পার্বত্য শান্তিচুক্তির ১৫ বছর-প্রধান শর্ত ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি অন্ধকারেই by বিপ্লব রহমান
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে ১৫ বছর আগে শান্তিচুক্তি করা হলেও চুক্তির প্রধান শর্ত পাহাড়ে জায়গাজমির বিরোধ নিষ্পত্তির তেমন কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। ভূমির বিরোধ মেটাতে ১৩ বছর আগে পার্বত্য ভূমি কমিশন গঠন করা হলেও এটি নিষ্ক্রিয় শুরু থেকেই।
প্রণয়ন করা হয়নি ভূমি কমিশনের বিধিমালা। এতে বেআইনিভাবে ভূমির ইজারা ও বন্দোবস্ত দেওয়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। পার্বত্য বিশ্লেষকরা বলছেন, সব মিলিয়ে দিন দিন অস্থিতিশীল হচ্ছে পাহাড়ের পরিস্থিতি। জায়গাজমির বিরোধকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতও বাড়ছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রশাসনিক ভূমিকার অভাবে বহু পাহাড়ি এবং সেখানে দীর্ঘদিন বসবাসকারী অনেক বাঙালির জমির ওপর আইনি দখলিস্বত্ব এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সংকটের অন্যতম কারণ এটিই। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত অন্তত ১৫টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। আদিবাসী পাহাড়িরাই এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিহত হয়েছে অন্তত ১০ পাহাড়ি; ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৬ পাহাড়ি নারী। পাহাড়ি ও বাঙালির আট শরও বেশি ঘরবাড়ি হিংসার অনলে ছাই হয়েছে। আহত ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে অনেক।
পাহাড়ের একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের আগস্টে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পাহাড়ে প্রায় ১২ হাজার একর জমি বেআইনিভাবে ইজারা ও বন্দোবস্ত দেওয়ার ঘটনা শনাক্ত করে।
একই বছর সেপ্টেম্বরে বান্দরবানে প্রায় সাড়ে আট হাজার একর এ ধরনের জমির ইজারা ও বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়। এর পরেও বেআইনিভাবে পাহাড় ও টিলার ইজারা এবং বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, শান্তিচুক্তির ৪ নম্বর শর্তানুযায়ী, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান করে ১৯৯৯ সালের ৩ জুন গঠন করা হয় ৯ সদস্যের পার্বত্য ভূমি কমিশন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেল চিফ (রাজা), পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান অথবা তাঁর একজন প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অথবা একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার এবং বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের তিন চেয়ারম্যান। কিন্তু কমিশন এখনো আইনি সীমাবদ্ধতা, অর্থ ও লোকবল সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দফায় দফায় কমিশনের কাঠামোর রদবদল হয়েছে মাত্র। সবশেষে পাহাড়ি নেতাদের মতামত ছাড়াই ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে গঠিত হয় নতুন ভূমি কমিশন। তিনি শান্তিচুক্তিকে পাশ কাটিয়ে সেখানে ভূমি জরিপ করার উদ্যোগ নিলে প্রবল রাজনৈতিক বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এ বছর ১৮ জুলাই তাঁর মেয়াদ শেষ হলেও নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভূমির বিরোধ দিন দিন বাড়তে থাকায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতও বাড়ছে। গত ১২-১৩ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি সদরে সন্ত্রাসীরা পাহাড়িদের ১১টি দোকানপাট ও বাড়িঘরে ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনায় আহত হয় ১১৭ পাহাড়ি। এর আগে গত বছর ১৪ ডিসেম্বর জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে বাঘাইছড়ি-দীঘিনালায় হামলায় একজন পাহাড়ি নিহত ও ১০ আহত হয়। একই বছর ১৭ এপ্রিল রামগড়-মানিকছড়ির হামলায় দুজন পাহাড়ি খুন ও ২৫ জন আহত হয়। ভস্মীভূত হয় পাহাড়িদের ১১১টি ঘরবাড়ি। গত বছর লংগদুতে পাহাড়িদের ২৭টি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে আগুন দেওয়া হয় ৬১টি ঘরবাড়িতে। একই বছর ২৫ জানুয়ারি বাঘাইছড়ির বাঘাইহাটে নতুন করে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সহিংসতার জের ধরে পরদিন সেখানে বাঙালিদের সাতটি বাড়িতে অগি্নসংযোগ করা হয়। হামলার আশঙ্কায় ভাইভাইছড়া, এমএসপাড়া ও হাজাছড়ার তিনটি পাহাড়ি গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে। সেই বছর ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি বাঘাইহাটে হামলায় দুই পাহাড়ি খুন, ২৫ জন আহত এবং ৪৩৭টি ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়। এ সহিংসতার জের সেই সময় খাগড়াছড়ি সদরে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে এক বাঙালি খুন হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় পাহাড়িদের বেশ কিছু ঘরবাড়ি।
এ ছাড়া জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীরা বাঘাইছড়ির গঙ্গারামমুখের বাঘাইহাট নার্সারি এলাকায় সাতটি গ্রামে আগুন দিয়ে ১৩২টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এতে ধ্বংস হয় বাঙালিদের ৭৯টি এবং পাহাড়িদের ৫৩টি ঘরবাড়ি। ২০০৬ সালের ৩ এপ্রিল মাইসছড়িতে প্রায় ১০০ পাহাড়ির বাড়িঘর তছনছ ও লুটপাট হয়। ২০০৩ সালের ২৬ আগস্ট মহালছড়িতে সংঘাতে নিহত হয় দুজন পাহাড়ি; ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয় ১০ পাহাড়ি নারী। আহত হয় প্রায় ৫০ জন। এ ছাড়া ২০০৩ সালের ১৯ এপ্রিল ভুয়াছড়া, ২০০২ সালের ১০ অক্টোবর রাজভিলা, ২০০১ সালের ১৮ মে বোয়ালখালী ও মেরুং, একই বছর ২৫ জুন রামগড়, ১৯৯৯ সালের ১৬ অক্টোবর বাবুছড়া, ১৯৯৯ সালের ৪ এপ্রিল বাঘাইহাটে সহিংসতা হয়েছে। এর মধ্যে বাবুছড়ার সহিংসতায় তিন পাহাড়ি নিহত হয়। ধর্ষিত হয় এক পাহাড়ি নারী।
এসব বিষয়ে সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা কালের কণ্ঠকে বলেন, "বছরের পর বছর ধরে সরকারগুলো ভূমি কমিশনকে সক্রিয় করার প্রশ্নে শুধু কালক্ষেপণ করে চলেছে। ফলে জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে একের পর এক সংঘাতও বাড়ছে। তিনি বলেন, এ সরকারের আমলে 'পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০১১'-এর বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধনের জন্য একাধিক বৈঠক হয়েছে। সবশেষ আইনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গত ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভাতে আইনটির ১৩টি সংশোধনী আনার সিদ্ধান্ত হয়। এই সংশোধিত আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করার কথা। কিন্তু এখনো কোনো বিলই উত্থাপন করা হয়নি।"
তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'একটি আইন সংশোধনের করতে চার বছর ধরে আলোচনা করার পরও যদি তা সংশোধন করা সম্ভব না হয় তাহলে প্রশ্ন ওঠে, বর্তমান সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আদৌ কি আন্তরিক?'
এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার বলেছেন, ভূমি সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবিত সংশোধনী জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে তোলা হবে।
ভূমি কমিশনের সদস্য ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, কমিশনের যথাযথ আইনি ক্ষমতা ও লোকবল নেই। তাই এটি এখনো পাহাড়ি-বাঙালিদের ভূমির বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারছে না।
পার্বত্য বিশ্লেষক বিজয় কেতন চাকমা বলেন, শান্তিচুক্তির মৌলিক শর্তই হচ্ছে পার্বত্য ভূমি সমস্যার সমাধান। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি এবং ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল বলা হলেও নতুন করে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ফলে পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালিদের জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, শান্তিচুক্তির মৌলিক শর্তগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন করলেই ভূমি কমিশন ও শরণার্থী পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্স সক্রিয় করা সম্ভব। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন অভিযোগ করেন, সরকারের উদাসীনতার কারণে এত বছরেও পাহাড়ে ভূমি কমিশন সক্রিয় হয়নি।
এদিকে গত শুক্রবার জনসংহতি সমিতির এক সংবাদ সম্মেলনে ভূমি কমিশনকে সক্রিয় করার পাশাপাশি ১৩টি সংশোধনীসহ ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করার পাশাপাশি শান্তিচুক্তির ১২টি মৌলিক শর্ত বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর 'অপারেশন উত্তরণ' ও অস্থায়ী সেনা ছাউনি প্রত্যাহার, চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ ঘোষণা, সংবিধান সংশোধন করে 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর' বদলে 'আদিবাসী' অভিধা ব্যবহার, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে করা ভোটার তালিকায় আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান, জেলা পরিষদগুলোর কাছে পাহাড়ের ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলাসহ অন্যান্য বিষয় হস্তান্তর, অস্থানীয়দের কাছে দেওয়া জমির ইজারা ও বন্দোবস্ত বাতিল ইত্যাদি অন্যতম।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রশাসনিক ভূমিকার অভাবে বহু পাহাড়ি এবং সেখানে দীর্ঘদিন বসবাসকারী অনেক বাঙালির জমির ওপর আইনি দখলিস্বত্ব এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সংকটের অন্যতম কারণ এটিই। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত অন্তত ১৫টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। আদিবাসী পাহাড়িরাই এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিহত হয়েছে অন্তত ১০ পাহাড়ি; ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৬ পাহাড়ি নারী। পাহাড়ি ও বাঙালির আট শরও বেশি ঘরবাড়ি হিংসার অনলে ছাই হয়েছে। আহত ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে অনেক।
পাহাড়ের একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের আগস্টে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পাহাড়ে প্রায় ১২ হাজার একর জমি বেআইনিভাবে ইজারা ও বন্দোবস্ত দেওয়ার ঘটনা শনাক্ত করে।
একই বছর সেপ্টেম্বরে বান্দরবানে প্রায় সাড়ে আট হাজার একর এ ধরনের জমির ইজারা ও বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়। এর পরেও বেআইনিভাবে পাহাড় ও টিলার ইজারা এবং বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, শান্তিচুক্তির ৪ নম্বর শর্তানুযায়ী, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান করে ১৯৯৯ সালের ৩ জুন গঠন করা হয় ৯ সদস্যের পার্বত্য ভূমি কমিশন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেল চিফ (রাজা), পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান অথবা তাঁর একজন প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অথবা একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার এবং বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের তিন চেয়ারম্যান। কিন্তু কমিশন এখনো আইনি সীমাবদ্ধতা, অর্থ ও লোকবল সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দফায় দফায় কমিশনের কাঠামোর রদবদল হয়েছে মাত্র। সবশেষে পাহাড়ি নেতাদের মতামত ছাড়াই ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে গঠিত হয় নতুন ভূমি কমিশন। তিনি শান্তিচুক্তিকে পাশ কাটিয়ে সেখানে ভূমি জরিপ করার উদ্যোগ নিলে প্রবল রাজনৈতিক বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এ বছর ১৮ জুলাই তাঁর মেয়াদ শেষ হলেও নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভূমির বিরোধ দিন দিন বাড়তে থাকায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতও বাড়ছে। গত ১২-১৩ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি সদরে সন্ত্রাসীরা পাহাড়িদের ১১টি দোকানপাট ও বাড়িঘরে ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনায় আহত হয় ১১৭ পাহাড়ি। এর আগে গত বছর ১৪ ডিসেম্বর জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে বাঘাইছড়ি-দীঘিনালায় হামলায় একজন পাহাড়ি নিহত ও ১০ আহত হয়। একই বছর ১৭ এপ্রিল রামগড়-মানিকছড়ির হামলায় দুজন পাহাড়ি খুন ও ২৫ জন আহত হয়। ভস্মীভূত হয় পাহাড়িদের ১১১টি ঘরবাড়ি। গত বছর লংগদুতে পাহাড়িদের ২৭টি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে আগুন দেওয়া হয় ৬১টি ঘরবাড়িতে। একই বছর ২৫ জানুয়ারি বাঘাইছড়ির বাঘাইহাটে নতুন করে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সহিংসতার জের ধরে পরদিন সেখানে বাঙালিদের সাতটি বাড়িতে অগি্নসংযোগ করা হয়। হামলার আশঙ্কায় ভাইভাইছড়া, এমএসপাড়া ও হাজাছড়ার তিনটি পাহাড়ি গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে। সেই বছর ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি বাঘাইহাটে হামলায় দুই পাহাড়ি খুন, ২৫ জন আহত এবং ৪৩৭টি ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়। এ সহিংসতার জের সেই সময় খাগড়াছড়ি সদরে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে এক বাঙালি খুন হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় পাহাড়িদের বেশ কিছু ঘরবাড়ি।
