বিশেষ লেখা-সরকারের কাজ ব্যবসা করা নয়, সুযোগ বৃদ্ধি by এফ আর চৌধুরী
আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বহু প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকায় বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এভাবে লোকসান দিতে দিতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এমন এক স্তরে গিয়ে পৌঁছে যে তার থেকে আর পুঁজি বের করে আনা সম্ভব নয়।
পরবর্তী সময় এসব প্রতিষ্ঠান সরকার তথা রাষ্ট্রের স্থায়ী বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু বেসরকারি খাত কর্মতৎপরতা, উৎসাহ, উদ্যোগের সুবাদে সুবিধাজনক স্থানে থাকে। এ কারণে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে বেশি। আরো একটি বিষয় এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। তা হলো টিকে থাকার লক্ষ্যে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের অদম্য স্পৃহা। ব্যবসায় ভালো করলে শেয়ারহোল্ডাররা লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন, কর্মচারীরা পান বোনাস। লাভ না হলে বা লোকসান দেখা দিলে ব্যবসা কৌশল খতিয়ে দেখা হয়, পুনর্গঠনের কথা ভাবা হয়। একটি কম্পানির অবকাঠামো যখন পুনর্বিন্যাস করা হয় তখন অনেক সময় কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি হারানোর আশঙ্কা অবশ্য থাকে। তার পরও ব্যবসা ঘুরে না দাঁড়ালে প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে ফেলা হয়। কারণ কোনো ব্যবসায়ী নিজের টাকায় বসে বসে দাতব্য ব্যয় করবেন না। এর বদলে তাঁরা তখন সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে, নতুন ব্যবসায় হাত দেবেন।
কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় সরকার নিজেই ব্যবসায় নামছে। এটা হয়ে থাকে সাধারণত বড় আকারের বিনিয়োগের বেলায়, যেখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঘাটতি থাকে। এমন একটি খাত হলো প্রতিরক্ষা শিল্প- যেখানে বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকার ভরসা রাখতে পারে না। এ ছাড়াও প্রায়ই দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জাতীয় এয়ারলাইনসের মালিকানা সরকারের হাতে থাকে এবং সরকারই এ ব্যবসা পরিচালনা করে। কোনো ক্ষেত্রে সরকার জাতীয় শিপিং লাইন চালু করারও উদ্যোগ নিয়ে থাকে। একই ব্যাপার ঘটে থাকে ইস্পাত, সার, তেল শোধন, জাহাজ নির্মাণ, তেল-গ্যাস উত্তোলন এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের মতো ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় সরকারকে অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হয়। একটি হলো, এসব শিল্পকে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের বাইরে রেখে সরকারকে সত্যিকার পেশাদার প্রকৃত পেশাদার লোকের হাতে সমর্পণ করা। দ্বিতীয়তটি হলো একমাত্র প্রতিরক্ষা শিল্প ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ না রাখা। এর ফলে তাদের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও সমানতালে এগিয়ে আসার সুযোগ পায়। বেশির ভাগ দেশেই টেলিযোগাযোগ সেবা একসময় সরকার পরিচালনা করত। প্রযুক্তির উৎকর্ষ, প্রতিযোগিতা ও উন্নত সেবার কথা বিবেচনা করে এখন এটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রায় সব দেশেই রেল যোগাযোগকে সরকারের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। এ খাতেও এখন পরিবর্তন আসছে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের কিছু দেশে রেলওয়েকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অবকাঠামো, রেলপথ, সিগন্যাল ব্যবস্থা এবং স্টেশনের সুবিধাদি হাতে রেখে সরকার তথা রাষ্ট্র রেলকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটি মাত্র রুট থেকে শুরু করে গোটা দেশের রেল চলাচল- সবই বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়ে থাকে।
