সাক্ষাৎকার-শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা চাই by জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শেখ রোকন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) ১৯৯৯ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামীরা অস্ত্র সমর্পণ করে এবং সরকার ও জেএসএসের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭২ সালে গঠিত জেএসএসের সাধারণ সম্পাদক মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তার বড় ভাই। ১৯৭৩ সালে সংগঠনটির সামরিক শাখা 'শান্তিবাহিনী' গঠিত হলে সন্তু লারমা তাতে যুক্ত হন এবং ১৯৭৫ সালে আত্মগোপনে যান। ১৯৮২ সালে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মানবেন্দ্র লারমা নিহত হলে সন্তু লারমা হাল ধরেন এবং এক পর্যায়ে সভাপতি নির্বাচিত হন। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় সন্তু লারমা বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর আগে তিনি ১৯৫৯ সালে রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রামের স্যার আশুতোষ মহাবিদ্যালয় এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি কিছুদিন মহালছড়িতে স্কুলে শিক্ষকতা ও রাজনৈতিক সচেতনতামূলক কাজে জড়িত ছিলেন। জনাব লারমার জন্ম ১৯৪৪ সালে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার মহাপুরম এলাকায়
সমকাল :পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ১৫ বছর পার হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আপনাদের অসন্তোষ রয়েছে, আমরা জানি। আসলে কতখানি বাস্তবায়ন হয়েছে, বা হয়নি। সংক্ষেপে বলবেন?
সন্তু লারমা :বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। একেবারে অচলাবস্থা চলছে। নামমাত্র একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন হয়েছে; কিন্তু এটা অথর্ব। এই পরিষদের হাতে কোনো ক্ষমতা অর্পণ করা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী এখনও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সংবলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি। এই কাঠামোগুলোকে ক্ষমতায়নের পরিবর্তে অথর্ব করে রাখা হয়েছে। বরং পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো পরিণত হয়েছে দুর্নীতির আখড়া আর ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে। চুক্তিতে বর্ণিত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিধানটি বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অব্যাহতভাবে সমতল থেকে বহিরাগতরা এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ে তুলছে। তারা স্থায়ী অধিবাসীদের জায়গা-জমি দখল করছে। উন্নয়নের নামে বহিরাগত প্রভাবশালীদের কাছে ভূমি ইজারা, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণার নামে জুম্ম জনগোষ্ঠীর জায়গা-জমি দখল করে তাদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছে। ওদিকে উদ্বাস্তু জুম্ম জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন উদ্যোগ বর্তমানে সম্পূর্ণ বন্ধ। শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ পুনর্বাসন টাস্কফোর্স সম্পূর্ণ অকার্যকর। স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকা প্রণয়ন নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের সব চাকরিতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও প্রতিটি ক্ষেত্রে বহিরাগতদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩৩টি বিষয় ও এখতিয়ার হস্তান্তরের কথা থাকলেও মাত্র ১২টি চুক্তির মৌলিক বিষয় এখনও বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমাধান এখনও জোরদার হয়নি।
সমকাল :বর্তমান সরকারই তো এর আগের মেয়াদে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে উদ্যোগী হয়েছিল। প্রথম দফায় হয়তো কিছু জটিলতা থাকতে পারে। এই মেয়াদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও কি চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়নি?
সন্তু লারমা : না, হয়নি। বর্তমান সরকার আগের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে কেবল চুক্তিই স্বাক্ষর করেনি; আপনি জানেন হয়তো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও অঙ্গীকার করা হয়েছিল যে, শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু গত চার বছরে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মৌলিক কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। একের পর এক প্রতিশ্রুতি মিলেছে; কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ দেখিনি আমরা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা এই বুলি আউড়ে চলছেন যে, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক। কিন্তু আন্তরিকতার কোনো প্রমাণ আপনি দেখাতে পারবেন না। গত ১৭ নভেম্বর বান্দরবান সফরের সময়, এর আগে জুলাই মাসে রাঙামাটিতে হেডম্যান সম্মেলন চলাকালে এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী চুক্তিটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জনসংহতি সমিতি সবসময়ই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে চলছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি দেখছি না আমরা।
সমকাল : পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে কিছু কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার তো সরকার হস্তান্তর করেছে। অতিসম্প্রতিও কয়েকটি বিষয় হস্তান্তর করা হয়েছে।
সন্তু লারমা : আমি মনে করি, ১৫ বছর ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্ব জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, মাধ্যমিক শিক্ষা, সাধারণ বন, পরিবেশ, পর্যটন, জন্ম-মৃত্যুর পরিসংখ্যান, জুমচাষ_ কিছুই হস্তান্তর করা হয়নি। সর্বশেষ গত ৮ নভেম্বর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অধীন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, বিএডিসি, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের খাগড়াছড়ি কার্যালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের অধীনে রামগড় মৎস্য হ্যাচারি ও সমাজকল্যাণ বিভাগের অধীন সরকারি শিশু সদন হস্তান্তর করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের মূল এখতিয়ার অনেক আগেই পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রতিষ্ঠানের সব কিছুর এখতিয়ার হস্তান্তর হওয়ার কথা। যেমন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সবকিছুই হস্তান্তর হওয়ার কথা। আলাদা করে রামগড় হ্যাচারি হস্তান্তরের মানে কী? অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এগুলোকে এমনভাবে ঘটা করে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়েছে, দেখে মনে হবে নতুন কোনো অধিদফতর হস্তান্তর করা হলো। এগুলো আইওয়াশ ছাড়া আর কী? আমরা চাই চুক্তি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বস্তরের দফতর, প্রতিষ্ঠান, জনবল, পরিসম্পদ, অর্থসহ সব কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার হস্তান্তর করতে হবে।
সমকাল :বর্তমান সরকার তো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করেছে। আরও কিছু শীর্ষ পদে আদিবাসী জনবল নিয়োগ করেছে। এগুলো কি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নয়?
সন্তু লারমা : তারপর? আমরা স্বীকার করি, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করেছে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিয়োগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আদিবাসী সাংসদকে প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ, শরণার্থী পুনর্বাসন টাস্কফোর্স ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে আদিবাসী দু'জন সাংসদ নিয়োগ পেয়েছেন। ওই পর্যন্তই। তারা শুধু সভা করেন। আপনি দেখবেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধনে চার বছর ধরে একের পর এক সভাই হচ্ছে। কাজ হচ্ছে না, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।
সমকাল :বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে কী কারণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
সন্তু লারমা :চুক্তি বাস্তবায়নে দেশের নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছার অভাব ছাড়া আমি তো আর কিছু দেখি না। সরকার আন্তরিক হলে চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা কোথায়? এর সঙ্গে রয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। বাস্তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও চুক্তির আগের দিনগুলোর মতো সেনা কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। এখনও সেখানে ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষণ-নিপীড়ন চলছে। অপারেশন উত্তরণের ছত্রছায়ায় জুম্মবিরোধী হামলা ও হয়রানি চলছে। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত পাঁচটি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে সব অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু পাঁচ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে মাত্র ৬৬টি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সমকাল :পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ও কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় সেনা ক্যাম্পগুলো থাকা দরকার বলে কেউ কেউ মনে করেন।
সন্তু লারমা :কিসের নিরাপত্তা? কার জন্য নিরাপত্তা? শান্তিবাহিনী তো অস্ত্র জমা দিয়েছে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আরও পুলিশ তো আছে। এখানে এই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সমতলে কি তাহলে নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই? সমতল অঞ্চলের কি কৌশলগত গুরুত্ব নেই? সেখানে সেনা ক্যাম্প নেই কেন? আমি মনে করি, শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নই হচ্ছে নিরাপত্তার প্রধান চাবিকাঠি। আর সেনা ক্যাম্প রেখে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
সমকাল :এমন ধারণাও তো রয়েছে যে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদের কারণে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়নে যথেষ্ট চাপ তৈরি হচ্ছে না।
সন্তু লারমা : বিভিন্ন দল, বিভিন্ন মত তো থাকবেই! এর সঙ্গে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের সম্পর্ক কী? আমি যদি প্রশ্ন তুলি, বাঙালি জনগোষ্ঠী কেন একটি দল গঠন করছে না? তাদের মধ্যে কেন এত দল? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন দল থাকতেই পারে।
সমকাল :বিশেষভাবে ইউপিডিএফের কথা বলছি। তাদের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির বিরোধের সুযোগ নিচ্ছে কি-না শাসক গোষ্ঠী? জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার আদায় সহজ হয় না?
