বিশ্বশান্তি দোদুল্যমান by ফিদেল কাস্ত্রো
বহুদিন পর মাহমুদ আহমাদিনেজাদের সঙ্গে আলোচনার পর ভালো লাগছে। ২০০৬ সালের পর ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। পাঁচ বছর আগে ও আমাদের দেশে এসেছিল। হাভানায় অনুষ্ঠিত চর্তুদশ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে।
এই সম্মেলনে কিউবাকে দ্বিতীয়বার তিন বছরের জন্য সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল।
কিন্তু সম্মেলনের মাস দেড়ক আগে ২০০৬ সালের ২৬ জুলাই আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন বিছানায় উঠে বসতেও খুব কষ্ট হতো। সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বহু রাষ্ট্রপ্রধান হাসপাতালে আমায় দেখতে আসতেন।
একদিন দুপুরে চারজন অতিথি এলেন। তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কোফি আন্নান, আমার বহু পুরানো বন্ধু ও আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি আবদেলাজিজ বুতেফ্লিকা, ইরানের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ এবং তখন উপ-বিদেশমন্ত্রী ও বর্তমান চীনের বিদেশমন্ত্রী ইয়াঙ জেইচি। সেদিন ইয়াঙ জেইচি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং দেশের রাষ্ট্রপতি হু জিন তাও’র বিশেষ বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। ওই সময়টা আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সান্টা ক্লারায় পড়ে গিয়েছিলাম। তাই ডান হাতে তখন রোজ ফিজিওথেরাপি করতে হতো।
বিশ্বের সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে চারজনের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। যে সমস্যা ক্রমশ জটিল হচ্ছিল।
আহমাদিনেজাদের সঙ্গে কথা বলার পর ওকে খুব ধীরস্থির মনে হলো। ইয়াঙ্কি হুঁশিয়ারীর বিষয়ে উদাসীন। নিজের দেশবাসীর ওপর ওর পূর্ণ আস্থা। সমস্ত রকমের আগ্রাসন মোকাবিলায় প্রস্তুত। নিজেদের শক্তিতেই-সেই অস্ত্রে, যা ওরা নিজেরাই উৎপাদন করেন। যা উসুল করে নিতে পারে হামলাকারীর থেকে চরম মূল্য।
কিন্তু বাস্তবে, যুদ্ধ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। মাহম্মদ আহমাদিনেজাদের কথার পুরোভাগ জুড়ে ছিল হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হলে তার দেয়া সেই ভাষণ। সেই ভাষণে তিনি শান্তি, নিরাপত্তা, সম্মানের মতো মানুষের চিরকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দেখিয়ে ছিলেন ইতিহাসে এর জন্য মানুষ কেমন লাগাতার সংগ্রামের অবতীর্ণ হয়েছেন।
আমি বিশ্বাস করি ইরান তড়িঘড়ি কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে না। যাতে যুদ্ধ বাধে। আর যদি কোন যুদ্ধ বাধে তবে তার জন্য দায়ী থাকবে ইয়াঙ্কি সাম্রাজ্যর অসহিষ্ণুতা ও অভিসন্ধিমূলক মনোভাব।
আমি মনে করি ইরানকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনাকেই জানান দিচ্ছে- যাতে আমরা সবাই জড়িয়ে পড়বো। সে আমাদের কাছে পরমাণু অস্ত্র থাক বা না থাক। পরমাণু শক্তি অত্যন্ত ভীষণ। যা মানব সভ্যতাকেই মুছে দিতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যই বিশ্বে সব থেকে সমস্যার জায়গা। এই অঞ্চলই সেই শক্তি সম্পদের উৎস, যা বিশ্বে অর্থনীতির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রের বিধ্বংসী শক্তি এবং মানুষের কষ্টভোগ, এই হাতিয়ারগুলির ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত তৈরি করেছিল। যেমন অ্যাসফিক্সসেটিং গ্যাস এবং অন্যান্য। কিন্তু তবু মারাত্মক অস্ত্রের উৎপাদন বন্ধ হয়নি। এরজন্য অস্ত্র বিক্রেতাদের লালসা অন্যতম কারণ।
অধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করা হয়েছে তা দিয়ে যদি কোন বিশ্বযুদ্ধ হয় তাহলে পৃথিবী থেকে সভ্যতা মুছে যাবে।
আমি সেই মতামতকে সমর্থন করি, যা ন্যূনতম মূল্যবোধ এবং দায়বদ্ধতারই পরিচয়, যেখানে বিশ্বের ছোট অথবা বড় যেকোনো দেশেরই পরমাণু অস্ত্র রাখার বিরোধিতা করা হয়।
হিরোশিমা এবং নাগাসকির মতো দুটি শহর, যেখানে কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই, যেখানে আক্রমণ করা কখনই উচিত হয়নি। এই আক্রমণে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। বিকিরণের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল আরো হাজার হাজার পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে, আর যে দেশে হামলা করা হয়েছিল, তারা আগেই যুদ্ধে সামরিক দিক থেকে পরাজিত হয়েছিল।
ফ্যাসিবাদ যদি মানব সভ্যতার শত্রু নাৎসিদের বিরুদ্ধে মিত্র শক্তিকে সঙ্ঘবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তাহলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রথম কাজ ছিল কোন বাছবিচার না করেই পরমাণু অস্ত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা।
অবশ্য বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সম্পদশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যদের নিজের পথ অনুসরণে বাধ্য করে। আজকে তাদের কয়েকশো উপগ্রহ মহাকাশ থেকে গোটা বিশ্বের ওপর চরবৃত্তি চালায়। তাদের নৌ, বিমান এবং মূল বাহিনী হাজারো পরমাণু অস্ত্রে বলিয়ান। তারাই বিশ্বের অর্থনীতি এবং বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের (আইএমএফ) মাধ্যমে।
মেক্সিকো থেকে পাটাগোনিয়া, সানটো ডমিঙ্গো অথবা হাইতি, লাতিন আমেরিকার ইতিহাস থেকে জানা যায় উনিশ শতকের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর শোষণের ইতিহাস। মানুষের অধিকারের ওপর এখানে ভয়ঙ্কর অপরাধ হয়েছে। যা ক্ষমতা অথবা বলপ্রয়োগের দ্বারা সম্ভব। সে যেভাবেই হোক না কেন। লাতিন আমেরিকার গুণী লেখকরা ক্রমশ সামনের সারিতে জায়গা করে নিচ্ছেন। তাদেরই একজন এদুয়ার্দো গালিয়ানো। তার বিখ্যাত বই, ‘ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা।’ বইটিতে একটি মহাদেশের পাঁচ শতকের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা হয়েছে। লেখকের প্রতি সম্মান জানাতে সম্প্রতি তাকে বিখ্যাত ‘কাসা ডি লাস আমেরিকাস অ্যাওয়ার্ড’ পুরষ্কারের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার জন্য আমন্ত্রিত করা হয়েছিল।
ঘটনা অত্যন্ত দ্রুত ঘটে। কিন্তু প্রযুক্তি তাকে আরো দ্রুততর মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। যেকোনো দিন, যেমন আজ, গুরুত্বপূর্ণ খবর ঢিমেতালে প্রকাশ পায়। গত ১১ জানুয়ারির একটি খবর যাতে বলা হয়েছিল ইউরোপিয় ইউনিয়নের সভাপতি ডেনমার্ক ইরানের ওপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এর কয়েক দিন আগেই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানিয়েছিল ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন। আর তা করা হবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির জন্য। ২৩শে জানুয়ারি ইউরোপিয় ইউনিয়নে এপ্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞায় শুধু ইরানের তেল শিল্পই নয়, প্রভাবিত হবে সেন্ট্রাল ব্যাংক পর্যন্ত।
সাংবাদিকদের দেয়া সাক্ষাৎকারে ডেনমার্কের বিদেশমন্ত্রী আরো বলেন, নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ইরানের তেল শিল্পের পাশাপাশি সেন্ট্রাল ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকেও দুর্বল করার চেষ্টা করা হবে। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় নিরস্ত্রীকরণের নামে ইসরাইল শয়ে শয়ে পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারে, কিন্তু ইরানের ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করার অধিকার নেই।
অন্য একটি সম্মানিয় ব্রিটিশ সংবাদসংস্থার খবর অনুসারে, ইরানের তেল থেকে উৎপন্ন রাজস্ব ছাঁটাইয়ের মার্কিন পদক্ষেপের বিরোধিতা করার আগাম বিষয়ে জানায়নি চীন। এই পদক্ষেপকে চীন বাড়াবাড়ি হিসেবে উল্লেখ করেছিল।
