নিরাপত্তা-নিউইয়র্কে নকল বোমা, বিপদ বার্তা কিন্তু ঢাকার জন্যও by ইমতিয়াজ আহমেদ

বাংলাদেশের ক'জনেই-বা কাজী মো. রেজওয়ানুল ইসলাম নাফিসকে চিনত? অথচ ২১ বছরের এ তরুণ এখন 'বিশ্বের টপ টেরর' হিসেবে চিহ্নিত। যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল আল কায়দার নতুন রিত্রুক্রট সে। সে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল এক হাজার পাউন্ড ওজনের প্রচণ্ড শক্তিশালী বোমার সাহায্যে।


এ জন্য অর্থের জোগানেও সমস্যা হয়নি। গাড়িতে বোমাটিও যথাযথভাবে ফিট করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য নাফিস এবং তার বোমার জোগানদারদের। কারণ বোমাটি ছিল নকল। তার যাবতীয় চেষ্টা বৃথা গেল। তবে ধন্য ধন্য পড়ে গেছে বোমার জোগানদারদের। প্রকৃতপক্ষে তারাই যে নকল বোমা সরবরাহ করেছে! নেপথ্যের কুশীলবরা হয়তো এখন দম ফাটানো হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছে_ এত সহজে কাউকে ফাঁদে ফেলা যায়!
আমার প্রথমে যা মনে হয়েছে_ কাজী নাফিস আল কায়দার রিত্রুক্রট হিসেবে মোটেই উপযুক্ত নয়। সম্ভবত সে নির্বোধও। মানসিক ভারসাম্য যথাযথ কি-না, সে প্রশ্নও তোলা যেতে পারে। নইলে এত সহজে যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্টার টেরোরিজমের লোকদের হাতে ধরা খায়! এ ধরনের ঘটনা এবারই যে প্রথম ঘটল, তা নয়। ২০০৪ সালে দুই পাকিস্তানি নাগরিকও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের ফাঁদে পা দিয়েছিল। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে ঘনিষ্ঠতম মিত্র। তারা এ ধরনের ফাঁদের খেলা পছন্দ করেনি এবং এফবিআইর এ কৌশলকে অভিহিত করেছিল 'চরম বিপজ্জনক' হিসেবে। তবে তখনও ঘটনায় জড়িত মার্কিন গোয়েন্দাদের পিঠ চাপড়ানো হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন একাধিক। প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ বয়সী কাউকে দিনের পর দিন খেলিয়ে কৃতিত্ব নেওয়ার যে পদ্ধতি, তা কতখানি গ্রহণযোগ্য? দ্বিতীয়ত, এ পথে চলে কি প্রকৃত সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করা যাবে? এ ধরনের ঘটনা যে ঘটতে পারে, সে বিষয়ে এখন তারা আরও সক্রিয় হবে এবং কৌশল পাল্টাবে। তারা মনে রাখবে_ কোনোভাবেই 'নাফিস' হওয়া চলবে না। আর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলার অভিজ্ঞতা থেকে বলব যে, যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার কৌশল ভালোভাবে পর্যালোচনার সময় এসেছে।
আরও যে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে, নাফিস কি বাংলাদেশ থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বড় কোনো লক্ষ্যবস্তুতে হামলার পরিকল্পনা নিয়ে দেশ ছেড়েছিল? এটা হয়ে থাকলে তার পেছনে কে বা কারা ছিল? নাকি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে তার এই মরণখেলায় জড়িয়ে পড়া? এ ধরনের কাঁচা লোককে আল কায়দার মতো সন্ত্রাসী সংগঠন রিত্রুক্রট করেছিল_ সেটা ভাবা কঠিন। তারা এত দুর্বলভাবে কাজ করে বলে বিশ্বাস হয় না। তবে এটা ধরে নেওয়া যায় যে, নাফিস ধর্মীয় অসহিষ্ণু মনোভাবাপন্ন এক তরুণ। এ শিক্ষা সে বাংলাদেশে থাকতেই পেয়ে থাকবে। আমাদের সমাজে এমন অনেকেই রয়েছে, যাদের দিয়ে ধর্মীয় চরমপন্থিরা ক্ষতিকর কাজ করিয়ে নিতে পারে। তাদের প্রতি আরও মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার_ সবার দায়িত্ব রয়েছে এ ক্ষেত্রে। নাফিস প্রলোভনের ফাঁদে পা দিক কিংবা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করুক যে, 'জিহাদ করা বৈধ', তার ইসলামের মর্মবস্তু সম্পর্কে জ্ঞান সামান্যই। কিংবা যা শিখেছে সেটা সম্পূর্ণ ভুল। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী খেলার ঝুঁকি সম্পর্র্কেও সে অবহিত নয়। তার কাজে নিজের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। পরিবার বিপন্ন হয়েছে। তার নিজের দেশ সম্পর্কে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভুল বার্তা পেঁৗছে গেছে। এ ঘটনার জেরে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে_ সেটাও ধরে নেওয়া যায়।
যে কোনো দেশে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সাধারণভাবে অনুসৃত পথগুলো হচ্ছে :এক. তাদের আটক রাখা। দুই. সম্ভাব্য সন্ত্রাসীদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো। এ জন্য জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও তথ্য বিনিময়। তিন. বুদ্ধিবৃত্তিগত পদক্ষেপ। প্রতিটি দেশেই ধর্মীয় চরমপন্থি ও অসহিষ্ণু লোকের অস্তিত্ব রয়েছে। তাদের ভাবাদর্শ যে ভ্রান্ত_ সে বিষয়ে বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মকে ধারণা দিতে হবে। চার. উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এ জন্য অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি চাই যথাযোগ্য মানবসম্পদ।
এ চার ধাপের মধ্যে বাংলাদেশে কেবল প্রথম ধাপই সরকারিভাবে অনুসৃত হতে দেখি। তাদের হাতে আটক রয়েছে অনেকেই। এদের কেউ কেউ প্রকৃতই সন্ত্রাসী, আবার কেউবা সন্দেহভাজন। সন্ত্রাসী কিংবা সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের আটক করলেই চরম পন্থা আপনাআপনি থেমে থাকবে_ তার নিশ্চয়তা কিন্তু মেলে না। যারা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ভুল পথে পা দেবে, তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য অবশ্যই তৃতীয় ধাপের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। চিন্তা জগতে ভুল বা বিভ্রান্তিকর কিছু ঢুকে গেলে সেটা বের করা মোটেই সহজ নয়। এ ধরনের কাজ যারা করে, তাদের বিশেষ নজর থাকে তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে রিত্রুক্রট করার প্রতি।
এখন বিশ্বায়নের যুগ। কোথায় কী ঘটছে, সেটা জানা যায় সহজেই। অসহিষ্ণুতার প্রকাশ আমরা নানাভাবে দেখছি। ইসলামী বিশ্বে বিশেষ করে সৌদি আরবকে কেন্দ্র করে ওহাবি ধারণার প্রকাশ ও বিস্তার ঘটছে। ওসামা বিন লাদেন এ ধারারই সৃষ্টি। এ ধারা অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদের প্রতি সহিষ্ণু হতে শেখায় না। এমনকি নিজ ধর্মের মধ্যে কেউ ভিন্ন কিছু বললে প্রকাশ ঘটে ক্ষোভ-রোষের। পেট্রো ডলার প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর এ ধারার অনুসারীরা নতুন উৎসাহে নানা দেশে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কয়েক লাখ লোক এখন সৌদি আরবে চাকরিসূত্রে অবস্থান করছে। তাদের মাধ্যমে আমাদের দেশেও এ অসহিষ্ণু ধারা শক্তি সঞ্চয় করছে। রামু-উখিয়া-টেকনাফের ঘটনা কিন্তু আমাদের জন্য নতুন বিপদ সংকেত।
অথচ আমাদের দেশের ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন এক চিত্র উপস্থাপন করে। এখানে ইসলাম ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল সহিষ্ণুতার দর্শনের হাত ধরে। সুফি সাধকরা কোটি কোটি মানুষের মন জয় করেছিলেন ইসলামের শান্তি ও সম্প্রীতির আদর্শ প্রচার করে। এ ইতিহাস এখন অনেকেরই অজানা। বাস্তবে এখন ইন্টারনেট ও অন্যান্য সূত্রে এর বিপরীত ধারাই যেন বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়। এর মোকাবেলা সহজ নয়, কিন্তু করতেই হবে। মাদ্রাসা কিংবা সেক্যুলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেখানেই তরুণরা যায়; তাদের একটি অংশের কাছে অসহিষ্ণু ইসলামকেই মনে হয় প্রকৃত ইসলাম। ভুল ধারণা নিয়ে তারা শুধু বেড়েই ওঠে না; কখনও কখনও প্রয়োগও ঘটায়। আবার প্রলোভনের ফাঁদেও পা দেয়। অর্থের প্রলোভন থাকে, জিহাদে শরিক হওয়ার আহ্বান থাকে। এ কারণেই নিউইয়র্কে যা ঘটেছে, তা কেবল সেখানেই শেষ হয়ে যায় না। এর সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও। কিংবা অন্যভাবেও কি বলা যায় না_ কাজী নাফিসের ভুল পথে চলার পেছনে আমাদের বিদ্যমান বাস্তবতারও দায় রয়েছে? আর এ থেকেই আমাদের করণীয় স্পষ্ট হয়ে যায়_ সমাজের সবাইকে বিশেষ করে তরুণ সমাজকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পথে চলতে শেখানো। এ জন্য সরকারের উদ্যোগ চাই। একই সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিগত কাজে যারা জড়িত, তাদের দিক থেকে চাই সক্রিয়তা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও নিরলস কাজ না করলে এ বিপদ ক্রমশ বাড়বাড়ন্ত হতে থাকবে। এ পথে চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অনেক দেশের সহযোগিতা মিলবে। মালয়েশিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, মিসরসহ আরও অনেক দেশে এ ধারায় কাজ করছেন অনেকেই। সহিষ্ণু ধারার আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে পারলে আমাদের কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করে যারা ফায়দা লুটতে চায়, তাদের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী এবং তা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের নানা স্থানে। তা ভাঙার জন্য যেখানে যতটুকু সহায়তা মেলে, তা নিতে হবে। আমাদের উপমহাদেশেও রয়েছে সহিষ্ণুতার এ ধারা। এক সময়ে তা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং আমাদের বাংলাদেশ তার উত্তরাধিকার বহন করে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, নিজের ঘর সামলানোর প্রধান দায় কিন্তু আমাদেরই। এ কাজে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
কাজী নাফিস যে ষড়যন্ত্র এঁটেছিল বা যে ফাঁদে পা দিয়েছিল, তা সফল করা যায়নি। কিন্তু তার অপচেষ্টা ইসলাম ধর্মের জন্য ক্ষতিকর, বাংলাদেশের জন্য নতুন এক বিপদ সংকেত। বিশ্বের জন্যও তা নতুন করে আতঙ্কের বার্তা দিচ্ছে। তার আটকের মধ্য দিয়েই এ ভুল পথের অবসান ঘটবে_ সেটা বলা চলে না। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক এবং বিশ্বের আরও কোনো কোনো স্থানে প্রতিনিয়ত অঘটন ঘটেই চলেছে। বোমা-গ্রেনেড হামলায় প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুর। যারা তা ঘটাচ্ছে, তারা নির্বিকার। বাংলাদেশেও আমরা এমনটি ঘটতে দেখেছি। এখানে পাবলিক প্লেসে বোমা-গ্রেনেড হামলা হয়েছে। আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ গেছে অনেক নারী-পুরুষ-শিশুর। আমরা চাই না, নতুন কোনো নাফিস এ দেশ থেকে সৃষ্টি হোক। রামু-উখিয়ার সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার শিক্ষাও কিন্তু মনে রাখা চাই।

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ :অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.