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, আউশ ও আমন চাষ উপযোগী এলাকা বোরো চাষের আওতাধীন। কৃষকদের বোরো চাষে অধিক আগ্রহের আরো দুটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। এক. উচ্চ ফলনশীল বীজ বোরো ধানের জন্য সর্বাধিক। আউশ ও আমন ধানে তুলনামূলক কম। দুই. শুকনো মৌসুমে বন্যা হয় না। এ জন্য বোরো চাষ অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিহীন।
তবে সেচের ভবিষ্যৎ প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেচের পানি প্রধানত দুই উৎসে। এক. ভূ-উপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ। এই দুই উৎসের পানি সরবরাহের ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। বিষয়টি এখন প্রায় সর্বজনবিদিত। অন্তত প্রথম উৎস যে বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে তা প্রশ্নাতীত। দ্বিতীয় উৎস, অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ পানিও এখন সহজে পাওয়া সম্ভব নয়। ১৯৮২ সাল থেকেই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় এ আশঙ্কা দৃশ্যমান হয়। ওই সময় দেখা যায়, বহুসংখ্যক অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। কারণ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে গেছে। কৃষকরা তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও ওই সময় নিয়েছিলেন। তাঁরা গর্ত করে সেচযন্ত্র তিন থেকে পাঁচ ফুট নিচে বসিয়ে কিছু সেচের ব্যবস্থা করেছিলেন।
ক্রমশ এ সমস্যা গভীর নলকূপেও দেখা দেয়। এ নিয়ে অনেক বিতর্কও হয়েছে। তবে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা একমত যে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার সীমিত না করলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে কৃষি মন্ত্রণালয় খসড়া জাতীয় কৃষিনীতিতে ভূ-উপরিস্থ সেচের এলাকা বৃদ্ধির কৌশলের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। একই সঙ্গে বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমনের চাষ বৃদ্ধি করার কৌশল চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ যেসব এলাকা এই দুই ধরনের ধান চাষের উপযোগী অথচ যেখানে বোরো চাষ করা হয়, সেসব এলাকায় আউশ ও আমন ধান চাষ করার কৌশল অবলম্বনের নীতি গ্রহণ করেছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও এ কৌশলের প্রতিফলন দেখা যায়। তবে এটা বলা যত সহজ, বাস্তবায়ন তত সহজ হবে না বলে অনেকেই মনে করেন।
এ কৌশল বাস্তবায়নের জন্য কিছু প্রযুক্তিসহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। এর মধ্যে একটি হলো- খরাসহিষ্ণু এবং অপেক্ষাকৃত কম সময়ের প্রয়োজন হয় এমন উচ্চ ফলনশীল আমন ধানবীজের ব্যবস্থা। ইরির সহযোগিতায় ব্রি এ ধরনের দুটি বীজ উদ্ভাবন করেছে। নাম ব্রি ধান-৫৬ ও ৫৭। অনুরূপ আমন বীজ অন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও উদ্ভাবন করেছে। নাম বিইউ-৪। এসব বীজ বৃহত্তর রংপুর জেলায় কৃষকরা ব্যবহার করছেন মর্মে জানা গেছে।
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণসহিষ্ণু আমন বীজেরও প্রচলন হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্য একটি প্রযুক্তিও এ অঞ্চলে ব্যবহার করা হয়। প্রচলিত নাম গুটি ইউরিয়া। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে হেক্টরপ্রতি ১৫-২০ শতাংশ অধিক ফলন হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন- টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, কুমিল্লা ও যশোর। এ প্রযুক্তির অন্য সুফলও রয়েছে। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে প্রচলিত প্রথায় যে পরিমাণ ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়, তার তুলনায় কম ইউরিয়া ব্যবহার করা সম্ভব। এ প্রযুক্তির ব্যবহার পরিবেশদূষণ রোধে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। অপেক্ষাকৃত কম ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে সরকার প্রদত্ত ভর্তুকি ব্যয়ও হ্রাস পায়। সার্বিক দৃষ্টিকোণে বিচার করলে বলা যায়, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে যেসব অঞ্চলের জমিতে বিদ্যমান প্রযুক্তি ব্যবহার সম্ভব হয়, সেসব অঞ্চলে উলি্লখিত প্রযুক্তি ব্যবহার সম্প্রসারণ করা হলে তা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সুফল বয়ে আনবে।
সেচব্যবস্থার ক্ষেত্রেও কম পানি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনের ক্ষতি হয় না। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে ধান চাষে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রেও পানি ব্যবহারে যথাযথ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপচয় হ্রাস করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মতপ্রকাশ করেছেন। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিটি পালাক্রমে পানি ব্যবহার বলে পরিচিত। ইংরেজি নাম Alternate Water and Drying (AWD)। চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অধিক খাদ্য উৎপাদনের কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। AWD প্রযুক্তির ব্যবহার এখনো সীমিত। মাঠ পর্যায়ে এর ব্যবহার পরীক্ষার ভিত্তিতে এ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
বিদ্যুৎ-পরিচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহারের জন্য আসন্ন বোরো মৌসুমে ২৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন। এ চাহিদা পূরণে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র থেকে চড়া দামে পিডিবিকে বিদ্যুৎ ক্রয় করতে হবে। এতে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ১৯ নভেম্বর প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত এ খাতে বেসরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া পাওনা ১৯০০ কোটি টাকা। এ অর্থ পিডিবি সরকারকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। অন্যদিকে গ্যাস সরবরাহ ঘাটতির কারণে অন্তত ৭০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন উৎপাদন বন্ধ করেছে। এরা এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করত বলে জানা যায়। সব মিলিয়ে বলা যায়, বিদ্যমান সেচযন্ত্রে নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে কি না, সেটাই ভাবার বিষয়।
সাম্প্রতিককালে সরকার উপলব্ধি করেছে, ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ বৃদ্ধি সাময়িকভাবে সম্ভব হলেও এর ব্যয় মেটানো বেশি দিন সম্ভব নয়। বকেয়া মেটালেও ভবিষ্যতের জন্য ক্রমাগত এ বিশাল ব্যয়ভার বহন করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব। মার্চ থেকে মে-জুন পর্যন্ত দেশে তাপমাত্রা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে সেচের পানির চাহিদাও বাড়বে। শহরাঞ্চলেও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাবে। তখন কী হবে? লোডশেডিং বৃদ্ধি পাবে।
নভেম্বর, ২০১২
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments