মুক্তিযুদ্ধ-তোমার আপন পতাকায়... by নাসির আহমেদ

কী বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস!_ এই বিস্ময়জড়ানো প্রশ্ন হাজার বছর পরেও বয়ে যাবে এই ভূখণ্ডে। সত্যি এ এক আশ্চর্য দেশ! এই দেশ আর দেশের মাটি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই সেই বৈপরীত্যের কথা বলেছিলেন এক জনসভায়। ঘুষখোর আমলাদের, কালোবাজারিদের তিনি সতর্ক করেছিলেন।
দরিদ্র-শ্রমজীবীদের অবহেলা, উপেক্ষা করতে নিষেধ করে বলেছিলেন, এ দেশের পলিমাটি খুব নরম, আবার চৈত্র মাসে দারুণ শক্ত। মাটির ঢিল মেরে মাথাও ফাটিয়ে দেওয়া যায়। মনে আছে, বঙ্গবন্ধুর উক্তি এতটাই আলোড়িত করেছিল যে আমি শিশুপাঠ্য একটি কবিতা লিখে ফেলেছিলাম তাৎক্ষণিক। সেই কবিতার দুটো চরণ এ রকম_ (শিশু পত্রিকার আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষ সংখ্যায় [১৯৭৮] মুদ্রিত)... বর্ষা এলে শ্যামল-কোমল সি্নগ্ধ পরিপাটি/চৈত্রে আবার দারুণ কঠিন এই দেশেরই মাটি।/মাটির মতই মনটা সবার, কখনোবা হাসি/কখনোবা সেই ঠোঁটেই বাজায় বিষের বাঁশি...।' আসলে বাংলাদেশের জলবায়ুর মতোই মানুষের মন দ্রুত পরিবর্তনশীল আর দারুণ বৈপরীত্যে ভরা। সেই মানুষ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে কিছু করে, তখন বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যায়। অসাধ্যও সাধন হয়ে যায়। যা ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ সম্মোহক নেতৃত্বের গুণে ১৯৭০-৭১ সালে। সেই ঐক্যই এনে দিয়েছিল অসম যুদ্ধে জয়ী এই স্বাধীনতা। ১৯৯০-এর ডিসেম্বরেও আর একবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিলাম আমরা। জেনারেল এরশাদের সামরিক শক্তি ভেসে গিয়েছিল গণঐক্যের জোয়ারে। সে আবেগ প্রমাণ করেছিল যে, বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য প্রাণও দিতে পারে। শহীদ নূর হোসেন সেই অসম সাহসের প্রতীক হয়ে আছেন আজও। বিস্ময়কর ঐক্য আর বৈপরীত্যের কথাটা মনে এলো বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে চারদিকে আবেগের প্রাবল্য দেখে। কী উত্তাল এই বিজয় মাসের গৌরবময় স্মৃতি! একাত্তরের অবিস্মরণীয় স্মৃতি। আবুল হাসনাত সম্পাদিত এবং সন্ধানী থেকে গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ প্রকাশিত 'মুক্তিযুদ্ধের কবিতা' সংকলন বেরিয়েছিল প্রায় ৩০ বছর আগে। সেই সংকলনের ভূমিকা লিখতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান একটি জায়গায় সম্ভবত এ রকম লিখেছিলেন, এমন আশ্চর্য সময় কখনও আসেনি বাঙালির জীবনে। এমন সুসময় আর এমন দুঃসময়ও কখনও দেখেনি বাঙালি।
শামসুর রাহমানের ওই উক্তি অবিনাশী সূর্যের মতো শাশ্বত সত্য হয়ে জ্বলবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামপ্রিয় মানুষের কাছে। আসলেই একাত্তরের মতো এমন ঐক্যে, আবেগের জোয়ারে বাংলাদেশের মানুষ কখনও ভাসেনি। এমন চরম দুঃসময় কল্পনাও করা যাবে না। তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা পড়ে, ইতিহাস পাঠে, ভিডিও চিত্রে পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের যে পৈশাচিক নির্যাতন আর ধ্বংসলীলার পরিচয় পাচ্ছেন, তা আংশিক। কারণ একাত্তরে যা ঘটেছিল তা এককথায় অনির্বচনীয়। ভাষায় প্রকাশের শক্তি কারও নেই। আমাদের নাটকে-চলচ্চিত্রে, গানে-কবিতায়, গল্পে-উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে এসেছে, আসবে। কিন্তু একাত্তরে যা ঘটে গেছে তার সবটুকু প্রকাশ অসম্ভব। তাই আজ যখন একাত্তরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর সৃষ্টিকারী, মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধকারীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে, তখন বিজয়ের মাসেই আমরা দেখি সেই দোসরদের সমর্থক জামায়াত-শিবির রাজপথে নেমেছে ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি নিয়ে। বিস্ময়কর হলেও এই বৈপরীত্যই বাস্তবতা। ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে যখন মহাজোট নির্বাচনী ইশতেহারে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করে, তখন তরুণ প্রজন্ম উল্লসিত হয়েছিল। নতুন ভোটাররা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ভোট দিয়েছিল মহাজোটকে। সেই বিচারে যখন ধীরগতি, তখন সঙ্গত কারণেই তরুণ প্রজন্ম কিছুটা হলেও হতাশ। সেরকম প্রেক্ষাপটে যখন সরকার তার মেয়াদের শেষ বছরে বিচারের আংশিক হলেও সম্পন্ন করে যেতে চাইছে, তখন আরেক একাত্তরের ভয়ঙ্কর রূপ দৃশ্যমান হয়ে উঠল। এমনকি একাত্তরের আলবদরদের মতো যখন মরিয়া হয়ে উঠেছে শিবির, তখন পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকাও ভাবিয়ে তুলছে মুক্তিযুদ্ধপ্রিয় কোটি মানুষকে। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার মতো ইস্যু নিয়ে যখন অনৈক্য সৃষ্টি হয়, তখনই এমন অবাঞ্ছিত বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়, যা কারও কাম্য ছিল না। রাজনীতিতে বিভেদ থাকবে, ভিন্নমত থাকবে, এমনকি সংঘাতময় পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। তাই বলে ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে, লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের মূল্যে যে পতাকা আর স্বাধীন মানচিত্র পেয়েছি আমরা, সেই মানচিত্রের সত্তা নিয়ে বিরুদ্ধাচরণকারীদের পক্ষে রাজনৈতিক স্বার্থে কারও কি দাঁড়ানো সম্ভব? হ্যাঁ, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশেই তা সম্ভব। অথচ কী গভীর আবেগে কবি হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা_ 'তোমার আপন পতাকা'য় :'এবার মোছাব মুখ তোমার আপন পতাকায়/হাজার বছরের বেদনা থেকে জন্ম নিল/রক্তিম সূর্যের অধিকারী যে শ্যামকান্ত ফুল/নিঃশঙ্ক হাওয়ায় আজ ওড়ে, দুঃখভোলানিয়া গান গায়।/মোছাব তোমার মুখ আজ সেই গাঢ় পতাকায়...'। জননী বাংলাদেশের ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত মুখ মোছাবার যে আকুতি, সেই আকুতি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের, '৫৪-র যুক্তফ্রন্ট আর সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালির গণজোয়ারের। সেই আকুতি একাত্তরে সর্বস্ব বাজি রেখে জননী জন্মভূমির স্বাধীন অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার। সেই আকুতি দুঃখিনী বাংলাদেশের হাজার বছরের শোষিত-বঞ্চিত-দুঃখী মানুষের দুঃখ মোছানোর। ওই আকুতির মধ্যেই ছিল অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের সুর আর অবিনাশী শক্তি। সেই ঐক্যের শক্তি অন্তরে থাকলেই অবলীলায় এমন চিত্র আঁকা যায়, 'দু হাতে সরায় দ্রুত শহরের জটিল পঙ্কিল,/মধ্যবিত্ত অনড় আবিল। একে একে সকলকে নামায় মিছিলে/ডাকে আপামর ভাইবোন। একসাথে মিলে নিশ্ছিদ্র/বিশাল শিলাদৃঢ় পাহাড় বানায়।/সেই কোটি হাত এক হয়ে/মোছাবে তোমার মুখ তোমার আপন পতাকায়।'
কিন্তু আজ যেখানে আছি আমরা সেখান থেকে কী করে সরাব সেই জগদ্দল পাথর। যে পাথর মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অসাম্প্রদায়িকতাকে মুছে ফেলতে চায়। যে পাথরের নিচে চাপা পড়ে যায় শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার শক্তি আর স্বপ্ন। সমাজ কতটা অধঃপতনে গেলে ডেপুটি স্পিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাবেক পদাধিকারী ফেরত দিতে চান না জাতীয় সংসদের আসবাবপত্র। কতটা অধঃপতন হলে জনপ্রতিনিধি হয়েও শোধ করতে চান না কয়েক কোটি টাকার টেলিফোন বিল। কতটা অধঃপতন হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশে একাত্তরের ঘাতকদের গাড়িতে ওড়ে লাখো শহীদের রক্তে রাঙা লাল-সবুজের পতাকা! মূল্যবোধের কতখানি অবক্ষয় হলে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারের উত্তরাধিকারীরা যায় রাজাকারের পক্ষে! মনে পড়ে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার সামনে জামায়াত-শিবিরের সেই স্লোগান ? _ 'আমরা হবো তালেবান/বাংলা হবে আফগান'। বেশিদিন আগের কথা তো নয়, ২০০১-এর সাধারণ নির্বাচনের অল্প কিছুদিন আগে পল্টনের জনসভায় বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতার সামনে এই স্লোগান উচ্চারিত হয়েছিল। হাসিমুখে তিনি এই স্লোগান উপভোগ করেছিলেন। তারপর দেশবাসী কী দেখেছেন? নিজামী-মুজাহিদদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা, তারা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। সারাদেশ ছেয়ে গেছে বাংলাদেশি তালেবান আর জঙ্গিতে। বাংলাভাই, শায়খ আবদুর রহমানরা 'ইসলামী হুকুমাত' কায়েম করতে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে নিলেন। বিচারকদের হত্যা করা হলো। তাদের রক্ষক পুলিশ। এসপিও জঙ্গিদের পক্ষে কথা বলেছেন। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আজকের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে প্রতিপক্ষহীন একচ্ছত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টাও তো হয়েছিল। শাহ এএমএস কিবরিয়ার মতো পণ্ডিত ব্যক্তিকে হত্যা করা হলো। বিচার পর্যন্ত হলো না।
শুধু দোষারোপের রাজনীতি, ক্ষমতার মোহের রাজনীতি প্রগতিশীল বাংলাদেশ তথা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে রক্ষা করতে পারবে না। দেশের শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী সমাজ_ অগ্রসর সমাজ এই দুঃসময়ে অন্তত একটা প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হোন, সেটা হচ্ছে আমাদের আপন পতাকা। সেই পতাকার বিরুদ্ধাচরণকারী একাত্তরের ঘাতকদের, মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধকারীদের বিচারের প্রশ্নে অন্তত ঐক্যে আসুন। সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা দুই-ই আছে। কোনটা কম, কোনটা বেশি ভোটাররা নিশ্চয়ই চিহ্নিত করবেন। কিন্তু জাতির এই ক্রান্তিকালে সচেতন সমাজ বিজয়ের মাসে নীরব থাকতে পারেন না। আজ অঙ্গীকার হোক, আমরা যেন ইতিহাসের সঙ্গে বেইমানি না করি।

নাসির আহমেদ : কবি ও সাংবাদিক
nasirahmed1971@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.