সৌমিকের দুর্গাপূজা by রণজিৎ সরকার

সৌমিক ঢাকার একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। ও পড়াশোনা করে নিয়মিত। পড়াশোনার পাশাপাশি আবৃত্তি, ড্রয়িং ক্লাসও করতে হয় সৌমিকের। গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ খুব কম হয়। কারণ, ওর বাবা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। মা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।


তবে বছরে একবার ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যায়, দুর্গাপূজার ছুটিতে। গ্রামের বাড়িতে থাকেন সৌমিকের দাদু আর ঠাকুরমা। গত বছর সৌমিক দুর্গাপূজাতে গিয়েছিল কিন্তু মন খারাপ করে চলেও এসেছিল। মন খারাপ করে চলে আসার কারণ আছে। সৌমিক ছাড়া আর অন্য কেউ জানে না। এ বছরও দুর্গাপূজায় গ্রামের বাড়িতে যাবে সৌমিক।
শুক্রবার সকালবেলা। মা-বাবার সঙ্গে সৌমিক খেতে বসেছে। ওর বাবা হাত দিয়ে রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, ‘সৌমিক, দুর্গাপূজার তো আর বেশি দিন নেই। শপিং করতে হবে। বলো, এবার পূজাতে তুমি কী কী নেবে?’
সৌমিক হাতের রুটির কিছু অংশ মুখের ভেতর না দিয়ে প্লেটে রেখে বলল, ‘বাবা, এবার পূজাতে আমি আমার জন্য কিছুই চাই না।’
‘কেন, তোমার মা কি কিছু বলেছে?’
‘না, মা কিছু বলেনি। আমি নিজের জন্য শপিং করব না, অন্যদের জন্য দুর্গাপূজার শপিং করলে কেমন হয়, বাবা?’
সৌমিকের মা বলল, ‘নিজের বাজেটের টাকা দিয়ে কাদের জন্য দুর্গাপূজার কেনাকাটা করতে চাও?’
মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সৌমিক বলল, ‘গত বছর যখন আমরা মাইক্রোবাস নিয়ে গ্রামে ঢুকলাম তখন তোমরা কি লক্ষ করেছ, গাড়ির পেছনে অনেক ছেলে-মেয়ে খালি শরীরের ছুটছিল। মন্দিরে গাড়ি থামার পর আমি ওদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাদের শরীরে পূজার নতুন পোশাক নেই কেন? ওরা কেউ কেউ বলেছিল, আমাদের বাবা-মা নতুন পোশাক কিনে দিতে পারে নাই। পরব কোত্থেকে। ওদের কথা শুনে আমার মন ভীষণ খারাপ হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমার পোশাকগুলো দিয়ে দিই কিন্তু দিতে পারিনি। কারণ ওরা সংখ্যায় ছিল অনেক। এবার পূজাতে ওদের জন্য কিছু করতে চাই, যদি তোমরা আমাকে সহযোগিতা করো। আমি গত বছর থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছি। তোমাদের এত দিন বলিনি। যদি তোমরা রাজি না হও, সে জন্য বলিনি। তবে, যদি তোমরা টাকা না দাও, তবু আমি এবার পূজাতে ওদের শরীরে নতুন পোশাক পরাবই।’
‘কীভাবে?’
‘আমি টিফিনের টাকা বাঁচিয়েছি। বিভিন্নভাবে এত দিনে অনেক টাকা সংগ্রহ করেছি।’
সৌমিকের মা-বাবা সন্তানের এমন কথা শুনে খুশি হলেন।
ওর বাবা বলল, ‘আমিও ভেবেছিলাম গ্রামের এমন অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করতে। আজ তুমি সে বিষয়টা আমাকে স্মরণ করে দিলে। তোমার দাদুকে এক্ষুনি মোবাইল করে বিষয়টা বলো, কতজন ছেলেমেয়ের জন্য নতুন পোশাক নিয়ে যেতে হবে?’
সৌমিকের মা মোবাইলটা এগিয়ে দিল। ও দাদুর নামটা বের করে মোবাইলের সবুজ বাটন চাপল।
ওপাশ থেকে দাদু কল রিসিভ করল। দাদুর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল সৌমিক...।
ও জানতে পারল, সর্বনিম্ন ৩০ জনের জন্য নিয়ে গেলেই হবে। তার বেশি হলেও আরও ভালো হয়। কারণ, কেউ যেন পোশাক নিতে এসে খালি হাতে ফেরত না যায়।
সৌমিকের বাবা টিস্যু দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে করতে বলল, ‘তুমি নিয়ে যাবে শিশু-কিশোদের জন্য, আর আমিও নতুন পোশাক নিয়ে যাব বৃদ্ধাদের জন্য। এক্ষুনি চলো, নিউমার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করে আসি।’
কাজের বুয়া ড্রাইভারকে বলতে গেল গাড়ি বের করতে।
খাওয়া শেষ। খাবার টেবিল থেকে উঠল সৌমিক। মা-বাবাকে সঙ্গে করে গাড়ি নিয়ে নিউমার্কেটে গেল সে। বিভিন্ন রকমের জামাকাপড় কিনে নিয়ে এল বাসায়।
ষষ্ঠী পূজার দিনে মা-বাবাকে নিয়ে বের হলো সৌমিক।
ওদের গাড়িটা গ্রামে ঢুকতেই অনেক ছেলেমেয়ে গাড়ির পেছনে ছুটতে লাগল। দুর্গামন্দিরে গাড়িটা পৌঁছামাত্র এলাকার ছেলেমেয়েরা ঘিরে ধরল। ওরা গাড়ি থেকে নামল। সৌমিক দেখে, দাদু চেয়ারে বসে আছে। দাদুকে দেখামাত্র সৌমিক এগিয়ে গেল, দাদুও এগিয়ে এলেন। দুজন কোলাকুলি করল। তারপর দাদুকে সঙ্গে করে গ্রামের যে ছেলেমেয়েরা দুর্গাপূজা উপলক্ষে নতুন জামাকাপড় কিনতে পারেনি, তাদের লাইনে দাঁড়াতে বলল। সবাই নতুন কাপড় পাওয়ার আশায় লাইন ধরল। সৌমিক আর ওর দাদু ওদের হাতে নতুন কাপড় তুলে দিতে লাগল। সবাই নতুন জামাকাপড় পেয়ে মহাখুশি। সৌমিক ওদের সবাইকে নতুন পোশাক পরতে বলল। সবাই পরল। নতুন পোশাকে ওদের ছবি তুলল। ওদের হাসিমাখা মুখ দেখে দুর্গাপূজার আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে গেল সৌমিকের।

No comments

Powered by Blogger.