যেরকম ধীরস্থিরভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সভ্য ইউরোপীয় দেশগুলি নিখুঁতভাবে সন্ত্রাস ছড়াতে প্রচার চালায় তা যেকোনো মানুষকে শঙ্কিত করতে পারে। আরো এক ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমের খবর দেখলে তা বোঝা যায়। ‘গত বুধবার ইরানের পরমাণু বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা আহমাদি রোমহান (নাতজান পরমাণু কেন্দ্রের একজন বিজ্ঞানী)-র হত্যা নিয়ে গত দু’বছরে ইরানের মোট চারজন প্রথম সারির বিজ্ঞানীকে খুন করা হলো।’
২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি বাড়ির কাছে মোটরসাইকেল বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক মাসুদ আলি মহম্মদ।
২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর দুটি হামলায় নিহত হন ইরানের নামী পরমাণু বিজ্ঞানী মাজিদ শরিয়ারি। তিনি দেশে অ্যাটোমিক এজেন্সির সদস্য ছিলেন। তেহরানে তার গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। একই দিনে আক্রান্ত হন ইরানের অন্য পরমাণু বিজ্ঞানী ফেরিয়োদুন আব্বাসি দাভানি। তারও গাড়িতে হামলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। গাড়িটি তেহরানের শইদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই দুই অধ্যাপক কর্মরত ছিলেন।
২০১১ সালের ২৩ জুলাই অজ্ঞাত পরিচয় বন্দুকবাজের গুলিতে মারা যান ইরানের প্রবীণ পরমাণু বিজ্ঞানী দারিউস রেজাই নেজাদ। তিনি দেশের প্রতিরক্ষা দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। তেহরানে একটি শিশুদের আবাসিক স্কুলের বাইরে নেজাদ ও তার স্ত্রীর ওপর প্রাণঘাতী এই আক্রমণ চালানো হয়।
২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি- যেদিন আহমাদিনেজাদ নিকারাগুয়া থেকে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মেলনে ভাষণ দেয়ার জন্য রওনা হন, সেদিনই নাতজান পরমাণুসমৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের ডেপুটি ডিরেক্টর বিজ্ঞানী মোস্তফা আহমাদি রোশান তেহরানের পূর্বে আল্লাহমে তাবাতাবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে মারা যান। আগের বছরগুলির মতো এই বিজ্ঞানী খুনের ঘটনার জন্যও ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলকেই দোষী বলে ঘোষণা করে।
এই হত্যাকাণ্ডগুলি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, ইরানের মেধাবী বিজ্ঞানীদের পূর্বপরিকল্পিতভাবেই খতম করা হয়েছে। ইসরাইলের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন লোকদের নিবন্ধ পড়ে আমি বুঝেছি কিভাবে মার্কিন এবং ন্যাটোর সহযোগিতায় ইসরাইলি গুপ্তচর সংস্থা সাধারণ কাজের মতোই অনায়াসে এগুলি করতে সক্ষম। এই সময়ই রাশিয়ার সংবাদসংস্থাগুলি সতর্ক করেছিল সিরিয়াতেও লিবিয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে তারা একটি অতিরিক্ত তথ্য যুক্ত করেছিল। যাতে বলা হয়েছিল সিরিয়ায় হামলা চালানো হবে তুরস্ক থেকে।
রাশিয়ান সিকিউরিটিজ কাউনশিলের সম্পাদক নিকোলাই পাত্রুসেভ জানিয়েছিলেন, দামাস্কাসকে শাস্তি দিতে চায় পশ্চিমী দেশগুলি। শক্ত হাতে বিক্ষোভকারীদের দমন করার চেয়েও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ না করার কারণে।
এক্ষেত্রে লিবিয়ার মতোই ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলি এবং কিছু পারস্য উপসাগরীয় দেশ ভূমিকা পালন করছে। অনেক ক্ষেত্রেই এরা সরাসরি আগ্রাসনের ফলে আড়াল থেকে সিরিয়ায় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে চাইছে। এবার প্রধান হানাদার বাহিনীর ভূমিকায় ফ্রান্স, ব্রিটেন অথবা ইতালি থাকবে না। হয়তো এ কাজ করবে তুরস্ক।
সিরিয়ার ওপর বিমান নিষিদ্ধ অঞ্চল ঘোষণা করার জন্য অভিসন্ধি চালাচ্ছে ওয়াশিংটন এবং আঙ্কারা। যেখানে সিরিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পরে এরাই দেশে নৈরাজ্য ছড়াবে, বলেন পাত্রুসেভ। খবর শুধু ইরান অথবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে না, আসতে শুরু করেছে মধ্য এশিয়া থেকেও। অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে এই বিপজ্জনক অঞ্চল থেকে। পাকিস্তানের মতো দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে তার দ্বিচারিতাপূর্ণ এবং ভ্রান্তনীতি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে উদ্যত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ঔপনিবেশিকরা আফগানিস্তানের সঙ্গে যার সীমানা নির্ধারণ করেছিল সাংস্কৃতিক অথবা নৈতিকতার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়েই।
ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের মানুষ স্বাধীনতার জন্য শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে, আর ইয়াঙ্কি আগ্রাসনের পর এদেশে মাদকের উৎপাদন বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মাঝে ইউরোপীয় সৈন্যবাহিনী ড্রোন বিমান এবং অত্যাধুনিক মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দেশে একের পর এক গণহত্যা সংগঠিত করছে। যার জন্য মানুষের ঘৃণা বাড়ছে। আর শান্তি ফেরার আশা দূর অস্ত। এইসব এবং অন্য সরাসরি ঘটনার বিষয়ে পশ্চিমী সংবাদসংস্থাগুলি থেকে জানা যায়।
২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি আফগানিস্তানে মৃতদেহের উপর চার মেরিন সেনার প্রস্রাব করার ঘটনার নিন্দা করেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লিওন ই পানেত্তা। গোটা কাণ্ডটির ভিডিও রেকর্ডিং করে ইন্টারনেটে ছাড়া হয়েছিল।
আমি সেই ভিডিও দেখেছি, এই মানসিকতা অত্যন্ত কুৎসিত বলেই মনে হয়। ‘মার্কিন সেনাদের কাছ থেকে এমন ব্যবহার কখনই কাঙ্ক্ষিত নয়, বিশেষত যে ধরনের শিক্ষা তাদের দেয়া হয়।’
বাস্তবে পানেত্তা ঘটনার কথা স্বীকার কিংবা খারিজ কোনোটাই করেননি। তার কথা থেকেই মনে হয় তিনি ঘটনার বিষয়ে নিশ্চিত নন। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের মনে হয়তো সন্দেহ আছে।
এছাড়া পুরুষ, মহিলা অথবা শিশু, বা কোন আফগান যোদ্ধা, বিদেশী দখলদারদের ড্রোন বিমান থেকে ফেলা বোমায় মারা যাচ্ছেন এটাও যথেষ্ট অমানবিক। এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। যেখানে সীমান্ত রক্ষা করার সময় ড্রোন হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন বহু পাকিস্তানী সেনা।
মৃতদেহের যেভাবে অবমাননা করা হয়েছে তাকে অমানবিক বলেছেন আফগান রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই। তিনি দ্রুত ঘটনার তদন্তের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন। যাতে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেয়া যায়। ইতোমধ্যেই তালিবানের পক্ষ থেকে দাবি করে বলা হয়েছে যে, গত দশ বছরে এমন অজস্র ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তা খবর হয়নি।
কেউ হয়তো ওই সেন্যদের জন্য চিন্তা করে দুঃখ পেতে পারেন, যারা হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে তাদের পরিবার, বন্ধু এবং দেশ ছেড়ে আছে, এমন একটি দেশে আগ্রাসন চালাতে যার নাম তারা হয়তো নিজেদের শৈশবে কখনও শোনেনি। তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে হয় মারো অথবা মরো। বহুজাতিক সংস্থা, অস্ত্রের ব্যাপারী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে। প্রতি বছর গোটা বিশ্বে অভুক্ত এবং নিরক্ষর মানুষের প্রয়োজনে বরাদ্দ তহবিল যারা তছরুপ করে। এমন অনেক সেনা আতঙ্কের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেন।
এটা কি বাড়িয়ে বলা হবে যে বিশ্বশান্তি দোদুল্যমান?
ফিদেল কাস্ত্রো: কিউবার বিপ্লবী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু সম্মেলনের মাস দেড়ক আগে ২০০৬ সালের ২৬ জুলাই আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন বিছানায় উঠে বসতেও খুব কষ্ট হতো। সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বহু রাষ্ট্রপ্রধান হাসপাতালে আমায় দেখতে আসতেন।
একদিন দুপুরে চারজন অতিথি এলেন। তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কোফি আন্নান, আমার বহু পুরানো বন্ধু ও আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি আবদেলাজিজ বুতেফ্লিকা, ইরানের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ এবং তখন উপ-বিদেশমন্ত্রী ও বর্তমান চীনের বিদেশমন্ত্রী ইয়াঙ জেইচি। সেদিন ইয়াঙ জেইচি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং দেশের রাষ্ট্রপতি হু জিন তাও’র বিশেষ বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। ওই সময়টা আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সান্টা ক্লারায় পড়ে গিয়েছিলাম। তাই ডান হাতে তখন রোজ ফিজিওথেরাপি করতে হতো।
বিশ্বের সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে চারজনের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। যে সমস্যা ক্রমশ জটিল হচ্ছিল।
আহমাদিনেজাদের সঙ্গে কথা বলার পর ওকে খুব ধীরস্থির মনে হলো। ইয়াঙ্কি হুঁশিয়ারীর বিষয়ে উদাসীন। নিজের দেশবাসীর ওপর ওর পূর্ণ আস্থা। সমস্ত রকমের আগ্রাসন মোকাবিলায় প্রস্তুত। নিজেদের শক্তিতেই-সেই অস্ত্রে, যা ওরা নিজেরাই উৎপাদন করেন। যা উসুল করে নিতে পারে হামলাকারীর থেকে চরম মূল্য।
কিন্তু বাস্তবে, যুদ্ধ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। মাহম্মদ আহমাদিনেজাদের কথার পুরোভাগ জুড়ে ছিল হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হলে তার দেয়া সেই ভাষণ। সেই ভাষণে তিনি শান্তি, নিরাপত্তা, সম্মানের মতো মানুষের চিরকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দেখিয়ে ছিলেন ইতিহাসে এর জন্য মানুষ কেমন লাগাতার সংগ্রামের অবতীর্ণ হয়েছেন।
আমি বিশ্বাস করি ইরান তড়িঘড়ি কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে না। যাতে যুদ্ধ বাধে। আর যদি কোন যুদ্ধ বাধে তবে তার জন্য দায়ী থাকবে ইয়াঙ্কি সাম্রাজ্যর অসহিষ্ণুতা ও অভিসন্ধিমূলক মনোভাব।
আমি মনে করি ইরানকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনাকেই জানান দিচ্ছে- যাতে আমরা সবাই জড়িয়ে পড়বো। সে আমাদের কাছে পরমাণু অস্ত্র থাক বা না থাক। পরমাণু শক্তি অত্যন্ত ভীষণ। যা মানব সভ্যতাকেই মুছে দিতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যই বিশ্বে সব থেকে সমস্যার জায়গা। এই অঞ্চলই সেই শক্তি সম্পদের উৎস, যা বিশ্বে অর্থনীতির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রের বিধ্বংসী শক্তি এবং মানুষের কষ্টভোগ, এই হাতিয়ারগুলির ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত তৈরি করেছিল। যেমন অ্যাসফিক্সসেটিং গ্যাস এবং অন্যান্য। কিন্তু তবু মারাত্মক অস্ত্রের উৎপাদন বন্ধ হয়নি। এরজন্য অস্ত্র বিক্রেতাদের লালসা অন্যতম কারণ।
অধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করা হয়েছে তা দিয়ে যদি কোন বিশ্বযুদ্ধ হয় তাহলে পৃথিবী থেকে সভ্যতা মুছে যাবে।
আমি সেই মতামতকে সমর্থন করি, যা ন্যূনতম মূল্যবোধ এবং দায়বদ্ধতারই পরিচয়, যেখানে বিশ্বের ছোট অথবা বড় যেকোনো দেশেরই পরমাণু অস্ত্র রাখার বিরোধিতা করা হয়।
হিরোশিমা এবং নাগাসকির মতো দুটি শহর, যেখানে কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই, যেখানে আক্রমণ করা কখনই উচিত হয়নি। এই আক্রমণে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। বিকিরণের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল আরো হাজার হাজার পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে, আর যে দেশে হামলা করা হয়েছিল, তারা আগেই যুদ্ধে সামরিক দিক থেকে পরাজিত হয়েছিল।
ফ্যাসিবাদ যদি মানব সভ্যতার শত্রু নাৎসিদের বিরুদ্ধে মিত্র শক্তিকে সঙ্ঘবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তাহলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রথম কাজ ছিল কোন বাছবিচার না করেই পরমাণু অস্ত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা।
অবশ্য বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সম্পদশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যদের নিজের পথ অনুসরণে বাধ্য করে। আজকে তাদের কয়েকশো উপগ্রহ মহাকাশ থেকে গোটা বিশ্বের ওপর চরবৃত্তি চালায়। তাদের নৌ, বিমান এবং মূল বাহিনী হাজারো পরমাণু অস্ত্রে বলিয়ান। তারাই বিশ্বের অর্থনীতি এবং বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের (আইএমএফ) মাধ্যমে।
মেক্সিকো থেকে পাটাগোনিয়া, সানটো ডমিঙ্গো অথবা হাইতি, লাতিন আমেরিকার ইতিহাস থেকে জানা যায় উনিশ শতকের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর শোষণের ইতিহাস। মানুষের অধিকারের ওপর এখানে ভয়ঙ্কর অপরাধ হয়েছে। যা ক্ষমতা অথবা বলপ্রয়োগের দ্বারা সম্ভব। সে যেভাবেই হোক না কেন। লাতিন আমেরিকার গুণী লেখকরা ক্রমশ সামনের সারিতে জায়গা করে নিচ্ছেন। তাদেরই একজন এদুয়ার্দো গালিয়ানো। তার বিখ্যাত বই, ‘ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা।’ বইটিতে একটি মহাদেশের পাঁচ শতকের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা হয়েছে। লেখকের প্রতি সম্মান জানাতে সম্প্রতি তাকে বিখ্যাত ‘কাসা ডি লাস আমেরিকাস অ্যাওয়ার্ড’ পুরষ্কারের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার জন্য আমন্ত্রিত করা হয়েছিল।
ঘটনা অত্যন্ত দ্রুত ঘটে। কিন্তু প্রযুক্তি তাকে আরো দ্রুততর মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। যেকোনো দিন, যেমন আজ, গুরুত্বপূর্ণ খবর ঢিমেতালে প্রকাশ পায়। গত ১১ জানুয়ারির একটি খবর যাতে বলা হয়েছিল ইউরোপিয় ইউনিয়নের সভাপতি ডেনমার্ক ইরানের ওপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এর কয়েক দিন আগেই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানিয়েছিল ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন। আর তা করা হবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির জন্য। ২৩শে জানুয়ারি ইউরোপিয় ইউনিয়নে এপ্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞায় শুধু ইরানের তেল শিল্পই নয়, প্রভাবিত হবে সেন্ট্রাল ব্যাংক পর্যন্ত।
সাংবাদিকদের দেয়া সাক্ষাৎকারে ডেনমার্কের বিদেশমন্ত্রী আরো বলেন, নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ইরানের তেল শিল্পের পাশাপাশি সেন্ট্রাল ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকেও দুর্বল করার চেষ্টা করা হবে। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় নিরস্ত্রীকরণের নামে ইসরাইল শয়ে শয়ে পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারে, কিন্তু ইরানের ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করার অধিকার নেই।
অন্য একটি সম্মানিয় ব্রিটিশ সংবাদসংস্থার খবর অনুসারে, ইরানের তেল থেকে উৎপন্ন রাজস্ব ছাঁটাইয়ের মার্কিন পদক্ষেপের বিরোধিতা করার আগাম বিষয়ে জানায়নি চীন। এই পদক্ষেপকে চীন বাড়াবাড়ি হিসেবে উল্লেখ করেছিল।
যেরকম ধীরস্থিরভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সভ্য ইউরোপীয় দেশগুলি নিখুঁতভাবে সন্ত্রাস ছড়াতে প্রচার চালায় তা যেকোনো মানুষকে শঙ্কিত করতে পারে। আরো এক ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমের খবর দেখলে তা বোঝা যায়। ‘গত বুধবার ইরানের পরমাণু বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা আহমাদি রোমহান (নাতজান পরমাণু কেন্দ্রের একজন বিজ্ঞানী)-র হত্যা নিয়ে গত দু’বছরে ইরানের মোট চারজন প্রথম সারির বিজ্ঞানীকে খুন করা হলো।’
২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি বাড়ির কাছে মোটরসাইকেল বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক মাসুদ আলি মহম্মদ।
২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর দুটি হামলায় নিহত হন ইরানের নামী পরমাণু বিজ্ঞানী মাজিদ শরিয়ারি। তিনি দেশে অ্যাটোমিক এজেন্সির সদস্য ছিলেন। তেহরানে তার গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। একই দিনে আক্রান্ত হন ইরানের অন্য পরমাণু বিজ্ঞানী ফেরিয়োদুন আব্বাসি দাভানি। তারও গাড়িতে হামলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। গাড়িটি তেহরানের শইদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই দুই অধ্যাপক কর্মরত ছিলেন।
২০১১ সালের ২৩ জুলাই অজ্ঞাত পরিচয় বন্দুকবাজের গুলিতে মারা যান ইরানের প্রবীণ পরমাণু বিজ্ঞানী দারিউস রেজাই নেজাদ। তিনি দেশের প্রতিরক্ষা দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। তেহরানে একটি শিশুদের আবাসিক স্কুলের বাইরে নেজাদ ও তার স্ত্রীর ওপর প্রাণঘাতী এই আক্রমণ চালানো হয়।
২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি- যেদিন আহমাদিনেজাদ নিকারাগুয়া থেকে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মেলনে ভাষণ দেয়ার জন্য রওনা হন, সেদিনই নাতজান পরমাণুসমৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের ডেপুটি ডিরেক্টর বিজ্ঞানী মোস্তফা আহমাদি রোশান তেহরানের পূর্বে আল্লাহমে তাবাতাবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে মারা যান। আগের বছরগুলির মতো এই বিজ্ঞানী খুনের ঘটনার জন্যও ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলকেই দোষী বলে ঘোষণা করে।
এই হত্যাকাণ্ডগুলি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, ইরানের মেধাবী বিজ্ঞানীদের পূর্বপরিকল্পিতভাবেই খতম করা হয়েছে। ইসরাইলের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন লোকদের নিবন্ধ পড়ে আমি বুঝেছি কিভাবে মার্কিন এবং ন্যাটোর সহযোগিতায় ইসরাইলি গুপ্তচর সংস্থা সাধারণ কাজের মতোই অনায়াসে এগুলি করতে সক্ষম। এই সময়ই রাশিয়ার সংবাদসংস্থাগুলি সতর্ক করেছিল সিরিয়াতেও লিবিয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে তারা একটি অতিরিক্ত তথ্য যুক্ত করেছিল। যাতে বলা হয়েছিল সিরিয়ায় হামলা চালানো হবে তুরস্ক থেকে।
রাশিয়ান সিকিউরিটিজ কাউনশিলের সম্পাদক নিকোলাই পাত্রুসেভ জানিয়েছিলেন, দামাস্কাসকে শাস্তি দিতে চায় পশ্চিমী দেশগুলি। শক্ত হাতে বিক্ষোভকারীদের দমন করার চেয়েও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ না করার কারণে।
এক্ষেত্রে লিবিয়ার মতোই ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলি এবং কিছু পারস্য উপসাগরীয় দেশ ভূমিকা পালন করছে। অনেক ক্ষেত্রেই এরা সরাসরি আগ্রাসনের ফলে আড়াল থেকে সিরিয়ায় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে চাইছে। এবার প্রধান হানাদার বাহিনীর ভূমিকায় ফ্রান্স, ব্রিটেন অথবা ইতালি থাকবে না। হয়তো এ কাজ করবে তুরস্ক।
সিরিয়ার ওপর বিমান নিষিদ্ধ অঞ্চল ঘোষণা করার জন্য অভিসন্ধি চালাচ্ছে ওয়াশিংটন এবং আঙ্কারা। যেখানে সিরিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পরে এরাই দেশে নৈরাজ্য ছড়াবে, বলেন পাত্রুসেভ। খবর শুধু ইরান অথবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে না, আসতে শুরু করেছে মধ্য এশিয়া থেকেও। অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে এই বিপজ্জনক অঞ্চল থেকে। পাকিস্তানের মতো দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে তার দ্বিচারিতাপূর্ণ এবং ভ্রান্তনীতি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে উদ্যত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ঔপনিবেশিকরা আফগানিস্তানের সঙ্গে যার সীমানা নির্ধারণ করেছিল সাংস্কৃতিক অথবা নৈতিকতার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়েই।
ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের মানুষ স্বাধীনতার জন্য শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে, আর ইয়াঙ্কি আগ্রাসনের পর এদেশে মাদকের উৎপাদন বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মাঝে ইউরোপীয় সৈন্যবাহিনী ড্রোন বিমান এবং অত্যাধুনিক মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দেশে একের পর এক গণহত্যা সংগঠিত করছে। যার জন্য মানুষের ঘৃণা বাড়ছে। আর শান্তি ফেরার আশা দূর অস্ত। এইসব এবং অন্য সরাসরি ঘটনার বিষয়ে পশ্চিমী সংবাদসংস্থাগুলি থেকে জানা যায়।
২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি আফগানিস্তানে মৃতদেহের উপর চার মেরিন সেনার প্রস্রাব করার ঘটনার নিন্দা করেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লিওন ই পানেত্তা। গোটা কাণ্ডটির ভিডিও রেকর্ডিং করে ইন্টারনেটে ছাড়া হয়েছিল।
আমি সেই ভিডিও দেখেছি, এই মানসিকতা অত্যন্ত কুৎসিত বলেই মনে হয়। ‘মার্কিন সেনাদের কাছ থেকে এমন ব্যবহার কখনই কাঙ্ক্ষিত নয়, বিশেষত যে ধরনের শিক্ষা তাদের দেয়া হয়।’
বাস্তবে পানেত্তা ঘটনার কথা স্বীকার কিংবা খারিজ কোনোটাই করেননি। তার কথা থেকেই মনে হয় তিনি ঘটনার বিষয়ে নিশ্চিত নন। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের মনে হয়তো সন্দেহ আছে।
এছাড়া পুরুষ, মহিলা অথবা শিশু, বা কোন আফগান যোদ্ধা, বিদেশী দখলদারদের ড্রোন বিমান থেকে ফেলা বোমায় মারা যাচ্ছেন এটাও যথেষ্ট অমানবিক। এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। যেখানে সীমান্ত রক্ষা করার সময় ড্রোন হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন বহু পাকিস্তানী সেনা।
মৃতদেহের যেভাবে অবমাননা করা হয়েছে তাকে অমানবিক বলেছেন আফগান রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই। তিনি দ্রুত ঘটনার তদন্তের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন। যাতে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেয়া যায়। ইতোমধ্যেই তালিবানের পক্ষ থেকে দাবি করে বলা হয়েছে যে, গত দশ বছরে এমন অজস্র ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তা খবর হয়নি।
কেউ হয়তো ওই সেন্যদের জন্য চিন্তা করে দুঃখ পেতে পারেন, যারা হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে তাদের পরিবার, বন্ধু এবং দেশ ছেড়ে আছে, এমন একটি দেশে আগ্রাসন চালাতে যার নাম তারা হয়তো নিজেদের শৈশবে কখনও শোনেনি। তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে হয় মারো অথবা মরো। বহুজাতিক সংস্থা, অস্ত্রের ব্যাপারী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে। প্রতি বছর গোটা বিশ্বে অভুক্ত এবং নিরক্ষর মানুষের প্রয়োজনে বরাদ্দ তহবিল যারা তছরুপ করে। এমন অনেক সেনা আতঙ্কের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেন।
এটা কি বাড়িয়ে বলা হবে যে বিশ্বশান্তি দোদুল্যমান?
ফিদেল কাস্ত্রো: কিউবার বিপ্লবী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট।
No comments