সন্তু লারমা : ইউপিডিএফ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মাত্র। একটি কায়েমি স্বার্থবাদী প্রভাবশালী মহল থেকে ইউপিডিএফ নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অবাধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তারা আসলে শান্তিচুক্তিবিরোধী গোষ্ঠীর ক্রীড়নক। আর তাদের সঙ্গে ঐক্য কীভাবে সম্ভব? গত ১৫ বছরে তারা জনসংহতি সমিতির ৮৬ জন সদস্যসহ তিন শতাধিক সাধারণ নাগরিককে হত্যা করেছে। তাদের সঙ্গে ঐক্য প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে আমি আপনাকে প্রশ্ন করি_ বর্তমান সরকার কি জেএমবির সঙ্গে ঐক্য করতে পারে?
সমকাল : জাতীয় সংসদে জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিত্ব থাকলে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন দ্রততর হতে পারত কি?
সন্তু লারমা :শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন তো করবে সরকার। জনসংহতি সমিতির কয়েকজন সংসদ সদস্য বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সামনে কী করবে? আমাদের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তো ১৯৭২ সালে একা আদিবাসীদের অধিকারের প্রশ্নে সংসদে অনেক যুক্তি-তর্ক দেখিয়েছেন, তাতে কী হয়েছে? আমরা মনে করি, সরকারের সদিচ্ছা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।
সমকাল : আপনারা বলছেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক নয়; তাহলে এখন পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
সন্তু লারমা : আমি আবারও বলতে চাই, শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকারকেই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে অনেক সময় চলে গেছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী গত ১৫ বছর আন্তরিকতা দেখিয়েছে, সহযোগিতা করেছে, ধৈর্য ধরেছে। আর কতদিন এভাবে অন্যায় কালক্ষেপণ মেনে নেব আমরা? দ্রুততম সময়ের মধ্যে চুক্তির সব ধারা বাস্তবায়ন করা দরকার। আমি তো মনে করি, এই সরকারের মেয়াদেই সেটা সম্ভব। অন্যথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আবারও অশান্ত ও জটিল হয়ে পড়তে পারে। সেটা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।
সমকাল : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সন্তু লারমা : সমকালের জন্য শুভেচ্ছা।
সমকাল :পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ১৫ বছর পার হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আপনাদের অসন্তোষ রয়েছে, আমরা জানি। আসলে কতখানি বাস্তবায়ন হয়েছে, বা হয়নি। সংক্ষেপে বলবেন?
সন্তু লারমা :বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। একেবারে অচলাবস্থা চলছে। নামমাত্র একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন হয়েছে; কিন্তু এটা অথর্ব। এই পরিষদের হাতে কোনো ক্ষমতা অর্পণ করা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী এখনও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সংবলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি। এই কাঠামোগুলোকে ক্ষমতায়নের পরিবর্তে অথর্ব করে রাখা হয়েছে। বরং পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো পরিণত হয়েছে দুর্নীতির আখড়া আর ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে। চুক্তিতে বর্ণিত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিধানটি বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অব্যাহতভাবে সমতল থেকে বহিরাগতরা এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ে তুলছে। তারা স্থায়ী অধিবাসীদের জায়গা-জমি দখল করছে। উন্নয়নের নামে বহিরাগত প্রভাবশালীদের কাছে ভূমি ইজারা, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণার নামে জুম্ম জনগোষ্ঠীর জায়গা-জমি দখল করে তাদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছে। ওদিকে উদ্বাস্তু জুম্ম জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন উদ্যোগ বর্তমানে সম্পূর্ণ বন্ধ। শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ পুনর্বাসন টাস্কফোর্স সম্পূর্ণ অকার্যকর। স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকা প্রণয়ন নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের সব চাকরিতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও প্রতিটি ক্ষেত্রে বহিরাগতদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩৩টি বিষয় ও এখতিয়ার হস্তান্তরের কথা থাকলেও মাত্র ১২টি চুক্তির মৌলিক বিষয় এখনও বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমাধান এখনও জোরদার হয়নি।
সমকাল :বর্তমান সরকারই তো এর আগের মেয়াদে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে উদ্যোগী হয়েছিল। প্রথম দফায় হয়তো কিছু জটিলতা থাকতে পারে। এই মেয়াদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও কি চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়নি?
সন্তু লারমা : না, হয়নি। বর্তমান সরকার আগের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে কেবল চুক্তিই স্বাক্ষর করেনি; আপনি জানেন হয়তো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও অঙ্গীকার করা হয়েছিল যে, শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু গত চার বছরে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মৌলিক কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। একের পর এক প্রতিশ্রুতি মিলেছে; কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ দেখিনি আমরা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা এই বুলি আউড়ে চলছেন যে, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক। কিন্তু আন্তরিকতার কোনো প্রমাণ আপনি দেখাতে পারবেন না। গত ১৭ নভেম্বর বান্দরবান সফরের সময়, এর আগে জুলাই মাসে রাঙামাটিতে হেডম্যান সম্মেলন চলাকালে এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী চুক্তিটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জনসংহতি সমিতি সবসময়ই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে চলছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি দেখছি না আমরা।
সমকাল : পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে কিছু কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার তো সরকার হস্তান্তর করেছে। অতিসম্প্রতিও কয়েকটি বিষয় হস্তান্তর করা হয়েছে।
সন্তু লারমা : আমি মনে করি, ১৫ বছর ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্ব জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, মাধ্যমিক শিক্ষা, সাধারণ বন, পরিবেশ, পর্যটন, জন্ম-মৃত্যুর পরিসংখ্যান, জুমচাষ_ কিছুই হস্তান্তর করা হয়নি। সর্বশেষ গত ৮ নভেম্বর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অধীন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, বিএডিসি, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের খাগড়াছড়ি কার্যালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের অধীনে রামগড় মৎস্য হ্যাচারি ও সমাজকল্যাণ বিভাগের অধীন সরকারি শিশু সদন হস্তান্তর করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের মূল এখতিয়ার অনেক আগেই পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রতিষ্ঠানের সব কিছুর এখতিয়ার হস্তান্তর হওয়ার কথা। যেমন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সবকিছুই হস্তান্তর হওয়ার কথা। আলাদা করে রামগড় হ্যাচারি হস্তান্তরের মানে কী? অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এগুলোকে এমনভাবে ঘটা করে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়েছে, দেখে মনে হবে নতুন কোনো অধিদফতর হস্তান্তর করা হলো। এগুলো আইওয়াশ ছাড়া আর কী? আমরা চাই চুক্তি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বস্তরের দফতর, প্রতিষ্ঠান, জনবল, পরিসম্পদ, অর্থসহ সব কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার হস্তান্তর করতে হবে।
সমকাল :বর্তমান সরকার তো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করেছে। আরও কিছু শীর্ষ পদে আদিবাসী জনবল নিয়োগ করেছে। এগুলো কি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নয়?
সন্তু লারমা : তারপর? আমরা স্বীকার করি, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করেছে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিয়োগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আদিবাসী সাংসদকে প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ, শরণার্থী পুনর্বাসন টাস্কফোর্স ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে আদিবাসী দু'জন সাংসদ নিয়োগ পেয়েছেন। ওই পর্যন্তই। তারা শুধু সভা করেন। আপনি দেখবেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধনে চার বছর ধরে একের পর এক সভাই হচ্ছে। কাজ হচ্ছে না, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।
সমকাল :বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে কী কারণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
সন্তু লারমা :চুক্তি বাস্তবায়নে দেশের নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছার অভাব ছাড়া আমি তো আর কিছু দেখি না। সরকার আন্তরিক হলে চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা কোথায়? এর সঙ্গে রয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। বাস্তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও চুক্তির আগের দিনগুলোর মতো সেনা কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। এখনও সেখানে ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষণ-নিপীড়ন চলছে। অপারেশন উত্তরণের ছত্রছায়ায় জুম্মবিরোধী হামলা ও হয়রানি চলছে। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত পাঁচটি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে সব অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু পাঁচ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে মাত্র ৬৬টি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সমকাল :পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ও কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় সেনা ক্যাম্পগুলো থাকা দরকার বলে কেউ কেউ মনে করেন।
সন্তু লারমা :কিসের নিরাপত্তা? কার জন্য নিরাপত্তা? শান্তিবাহিনী তো অস্ত্র জমা দিয়েছে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আরও পুলিশ তো আছে। এখানে এই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সমতলে কি তাহলে নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই? সমতল অঞ্চলের কি কৌশলগত গুরুত্ব নেই? সেখানে সেনা ক্যাম্প নেই কেন? আমি মনে করি, শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নই হচ্ছে নিরাপত্তার প্রধান চাবিকাঠি। আর সেনা ক্যাম্প রেখে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
সমকাল :এমন ধারণাও তো রয়েছে যে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদের কারণে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়নে যথেষ্ট চাপ তৈরি হচ্ছে না।
সন্তু লারমা : বিভিন্ন দল, বিভিন্ন মত তো থাকবেই! এর সঙ্গে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের সম্পর্ক কী? আমি যদি প্রশ্ন তুলি, বাঙালি জনগোষ্ঠী কেন একটি দল গঠন করছে না? তাদের মধ্যে কেন এত দল? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন দল থাকতেই পারে।
সমকাল :বিশেষভাবে ইউপিডিএফের কথা বলছি। তাদের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির বিরোধের সুযোগ নিচ্ছে কি-না শাসক গোষ্ঠী? জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার আদায় সহজ হয় না?
সন্তু লারমা : ইউপিডিএফ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মাত্র। একটি কায়েমি স্বার্থবাদী প্রভাবশালী মহল থেকে ইউপিডিএফ নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অবাধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তারা আসলে শান্তিচুক্তিবিরোধী গোষ্ঠীর ক্রীড়নক। আর তাদের সঙ্গে ঐক্য কীভাবে সম্ভব? গত ১৫ বছরে তারা জনসংহতি সমিতির ৮৬ জন সদস্যসহ তিন শতাধিক সাধারণ নাগরিককে হত্যা করেছে। তাদের সঙ্গে ঐক্য প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে আমি আপনাকে প্রশ্ন করি_ বর্তমান সরকার কি জেএমবির সঙ্গে ঐক্য করতে পারে?
সমকাল : জাতীয় সংসদে জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিত্ব থাকলে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন দ্রততর হতে পারত কি?
সন্তু লারমা :শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন তো করবে সরকার। জনসংহতি সমিতির কয়েকজন সংসদ সদস্য বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সামনে কী করবে? আমাদের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তো ১৯৭২ সালে একা আদিবাসীদের অধিকারের প্রশ্নে সংসদে অনেক যুক্তি-তর্ক দেখিয়েছেন, তাতে কী হয়েছে? আমরা মনে করি, সরকারের সদিচ্ছা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।
সমকাল : আপনারা বলছেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক নয়; তাহলে এখন পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
সন্তু লারমা : আমি আবারও বলতে চাই, শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকারকেই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে অনেক সময় চলে গেছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী গত ১৫ বছর আন্তরিকতা দেখিয়েছে, সহযোগিতা করেছে, ধৈর্য ধরেছে। আর কতদিন এভাবে অন্যায় কালক্ষেপণ মেনে নেব আমরা? দ্রুততম সময়ের মধ্যে চুক্তির সব ধারা বাস্তবায়ন করা দরকার। আমি তো মনে করি, এই সরকারের মেয়াদেই সেটা সম্ভব। অন্যথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আবারও অশান্ত ও জটিল হয়ে পড়তে পারে। সেটা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।
সমকাল : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সন্তু লারমা : সমকালের জন্য শুভেচ্ছা।
No comments