কালের পুরাণ- সরকারের সাংবাদিক বর্জন! by সোহরাব হাসান
পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের অনুষ্ঠানাদির খবর সংগ্রহের দুটি উপায় আছে। প্রথমত, গণমাধ্যমকর্মীরা অনুমতি নিয়ে সরাসরি সেই অনুষ্ঠানের খবর পরিবেশন করবেন। দ্বিতীয়ত, সেই অনুষ্ঠানে প্রবেশের সুযোগ না দিয়ে সরকার মুখপাত্রের মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীদের অনুষ্ঠানের খবর জানাবে।
নিরাপত্তা বা অন্য কোনো কারণে তারা প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির সব কর্মসূচিতে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ না-ও জানাতে পারে। সে ক্ষেত্রে অনুষ্ঠান বা কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর সরকারের মুখপাত্র প্রেস ব্রিফিং করবেন এবং সেখানে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাবেন—এটাই সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের রীতি। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত না হয়েও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা তথ্য পাওয়ার অধিকারী। সে কারণেই সরকার মুখপাত্রের মাধ্যমে তার কর্মকাণ্ডের খবর জানিয়ে থাকে।
বাংলাদেশে এত দিন প্রধানমন্ত্রীর প্রায় সব অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহের জন্য গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা আমন্ত্রণ পেতেন। এটি ভালো দৃষ্টান্ত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সম্পর্কও বেশ ভালো বলে আমরা জানতাম। বিশেষ করে, ঢাকার বা দেশের বাইরে কোথাও সফরে গেলে শেখ হাসিনা সব সময় সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। ফলে সরকারের বৈরী বলে পরিচিত, এমন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও শেখ হাসিনার এই আন্তরিকতা সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখেন। এর বিপরীতে অনেকেরই মনে থাকার কথা, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী সাংবাদিকেরা একবার চরম বৈরী পরিস্থিতির শিকার হয়ে সংবাদ না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে যা কখনোই ঘটেনি।
কিন্তু হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানাদিতে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ বা আমন্ত্রণ না জানানো যেমন গণমাধ্যমের কর্মীদের প্রতি সরকারের বৈরী আচরণের বহিঃপ্রকাশ, তেমনি স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্যও মহা অশনিসংকেত। গত বুধবার এ-সংক্রান্ত খবর পত্রিকায় প্রকাশের পর নতুন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে বলেছিলেন, ‘আনুষ্ঠানিক কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
যে বিষয়টি প্রকাশ্যে ঘটেছে এবং দেশের তাবৎ সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যম প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত, সেখানে খতিয়ে দেখার কিছু আছে বলে মনে হয় না। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার ক্ষমতা কারও নেই।’ কিন্তু গণমাধ্যমের সঙ্গে অসহযোগিতা করা কিংবা সরকারপ্রধানের অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত করা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে না।
পরদিনই প্রথম আলোয় খবর হলো: ‘প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর ব্রিফিংয়ে নিয়মিত সাংবাদিকদের ডাকা হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল এর ব্যতিক্রম। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিশেষ মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সংবাদ ব্রিফিংয়ের জন্য প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের ডাকা হয়নি। তবে শুধু সরকারি পরিচালনাধীন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এবং বেসরকারি সংবাদ সংস্থা ইউএনবি ও অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ ২৪ ডটকম ওই বৈঠকের ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছে...সাধারণভাবে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে তথ্য অধিদপ্তর থেকে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হলে প্রেস শাখা থেকে বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের জানানো হতো। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের বৈঠকের বিষয়ে ব্রিফ করেন। প্রসঙ্গত, তিন দিন ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহের জন্য আগের মতো সাংবাদিকদের ডাকা হচ্ছে না।’ (প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর ২০১২)
এখন প্রশ্ন হলো, এই অভূতপূর্ব ঘটনা কেন ঘটল? প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তথ্যমন্ত্রী বললেন, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহ করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, চীনের প্রাচীরের মতো কঠিন বাধা।
আমাদের ধারণা ছিল, পত্রিকার লেখালেখি কিংবা টিভি টক শোতে কোনো কাজ হয় না। এখন দেখতে পাচ্ছি, অনেক বেশি কাজ হয়। প্রতিটি সংবাদ ও বিশ্লেষণ পড়ে পাঠক অনলাইনে ত্বরিত জবাব দেন। প্রতিদিন পক্ষে-বিপক্ষে অজস্র প্রতিক্রিয়া আসে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রচার বিভাগের বিশাল বাহিনীকে দিয়ে এসব প্রতিক্রিয়া দেখে নিলে সারা দেশের মানুষের প্রকৃত মনোভাবটি বুঝতে পারতেন, যা দলীয় লোক বা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জানা যায় না। তাঁরা সেই খবরই প্রধানমন্ত্রীকে দেবেন, যেটি তিনি শুনতে পছন্দ করবেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকারকে কী ধরনের প্রতিবেদন দিত, প্রধানমন্ত্রী একবার স্মরণ করে দেখতে পারেন। সরকারের বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করার অর্থ তাঁর শত্রুতা করা নয়। প্রধানমন্ত্রী সমালোচকদের কাছে টানতে না পারুন, স্তাবকদের থেকে দূরে থাকুন।
গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর প্রতিবেদনে সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারে সরকার ক্ষুব্ধ। সরকার মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে অগ্রাধিকার নির্ণয় ও গুরুত্ব নির্ধারণ করা হয় না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ ব্যাপারে নাখোশ বলে সূত্র জানিয়েছে। (প্রথম আলো, ১৮ অক্টোবর ২০১২)।
তা প্রধানমন্ত্রী নাখোশ হতেই পারেন। কিন্তু তাই বলে তাঁর দরজা সাংবাদিকদের জন্য বন্ধ করতে পারেন না। তিনি একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধান। জনগণের কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতেই হবে। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার বিষয়টিও আলোচনা হওয়া জরুরি। কোনো কোনো গণমাধ্যম যে মনের মাধুরী মিশিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে, তাতে সন্দেহ নেই। যেমন, একটি পত্রিকা প্রথম পাতায় সংবাদ ছেপে দেয়, ‘বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর রাতের টক শোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হবে।’ (আমার দেশ, ১৬ অক্টোবর ২০১২)। ওই দিন তথ্যমন্ত্রী ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করলেও টিভির টক শো নিয়ে কোনো কথা হয়নি। আরেকটি বার্তা সংস্থা খবর দিয়েছে, ‘সফররত বিশ্বব্যাংক প্যানেলের সঙ্গে সরকারবিরোধী নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নৈশভোজ’। নাগরিক সমাজের এই প্রতিনিধিরা যে সরকারবিরোধী, এই তথ্যটি বার্তা সংস্থাটি কোথায় পেল? সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করলেই কেউ সরকারবিরোধী হয়ে যান না। সাংবাদিকতার স্বাধীনতার নামে এ ধরনের মনের মাধুরী মেশানো খবর পরিবেশন সমীচীন নয়।
আমরা যত দূর জানি, সাম্প্রতিক কালে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জেলার দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যে মতবিনিময় করেন, তাতে তাঁর বেশ কিছু মন্তব্য নিয়ে সব মহলে ব্যাপক আলোচনা হয়। বিশেষ করে, বিশ্বব্যাংকের প্যানেল সদস্যদের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে আমন্ত্রিত অতিথি, সাংসদদের নেতিবাচক কার্যক্রম সম্পর্কে টিআইবির প্রতিবেদন, মধ্যরাতে টিভি টক শো এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান, সাংবাদিক এবিএম মূসাসহ অনেকের নাম ধরে তিনি সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নানা মন্তব্য পাঠক ও দর্শকের মধ্যে যেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তেমনি এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। সেসব সমালোচনা অযৌক্তিক হলে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো যেত, এমনকি প্রতিকার চেয়ে প্রেস কাউন্সিলে মামলাও করা যেত। কিন্তু সেসব না করে সাংবাদিক বর্জনের কাজটি আত্মঘাতী হয়েছে বলেই আমরা মনে করি। যেই সরকার বেসরকারি টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠার দাবিদার, যেই সরকার জনগণের তথ্য পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তথ্য অধিকার আইন করেছে, সেই সরকার কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রবেশ রুদ্ধ করে দেয়? শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী থাকাকালে তাঁর অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহে কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ওপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করা হয়েছিল। সেটি ছিল সাময়িক। আশা করি, এবারও প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে বা প্রেস ব্রিফিংয়ে সব গণমাধ্যম প্রবেশের ওপর জারি করা ‘নিষেধাজ্ঞা’ও স্থায়ী হবে না।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে পড়ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী, তখনো তাঁর বক্তব্য নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছিল। সেসব সমালোচনা সম্পর্কে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেছিলেন, অন্য কেউ কথা বললে পত্রিকায় আসে না, সে কারণেই সত্য কথাটি তাঁর বলতে হয়। সে সময় শেখ হাসিনা সৎ সাহসের সঙ্গে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে পারলে এখন ভয় পাচ্ছেন কেন?
হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতে পারেন। সেসব বৈঠকের খবর বাইরে প্রচার করতে না-ও পারেন। সাংবাদিকের কাজ হবে সেখানে প্রবেশাধিকার না পেয়েও বৈঠকের বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশন করা। কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠক বা সরকারের কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে জানানো সরকারের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। রাষ্ট্র পরিচালনা কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা পছন্দ-অপছন্দের বিষয় নয়। সরকার তথ্য অধিকার আইন করেছে জনগণকে তথ্য জানাতে। সেখানে তথ্য থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই।
বৃহস্পতিবারের মন্ত্রিসভার খবর সংগ্রহের জন্য সরকারনিয়ন্ত্রিত বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি বার্তা সংস্থা ইউএনবি ও বিডিনিউজ ২৪ ডটকমকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কোন নীতিমালার ভিত্তিতে? বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার সরকারি সংস্থা, কিন্তু ইউএনবি বা বিডিনিউজ তো ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রতিনিধিরা আমন্ত্রণ পেলে অন্যরা পাবেন না কেন? যেকোনো সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেল তো এই তিনটি সংস্থার গ্রাহক না-ও হতে পারে? সে ক্ষেত্রে তারা কি প্রধানমন্ত্রীর খবর পরিবেশন থেকে বঞ্চিত থাকবে?
সাংবাদিকেরা সরকারের বন্ধুও নয়, শত্রুও নয়। তার কাজ বস্তুনিষ্ঠভাবে খবর পরিবেশন। কারও সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া কিংবা কারও বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপনের অধিকার তার নেই। তেমনি সরকার কোনো গণমাধ্যমকে পছন্দ করতে পারে, আবার কাউকে অপছন্দ করতে পারে। কিন্তু আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে বৈষম্য করতে পারে না। সাংবাদিকদের জন্য সরকারের দরজা বন্ধ করা খুবই বিপজ্জনক। তাতে দেশে গণতন্ত্রের দরজাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
বাংলাদেশে এত দিন প্রধানমন্ত্রীর প্রায় সব অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহের জন্য গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা আমন্ত্রণ পেতেন। এটি ভালো দৃষ্টান্ত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সম্পর্কও বেশ ভালো বলে আমরা জানতাম। বিশেষ করে, ঢাকার বা দেশের বাইরে কোথাও সফরে গেলে শেখ হাসিনা সব সময় সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। ফলে সরকারের বৈরী বলে পরিচিত, এমন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও শেখ হাসিনার এই আন্তরিকতা সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখেন। এর বিপরীতে অনেকেরই মনে থাকার কথা, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী সাংবাদিকেরা একবার চরম বৈরী পরিস্থিতির শিকার হয়ে সংবাদ না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে যা কখনোই ঘটেনি।
কিন্তু হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানাদিতে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ বা আমন্ত্রণ না জানানো যেমন গণমাধ্যমের কর্মীদের প্রতি সরকারের বৈরী আচরণের বহিঃপ্রকাশ, তেমনি স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্যও মহা অশনিসংকেত। গত বুধবার এ-সংক্রান্ত খবর পত্রিকায় প্রকাশের পর নতুন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে বলেছিলেন, ‘আনুষ্ঠানিক কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
যে বিষয়টি প্রকাশ্যে ঘটেছে এবং দেশের তাবৎ সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যম প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত, সেখানে খতিয়ে দেখার কিছু আছে বলে মনে হয় না। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার ক্ষমতা কারও নেই।’ কিন্তু গণমাধ্যমের সঙ্গে অসহযোগিতা করা কিংবা সরকারপ্রধানের অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত করা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে না।
পরদিনই প্রথম আলোয় খবর হলো: ‘প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর ব্রিফিংয়ে নিয়মিত সাংবাদিকদের ডাকা হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল এর ব্যতিক্রম। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিশেষ মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সংবাদ ব্রিফিংয়ের জন্য প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের ডাকা হয়নি। তবে শুধু সরকারি পরিচালনাধীন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এবং বেসরকারি সংবাদ সংস্থা ইউএনবি ও অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ ২৪ ডটকম ওই বৈঠকের ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছে...সাধারণভাবে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে তথ্য অধিদপ্তর থেকে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হলে প্রেস শাখা থেকে বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের জানানো হতো। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের বৈঠকের বিষয়ে ব্রিফ করেন। প্রসঙ্গত, তিন দিন ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহের জন্য আগের মতো সাংবাদিকদের ডাকা হচ্ছে না।’ (প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর ২০১২)
এখন প্রশ্ন হলো, এই অভূতপূর্ব ঘটনা কেন ঘটল? প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তথ্যমন্ত্রী বললেন, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহ করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, চীনের প্রাচীরের মতো কঠিন বাধা।
আমাদের ধারণা ছিল, পত্রিকার লেখালেখি কিংবা টিভি টক শোতে কোনো কাজ হয় না। এখন দেখতে পাচ্ছি, অনেক বেশি কাজ হয়। প্রতিটি সংবাদ ও বিশ্লেষণ পড়ে পাঠক অনলাইনে ত্বরিত জবাব দেন। প্রতিদিন পক্ষে-বিপক্ষে অজস্র প্রতিক্রিয়া আসে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রচার বিভাগের বিশাল বাহিনীকে দিয়ে এসব প্রতিক্রিয়া দেখে নিলে সারা দেশের মানুষের প্রকৃত মনোভাবটি বুঝতে পারতেন, যা দলীয় লোক বা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জানা যায় না। তাঁরা সেই খবরই প্রধানমন্ত্রীকে দেবেন, যেটি তিনি শুনতে পছন্দ করবেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকারকে কী ধরনের প্রতিবেদন দিত, প্রধানমন্ত্রী একবার স্মরণ করে দেখতে পারেন। সরকারের বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করার অর্থ তাঁর শত্রুতা করা নয়। প্রধানমন্ত্রী সমালোচকদের কাছে টানতে না পারুন, স্তাবকদের থেকে দূরে থাকুন।
গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর প্রতিবেদনে সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারে সরকার ক্ষুব্ধ। সরকার মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে অগ্রাধিকার নির্ণয় ও গুরুত্ব নির্ধারণ করা হয় না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ ব্যাপারে নাখোশ বলে সূত্র জানিয়েছে। (প্রথম আলো, ১৮ অক্টোবর ২০১২)।
তা প্রধানমন্ত্রী নাখোশ হতেই পারেন। কিন্তু তাই বলে তাঁর দরজা সাংবাদিকদের জন্য বন্ধ করতে পারেন না। তিনি একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধান। জনগণের কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতেই হবে। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার বিষয়টিও আলোচনা হওয়া জরুরি। কোনো কোনো গণমাধ্যম যে মনের মাধুরী মিশিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে, তাতে সন্দেহ নেই। যেমন, একটি পত্রিকা প্রথম পাতায় সংবাদ ছেপে দেয়, ‘বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর রাতের টক শোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হবে।’ (আমার দেশ, ১৬ অক্টোবর ২০১২)। ওই দিন তথ্যমন্ত্রী ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করলেও টিভির টক শো নিয়ে কোনো কথা হয়নি। আরেকটি বার্তা সংস্থা খবর দিয়েছে, ‘সফররত বিশ্বব্যাংক প্যানেলের সঙ্গে সরকারবিরোধী নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নৈশভোজ’। নাগরিক সমাজের এই প্রতিনিধিরা যে সরকারবিরোধী, এই তথ্যটি বার্তা সংস্থাটি কোথায় পেল? সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করলেই কেউ সরকারবিরোধী হয়ে যান না। সাংবাদিকতার স্বাধীনতার নামে এ ধরনের মনের মাধুরী মেশানো খবর পরিবেশন সমীচীন নয়।
