৩১ কোম্পানির ৪৩ খাদ্যপণ্যের অনুমোদন বাতিল by পার্থ শঙ্কর সাহা

নামে ফ্রুট ড্রিংকস (ফলজাত পানীয়), কিন্তু তাতে ফলের লেশমাত্র নেই। সেমাই, চাটনি, বিস্কুট তৈরি হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। তা-ই খাচ্ছে মানুষ দিনের পর দিন। ভেজিটেবল ঘিয়ের নামে যা বিক্রি হচ্ছে, তাতে রক্ষিত হয়নি কোনো মান।


মোট ৩১টি কোম্পানির এ রকম ৪৩টি খাদ্যপণ্যের লাইসেন্স বাতিল করেছে বাংলাদেশের পণ্য মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। এসব পণ্যের মোড়কে লোগো ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি পণ্যগুলো কেনাবেচার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ জানানো হয়েছে বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে।
কেন বাতিল: বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক মো. লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত ১৩ অক্টোবরের চিঠিতে কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা হয়। বিএসটিআইয়ের মান নিয়ন্ত্রণকারী পরীক্ষাগারের সুপারিশের ভিত্তিতেই ঘটে বাতিলের কাজ।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যেসব কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে, তারা লাইসেন্স নেওয়ার সময় পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখলেও পরে আর মান মোটেও নিয়ন্ত্রণ করেনি। তিন বছরের জন্য এসব খাদ্যপণ্যের লাইসেন্স দেওয়া হয়। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য প্রতিবছর অন্তত দুবার বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে এসব পণ্য পরীক্ষা করা হয়। একবার এসব পণ্যের নমুনা নেওয়া হয় বাজার থেকে, আরেকবার কারখানা থেকে। বিএসটিআই মোট ১৪টি ব্র্যান্ডের ফ্রুট ড্রিংকসের লাইসেন্স বাতিল করেছে। নুরুল ইসলাম জানান, এসব ড্রিংকসে যে ফলের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই ফলের অন্তত ১০ শতাংশ উপাদান থাকতে হবে। কিন্তু বাতিল হওয়া ড্রিংকসগুলোতে প্রাকৃতিক ফলের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বাতিল করা পণ্যগুলোর পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক মো. নজির আহমদ মিয়া জানান, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরির জন্য সেমাইয়ের কোম্পানিগুলোর অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে। প্রতিটি কোম্পানির সেমাই শুকানো হয় খোলা জায়গায়। সেমাই প্যাকেট করতে যে দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, তাও অস্বাস্থ্যকর। তাঁর মতে, একটি কোম্পানি ছাড়া দেশের কোনো কোম্পানির সরু সেমাই মানসম্পন্ন নয়।
বিএসপি ফুড প্রোডাক্টসের ভেজিটেবল ঘির লাইসেন্স বাতিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, এখানে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাব রয়েছে। বাতিল হওয়া ধনিয়ার গুঁড়া তৈরি হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। চাটনি তৈরি হয় হাতে, এর মোড়কও স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক খুরশীদা বেগম বলেন, ফ্রুট ড্রিংকসের মতো পণ্যগুলো শিশুদের মাঝে বেশি জনপ্রিয়। মানহীন পণ্য গ্রহণ করার ফলে শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘কৃত্রিম রং এবং গন্ধ দিয়ে তৈরি পণ্য গ্রহণের ফলে কী ধরনের ক্ষতি হয়, তা নিয়ে কোনো গবেষণা আমাদের দেশে নেই। কিন্তু এটা সাধারণ ধারণাতেই বোঝা যায়, যা কিছু কৃত্রিম তা ভালো হতে পারে না। তিনি যেসব পণ্য নিষিদ্ধ হয়েছে সেগুলোর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন।
বাতিল হওয়া পণ্যের তালিকা: বাতিল হওয়া পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেড বা প্রাণের ফ্রুট ড্রিংকস। প্রাণ দুই ধরনের ফ্রুট ড্রিংকস বাজারে বিক্রি করে। একটি হলো ‘ফ্রুট ফ্লেভারড ড্রিংকস’, অন্যটি ‘ফ্রুট জুস’। বিএসটিআই প্রাণের ‘ফ্রুট ফ্লেভারড ড্রিংকস’-এর লাইসেন্স বাতিল করেছে। এগুলো সাদা ছোট প্লাস্টিকের বোতলে বাজারজাত করা হয়।
বাতিল করা অন্য পণ্যগুলো হলো: প্রমি এগ্রো ফুডস লিমিটেডের প্রমি (লিচি ও অরেঞ্জ), মডার্ন ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেডের ফ্রুট ড্রিংকস মডার্ন, মডার্ন, নিউট্রি এগ্রো ফুডস অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের ফ্রুট ড্রিংকস নিউট্রি অরেঞ্জ, সাফা কনজুমারস প্রোডাক্টসের ফ্রুট ড্রিংকস রকস্টার, ফাস্ট্রাক এগ্রো প্রোডাক্টসের চাটনি কিইসি, মডার্ন হারবাল ফুডের চাটনি মডার্ন, এলিট কনজুমার প্রোডাক্টসের চাটনি এলিট, হাসেম ফুডসের চাটনি সেজান (তেঁতুল), জে কে এগ্রো ফুড প্রোডাক্টের চাটনি সিনথিয়া, ইবনে সিনা ফুড অ্যান্ড প্রোডাক্টের চাটনি ইবনে সিনা, স্বর্ণা ডেইলি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টসের চাটনি স্বর্ণা, হক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজের ওয়েফার বিস্কুট অরেঞ্জ ক্রিম, চকোলেট ক্রিম, কোকোনাটি আলমন্ড অ্যান্ড হানি, ট্রটি ফ্রুটি, ডিংডং, অ্যাংকার ফুড প্রোডাক্টের ওয়েফার বিস্কুট অ্যাংকার, মায়ের অনুদান ফুড প্রোডাক্টের ধনিয়া গুঁড়া জান্নাত, প্রক্সিমার ধনিয়া গুঁড়া পিপিএল, নরসিংদী সিটি মসলা প্রোডাক্টের ধনিয়া গুঁড়া নরসিংদী সিটি, এমএমএইচ মাল্টি কেমিক্যালের ধনিয়া গুঁড়া বাবু ঘোষাল, আরএমপি ম্যানু প্রোডাক্টের ফ্রুট ড্রিংকস আরএমপি, আরা ফুডসের ফ্রুট ড্রিংকস আরা, সিটিজি কনজুমার প্রোডাক্টের ধনিয়া গুঁড়া গৃহিণী, রংধনু ফুডসের ধনিয়া গুঁড়া রংধনু, টিএম এগ্রো ফুড প্রোডাক্টের ধনিয়া গুঁড়া আজ্জ, রহমতউল্লা বাণিজ্যালয়ের ধনিয়া গুঁড়া রান্না, বিএসপি ফুড প্রোডাক্টের ভেজিটেবল ঘি কুকমি, পদ্মা ইলেট্রিক কোম্পানির স্ট্যাটিক ওয়াট আওয়ার মিটার পদ্মা, ঢাকা ফুড ইন্ডাস্ট্রির সেমাই ডায়মন্ড, আলাউদ্দিন সেমাই ফ্যাক্টরির সেমাই আলাউদ্দিন, সার্স ফুড প্রোডাক্টের সেমাই নুরী, মায়া চানাচুর ফ্যাক্টরির সেমাই মদিনা এবং শাহানা সেমাই ফ্যাক্টরির সেমাই লাবণী।
প্রাণ গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান বলেন, প্রাকৃতিক উপাদান থাকতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা তাঁদের ফ্রুট ড্রিংকসের বেলায় ছিল না। এটা কৃত্রিম (সিনথেটিক) পানীয়। দীর্ঘদিন ধরেই বাজারজাত হচ্ছে। কিন্তু বিএসটিআই সম্প্রতি প্রাকৃতিক উপাদান দেওয়ার নতুন মান আরোপ করেছে। এ সম্পর্কে ধারণা ছিল না। ইতিমধ্যে বাজার থেকে লাইসেন্স বাতিল হওয়া পণ্যগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাতিল হওয়া পণ্যগুলো এখন বাজারে নেই বলে জানান হক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কর এ হাফিজ। তিনি বলেন, বিএসটিআই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে লাইসেন্স বাতিল করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম বলেন, কোম্পানিগুলোকে অনেক আগে থেকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রায় কেউই এ ব্যাপারে কোনো জবাব দেয়নি। সচেতনভাবেই মানহীন পণ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.