বিশ্বের বহু দেশে বিমানবন্দর এবং নৌবন্দরও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি দেশই তার নিজস্ব সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং বেসরকারীকরণের ধরনের ওপর ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কোনো কোনো সরকার নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারগুলো (সমুদ্রবন্দরের ক্ষেত্রে ভিটিএস) নিজেদের হাতেই রেখে দেয়। নিরাপত্তার বিষয়টি কোনো ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য হলে রাষ্ট্রের হাতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভার থাকে।
বেসরকারীকরণ চলে অন্যভাবেও এবং সেটাকে সাধারণত বলা হয়ে থাকে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি। এই পার্টনারশিপ সাধারণত দেখা যায় সেতু ও টানেল তৈরির ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে কাজ করতে আগ্রহী কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার সমঝোতা করে থাকে। এসব ঠিকাদার প্রকল্প নির্মাণের অর্থ জোগাড় করে থাকে এবং তাদের বিনিয়োগের অর্থ উত্তোলনের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টোল আদায় করে (সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী) এবং সেটা শেষ হলে সরকারের হাতে হস্তান্তর করে।
আমি সম্প্রতি এ বিষয়ে মজার কিছু ঘটনা পড়েছি আমাদের পত্রিকাগুলোয়। চট্টগ্রাম থেকে পানগাঁও টার্মিনাল পর্যন্ত পরিবহনের জন্য জাহাজ নির্মাণে যে ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে তাদের কেউ একটি জাহাজ নির্মাণেরও উদ্যোগ নেইনি। বরং মোটা অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তির আশায় তারা লাইসেন্স বিক্রি করার চেষ্টা করেছে। অভিযোগ রয়েছে, জাহাজ নির্মাণের লাইসেন্স যাদেরকে দেওয়া হয়েছে তাদের কারোরই এ জাতীয় ব্যবসার অভিজ্ঞতা নেই। তারা লাইসেন্স পেয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায়। আমি বিস্মিত হয়েছি এ কারণে, এমন যে ঘটে থাকে সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না।
আর এ ধরনের সংবাদ জন্ম দিয়েছে বহু প্রশ্নের। আমি যতটা জানি বাণিজ্যিক অথবা অভ্যন্তরীণ শিপিং আইনে এ ধরনের লাইসেন্স দেওয়ার কোনো সুযোগ সরকারের নেই। আমি যতটা বুঝতে পারি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহন এবং যাত্রী পরিবহন শুধু বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজই পারে; আর এসব নৌযানের মালিকানা ও পরিচালনায় থাকেন বাংলাদেশীরা। এর বাইরে অন্য কোনো বাধ্যবাধকতা বা প্রতিবন্ধকতা আছে বলে আমার জানা নেই। অবশ্য এ ক্ষেত্রে পূরণ করতে হয় অভিন্ন কিছু শর্তাবলী- যেমন ফিটনেস সার্টিফিকেট, ব্যক্তির যোগ্যতা, দক্ষতা ও আইনগত বিষয়াদি।
আমরা এখন বিশ্বে একটি অবাধ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বসবাস করি, যাকে আমরা বলে থাকি মুক্তবাজার অর্থনীতি। এখানে কোনো ব্যক্তি বিদ্যমান আইনের অধীনে থাকলে এবং আইন মেনে চললে যেকোনো ব্যবসা করতে বা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। কেন তাহলে বিশেষ লাইসেন্সের প্রয়োজন পড়বে? যদি চট্টগ্রাম থেকে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও পর্যন্ত মালামাল পরিবহনের প্রয়োজন হয় তাহলে আমি নিশ্চিত যে, আমাদের দেশের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে এ সুযোগ দেওয়া হলে তারা নিজেরাই জাহাজ নামিয়ে দেবে। তাঁদের কাছে যথোপযুক্ত জাহাজ যদি নাও থাকে তারা বাইরে থেকে দ্রুত কিনে আনতে অথবা ভাড়া করতে পারবে। আর যেহেতু এখন বাংলাদেশেই জাহাজ নির্মাণের কারিগরি দক্ষতা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা যেমন জাহাজ প্রয়োজন সেই অনুসারে জাহাজ নির্মাণের অর্ডার দেবেন। এগুলো স্থায়ীভাবে ব্যবসার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। আমাদের নৌস্থপতি ও জাহাজ ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে ভালোমানের নকশা প্রণয়ন ও সে অনুযায়ী জাহাজ তৈরির দক্ষতা রাখেন। এখন শুধু দরকার বাজারকে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তিতে চলতে দেওয়া। আর দরকার হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণাটিতে প্রতিষ্ঠিত করা। কোনো কৃত্রিম চাহিদা ও বাধা হাজির করা চলবে না।
এ ছাড়া সংরক্ষণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিস্ময়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এই ব্যবসায়ও নিয়োজিত হতে আগ্রহী। তারা বলছে, জাহাজ কেনার মতো যথেষ্ট পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ তাদের রয়েছে এবং এ ধরনের ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার বিষয়টি তাদের বিধিবিধানও সমর্থন করে। আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, সরকার ভিন্ন ভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য থেকে। সরকারের সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন এবং অভ্যন্তরীণ খাতের জন্য বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) নামে দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআইডাব্লিউটিএ) নামে সরকারের আরো একটি কর্তৃপক্ষ রয়েছে যার কাজ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল ও বন্দর ব্যবস্থা পরিচালনা করা। এই বিআইটিএ জাহাজ ক্রয় ও পরিচালনা করবে এটা আমরা ভাবতেও পারি না। সমুদ্রবন্দরের কর্তৃপক্ষ হিসেবে সিপিএর পাইলট বোট, মুরিং বোট, টাগ, পানি ও তেলের বার্জ থাকা দরকার। সিপিএ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার জন্য উদ্ধারকারী দলও রাখতে পারে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পণ্য পরিবহনের কাজ কোনো বন্দর কর্তৃপক্ষ করতে পারে না। কেউ এমন করে বলে আমি আগে কখনো শুনিনি। আমরা যদি এটা করি তাহলে সবকিছু কুক্ষিগতকারী এবং একচেটিয়া ব্যবসাকারী হিসেবে বিশ্বে আমাদের দুর্নাম রটে যাবে। সাবেক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো যখন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিচ্ছে সেখানে আমরা উল্টা দিকে হাঁটতে পারি না। তাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে (সিপিএ) এই ব্যবসায় আসার অনুমতি দেওয়া সরকারের জন্য কিছুতেই উচিত হবে না। দিলে এক সময় অভিযোগ উঠবে সিপিএ নিজেদের নৌযানগুলোকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। সিপিএর মূল কাজ বন্দরের উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো এবং এ ক্ষেত্রে তাদের অনেক করণীয় বাকি আছে।
সরকারকে অবশ্যই বুঝতে হবে, এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ, অনুমতিদান ও লাইসেন্সের পথ ধরেই দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয় এবং সব তালগোল পাকিয়ে যায়। তাহলে কেন আমরা এমন লাইসেন্স দেব যার কোনো প্রয়োজনই নাই? ঊরং বাজারের চালিকাশক্তিই তার ভবিষ্যৎ পথ খুঁজে নেবে। এভাবে কৃত্রিম বাধা তৈরি করা বা লাইসেন্স দেওয়া আমাদের জন্য উচিত না এবং করলে সেটি অগণতান্ত্রিক বলে গণ্য হবে।
সে যা হোক, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই জাহাজ নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। তাই ৫ জিআরটি (গ্রস রেজিস্টার টনেজ) ধারণক্ষমতার কম জাহাজ আমদানি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে। এটি করা হলে আমাদের শিল্প খাত যেমন উপকৃত হবে, সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থানও। সরকার এটি নিশ্চিত করতে পারে যথোপযুক্ত বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে। অতীতে আমরা বাড়তি মূল্য দেখিয়ে বিদেশে অর্থ পাঠানোর কথা অনেক শুনেছি। ওপরের উদ্যোগ নেওয়া হলে অন্তত এই সুযোগটি বন্ধ হবে। আর কেবল দুর্নীতিবাজ সামরিক স্বৈরশাসকরাই লাইসেন্স ও পারমিটের মধ্য দিয়ে টাকা বানিয়ে থাকে। এ ধরনের অন্যায় কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকার করতে পারে না।
লেখক : ডেইলি সানের নিয়মিত কলামিস্ট। ইংরেজি থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
কিন্তু বেসরকারি খাত কর্মতৎপরতা, উৎসাহ, উদ্যোগের সুবাদে সুবিধাজনক স্থানে থাকে। এ কারণে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে বেশি। আরো একটি বিষয় এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। তা হলো টিকে থাকার লক্ষ্যে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের অদম্য স্পৃহা। ব্যবসায় ভালো করলে শেয়ারহোল্ডাররা লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন, কর্মচারীরা পান বোনাস। লাভ না হলে বা লোকসান দেখা দিলে ব্যবসা কৌশল খতিয়ে দেখা হয়, পুনর্গঠনের কথা ভাবা হয়। একটি কম্পানির অবকাঠামো যখন পুনর্বিন্যাস করা হয় তখন অনেক সময় কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি হারানোর আশঙ্কা অবশ্য থাকে। তার পরও ব্যবসা ঘুরে না দাঁড়ালে প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে ফেলা হয়। কারণ কোনো ব্যবসায়ী নিজের টাকায় বসে বসে দাতব্য ব্যয় করবেন না। এর বদলে তাঁরা তখন সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে, নতুন ব্যবসায় হাত দেবেন।
কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় সরকার নিজেই ব্যবসায় নামছে। এটা হয়ে থাকে সাধারণত বড় আকারের বিনিয়োগের বেলায়, যেখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঘাটতি থাকে। এমন একটি খাত হলো প্রতিরক্ষা শিল্প- যেখানে বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকার ভরসা রাখতে পারে না। এ ছাড়াও প্রায়ই দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জাতীয় এয়ারলাইনসের মালিকানা সরকারের হাতে থাকে এবং সরকারই এ ব্যবসা পরিচালনা করে। কোনো ক্ষেত্রে সরকার জাতীয় শিপিং লাইন চালু করারও উদ্যোগ নিয়ে থাকে। একই ব্যাপার ঘটে থাকে ইস্পাত, সার, তেল শোধন, জাহাজ নির্মাণ, তেল-গ্যাস উত্তোলন এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের মতো ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় সরকারকে অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হয়। একটি হলো, এসব শিল্পকে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের বাইরে রেখে সরকারকে সত্যিকার পেশাদার প্রকৃত পেশাদার লোকের হাতে সমর্পণ করা। দ্বিতীয়তটি হলো একমাত্র প্রতিরক্ষা শিল্প ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ না রাখা। এর ফলে তাদের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও সমানতালে এগিয়ে আসার সুযোগ পায়। বেশির ভাগ দেশেই টেলিযোগাযোগ সেবা একসময় সরকার পরিচালনা করত। প্রযুক্তির উৎকর্ষ, প্রতিযোগিতা ও উন্নত সেবার কথা বিবেচনা করে এখন এটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রায় সব দেশেই রেল যোগাযোগকে সরকারের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। এ খাতেও এখন পরিবর্তন আসছে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের কিছু দেশে রেলওয়েকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অবকাঠামো, রেলপথ, সিগন্যাল ব্যবস্থা এবং স্টেশনের সুবিধাদি হাতে রেখে সরকার তথা রাষ্ট্র রেলকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটি মাত্র রুট থেকে শুরু করে গোটা দেশের রেল চলাচল- সবই বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়ে থাকে।
বিশ্বের বহু দেশে বিমানবন্দর এবং নৌবন্দরও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি দেশই তার নিজস্ব সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং বেসরকারীকরণের ধরনের ওপর ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কোনো কোনো সরকার নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারগুলো (সমুদ্রবন্দরের ক্ষেত্রে ভিটিএস) নিজেদের হাতেই রেখে দেয়। নিরাপত্তার বিষয়টি কোনো ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য হলে রাষ্ট্রের হাতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভার থাকে।
বেসরকারীকরণ চলে অন্যভাবেও এবং সেটাকে সাধারণত বলা হয়ে থাকে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি। এই পার্টনারশিপ সাধারণত দেখা যায় সেতু ও টানেল তৈরির ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে কাজ করতে আগ্রহী কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার সমঝোতা করে থাকে। এসব ঠিকাদার প্রকল্প নির্মাণের অর্থ জোগাড় করে থাকে এবং তাদের বিনিয়োগের অর্থ উত্তোলনের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টোল আদায় করে (সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী) এবং সেটা শেষ হলে সরকারের হাতে হস্তান্তর করে।
আমি সম্প্রতি এ বিষয়ে মজার কিছু ঘটনা পড়েছি আমাদের পত্রিকাগুলোয়। চট্টগ্রাম থেকে পানগাঁও টার্মিনাল পর্যন্ত পরিবহনের জন্য জাহাজ নির্মাণে যে ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে তাদের কেউ একটি জাহাজ নির্মাণেরও উদ্যোগ নেইনি। বরং মোটা অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তির আশায় তারা লাইসেন্স বিক্রি করার চেষ্টা করেছে। অভিযোগ রয়েছে, জাহাজ নির্মাণের লাইসেন্স যাদেরকে দেওয়া হয়েছে তাদের কারোরই এ জাতীয় ব্যবসার অভিজ্ঞতা নেই। তারা লাইসেন্স পেয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায়। আমি বিস্মিত হয়েছি এ কারণে, এমন যে ঘটে থাকে সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না।
আর এ ধরনের সংবাদ জন্ম দিয়েছে বহু প্রশ্নের। আমি যতটা জানি বাণিজ্যিক অথবা অভ্যন্তরীণ শিপিং আইনে এ ধরনের লাইসেন্স দেওয়ার কোনো সুযোগ সরকারের নেই। আমি যতটা বুঝতে পারি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহন এবং যাত্রী পরিবহন শুধু বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজই পারে; আর এসব নৌযানের মালিকানা ও পরিচালনায় থাকেন বাংলাদেশীরা। এর বাইরে অন্য কোনো বাধ্যবাধকতা বা প্রতিবন্ধকতা আছে বলে আমার জানা নেই। অবশ্য এ ক্ষেত্রে পূরণ করতে হয় অভিন্ন কিছু শর্তাবলী- যেমন ফিটনেস সার্টিফিকেট, ব্যক্তির যোগ্যতা, দক্ষতা ও আইনগত বিষয়াদি।
আমরা এখন বিশ্বে একটি অবাধ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বসবাস করি, যাকে আমরা বলে থাকি মুক্তবাজার অর্থনীতি। এখানে কোনো ব্যক্তি বিদ্যমান আইনের অধীনে থাকলে এবং আইন মেনে চললে যেকোনো ব্যবসা করতে বা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। কেন তাহলে বিশেষ লাইসেন্সের প্রয়োজন পড়বে? যদি চট্টগ্রাম থেকে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও পর্যন্ত মালামাল পরিবহনের প্রয়োজন হয় তাহলে আমি নিশ্চিত যে, আমাদের দেশের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে এ সুযোগ দেওয়া হলে তারা নিজেরাই জাহাজ নামিয়ে দেবে। তাঁদের কাছে যথোপযুক্ত জাহাজ যদি নাও থাকে তারা বাইরে থেকে দ্রুত কিনে আনতে অথবা ভাড়া করতে পারবে। আর যেহেতু এখন বাংলাদেশেই জাহাজ নির্মাণের কারিগরি দক্ষতা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা যেমন জাহাজ প্রয়োজন সেই অনুসারে জাহাজ নির্মাণের অর্ডার দেবেন। এগুলো স্থায়ীভাবে ব্যবসার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। আমাদের নৌস্থপতি ও জাহাজ ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে ভালোমানের নকশা প্রণয়ন ও সে অনুযায়ী জাহাজ তৈরির দক্ষতা রাখেন। এখন শুধু দরকার বাজারকে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তিতে চলতে দেওয়া। আর দরকার হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণাটিতে প্রতিষ্ঠিত করা। কোনো কৃত্রিম চাহিদা ও বাধা হাজির করা চলবে না।
এ ছাড়া সংরক্ষণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিস্ময়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এই ব্যবসায়ও নিয়োজিত হতে আগ্রহী। তারা বলছে, জাহাজ কেনার মতো যথেষ্ট পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ তাদের রয়েছে এবং এ ধরনের ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার বিষয়টি তাদের বিধিবিধানও সমর্থন করে। আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, সরকার ভিন্ন ভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য থেকে। সরকারের সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন এবং অভ্যন্তরীণ খাতের জন্য বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) নামে দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআইডাব্লিউটিএ) নামে সরকারের আরো একটি কর্তৃপক্ষ রয়েছে যার কাজ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল ও বন্দর ব্যবস্থা পরিচালনা করা। এই বিআইটিএ জাহাজ ক্রয় ও পরিচালনা করবে এটা আমরা ভাবতেও পারি না। সমুদ্রবন্দরের কর্তৃপক্ষ হিসেবে সিপিএর পাইলট বোট, মুরিং বোট, টাগ, পানি ও তেলের বার্জ থাকা দরকার। সিপিএ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার জন্য উদ্ধারকারী দলও রাখতে পারে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পণ্য পরিবহনের কাজ কোনো বন্দর কর্তৃপক্ষ করতে পারে না। কেউ এমন করে বলে আমি আগে কখনো শুনিনি। আমরা যদি এটা করি তাহলে সবকিছু কুক্ষিগতকারী এবং একচেটিয়া ব্যবসাকারী হিসেবে বিশ্বে আমাদের দুর্নাম রটে যাবে। সাবেক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো যখন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিচ্ছে সেখানে আমরা উল্টা দিকে হাঁটতে পারি না। তাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে (সিপিএ) এই ব্যবসায় আসার অনুমতি দেওয়া সরকারের জন্য কিছুতেই উচিত হবে না। দিলে এক সময় অভিযোগ উঠবে সিপিএ নিজেদের নৌযানগুলোকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। সিপিএর মূল কাজ বন্দরের উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো এবং এ ক্ষেত্রে তাদের অনেক করণীয় বাকি আছে।
সরকারকে অবশ্যই বুঝতে হবে, এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ, অনুমতিদান ও লাইসেন্সের পথ ধরেই দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয় এবং সব তালগোল পাকিয়ে যায়। তাহলে কেন আমরা এমন লাইসেন্স দেব যার কোনো প্রয়োজনই নাই? ঊরং বাজারের চালিকাশক্তিই তার ভবিষ্যৎ পথ খুঁজে নেবে। এভাবে কৃত্রিম বাধা তৈরি করা বা লাইসেন্স দেওয়া আমাদের জন্য উচিত না এবং করলে সেটি অগণতান্ত্রিক বলে গণ্য হবে।
সে যা হোক, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই জাহাজ নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। তাই ৫ জিআরটি (গ্রস রেজিস্টার টনেজ) ধারণক্ষমতার কম জাহাজ আমদানি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে। এটি করা হলে আমাদের শিল্প খাত যেমন উপকৃত হবে, সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থানও। সরকার এটি নিশ্চিত করতে পারে যথোপযুক্ত বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে। অতীতে আমরা বাড়তি মূল্য দেখিয়ে বিদেশে অর্থ পাঠানোর কথা অনেক শুনেছি। ওপরের উদ্যোগ নেওয়া হলে অন্তত এই সুযোগটি বন্ধ হবে। আর কেবল দুর্নীতিবাজ সামরিক স্বৈরশাসকরাই লাইসেন্স ও পারমিটের মধ্য দিয়ে টাকা বানিয়ে থাকে। এ ধরনের অন্যায় কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকার করতে পারে না।
লেখক : ডেইলি সানের নিয়মিত কলামিস্ট। ইংরেজি থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
No comments