আমরা যত দূর জানি, সাম্প্রতিক কালে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জেলার দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যে মতবিনিময় করেন, তাতে তাঁর বেশ কিছু মন্তব্য নিয়ে সব মহলে ব্যাপক আলোচনা হয়। বিশেষ করে, বিশ্বব্যাংকের প্যানেল সদস্যদের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে আমন্ত্রিত অতিথি, সাংসদদের নেতিবাচক কার্যক্রম সম্পর্কে টিআইবির প্রতিবেদন, মধ্যরাতে টিভি টক শো এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান, সাংবাদিক এবিএম মূসাসহ অনেকের নাম ধরে তিনি সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নানা মন্তব্য পাঠক ও দর্শকের মধ্যে যেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তেমনি এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। সেসব সমালোচনা অযৌক্তিক হলে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো যেত, এমনকি প্রতিকার চেয়ে প্রেস কাউন্সিলে মামলাও করা যেত। কিন্তু সেসব না করে সাংবাদিক বর্জনের কাজটি আত্মঘাতী হয়েছে বলেই আমরা মনে করি। যেই সরকার বেসরকারি টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠার দাবিদার, যেই সরকার জনগণের তথ্য পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তথ্য অধিকার আইন করেছে, সেই সরকার কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রবেশ রুদ্ধ করে দেয়? শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী থাকাকালে তাঁর অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহে কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ওপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করা হয়েছিল। সেটি ছিল সাময়িক। আশা করি, এবারও প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে বা প্রেস ব্রিফিংয়ে সব গণমাধ্যম প্রবেশের ওপর জারি করা ‘নিষেধাজ্ঞা’ও স্থায়ী হবে না।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে পড়ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী, তখনো তাঁর বক্তব্য নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছিল। সেসব সমালোচনা সম্পর্কে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেছিলেন, অন্য কেউ কথা বললে পত্রিকায় আসে না, সে কারণেই সত্য কথাটি তাঁর বলতে হয়। সে সময় শেখ হাসিনা সৎ সাহসের সঙ্গে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে পারলে এখন ভয় পাচ্ছেন কেন?
হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতে পারেন। সেসব বৈঠকের খবর বাইরে প্রচার করতে না-ও পারেন। সাংবাদিকের কাজ হবে সেখানে প্রবেশাধিকার না পেয়েও বৈঠকের বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশন করা। কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠক বা সরকারের কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে জানানো সরকারের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। রাষ্ট্র পরিচালনা কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা পছন্দ-অপছন্দের বিষয় নয়। সরকার তথ্য অধিকার আইন করেছে জনগণকে তথ্য জানাতে। সেখানে তথ্য থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই।
বৃহস্পতিবারের মন্ত্রিসভার খবর সংগ্রহের জন্য সরকারনিয়ন্ত্রিত বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি বার্তা সংস্থা ইউএনবি ও বিডিনিউজ ২৪ ডটকমকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কোন নীতিমালার ভিত্তিতে? বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার সরকারি সংস্থা, কিন্তু ইউএনবি বা বিডিনিউজ তো ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রতিনিধিরা আমন্ত্রণ পেলে অন্যরা পাবেন না কেন? যেকোনো সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেল তো এই তিনটি সংস্থার গ্রাহক না-ও হতে পারে? সে ক্ষেত্রে তারা কি প্রধানমন্ত্রীর খবর পরিবেশন থেকে বঞ্চিত থাকবে?
সাংবাদিকেরা সরকারের বন্ধুও নয়, শত্রুও নয়। তার কাজ বস্তুনিষ্ঠভাবে খবর পরিবেশন। কারও সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া কিংবা কারও বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপনের অধিকার তার নেই। তেমনি সরকার কোনো গণমাধ্যমকে পছন্দ করতে পারে, আবার কাউকে অপছন্দ করতে পারে। কিন্তু আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে বৈষম্য করতে পারে না। সাংবাদিকদের জন্য সরকারের দরজা বন্ধ করা খুবই বিপজ্জনক। তাতে দেশে গণতন্ত্রের দরজাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments