আমাদের পাথারিয়া ছোটলিখা স্কুল by আবু এন. এম. ওয়াহিদ
ঘড়িতে সকাল ১০টা বাজতেই পাথারিয়া ছোটলিখা হাইস্কুলের বারান্দার কাঠের বিমে ঝোলানো পিতলের ঘণ্টিতে হাতুড়ি মারতেন চৌকিদার শচীন্দ্র_ ঢং ঢং ঢং। বশির স্যারের বাঁশির সুরে দৌড়ে এসে লাইনে দাঁড়াতাম রোদের নিচে খোলা মাঠে অ্যাসেমবি্লতে।
লেফ্ট-রাইট, লেফ্ট-রাইট, কিছু শরীরচর্চা, জাতীয় সঙ্গীত, তারপর দিনের ওয়াদা। আবার হুইসেল বাজলে লাইন ধরে সুশৃঙ্খলভাবে সবাই ফিরে আসতাম নিজ নিজ ক্লাসে। ঘণ্টিতে শচীন্দ্রর হাতুড়িতে শুরু হতো ফার্স্ট পিরিয়ড। মঈন স্যার আবার আসতেন ইংরেজি পড়াতে।
তারপর আসতেন সৈয়দ সা'ব_ বেত হাতে। রুমে ঢুকে চেয়ারে বসার আগেই 'টুপি কোথায়?' বলে খালি মাথায় ঠক্ ঠ্ক করে বেত দিয়ে মারতেন একে একে। যদি কেউ বলত, 'স্যার আমি হিন্দু'। 'দেখে তো মুসলমানই মনে হয়।' সবশেষে আগের দিনের পড়া থেকে ছোট ছোট প্রশ্ন করতেন। না পারলে হাতের তালু মেলে ধরতে হতো। বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন মনিন্দ্র বাবু_ কোনো দিন চেয়ারে বসে কোনো দিন দাঁড়িয়ে পড়াতেন। মাঝে মধ্যে ফিজিক্স ল্যাব থেকে যন্ত্রপাতি এনে ক্লাসে এক্সপেরিমেন্ট করতেন। বাংলা পড়তাম বশির স্যারের কাছে। তার পড়া কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ক্লাসে বসে শুনতাম। পড়ানোর সময়, বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের অনেক প্রসঙ্গ টেনে আনতেন তিনি_ কিছু বুঝতাম, কিছু বুঝতাম না।
অঙ্ক শেখাতেন প্রমথ বাবু। জ্যামিতির ক্লাসে খালি হাতে যখন বল্গ্যাক বোর্ডে নিখুঁত বৃত্ত আঁকতেন, তখন অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতাম। সিভিল ডিফেন্সের ক্লাস নিতেন কাদির স্যার। মারার অভ্যাস ছিল না, তবে তির্যক ভাষা আর ধারালো কথার খোঁচা বেতের চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রণার। আবার রসবোধে হাসাতেনও। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র কাদির স্যারই ক্লাসে ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতেন। স্যারের কথা শুনে ভাবতাম, 'আমি কবে এভাবে ইংরেজি বলতে শিখব।' দিনের শেষের দিকে কাজী সা'ব আসতেন আরবি পড়াতে। স্যার এলে একজন হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতাম আর একজন স্যারের মাথার পাকা চুল বেছে দিতাম। কোনো দিন পড়াতেন, কোনো দিন বাতাস খেয়েই সময় শেষ। মাঝে মধ্যে আমরা কেচ্ছা বলার জন্য পীড়াপীড়ি করতাম। সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন পণ্ডিত সুধীর ভট্টাচার্য। মাঝে মধ্যে বাংলা ক্লাসে এসে প্রক্সি দিতেন। তিনি ছিলেন সহজ-সরল ও খোলা মনের মানুষ। কোনো সময় খুশি হলে, অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন। সে সময় পরীক্ষার খাতা সুই-সুতো দিয়ে সেলাই করা হতো। আমরা যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন প্রথম স্টু্কলে এলো স্টেপলার। পরীক্ষার হলে পণ্ডিত মশাই স্টেপলার দেখে বিস্ময়ে 'বিজ্ঞানের আশীর্বাদ' বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন।
লেখাপড়া ছাড়া আনন্দেরও অনেক ব্যবস্থা ছিল স্কুলে। প্রতি বছর স্কুলে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হতো। এ উপলক্ষে দিনব্যাপী চলত কবিতা আবৃত্তি, গান, নাটক ইত্যাদি। নাটক আর আবৃত্তির দায়িত্বে থাকতেন প্রমথ বাবু। আমি সব সময় আবৃত্তি করতাম। দু'একবার নাটকেও অভিনয় করেছি। গান শেখাতেন দ্বীগেন্দ্র বাবু। এ ধরনেরই এক অনুষ্ঠানে আমি প্রথম বাসু দেবের কণ্ঠে শুনেছিলাম, 'কে বিদেশি মন উদাসী...' গানটি। বড় হয়ে জেনেছি, গানটি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা।
স্টু্কলে হিন্দু ছাত্রছাত্রীরা করত সরস্বতী পূজা আর মুসলিমরা নবী (সাঃ)-এর জন্মদিন উপলক্ষে মিলাদ। মিলাদের আকর্ষণীয় দিক ছিল দরুদ ও মোনাজাতের পরে দুই গোলা ঘি আর চিনির রসে ভাজা ময়দার হালুয়া (সিলেটি ভাষায় তোশা শিনি্ন)। মিলাদে বক্তৃতা দিয়েছিলেন আব্বার বন্ধু ডা. আবদুশ শুকুর। তিনি বলেছিলেন, "পবিত্র কোরআনের প্রথম ওহির প্রথম শব্দ হলো 'ইকরা' অর্থাৎ 'পড়'। মুসলমানরা 'ইকরা' থেকে দূরে সরে গেছে বলেই আজ পেছনে পড়ে আছে। বিশ্বসভ্যতায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে মুসলমানদের 'ইকরা'কে শক্ত করে ধরতে হবে। আসুন আমরা 'ইকরা'র চর্চা করি।" কচি বয়সে তার কথাগুলো আমার মনে খুব লেগেছিল।
প্রতি মাসের ১৫ তারিখ ছিল স্কুলের টিউশন ফি কালেকশনের দিন। ওই দিন পড়ার বদলে ক্লাসটিচার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন তুলতেন ফার্স্ট পিরিয়ডে। ক্লসের শেষে হিসাব বুঝিয়ে দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো, কিন্তু অল্প বয়সে এক সঙ্গে দু'শ' তিনশ' টাকা ছোঁয়া এবং গোনার এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। হাফ টাইমের পরে নজর থাকত কখন শচীন্দ্র ঘণ্টায় মারেন ছুটির বাড়ি। স্কুলে ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীও ছিল জনাকয়েক। কিন্তু মেয়েদের কমনরুমের আশপাশে ঘোরাঘুরি করার বয়স তখনও হয়নি।
awahid@tnstate.edu
তারপর আসতেন সৈয়দ সা'ব_ বেত হাতে। রুমে ঢুকে চেয়ারে বসার আগেই 'টুপি কোথায়?' বলে খালি মাথায় ঠক্ ঠ্ক করে বেত দিয়ে মারতেন একে একে। যদি কেউ বলত, 'স্যার আমি হিন্দু'। 'দেখে তো মুসলমানই মনে হয়।' সবশেষে আগের দিনের পড়া থেকে ছোট ছোট প্রশ্ন করতেন। না পারলে হাতের তালু মেলে ধরতে হতো। বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন মনিন্দ্র বাবু_ কোনো দিন চেয়ারে বসে কোনো দিন দাঁড়িয়ে পড়াতেন। মাঝে মধ্যে ফিজিক্স ল্যাব থেকে যন্ত্রপাতি এনে ক্লাসে এক্সপেরিমেন্ট করতেন। বাংলা পড়তাম বশির স্যারের কাছে। তার পড়া কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ক্লাসে বসে শুনতাম। পড়ানোর সময়, বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের অনেক প্রসঙ্গ টেনে আনতেন তিনি_ কিছু বুঝতাম, কিছু বুঝতাম না।
অঙ্ক শেখাতেন প্রমথ বাবু। জ্যামিতির ক্লাসে খালি হাতে যখন বল্গ্যাক বোর্ডে নিখুঁত বৃত্ত আঁকতেন, তখন অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতাম। সিভিল ডিফেন্সের ক্লাস নিতেন কাদির স্যার। মারার অভ্যাস ছিল না, তবে তির্যক ভাষা আর ধারালো কথার খোঁচা বেতের চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রণার। আবার রসবোধে হাসাতেনও। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র কাদির স্যারই ক্লাসে ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতেন। স্যারের কথা শুনে ভাবতাম, 'আমি কবে এভাবে ইংরেজি বলতে শিখব।' দিনের শেষের দিকে কাজী সা'ব আসতেন আরবি পড়াতে। স্যার এলে একজন হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতাম আর একজন স্যারের মাথার পাকা চুল বেছে দিতাম। কোনো দিন পড়াতেন, কোনো দিন বাতাস খেয়েই সময় শেষ। মাঝে মধ্যে আমরা কেচ্ছা বলার জন্য পীড়াপীড়ি করতাম। সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন পণ্ডিত সুধীর ভট্টাচার্য। মাঝে মধ্যে বাংলা ক্লাসে এসে প্রক্সি দিতেন। তিনি ছিলেন সহজ-সরল ও খোলা মনের মানুষ। কোনো সময় খুশি হলে, অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন। সে সময় পরীক্ষার খাতা সুই-সুতো দিয়ে সেলাই করা হতো। আমরা যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন প্রথম স্টু্কলে এলো স্টেপলার। পরীক্ষার হলে পণ্ডিত মশাই স্টেপলার দেখে বিস্ময়ে 'বিজ্ঞানের আশীর্বাদ' বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন।
লেখাপড়া ছাড়া আনন্দেরও অনেক ব্যবস্থা ছিল স্কুলে। প্রতি বছর স্কুলে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হতো। এ উপলক্ষে দিনব্যাপী চলত কবিতা আবৃত্তি, গান, নাটক ইত্যাদি। নাটক আর আবৃত্তির দায়িত্বে থাকতেন প্রমথ বাবু। আমি সব সময় আবৃত্তি করতাম। দু'একবার নাটকেও অভিনয় করেছি। গান শেখাতেন দ্বীগেন্দ্র বাবু। এ ধরনেরই এক অনুষ্ঠানে আমি প্রথম বাসু দেবের কণ্ঠে শুনেছিলাম, 'কে বিদেশি মন উদাসী...' গানটি। বড় হয়ে জেনেছি, গানটি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা।
স্টু্কলে হিন্দু ছাত্রছাত্রীরা করত সরস্বতী পূজা আর মুসলিমরা নবী (সাঃ)-এর জন্মদিন উপলক্ষে মিলাদ। মিলাদের আকর্ষণীয় দিক ছিল দরুদ ও মোনাজাতের পরে দুই গোলা ঘি আর চিনির রসে ভাজা ময়দার হালুয়া (সিলেটি ভাষায় তোশা শিনি্ন)। মিলাদে বক্তৃতা দিয়েছিলেন আব্বার বন্ধু ডা. আবদুশ শুকুর। তিনি বলেছিলেন, "পবিত্র কোরআনের প্রথম ওহির প্রথম শব্দ হলো 'ইকরা' অর্থাৎ 'পড়'। মুসলমানরা 'ইকরা' থেকে দূরে সরে গেছে বলেই আজ পেছনে পড়ে আছে। বিশ্বসভ্যতায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে মুসলমানদের 'ইকরা'কে শক্ত করে ধরতে হবে। আসুন আমরা 'ইকরা'র চর্চা করি।" কচি বয়সে তার কথাগুলো আমার মনে খুব লেগেছিল।
প্রতি মাসের ১৫ তারিখ ছিল স্কুলের টিউশন ফি কালেকশনের দিন। ওই দিন পড়ার বদলে ক্লাসটিচার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন তুলতেন ফার্স্ট পিরিয়ডে। ক্লসের শেষে হিসাব বুঝিয়ে দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো, কিন্তু অল্প বয়সে এক সঙ্গে দু'শ' তিনশ' টাকা ছোঁয়া এবং গোনার এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। হাফ টাইমের পরে নজর থাকত কখন শচীন্দ্র ঘণ্টায় মারেন ছুটির বাড়ি। স্কুলে ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীও ছিল জনাকয়েক। কিন্তু মেয়েদের কমনরুমের আশপাশে ঘোরাঘুরি করার বয়স তখনও হয়নি।
awahid@tnstate.edu
আপনার লেখাটি পড়ে ভালো লাগল। এই বিদ্যালয় থেকে আমিও মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন শেষ করেছি। তখনকার সময় বিদ্যালয় এর পরিবেশ, শিক্ষক-কর্মচারীদের বর্ণনার ভাষাতে আপনার স্মৃতিচারণকে খুঁজে পেয়েছি।
ReplyDeleteসবথেকে ভালো লাগল শিক্ষকদের মাঝে আমার দাদুর নাম ও তার শিক্ষক জীবনের বর্ণনা পেয়ে। আমি বিপ্রজ্যোতি চক্রবর্তী, "প্রমথ বাবু" বলে আপনার লেখায় উল্লেখ করা তৎকালীন অঙ্কের শিক্ষক শ্রীযুক্ত প্রমথ রঞ্জন চক্রবর্তীর পৌত্র। ধন্যবাদ, ভালো থাকুন।