মানবিক বোধের চর্চা চাই by রেজা শাওন

প্রতিদিনই মন খারাপ করা হাজারো খবরকে পাশে রেখে আমাদের চলতে হয়। তবে কিছু খবর থমকে দেয়। এমন একটা খবরে বেশ কিছুদিন আগে চমকে যেতে হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বরের একটা খবরে পড়তে হলো_ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র দুপুরে ধানমণ্ডির জনারণ্যে এক বৃদ্ধ বাবার সামনে তার ছেলেকে পিটিয়েছে।


ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে বাবাও আহত হয়েছেন। মোজাফফর নামের যে ভদ্রলোককে পেটানো হয়েছে, তার অপরাধ হলো_ তিনি রাস্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের সামনে গাড়ি রেখেছেন। ট্রাফিক আইন না মেনে বিপরীত দিকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস জ্যাম ঠেলে সামনে এগোতে পারছে না। বস্তুত বাংলাদেশ মানুষের দেশ। কাউকে সামনে ঠেলে, এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে এ দেশের জীবন চালিয়ে নেওয়ার এক অনন্য উপায়। আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত। আমাদের চলতেই হচ্ছে এভাবে। সেক্ষেত্রে সহনশীলতার ব্যাপারটা এসে যায়। তাহলে কি এই প্রজন্মের আমরা নিদারুণ অসহিষুষ্ণ হয়ে পড়ছি? সামান্য কারণে আমরা তীব্র আক্রোশে একাকার করছি সব। ভরদুপুরে রাস্তাভরা মানুষ দেখছে, কী অমানুষিক উন্মাদনায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছেলেরা রাস্তায় নেমেছে।
খবরটার সঙ্গে আমার নিজেরও একটা ব্যক্তিগত দুঃখবোধ জড়িয়ে আছে। ২০০৮ সালের কোনো দুপুরের কথা। আমার বোনের মেয়ের স্কুল ছুটি হয়েছে খানিক আগে। আজিমপুর থেকে ভাগনিকে আনতে গেছি। যাওয়ার সময় কোনো সমস্যা ছিল না, নিরাপদ রাস্তা। ফেরার সময় দেখলাম, নীলক্ষেত রণক্ষেত্র। কে বা কারা গাড়ি ভাঙছে। আমার সামনের কয়েকটা গাড়ির কাচের রাস্তায় গুঁড়িয়ে পড়ার তীব্র শব্দ কানে এলো। পেছনে গাড়ির জট, ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ড্রাইভার ডান দিকটাকে নিরাপদ মনে করল মনে হয়। ঢাবি এলাকা হয়ে বের হয়ে গিয়ে সে পরিস্থিতি আরও জটিল করে ফেলে। আমি শুধু দেখলাম, চলন্ত গাড়ির ওপর অনবরত লাঠির বাড়ি পড়ছে, শেষ দিকে ইটের টুকরো। কয়েক সেকেন্ডে সে কী এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন! সেদিনের এ ঘটনার পর আমার নয় বছরের ভাগনির মনে চিরস্থায়ী একটা ধারণার জন্ম নিল। সেটা হচ্ছে, নীলক্ষেত থেকে তার স্কুলের বাকি রাস্তাটুকু মোটেই তার জন্য নিরাপদ নয়। এরপরও অগণিতবার তাকে নিয়ে আমি এই পথে গিয়েছি। সে প্রতিবারই এই পথটুকু উৎকণ্ঠা নিয়ে পাড়ি দিয়েছে। আমার মনে হয়, তার বাকি জীবনটাও এভাবে যাবে। শৈশবের এই ভয়টাকে সে বাকি জীবন আর জয় করতে পারবে না।
প্রসঙ্গের অবতারণা এ জন্য করলাম যে, আমরা জেনে না জেনে প্রতিদিনই দেশটাকে কিছু মানুষের জন্য দুঃস্বপ্ন বানিয়ে ফেলছি। যারা বানিয়ে ফেলছে তাদের ব্যক্তিগত কুকর্ম আর ব্যক্তিগত থাকছে না। ব্যক্তিগত সে পরিচয় ছাপিয়ে তারা কলুষিত করছে তাদের পরিবার, প্রতিষ্ঠান আর কখনও কখনও পুরো দেশকে। ২ সেপ্টেম্বরের ঘটনা পড়ে চমকে উঠেছি। কারণ এক বাসভর্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সামনে এমন অমানবিক একটা ঘটনা কীভাবে ঘটে গেল? পুরো ব্যাপারটাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য সবার একসঙ্গে উচ্চস্বরে 'না' বলাটাই কি যথেষ্ট ছিল না? ঘটনা পড়ে জানতে পেরেছি, সেদিন যে মানুষটাকে তার বাবার সামনে পেটানো হয়েছে, তিনিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্র। সাবেক একজন ছাত্রকে কীভাবে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এভাবে পেটাতে পারে? বাকিরাই-বা তখন কোথায় থাকে?
আমি বিশ্বাস করি, সংখ্যায় অল্প কিছু মানুষের ছড়িয়ে দেওয়া বিষে হয়তো পুরো একটা প্রতিষ্ঠান নীল হয়ে যাবে না। কিন্তু একথাও ঠিক, এ চিত্র দেশজুড়ে। বিশেষ একটি শ্রেণী কিংবা অল্প কিছু মানুষের হাতে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জিম্মি এ দেশের সাধারণ মানুষ আকাশের দিকে চেয়ে আছেন নেতার অপেক্ষায়। পরিবেশ আর পরিস্থিতি একজন সাধারণের নেতা হয়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে বড় দুটি নিয়ামক। আমাদের এই ব্যাপারটুকুই বুঝতে হবে। যেখানে মানবিক হওয়া দরকার, সেখানে মানবিক হতে হবে। নূ্যনতম যে বোধটুকু থাকলে মানুষকে মানুষ বলা যায় সে বোধের চর্চাটুকুই দরকার এখন।
siddique1237@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.