এ ছাড়া জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীরা বাঘাইছড়ির গঙ্গারামমুখের বাঘাইহাট নার্সারি এলাকায় সাতটি গ্রামে আগুন দিয়ে ১৩২টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এতে ধ্বংস হয় বাঙালিদের ৭৯টি এবং পাহাড়িদের ৫৩টি ঘরবাড়ি। ২০০৬ সালের ৩ এপ্রিল মাইসছড়িতে প্রায় ১০০ পাহাড়ির বাড়িঘর তছনছ ও লুটপাট হয়। ২০০৩ সালের ২৬ আগস্ট মহালছড়িতে সংঘাতে নিহত হয় দুজন পাহাড়ি; ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয় ১০ পাহাড়ি নারী। আহত হয় প্রায় ৫০ জন। এ ছাড়া ২০০৩ সালের ১৯ এপ্রিল ভুয়াছড়া, ২০০২ সালের ১০ অক্টোবর রাজভিলা, ২০০১ সালের ১৮ মে বোয়ালখালী ও মেরুং, একই বছর ২৫ জুন রামগড়, ১৯৯৯ সালের ১৬ অক্টোবর বাবুছড়া, ১৯৯৯ সালের ৪ এপ্রিল বাঘাইহাটে সহিংসতা হয়েছে। এর মধ্যে বাবুছড়ার সহিংসতায় তিন পাহাড়ি নিহত হয়। ধর্ষিত হয় এক পাহাড়ি নারী।
এসব বিষয়ে সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা কালের কণ্ঠকে বলেন, "বছরের পর বছর ধরে সরকারগুলো ভূমি কমিশনকে সক্রিয় করার প্রশ্নে শুধু কালক্ষেপণ করে চলেছে। ফলে জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে একের পর এক সংঘাতও বাড়ছে। তিনি বলেন, এ সরকারের আমলে 'পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০১১'-এর বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধনের জন্য একাধিক বৈঠক হয়েছে। সবশেষ আইনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গত ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভাতে আইনটির ১৩টি সংশোধনী আনার সিদ্ধান্ত হয়। এই সংশোধিত আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করার কথা। কিন্তু এখনো কোনো বিলই উত্থাপন করা হয়নি।"
তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'একটি আইন সংশোধনের করতে চার বছর ধরে আলোচনা করার পরও যদি তা সংশোধন করা সম্ভব না হয় তাহলে প্রশ্ন ওঠে, বর্তমান সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আদৌ কি আন্তরিক?'
এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার বলেছেন, ভূমি সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবিত সংশোধনী জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে তোলা হবে।
ভূমি কমিশনের সদস্য ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, কমিশনের যথাযথ আইনি ক্ষমতা ও লোকবল নেই। তাই এটি এখনো পাহাড়ি-বাঙালিদের ভূমির বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারছে না।
পার্বত্য বিশ্লেষক বিজয় কেতন চাকমা বলেন, শান্তিচুক্তির মৌলিক শর্তই হচ্ছে পার্বত্য ভূমি সমস্যার সমাধান। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি এবং ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল বলা হলেও নতুন করে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ফলে পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালিদের জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, শান্তিচুক্তির মৌলিক শর্তগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন করলেই ভূমি কমিশন ও শরণার্থী পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্স সক্রিয় করা সম্ভব। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন অভিযোগ করেন, সরকারের উদাসীনতার কারণে এত বছরেও পাহাড়ে ভূমি কমিশন সক্রিয় হয়নি।
এদিকে গত শুক্রবার জনসংহতি সমিতির এক সংবাদ সম্মেলনে ভূমি কমিশনকে সক্রিয় করার পাশাপাশি ১৩টি সংশোধনীসহ ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করার পাশাপাশি শান্তিচুক্তির ১২টি মৌলিক শর্ত বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর 'অপারেশন উত্তরণ' ও অস্থায়ী সেনা ছাউনি প্রত্যাহার, চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ ঘোষণা, সংবিধান সংশোধন করে 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর' বদলে 'আদিবাসী' অভিধা ব্যবহার, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে করা ভোটার তালিকায় আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান, জেলা পরিষদগুলোর কাছে পাহাড়ের ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলাসহ অন্যান্য বিষয় হস্তান্তর, অস্থানীয়দের কাছে দেওয়া জমির ইজারা ও বন্দোবস্ত বাতিল ইত্যাদি অন্যতম।
No comments