ভারত ও বাংলাদেশ-সম্পর্ক কি প্রকৃতই বন্ধুত্বের? by সিরাজুর রহমান

ইংরেজিতে কথাটা হচ্ছে ‘মেকিং দ্য ফেন্স’-বেড়া মেরামত করা। কথাটা ব্যবহার করা হয় বন্ধুত্ব সংহত করা অর্থে। তাৎপর্য এই যে, দুই বাড়ি কিংবা দুই সম্পত্তির মধ্যকার বেড়াটা মজবুত না হলে প্রতিবেশীদের মধ্যে বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার কারণ যে কোনো সময় ঘটতে পারে।

এক বাড়ির আবর্জনা প্রতিবেশীর বাগানে ফেলা থেকে শুরু করে এ-বাড়ির লিচু ও-বাড়ির ছেলেদের পেড়ে খাওয়া, প্রতিবেশীর গরু এ-বাড়ির ফুলের চারা কিংবা এ প্রতিবেশীর ক্ষেতের ফসল খাওয়া ইত্যাদি থেকে শুরু করে ক্ষেতের আইল কিংবা খুঁটি সরিয়ে প্রতিবেশীর খানিকটা জমি দখল করে নেয়া পর্যন্ত বহু সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে শক্ত বেড়া দিয়ে দুই প্রতিবেশীর সম্পত্তি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা না হলে। বেড়াটা মেরামত করা সেজন্যই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

এই ইংরেজি কথাটা সচরাচর ব্যবহার করা হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। বন্ধুত্বের গোড়ার কথা হচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে একপ্রস্থ নিয়মাবলী কঠোরভাবে মেনে চলা। বন্ধুর সম্পত্তিতে যেমন হাত দেয়া যাবে না, তেমনি তার ঘরোয়া ব্যাপারে কথা বলাও বিধিবহির্ভূত। বিশ্বমঞ্চের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঐতিহাসিক কাল থেকেই বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ বন্ধুত্ব টিকে আছে তারা এই বিধি-নিষেধগুলো মেনে চলছে বলেই। দু’দেশের মধ্যে আছে বিশাল অতলান্তিক মহাসাগর। সুতরাং আইল-ঠেলাঠেলির প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু অন্য সব ব্যাপারেও তারা এসব নিয়ম মেনে চলে।

সবাই জানে, মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক দলের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বেশি বৃটিশ লেবার পার্টির। অন্যদিকে বৃটিশ টোরি পার্টি ও মার্কিন রিপাবলিকান পার্টি মোটামুটি একই ধরনের রক্ষণশীল নীতি অনুসরণ করে। কিন্তু একে অন্যের নীতি সম্পর্কে তারা কখনও কথা বলে না। বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক চলছে নভেম্বর মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু কোনো বৃটিশ রাজনীতিককে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নাক গলাতে দেখেছেন কেউ? মোটামুটি বলা চলে, বৃটিশ মিডিয়াও মার্কিন নির্বাচনের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে না।

এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতেই হবে যে, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের সম্পর্ক সত্যিকারের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নয়। বলতেই হবে যে সেজন্য দায়ী ভারতের বৈদেশিক নীতি, বিশেষ করে ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং ‘র’-এর অনভিপ্রেত কার্যকলাপ।

আধুনিক কূটনীতিতে গোয়েন্দাগিরি ও গুপ্তচরবৃত্তি একটা স্বীকৃত আচরণ। পরস্পরের দেশে কী ঘটছে সেটা আগাম জানা থাকলে নীতিনির্ধারণ সহজ হয়। তাছাড়া পরস্পরের নীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও এখন সবাই মেনে নিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত মূলত স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহু দেশেই সরকার ও নীতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে সহিংস, রক্তাক্ত পন্থা অনুসরণ করেছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে নেতৃত্ব পরিবর্তনে বহু সহিংসতা, এমনকি হত্যা প্রক্রিয়াও ব্যবহৃত হয়েছে। তেমনি মার্কিন নীতির বিরোধী বহু দেশে সরকার পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) হত্যাসহ বহু সহিংস পন্থা অনুসরণ করেছে। চিলিতে প্রেসিডেন্ট আইয়েন্দের এবং কঙ্গোয় প্রধানমন্ত্রী লুমুম্বার হত্যা বহু দৃষ্টান্তের মধ্যে মাত্র দুটি। অনেকে বলে থাকেন, বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পেছনেও সিআইএ’র হাত ছিল।

মধ্যপ্রাচ্যে তার স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে ওয়াশিংটন ইসরাইলকে ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে চেলা গুরুর চাইতেও বেশি আগ্রাসী ভূমিকা নিচ্ছে। ছিনতাই, হত্যা ইত্যাদি এমন কোনো দুষ্কর্ম নেই যেটা ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ করে না। বিগত বছর দুয়েকে ভারতীয় মিডিয়াতেও বলা হচ্ছে, মোসাদ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’কে বিভিন্ন ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছে। র’-এর ভূমিকা আগে থেকেই অস্বাভাবিক রকম আগ্রাসী। বিশেষ করে এশিয়ায় র’ বরাবরই প্রাচীন ভারতের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের অমাত্য চানক্যের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে চলছে। সেটা হচ্ছে কোনো দেশকে জয় করার আগে গোয়েন্দা পাঠিয়ে সে দেশের ভেতরে দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি সৃষ্টি করা, সে দেশের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করা।

সাম্প্রতিক কালে বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে র’-এর ভূমিকা অনেক বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। কোনো কোনো সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে র’-এর চরের সংখ্যা ছয় লাখ তিন হাজার। কেউ কেউ তো বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদকে সর্বক্ষণ ঘিরে আছে র’-এর চরেরা, এমনকি তার পারিবারিক সেবকরাও নাকি র’-এর লোক। সরকারি নির্যাতন ও উত্পীড়নের ভয়ে খোলাখুলি কেউ বলে না, কিন্তু লোকমুখে ব্যাপক চালাচালি হয়ে থাকে যে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের সময় ‘মাথায় রুমাল বাঁধা’ যে একদল লোকের কথা শোনা গিয়েছিল এবং প্রথম দফা হত্যাকাণ্ডের পর যারা আবার হঠাত্ করেই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, তারা আসলে র’-এরই চর ছিল।

বিডিআর বিদ্রোহের পেছনের রহস্য
প্রশ্ন উঠতে পারে, বিডিআর বিদ্রোহে র’-এর কী স্বার্থ থাকতে পারে? জবাবের মোটেই অভাব নেই। সে জবাব নিহিত আছে সেই বিদ্রোহের পরিণতির মধ্যে। সেই বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন সিনিয়র অফিসার নিহত হয়েছেন। তারপর থেকে সেনাবাহিনীতে কী ঘটছে না ঘটছে, দেশবাসীর জানা নেই। অনেকে আশঙ্কা করছেন বিডিআর বিদ্রোহের জের ধরে বাংলাদেশের নিজস্ব সেনাবাহিনীর অবলুপ্তির পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে। সে বিদ্রোহের পরিণতিতে বিডিআরকে ভেঙেই দেয়া হয়েছে। তার স্থলে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বাহিনী।

বিডিআর বরাবরই পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সীমান্তের অত্যন্ত সফল অতন্দ্র প্রহরী ছিল। বাংলাদেশের সীমান্তে হানা দেয়া, বাংলাদেশের জমি দখল করা, সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করা-বিডিআর যতদিন সীমান্তে কর্মরত ছিল ততদিন ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ বাহিনী সেসব করে পার পায়নি। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে রৌমারীতে বাংলাদেশী এলাকায় ঢুকে পড়ে বিএসএফকে কেমন নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছিল সেটা অজস্র দৃষ্টান্তের মধ্যে মাত্র একটা। বিডিআরের বিরুদ্ধে ভারতের গাত্রদাহের সূচনা একেবারে গোড়া থেকে।

একাত্তর সালে আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্রয় দান এবং নির্বাসিত সরকারকে স্বীকৃতি দানের বিনিময়ে তাজউদ্দীন আহমেদ ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের সঙ্গে একটা সাত দফা চুক্তি করেছিলেন। বহুল আলোচিত সে চুক্তির কিছু শর্ত ছিল এ রকম : স্বাধীন হলে বাংলাদেশের নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি ও স্বাধীন সেনাবাহিনী থাকবে না; বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেবে ভারতীয় সেনাবাহিনী; বিডিআর ভেঙে দেয়া হবে এবং বিএসএফের তত্ত্বাবধানে একটা বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বাহিনী গঠন করা হবে।

বিডিআর বিদ্রোহে অংশ নেয়ার অভিযোগে হাজার হাজার জওয়ানকে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে বিদ্রোহ কারা এবং কী উদ্দেশ্যে ঘটিয়েছে, সেসব রহস্য এখনও উদঘাটিত হয়নি, কেননা বর্তমান সরকার সে বিদ্রোহ সম্পর্কে যথাযথ তদন্তের দাবি এড়িয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বিদ্রোহ সম্পর্কে যেসব কাহিনী শোনা গেছে ও যাচ্ছে, সেগুলোকে এখনও গুজব বলেই বর্ণনা করতে হবে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয়, বিদ্রোহের পর তড়িঘড়ি যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেগুলো ১৯৭১ সালের সাত দফা দিল্লি চুক্তির উদ্দেশ্যের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। আরও লক্ষণীয় এই যে, আর আর সব ব্যাপারে হাসিনা পিতার ভুলভ্রান্তি ও ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো অনুসরণ করে চলেছেন-শুধু এ ব্যাপারে ছাড়া। মুজিব ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বলে দিয়েছিলেন যে সাত দফা চুক্তি তিনি মানেন না। তার অনড় মনোভাবের ফলে ইন্দিরা গান্ধী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।


এত কথা বলতে হচ্ছে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে ভারতের অনভিপ্রেত ভূমিকার কারণে। সে নির্বাচন হতে হবে আগামী বছরের শেষ নাগাদ। কিন্তু এরই মধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় নেতাদের থেকে শুরু করে ভারতীয় মিডিয়া হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগকে সে নির্বাচনেও জয়ী করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেছে বলেই মনে হয়। বাংলাদেশ যে স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন একটা দেশ, এদেশের মানুষের যে স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে নিজেদের পছন্দসই সংসদ ও সরকার গঠনের অধিকার আছে, সীমান্তের ওপারের কলরব থেকে সেটা বোঝার উপায় নেই।

শেখ হাসিনা আবারও প্রধানমন্ত্রী হলে সবদিক থেকে ভারতের স্বার্থ উদ্ধার হবে, হাসিনার পরিবর্তে বিএনপি সরকার গঠন করলে বাংলাদেশ ভারতের হুকুমমত চলবে না-এসবই ভারতীয় নেতাদের এবং ভারতীয় মিডিয়ার বক্তব্য। বাংলাদেশের মানুষ কোন সরকার চায়, কোন দল বিজয়ী হলে এবং কে প্রধানমন্ত্রী হলে তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষিত হবে বলে তারা মনে করে, সেসব কথা একবারও দিল্লির নেতাদের এবং ভারতীয় মিডিয়ার বক্তব্যে শোনা যায় না। তাদের বক্তব্য থেকে মনে হতে পারে তারা যেন আসাম, মেঘালয় কিংবা সিকিমের কথা বলছেন। এটাকে কিছুতেই বন্ধুত্বপূর্ণ কিংবা সৎ প্রতিবেশীসুলভ বলা যাবে না।

থলের ভেতরের কেউটে সাপ
দুই হাজার দশ সালে হাসিনা দিল্লিতে গিয়ে ভারত সরকারকে এক ঝুড়ি প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন। সেসব প্রতিশ্রুতি যে কী ছিল-বাংলাদেশের মানুষকে, এমনকি বাংলাদেশ সংসদকেও জানতে দেয়া হয়নি। তারপর থেকে আমরা জানতে এবং দেখতে পারছি যে, প্রতিশ্রুতির লক্ষ্য ছিল ভারত যা চায় সবকিছু তাকে দিয়ে দেয়া। ভারতবর্ষ বিভাগের পরের ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চিত, উপেক্ষিত, নির্যাতিত ও শোষিত হয়েছে। প্রতিবাদে আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম। ভারত আমাদের কিছু অস্ত্র দিয়েছে, সামরিক ও অন্যান্য সাহায্য দিয়েছে। আমরা সেজন্য কৃতজ্ঞ। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য ঠিক সেরকমই বঞ্চিত, উপেক্ষিত, শোষিত ও নির্যাতিত হয়ে আসছে ৬৫ বছর আগে ভারতবর্ষের বিভক্তির সময় থেকে। তাদের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়েছে একাত্তরের অনেক আগে। বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত সূত্রে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তারা কোনো সাহায্য-সরবরাহ পেলে ভারত সেটাকে সন্ত্রাসী তত্পরতা মনে করে, একাত্তরের নজির তাদের মনে আসে না।

আসামের, মেঘালয়ের, মিজোরামের মুক্তিসংগ্রামকে গুঁড়িয়ে দিতে ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে অস্ত্র পাঠাতে চায়। ভারতীয় ভাষ্যকারদের বয়ান অনুযায়ী অরুণাচলের বিবদমান বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত। সেখানে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্য পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তার করিডোর দরকার। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি-ভারতকে সড়ক, রেল ও নদীপথে করিডোর দেয়ার আয়োজন হচ্ছে। বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলো ভারতের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার ঘোষণা সরকার আগেই দিয়েছে। অর্থাত্ দেখা যাচ্ছে, দিল্লিতে হাসিনা এক থলে কেউটে সাপই দিয়ে এসেছিলেন ভারতকে। সেগুলো এখন একে-দুয়ে বাংলাদেশে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।

আগেই বলেছি, একাত্তরে প্রাপ্ত সাহায্যের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু কৃতজ্ঞতা মানে আত্মসমর্পণ নয়। একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙে দিয়ে ভারতের লাভ হয়েছে অবর্ণনীয়। পশ্চিম এবং পূর্ব উভয় সীমান্তে পাকিস্তানের মোকাবিলা করতে হচ্ছে না বলে প্রতি বছর ভারতের সাশ্রয় হচ্ছে বহু বিলিয়ন ডলার। তার পরও অনন্ত কাল ধরে বাংলাদেশীদের ভারতের ঋণের সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে পরিশোধ করে যেতে হবে? একাত্তরের ঋণ কি কখনও শোধ হবে না?

অনুন্নত বাংলাদেশকে ভারত মুক্ত বাণিজ্যের বাজার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তার যেসব পণ্য অন্যত্র বিক্রি হচ্ছে না সেগুলো বাংলাদেশে ‘ডাম্প’ করা হচ্ছে। দু’দেশের বাণিজ্যের ভারসাম্য ক্রমেই ভারতের দিকে বেশি ঝুঁকছে। ভারতকে করিডোর দিলে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও রণকৌশলগত দিক থেকে বরাবরের জন্য বাংলাদেশকে কী মূল্য দিয়ে যেতে হবে সে হিসাব খুব কম বিশেষজ্ঞই করেছেন বলে আমার বিশ্বাস। তার ওপরও এসব ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পাবে না ভারতের কাছ থেকে। দিল্লি হাসিনাকে ব্যক্তিগত ভাবে কী দিয়েছে এবং কী দেবে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কিছুই পাচ্ছে না, তারা কেবলই বঞ্চিত এবং শোষিত হচ্ছে।

গোদের ওপর খাঁড়ার ঘা
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সম্পর্কে দিল্লির নেতারা যা বলছেন এবং ভারতীয় মিডিয়ায় যা বলা হচ্ছে সেগুলো বাংলাদেশের মানুষের গোদের ওপর খাঁড়ার ঘা বলেই মনে হবে। মাত্র কয়েকদিন আগেই ভারত সরকার ধিকৃত সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ করেছিল। ভারতীয় মিডিয়া থেকেই আমরা জানতে পেরেছি, আগামী নির্বাচনে হাসিনার সঙ্গে থেকে তাকে মদত দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এরশাদকে পীড়াপীড়ি করেছেন। এটা স্পষ্টত এবং বাহ্যতই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ। ভারত সরকার বুঝে গেছে, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন হলে শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগের জয়ের সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই। তাই তারা কৃত্রিম, ‘জেনেটিক’ পদ্ধতিতে আবারও হাসিনাকে গদিতে বসাতে চায়, যাতে তারা করিডোরগুলো পাকাপাকি হাতিয়ে নিতে এবং বাংলাদেশকে শোষণের প্রক্রিয়া চিরস্থায়ী করে নিতে পারে।

টাইমস অব ইন্ডিয়া ভারতের একটি সম্মানিত পত্রিকা। একটা ব্যাপারে তারা আমাদের ধন্যবাদ পেতে পারে। টাইমস গত সপ্তাহের বুধবার খবর দিয়েছে, (বাংলাদেশের) আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ক্ষমতায় আসতে পারে-এমন পূর্বাভাস পেয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো (আসলে র’) শঙ্কিত। আগেই বলেছি, র’-এর চরেরা বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। অতএব বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নাড়ি-নক্ষত্র সম্পর্কে র’-এর আশঙ্কা সঠিক হতে বাধ্য। কিন্তু র’ নিছক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপলব্ধিকেই সমর্থন করল। এর পরে হানিফ প্রমুখ অন্তঃসারশূন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের আস্ফাালন ও ঢাকের বাদ্য থামবে কি?

পত্রিকাটি আরও লিখেছে: ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ও সেদেশে সন্ত্রাসী তত্পরতায় জড়িতদের বাংলাদেশের মাটি থেকে নির্মূল করার ব্যাপারে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সহযোগিতা পেয়েছে নয়া দিল্লি। তবে শেখ হাসিনা সরকারের জনসমর্থন কমতে থাকায় বিএনপির ফের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। আর খালেদা জিয়া ফের ক্ষমতায় গেলে সন্ত্রাসবাদ দমনে গত কয়েক বছরের সাফল্য নস্যাৎ হতে পারে।

খালেদা জিয়া আবারও প্রধানমন্ত্রী হলে প্রকৃত সন্ত্রাসবাদ দমন সম্ভব হবে না বলে মনে করার কী অধিকার দিল্লির সরকারের আছে প্রশ্ন করা যেতে পারে। উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্য ছাড়াও ভারতের মূল অংশের অধিকাংশ রাজ্যেই বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাস আছে এবং সে সন্ত্রাস ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্য পুঁজিবাদের আজ্ঞাবহ সরকারের শোষণ ও বঞ্চনার নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে এখন বিচ্ছিন্নতার পথ ধরেছে। তিন কিংবা চার দশকের পুরনো এসব বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়ে দিল্লি এখন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাহায্যপ্রার্থী হয়েছে। খালেদা জিয়ার সরকার নিজ দেশে সন্ত্রাস দমন করতে পারবে কিনা সে নিয়ে মন্তব্য করা মনমোহন সিংয়ের সরকারের শোভা পায় না।

বন্ধুত্বের ক্ষেত্র এখনও প্রস্তুত হয়নি
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনের অন্যত্র স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ভাবাপন্নদের ভারত ভীতির চোখে দেখছে। শেখ হাসিনার সরকার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের অজুহাতে জামায়াতে ইসলামীর বহু নেতাকে গ্রেফতার করেছে, জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরের কর্মী ও ঢালাওভাবে ইসলামী ভাবাপন্ন হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাস্তব ও কাল্পনিক সন্ত্রাসী সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে আরও হাজার হাজার মানুষকে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন থেকে প্রমাণ হয়ে গেল, এ সবই করা হয়েছে ভারতের নির্দেশে, বাংলাদেশের রাজনীতির কারণে নয়। প্রকারান্তরে ভারতীয় নেতারা স্বীকার করে নিচ্ছেন যে হাসিনার সরকার পরিচালিত হয় দিল্লির নির্দেশে।

বাংলাদেশের প্রায় ৯১ শতাংশ মানুষ ধর্মভীরু মুসলমান। এ দেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব পড়তেই পারে। ভারতে প্রধান বিরোধী দল হিন্দু সাম্প্রদায়িক ভারতীয় জনতা পার্টি। তারা মুসলমানদের ভারতের নাগরিক বলে স্বীকৃতি দিতেই নারাজ। বিজেপির অঙ্গদল শিবসেনারা তো সব সময় মুসলিম বিতাড়নের দাবি করে আসছে। দিল্লির সরকার এদের মোকাবিলার সাহস কোনোদিন দেখায়নি। বাংলাদেশে কারা রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না, সে সম্পর্কে লেকচার দেয়ার কোনো অধিকার ভারতের নেই। ভারতীয় নেতারা যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে, এ দেশের নির্বাচন কিংবা সরকার পরিবর্তনের ব্যাপারে অন্যায় হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে পারেন, তাহলেই দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। অন্যথায় নয়।


সিরাজুল ইসলাম: বিবিসিখ্যাত প্রখ্যাত সাংবাদিক
                          ইমেইল: serajurrahman34@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.