পাকিস্তান- একজন মালালার জন্য প্রার্থনা by আবদুল মান্নান
পাকিস্তানের সুইজারল্যান্ড হিসেবে খ্যাত সোয়াত উপত্যকার সবচেয়ে বড় শহর মিংগোরার বাসিন্দা ১১ বছরের বালিকা মালালা ইউসুফজাই। শিক্ষক বাবা জিয়া ইউসুফজা ইয়ের আদুরে মেয়ে। প্রথমে হতে চেয়েছিল চিকিৎসক। পরে মত পাল্টে বলল—না, সে একজন সৎ রাজনীতিবিদ হবে। মালালা ভালো উর্দু, ইংরেজি আর পশতু ভাষা জানে।
বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে। মালালা হঠাৎ হোঁচট খেল। কারণ, একদল অন্ধকারের গুহাবাসী, যাদের নাম তালেবান। সবাইকে জানিয়ে দিল—না, কোনো মেয়ে লেখাপড়া করতে পারবে না, বাড়ির চৌহদ্দি পেরোতে পারবে না। মেয়েদের লেখাপড়া আর তাদের বাড়ির বাইরে যাওয়া বেদাত, একেবারে ইসলামবিরোধী হারাম কাজ।
মালালা মানতে নারাজ। তালেবানরা যা-ই বলুক সে স্কুলে যাবে, একদিন বড় রাজনীতিবিদ হবে এবং জনগণের সেবা করবে। স্বপ্ন দেখত মেয়েদের জন্য স্কুল খুলছে। ইসলামের রাসুল (সা.)-ই তো বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ। প্রয়োজনে চীন দেশে যাও। তা হলে কেন মালালা স্কুলে যেতে পারবে না। এটি ২০০৯ সালের কথা। ইতিমধ্যে তালেবান তস্করেরা সোয়াত উপত্যকা দখল করে নিয়েছে। জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে মেয়েদের ৪০০ স্কুল। গৃহবন্দী হয়ে গেল প্রায় ৫০ হাজার স্কুলপড়ুয়া মেয়ে। তাতে ওই অন্ধকারের জীবদের কিছু আসে যায় না। তারা তো নিজেদের ‘আল্লাহর সৈনিক’ মনে করে। মনে করে সব নারীকে বাড়ির অন্দরে বন্দী করে রাখতে পারলে বেহেশতের টিকিট সহজলভ্য হবে।
আফগানিস্তান থেকে দখলদার সোভিয়েত বাহিনীকে উচ্ছেদ করার জন্য আশির দশকে সম্মিলিতভাবে এই তালেবানদের অস্ত্র, অর্থ আর প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র (সিআইএ), সৌদি আরব আর পাকিস্তান (আইএসআই)। তখন তারা বুঝতে পারেনি, একবার এই দৈত্য বোতল থেকে বের হতে পারলে তাকে আর বোতলে ঢোকানো যায় না।
সোয়াত উপত্যকাকে তালেবানমুক্ত করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সাঁড়াশি আক্রমণ চালালে ইউসুফজাই পরিবারসহ প্রায় ১২ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই সাঁড়াশি আক্রমণে তালেবানরা টিকতে না পেরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আফগানিস্তানের কানুর আর নূরিস্তান জেলায় ঘাঁটি গাড়ে। সবাই মনে করেছিল, বোধ হয় আপদ গেল। না, সেই আপদ আবার ভিন্ন লেবাসে ফিরে এসেছে এবং আরও ভয়ংকরভাবে। এবার তাদের প্রধান শত্রু ১৪ বছর বয়সের কিশোরী মালালা। সে তাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সে নিজে তো স্কুলে যায়-ই, সঙ্গে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে স্কুলে যেতে। সে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ সাবলীলভাবে সাক্ষাৎকার দেয় এবং সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়, তালেবানদের হুমকি সত্ত্বেও সে এবং তার সঙ্গীরা স্কুলে যাবে। পড়ালেখা করবে। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী অথবা রাজনীতিবিদ হবে।
বিবিসি আর নিউইয়র্ক টাইমস-এ ছদ্মনামে তার চিন্তাধারার কথা লিখে মালালা ব্লগ লেখে। সোয়াতে তো বটেই, সারা পাকিস্তানের সবাই অবাক হয়ে যায় এই বালিকার সাহস দেখে। এমনকি যারা তালেবানদের ভয়ে গুটিয়ে থাকে, তারাও মনে মনে প্রার্থনা করে মালালার জন্য। পাকিস্তান সরকার তাকে ভূষিত করে জাতীয় শান্তি পুরস্কারে। ২০১১ সালে সে আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়। তালেবানদের মতে, মালালার কথাবার্তা আর কাজের মতো অনৈসলামিক, অশোভন ও অশ্লীল কাজ আর হতে পারে না। খতম করে দিতে হবে ‘ইসলামের এই নালায়েক শত্রুটিকে’।
৯ অক্টোবর, মঙ্গলবার। বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ। একটা সময় ছিল, যখন এ সময় সোয়াত উপত্যকায় আসতেন অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক আর মধুচন্দ্রিমা কাটাতে নতুন বিবাহিত ব্যক্তিরা। এত মনোরম পরিবেশ পাকিস্তানের আর কোথাও পাওয়া যাবে না। কিছুদিন পর সাদা সাদা তুলার মতো বরফ পড়া শুরু হবে। ইংরেজ আমলে অবকাশযাপনের জন্য সারা বছর আসতেন ইংরেজ সাহেবেরা। সবাই ছুটি কাটাতে। ১৯৬১ সালে ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ সোয়াতে এক দিন এক রাত অবকাশযাপনের জন্য এসেছিলেন। বরফ ঢাকা পাহাড়ে স্কি করার জন্য সোয়াতের তুলনা হয় না।
এখন সোয়াতে কেউ একটা আসে না। এই উপত্যকা কিছুদিন আগে পর্যন্ত তালেবানদের বিচরণক্ষেত্র ছিল। হয়ে উঠেছিল এক ভয়াবহ মৃত্যুপুরী। এখনো সম্পূর্ণ নিরাপদ নয় এই উপত্যকা। বলা যেতে পারে, একধরনের কবরের শান্তি বিরাজ করছে এখানে। রাস্তায় দেখা যায় মাথায় বড় পাগড়ি গায়ে নোংরা চাদরওয়ালাদের। কেউ বলতে পারে না চাদরের ভেতরে কী আছে। হয়তো কিছুই নেই অথবা থাকতে পারে একটি আধুনিক কালাশনিকভ সাব-মেশিনগান। এক নিমেষে যে কাউকে ঝাঁজরা করে মিশে যেতে পারে সোয়াতের জনারণ্যে অথবা মিলিয়ে যেতে পারে যেকোনো পর্বতমালায়। তালেবান গেরিলা যোদ্ধাদের সামনে প্রায় সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে অসহায় থাকতে হয়েছে।
দুপুর নাগাদ মালালাদের স্কুল শেষ হয়। বন্ধুদের নিয়ে স্কুলের বাসে বাড়ি ফিরছিল মালালা। স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার সময় সবাই বেশ আনন্দে থাকে। এদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। হঠাৎ সবাই দেখে, বাসের পাশে এক মোটরসাইকেলে দুজন আরোহী। মাথায় পাগড়ি, গায়ে চাদর আর মুখ ঢাকা। বাসের সামনে দিয়ে গিয়ে চালককে বাস থামাতে বাধ্য করে। একজন বাসে চড়ে চাদরের ভেতর থেকে তার আধুনিক কালাশনিকভ রাইফেলটা বের করে বেশ রূঢ়ভাবে বলে, ‘তোমাদের মধ্যে মালালা কে? তাড়াতাড়ি বল, না হয় সবাইকে শেষ করে দেব। সে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। তাকে শাস্তি পেতে হবে।’ হিংস্র দানবটা চিনে ফেলে মালালাকে। সে তো ইতিমধ্যে পাকিস্তানের একজন জাতীয় বীরে পরিণত হয়েছে। তার ছবি শুধু পাকিস্তানে নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। সে ইতিমধ্যে সাহসের প্রতীক হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে সব স্কুলছাত্রী ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। মালালা নির্বিকার। বন্দুকধারী কাছে এসে মালালার মাথায় আর ঘাড়ে তার অস্ত্র ঠেকিয়ে দুটি গুলি করে। কোনো কোনো সংবাদপত্রের মতে তিনটি। সবকিছু হয় ইসলামের নামে। বাসের মেঝে ভেসে যায় একজন মালালা, এ সময়ের সবচেয়ে সাহসী সন্তান, তার রক্তে। তার সঙ্গে ওই দুর্বৃত্ত গুলি করে মালালার আরও দুজন সহপাঠীকে। পরে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের তালেবানের মুখপাত্র এহসানউল্লাহ এহসান ফোনে গণমাধ্যমে জানিয়ে দেন, মালালাকে তাঁর সেনারাই গুলি করেছে। ইসলামের দুশমনদের তাঁরা এভাবে শিক্ষা দেবেন। এবার কোনোমতে বেঁচে গেলে তাঁরা মালালাকে আবার হত্যার জন্য গুলি করবেন। সবকিছুই হবে ইসলামের নামে।
রক্তাক্ত মালালাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় পেশোয়ারে, পরে মুমূর্ষু অবস্থায় রাওয়ালপিন্ডির সামরিক হাসপাতালে। বুলেটের আঘাত এতই গুরুতর ছিল যে চিকিৎসকেরা ভরসা পাচ্ছিলেন না। আবুধাবির শেখের পাঠানো একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে মালালাকে নিয়ে যাওয়া হলো ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের এক বিশেষায়িত হাসপাতালে। মালালা এখন তার মা-বাবার একার সন্তান নয়, সারা বিশ্বের প্রগতিশীল, আধুনিক ও মুক্তমনা সব মানুষের মেয়ে। গুলি খাওয়ার সংবাদ শুনে মালালার বাবা জিয়া ইউসুফজাই ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। তখনো মালালা জ্ঞান হারায়নি। বাবার হাত ধরে মালালা বলে, ‘চিন্তা কোরো না বাবা, আমি ভালো হয়ে যাব। বিজয় আমাদের হবে।’ এরপর সে জ্ঞান হারায়। মালালার বন্ধুরা জানায়, তালেবান তস্করেরা তাদের ওপর হামলা করার আগে তারা সম্মিলিতভাবে একটি পশতু লোকগীত করে, যার সারমর্ম হচ্ছে, ‘আমার মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য আমার প্রেমিকার ঝরানো একটি রক্তবিন্দু দিয়ে আমার কপালে আমি একটা একটা ছোট্ট টিপ দেব; যা বাগানের গোলাপকেও লজ্জায় ফেলে দেবে।’ এই গান ঊনবিংশ শতকের পশতু চারণকবি মালালাই মাইওয়ান্দ জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। মাইওয়ান্দের মালালাই দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধে (১৯৭৮-৮০) অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে এক জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
মনে করা হয়, মালালার নামকরণ তাঁর নামেই করা হয়েছিল। একসময় বাংলাদেশে ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগানটি বেশ পরিচিত ছিল। স্লোগানটি প্রথম দেওয়া হয় সম্ভবত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ১৯৯৭ সালে। তখন আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। যার নেতৃত্বে এই স্লোগান, সেই ছাত্রনেতা এখন কক্সবাজারের জামায়াতের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। বেশ কটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল নাকি সে চালায়। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তখন এই স্লোগানের তাৎপর্য বোঝেননি। এখন নিয়মিত বিরতি দিয়ে পাকিস্তানি তালেবানদের বাংলাদেশি বংশধরেরা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে নারীনীতি আর সেক্যুলার শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এখন থেকে সরকারসহ সবাই সাবধান না হলে হয়তো কিছুদিন পর বাংলাদেশি তালেবানেরা বাংলাদেশি মালালাদের খোঁজা শুরু করবে।
একসময় মনে হতো, সার্বিক বিশ্লেষণে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এটির বিলুপ্তি সময়ের ব্যাপার। কিন্তু যখন দেখি পাকিস্তানে একটি মালালা প্রজন্মের জন্ম হয়েছে তখন মনে হয়, হয়তো রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব ঠিক থাকলে টিকে যেতে পারে পাকিস্তান। সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক মালালা তার মাতৃভূমিতে, ফিরে আসুক তার মা-বাবা আর বন্ধুদের কাছে। মালালা আবার বলুক, ‘আমরা লেখাপড়া করতে চাই। হতে চাই চিকিৎসক, প্রকৌশলী অথবা রাজনীতিবিদ।’ শান্তির ধর্ম ইসলামে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করা মহাপাপ। ইসলাম ধর্মই ঘোষণা করেছে, শহীদের রক্তের চেয়ে একজন জ্ঞানীর মসির (কলম) কালি অনেক বেশি পবিত্র। ইসলামের প্রথম যুগে নারীরা যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে পুরুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন।
ফিরে আসো মালালা। সভ্যতা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশ থেকে তোমাকে অভিবাদন মালালা।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মালালা মানতে নারাজ। তালেবানরা যা-ই বলুক সে স্কুলে যাবে, একদিন বড় রাজনীতিবিদ হবে এবং জনগণের সেবা করবে। স্বপ্ন দেখত মেয়েদের জন্য স্কুল খুলছে। ইসলামের রাসুল (সা.)-ই তো বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ। প্রয়োজনে চীন দেশে যাও। তা হলে কেন মালালা স্কুলে যেতে পারবে না। এটি ২০০৯ সালের কথা। ইতিমধ্যে তালেবান তস্করেরা সোয়াত উপত্যকা দখল করে নিয়েছে। জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে মেয়েদের ৪০০ স্কুল। গৃহবন্দী হয়ে গেল প্রায় ৫০ হাজার স্কুলপড়ুয়া মেয়ে। তাতে ওই অন্ধকারের জীবদের কিছু আসে যায় না। তারা তো নিজেদের ‘আল্লাহর সৈনিক’ মনে করে। মনে করে সব নারীকে বাড়ির অন্দরে বন্দী করে রাখতে পারলে বেহেশতের টিকিট সহজলভ্য হবে।
আফগানিস্তান থেকে দখলদার সোভিয়েত বাহিনীকে উচ্ছেদ করার জন্য আশির দশকে সম্মিলিতভাবে এই তালেবানদের অস্ত্র, অর্থ আর প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র (সিআইএ), সৌদি আরব আর পাকিস্তান (আইএসআই)। তখন তারা বুঝতে পারেনি, একবার এই দৈত্য বোতল থেকে বের হতে পারলে তাকে আর বোতলে ঢোকানো যায় না।
সোয়াত উপত্যকাকে তালেবানমুক্ত করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সাঁড়াশি আক্রমণ চালালে ইউসুফজাই পরিবারসহ প্রায় ১২ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই সাঁড়াশি আক্রমণে তালেবানরা টিকতে না পেরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আফগানিস্তানের কানুর আর নূরিস্তান জেলায় ঘাঁটি গাড়ে। সবাই মনে করেছিল, বোধ হয় আপদ গেল। না, সেই আপদ আবার ভিন্ন লেবাসে ফিরে এসেছে এবং আরও ভয়ংকরভাবে। এবার তাদের প্রধান শত্রু ১৪ বছর বয়সের কিশোরী মালালা। সে তাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সে নিজে তো স্কুলে যায়-ই, সঙ্গে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে স্কুলে যেতে। সে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ সাবলীলভাবে সাক্ষাৎকার দেয় এবং সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়, তালেবানদের হুমকি সত্ত্বেও সে এবং তার সঙ্গীরা স্কুলে যাবে। পড়ালেখা করবে। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী অথবা রাজনীতিবিদ হবে।
বিবিসি আর নিউইয়র্ক টাইমস-এ ছদ্মনামে তার চিন্তাধারার কথা লিখে মালালা ব্লগ লেখে। সোয়াতে তো বটেই, সারা পাকিস্তানের সবাই অবাক হয়ে যায় এই বালিকার সাহস দেখে। এমনকি যারা তালেবানদের ভয়ে গুটিয়ে থাকে, তারাও মনে মনে প্রার্থনা করে মালালার জন্য। পাকিস্তান সরকার তাকে ভূষিত করে জাতীয় শান্তি পুরস্কারে। ২০১১ সালে সে আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়। তালেবানদের মতে, মালালার কথাবার্তা আর কাজের মতো অনৈসলামিক, অশোভন ও অশ্লীল কাজ আর হতে পারে না। খতম করে দিতে হবে ‘ইসলামের এই নালায়েক শত্রুটিকে’।
৯ অক্টোবর, মঙ্গলবার। বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ। একটা সময় ছিল, যখন এ সময় সোয়াত উপত্যকায় আসতেন অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক আর মধুচন্দ্রিমা কাটাতে নতুন বিবাহিত ব্যক্তিরা। এত মনোরম পরিবেশ পাকিস্তানের আর কোথাও পাওয়া যাবে না। কিছুদিন পর সাদা সাদা তুলার মতো বরফ পড়া শুরু হবে। ইংরেজ আমলে অবকাশযাপনের জন্য সারা বছর আসতেন ইংরেজ সাহেবেরা। সবাই ছুটি কাটাতে। ১৯৬১ সালে ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ সোয়াতে এক দিন এক রাত অবকাশযাপনের জন্য এসেছিলেন। বরফ ঢাকা পাহাড়ে স্কি করার জন্য সোয়াতের তুলনা হয় না।
এখন সোয়াতে কেউ একটা আসে না। এই উপত্যকা কিছুদিন আগে পর্যন্ত তালেবানদের বিচরণক্ষেত্র ছিল। হয়ে উঠেছিল এক ভয়াবহ মৃত্যুপুরী। এখনো সম্পূর্ণ নিরাপদ নয় এই উপত্যকা। বলা যেতে পারে, একধরনের কবরের শান্তি বিরাজ করছে এখানে। রাস্তায় দেখা যায় মাথায় বড় পাগড়ি গায়ে নোংরা চাদরওয়ালাদের। কেউ বলতে পারে না চাদরের ভেতরে কী আছে। হয়তো কিছুই নেই অথবা থাকতে পারে একটি আধুনিক কালাশনিকভ সাব-মেশিনগান। এক নিমেষে যে কাউকে ঝাঁজরা করে মিশে যেতে পারে সোয়াতের জনারণ্যে অথবা মিলিয়ে যেতে পারে যেকোনো পর্বতমালায়। তালেবান গেরিলা যোদ্ধাদের সামনে প্রায় সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে অসহায় থাকতে হয়েছে।
দুপুর নাগাদ মালালাদের স্কুল শেষ হয়। বন্ধুদের নিয়ে স্কুলের বাসে বাড়ি ফিরছিল মালালা। স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার সময় সবাই বেশ আনন্দে থাকে। এদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। হঠাৎ সবাই দেখে, বাসের পাশে এক মোটরসাইকেলে দুজন আরোহী। মাথায় পাগড়ি, গায়ে চাদর আর মুখ ঢাকা। বাসের সামনে দিয়ে গিয়ে চালককে বাস থামাতে বাধ্য করে। একজন বাসে চড়ে চাদরের ভেতর থেকে তার আধুনিক কালাশনিকভ রাইফেলটা বের করে বেশ রূঢ়ভাবে বলে, ‘তোমাদের মধ্যে মালালা কে? তাড়াতাড়ি বল, না হয় সবাইকে শেষ করে দেব। সে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। তাকে শাস্তি পেতে হবে।’ হিংস্র দানবটা চিনে ফেলে মালালাকে। সে তো ইতিমধ্যে পাকিস্তানের একজন জাতীয় বীরে পরিণত হয়েছে। তার ছবি শুধু পাকিস্তানে নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। সে ইতিমধ্যে সাহসের প্রতীক হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে সব স্কুলছাত্রী ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। মালালা নির্বিকার। বন্দুকধারী কাছে এসে মালালার মাথায় আর ঘাড়ে তার অস্ত্র ঠেকিয়ে দুটি গুলি করে। কোনো কোনো সংবাদপত্রের মতে তিনটি। সবকিছু হয় ইসলামের নামে। বাসের মেঝে ভেসে যায় একজন মালালা, এ সময়ের সবচেয়ে সাহসী সন্তান, তার রক্তে। তার সঙ্গে ওই দুর্বৃত্ত গুলি করে মালালার আরও দুজন সহপাঠীকে। পরে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের তালেবানের মুখপাত্র এহসানউল্লাহ এহসান ফোনে গণমাধ্যমে জানিয়ে দেন, মালালাকে তাঁর সেনারাই গুলি করেছে। ইসলামের দুশমনদের তাঁরা এভাবে শিক্ষা দেবেন। এবার কোনোমতে বেঁচে গেলে তাঁরা মালালাকে আবার হত্যার জন্য গুলি করবেন। সবকিছুই হবে ইসলামের নামে।
রক্তাক্ত মালালাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় পেশোয়ারে, পরে মুমূর্ষু অবস্থায় রাওয়ালপিন্ডির সামরিক হাসপাতালে। বুলেটের আঘাত এতই গুরুতর ছিল যে চিকিৎসকেরা ভরসা পাচ্ছিলেন না। আবুধাবির শেখের পাঠানো একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে মালালাকে নিয়ে যাওয়া হলো ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের এক বিশেষায়িত হাসপাতালে। মালালা এখন তার মা-বাবার একার সন্তান নয়, সারা বিশ্বের প্রগতিশীল, আধুনিক ও মুক্তমনা সব মানুষের মেয়ে। গুলি খাওয়ার সংবাদ শুনে মালালার বাবা জিয়া ইউসুফজাই ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। তখনো মালালা জ্ঞান হারায়নি। বাবার হাত ধরে মালালা বলে, ‘চিন্তা কোরো না বাবা, আমি ভালো হয়ে যাব। বিজয় আমাদের হবে।’ এরপর সে জ্ঞান হারায়। মালালার বন্ধুরা জানায়, তালেবান তস্করেরা তাদের ওপর হামলা করার আগে তারা সম্মিলিতভাবে একটি পশতু লোকগীত করে, যার সারমর্ম হচ্ছে, ‘আমার মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য আমার প্রেমিকার ঝরানো একটি রক্তবিন্দু দিয়ে আমার কপালে আমি একটা একটা ছোট্ট টিপ দেব; যা বাগানের গোলাপকেও লজ্জায় ফেলে দেবে।’ এই গান ঊনবিংশ শতকের পশতু চারণকবি মালালাই মাইওয়ান্দ জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। মাইওয়ান্দের মালালাই দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধে (১৯৭৮-৮০) অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে এক জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
মনে করা হয়, মালালার নামকরণ তাঁর নামেই করা হয়েছিল। একসময় বাংলাদেশে ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগানটি বেশ পরিচিত ছিল। স্লোগানটি প্রথম দেওয়া হয় সম্ভবত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ১৯৯৭ সালে। তখন আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। যার নেতৃত্বে এই স্লোগান, সেই ছাত্রনেতা এখন কক্সবাজারের জামায়াতের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। বেশ কটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল নাকি সে চালায়। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তখন এই স্লোগানের তাৎপর্য বোঝেননি। এখন নিয়মিত বিরতি দিয়ে পাকিস্তানি তালেবানদের বাংলাদেশি বংশধরেরা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে নারীনীতি আর সেক্যুলার শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এখন থেকে সরকারসহ সবাই সাবধান না হলে হয়তো কিছুদিন পর বাংলাদেশি তালেবানেরা বাংলাদেশি মালালাদের খোঁজা শুরু করবে।
একসময় মনে হতো, সার্বিক বিশ্লেষণে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এটির বিলুপ্তি সময়ের ব্যাপার। কিন্তু যখন দেখি পাকিস্তানে একটি মালালা প্রজন্মের জন্ম হয়েছে তখন মনে হয়, হয়তো রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব ঠিক থাকলে টিকে যেতে পারে পাকিস্তান। সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক মালালা তার মাতৃভূমিতে, ফিরে আসুক তার মা-বাবা আর বন্ধুদের কাছে। মালালা আবার বলুক, ‘আমরা লেখাপড়া করতে চাই। হতে চাই চিকিৎসক, প্রকৌশলী অথবা রাজনীতিবিদ।’ শান্তির ধর্ম ইসলামে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করা মহাপাপ। ইসলাম ধর্মই ঘোষণা করেছে, শহীদের রক্তের চেয়ে একজন জ্ঞানীর মসির (কলম) কালি অনেক বেশি পবিত্র। ইসলামের প্রথম যুগে নারীরা যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে পুরুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন।
ফিরে আসো মালালা। সভ্যতা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশ থেকে তোমাকে অভিবাদন মালালা।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments