যত বড় নেতা, তত বড় কোন্দল by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত জুলাই মাসে। আগামী ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে সম্মেলন হওয়ার সম্ভাবনা কম।
ঘোষিত সময়ের আগে জেলা সম্মেলন শেষ করার কথা থাকলেও তা আদৌ হবে কি না সে বিষয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতারাই সংশয়ে আছেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্বন্দ্ব-কোন্দলের কারণেই জেলা সম্মেলন করা যাচ্ছে না। যে জেলায় যত বড় নেতা আছেন, সে জেলায় দ্বন্দ্বও তত প্রকট বলে জানা গেছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ক্ষমতাসীন দলের প্রায় সব সাংগঠনিক জেলায় রয়েছে কোন্দল। ৭৩টি সাংগঠনিক জেলার ৭১টিই বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নিজ জেলায় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগে। অন্যদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জেলা কিশোরগঞ্জের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ১২ বছর আগে। আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, প্রায় সব সাংগঠনিক জেলায় নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও প্রভাবশালী নেতাদের এলাকায় দ্বন্দ্ব বেশি প্রকট।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যেখানে যত ক্ষমতা সেখানে দ্বন্দ্ব বেশি। প্রভাবশালীরা দলের নির্দেশ শুনতে চান না। তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন বলে দ্বন্দ্ব আরো বেশি হয়।' তবে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠিত হলে দ্বন্দ্ব কমবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই নেতা।
চট্টগ্রামে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর দ্বন্দ্ব একসময় দেশব্যাপী আলোচনার বিষয় ছিল। এখন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব বহুমুখী। জানা গেছে, দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই দুই ধারায় বিভক্ত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ। দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় আলাদাভাবে। নগর কমিটির সভাপতি সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিপক্ষে আছেন নগর কমিটির সহসভাপতি ও সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম বিএসসি। নুরুল ইসলাম বিএসসির সঙ্গে আছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফসারুল আমিন। সম্প্রতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন দলীয় সংসদ সদস্য এম এ লতিফ। মহিউদ্দিন গ্রুপে আছেন সাবেক ছাত্রনেতা আ জ ম নাছির উদ্দিন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আখতারুজ্জামান বাবুর সমর্থন মহিউদ্দিন চৌধুরীর দিকেই।
জানা যায়, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও চট্টগ্রামের দলীয় কোন্দল নিরসন করতে পারেননি। ২০০৬ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি।
তোফায়েল-ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বিরোধ ভোলায় : ভোলায় বিরোধে জড়িয়ে আছেন দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। গত রমজানে শহরে জেলা আওয়ামী লীগ একই দিনে আলাদা ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে। ভোলা টাউল হলে অনুষ্ঠিত ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। অন্যদিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি ছিলেন ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত নির্বাচনের প্রাক্কালে শেখ হাসিনার একটি ঘোষণা থেকেই এ বিরোধের সূত্রপাত। ওই নির্বাচনের চার-পাঁচ দিন আগে ভোলার বাংলা স্কুল মাঠে ভিডিও কনফারেন্সে দেওয়া বক্তব্যে শেখ হাসিনা ভোটারদের উদ্দেশে বলেছিলেন, 'আপনারা আপনাদের মূল্যবান ভোটটি দিয়ে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনকে জয়যুক্ত করুন, এর প্রতিদান হিসেবে আপনাদের একজন মন্ত্রী উপহার দিব।' ওই অনুষ্ঠানে তোফায়েল-হুমায়ুন দুজনই উপস্থিত ছিলেন।
দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান, গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে ভোলায় তোফায়েলের বাসায় থেকেই নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছিলেন হুমায়ুন। নির্বাচনের এক দিন আগে তোফায়েলের বাসা থেকে হুমায়ুন চলে যান। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা তাঁকে নিজের বাসায় নিয়ে যান।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে সম্প্রতি মাঠে নেমেছেন তোফায়েল আহমেদ। অন্যদিকে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনকে সামনে রেখে মজনু মোল্লা পাল্টা অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর গ্রুপকে দলের মূল স্রোত বলে দাবি করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতি করি। ভোলায় আমাদের অন্য কোনো প্রভু নেই।'
এদিকে তোফায়েল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভোলার আওয়ামী লীগে এক ব্যক্তি ব্যতীত (ফজলুল কাদের) কোনো দ্বিধাবিভক্তি নেই।'
চাঁদপুরে তিন ধারা : দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং কেন্দ্রীয় নেতা সুজিত রায় নন্দীর বাড়ি চাঁদপুরে। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, তিন নেতাই যাঁর যাঁর ইচ্ছামতো এলাকার সংগঠন চালাতে চান। কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ তিন ধারায় বিভক্ত। চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০০৫ সালের নভেম্বরে।
স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচন ঘিরে জেলা আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয় ডা. দীপু মনির। অতিসম্প্রতি মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে দূরত্ব আরো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সূত্র মতে, চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামছুল হক ভুঁইয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লোক হিসেবে বিবেচিত। জেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বিল্লালও তাঁর সঙ্গে আছেন। যুবলীগের এই নেতা চাঁদপুর সদর উপজেলার ৮ নম্বর বাগাদী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান এবং অভিযোগ তোলেন দীপু মনির দিকে। যুবলীগের এই নেতা বলেন, 'বিগত ইউপি নির্বাচনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লোকজন আমার বিরোধিতা করেছেন। এ কারণে আমি পরাজিত হয়েছি।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দীপু মনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একক প্রার্থী নির্বাচন করার জন্য আমি সহযোগিতা করেছিলাম মাত্র। এর বাইরে আমার কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে দিয়ে এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ ও টিআর-কাবিখার চাল-গম বিতরণ করানোই দীপু মনির সঙ্গে স্থানীয় সংগঠনের দ্বন্দ্বের মূল কারণ। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দীপু মনি। তিনি বলেন, 'জনসংখ্যার অনুপাতে এবং আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই টিআর-কাবিখা বিতরণ করা হয়।'
জানা গেছে, গত ১০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ায় ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে সংবর্ধনা দেয় জেলা আওয়ামী লীগ। ওই অনুষ্ঠানে মহীউদ্দীন খান আলমগীর আগে উঠলেও কিছুক্ষণ পর মঞ্চে যান দীপু মনি। অনুষ্ঠানে চাঁদপুরে দীপু মনির অনুসারী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। গত রমজান মাসে চাঁদপুর ক্লাবে জেলা আওয়ামী লীগের ইফতার পার্টি এবং ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সফর ছাড়া চাঁদপুরের চার সংসদ সদস্যকে একমঞ্চে দেখা যায়নি কখনো।
ফরিদপুরে সাজেদা-মোশাররফ দ্বন্দ্ব : এ জেলায় আছেন আওয়ামী লীগের তিন প্রভাবশালী নেতা। তাঁরা হলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও কাজী জাফরউল্লাহ এবং প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সাজেদা চৌধুরী ও কাজী জাফরউল্লাহ একসঙ্গে থাকলেও মোশাররফের সঙ্গে তাঁদের রয়েছে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব। সাজেদা ও জাফরউল্লাহ একে অপরের এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে গেলেও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকা ছাড়া কোথাও যান না।
জানা যায়, ২০০৫ সালের সম্মেলনে গঠিত ৭১ সদস্যের জেলা কমিটিতে কাজী জাফরউল্লাহর সমর্থক হিসেবে পরিচিত উপজেলা পর্যায়ের ১৫-১৬ জন নেতা অন্তর্ভুক্ত হন। অন্যদিকে মোশাররফ হোসেনের সমর্থক মাত্র দুই-তিনজন নেতা কমিটিতে ঠাঁই পান। সেই থেকেই দুজনের দ্বন্দ্বের শুরু। তবে তা কখনোই প্রকাশ্য রূপ নেয়নি।
জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির মেয়াদ ২০০৯ সালে শেষ হলেও এখনো সম্মেলন হয়নি। সবশেষ সম্মেলনে কাজী জায়নুল আবেদীন সভাপতি এবং হাসিবুল হাসান লাবলু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। লাবলু মারা যান ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারি। এরপর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কে হবেন তা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় খন্দকার মোশাররফ ও লাবলুর সমর্থকদের মধ্যে। জেলা কমিটির বর্ধিত সভায় লাবলুর ছোট ভাই ও জেলা কমিটির সদস্য মনিরুল হাসান মিঠুকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সময়ে মন্ত্রীর সমর্থকরা ওই কমিটির এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। বিষয়টি আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সৈয়দ মাসুদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি নেতারা দলের সভাপতির কাছে জানিয়েও প্রতিকার পাননি। অন্যদিকে মনিরুল হাসান মিঠু বলেন, দীর্ঘদিন দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের অবহেলা-অবমূল্যায়ন আর বিএনপি, জামায়াত ও সুযোগ সন্ধানীদের দলে আধিপত্য বিস্তারের কারণে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে।
ওই দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর সমর্থকরা শহরের আলীপুর এলাকায় লাবলুর বাড়িতে ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ করে বলে তাঁর পরিবারের অভিযোগ। লাবলুর সমর্থকরা আলাদা সভা-সমাবেশের আয়োজন করলে পুলিশ দিয়ে সে কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ আছে, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও তাঁর ছেলে আয়মন আকবর চৌধুরীকে তাঁদের গ্রামের বাড়ি ও নির্বাচনী এলাকায় যেতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন মন্ত্রীর সমর্থকরা। তাঁরা ফরিদপুর-সালথা আঞ্চলিক সড়কে ফরিদপুর সদরের বিভিন্ন স্থানে ঢাল-সড়কি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন। তবে এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন মন্ত্রীর সমর্থক এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোকাররম মিয়া বাবু। মন্ত্রীর সঙ্গে সাজেদা চৌধুরী ও কাজী জাফরউল্লাহর সম্পর্ক চমৎকার বলে দাবি করলেও তিনি অভিযোগ করেন, আয়মন আকবর চৌধুরী নিজ এলাকা বাদ দিয়ে ফরিদপুর সদর এলাকায় অযাচিত হস্তক্ষেপ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে ইন্ধন দেওয়ার চেষ্টা করেন।
বরিশালে ভাই-দাদু দ্বন্দ্ব তুঙ্গে : এ জেলায় আছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। তিনি জেলা কমিটিরও সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বড় পরিচয়- তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি ভাই বলেই পরিচিত। অন্যদিকে আছেন মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র শওকত হোসেন হিরণ। দলীয় নেতা-কর্মীরা তাঁকে দাদু বলে সম্বোধন করেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ভাই-দাদুর দুই ধারায় বিভক্ত। উপজেলার রাজনীতি পুরোটাই ভাইয়ের কবজায়, আর মহানগরের রাজনীতি দাদুনির্ভর। যদিও হাসানাত আবদুল্লাহ একসময় ছিলেন হিরণের গুরুর মতো।
জানা গেছে, বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগে অধিপত্য বিস্তারের জন্য দুই নেতা আদাজল খেয়ে নেমেছেন। হাসানাতের অনুসারীদের ঠিকাদারি কাজের টোপ দিয়ে নিজের দিকে টানতে শুরু করেছেন হিরণ। এরই মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সৈয়দ আনিস, সদর উপজেলা শাখার সভাপতি আনোয়ার হোসাইন, ছাত্রনেতা জসীম উদ্দিন, পানামা ফারুক, কুতুব রানা, জিয়া উদ্দিন, ছাবিদ হোসেন, মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ান, সাংগঠনিক সম্পাদক তৌছিক আহমেদ রাহাদসহ বেশির ভাগ নেতা-কর্মী মেয়রের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নগরীতে হঠাৎ করেই হিরণের ক্ষমতার কাছে হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর অনুসারীরা কাবু হয়ে পড়েছেন। একসময়ের গুরু-শিষ্যের স্নায়ুযুদ্ধ এখন প্রকাশ্যে এসেছে। এতে মহানগর আওয়ামী লীগে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা।
স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৯ জুলাই ছাত্রলীগের ৩০ ওয়ার্ডসহ চারটি থানা কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে হাসানাতের অনুসারী নেতা-কর্মীরা ঠাঁই না পাওয়ায় তা বাতিল করা হয়। অতিসম্প্রতি মহানগর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্য কো-অপট করা হয়। সেখানে হাসানাতপন্থী নেতা-কর্মীদের স্থান দেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস এমপি বলেন, 'দলে বিভক্তি নেই। বরিশালের নেতা হাসানাত ভাই, আমরা সবাই কর্মী।' কারো নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, 'কেউ যদি নিজেকে দলের অনেক কিছু মনে করেন, তাহলে তার খেসারত তাঁকেই দিতে হবে।'
এ প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নির্মলেন্দু চক্রবর্তী (ফরিদপুর), রফিকুল ইসলাম (বরিশাল) ও ফারুক আহমেদ (চাঁদপুর)।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ক্ষমতাসীন দলের প্রায় সব সাংগঠনিক জেলায় রয়েছে কোন্দল। ৭৩টি সাংগঠনিক জেলার ৭১টিই বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নিজ জেলায় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগে। অন্যদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জেলা কিশোরগঞ্জের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ১২ বছর আগে। আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, প্রায় সব সাংগঠনিক জেলায় নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও প্রভাবশালী নেতাদের এলাকায় দ্বন্দ্ব বেশি প্রকট।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যেখানে যত ক্ষমতা সেখানে দ্বন্দ্ব বেশি। প্রভাবশালীরা দলের নির্দেশ শুনতে চান না। তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন বলে দ্বন্দ্ব আরো বেশি হয়।' তবে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠিত হলে দ্বন্দ্ব কমবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই নেতা।
চট্টগ্রামে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর দ্বন্দ্ব একসময় দেশব্যাপী আলোচনার বিষয় ছিল। এখন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব বহুমুখী। জানা গেছে, দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই দুই ধারায় বিভক্ত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ। দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় আলাদাভাবে। নগর কমিটির সভাপতি সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিপক্ষে আছেন নগর কমিটির সহসভাপতি ও সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম বিএসসি। নুরুল ইসলাম বিএসসির সঙ্গে আছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফসারুল আমিন। সম্প্রতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন দলীয় সংসদ সদস্য এম এ লতিফ। মহিউদ্দিন গ্রুপে আছেন সাবেক ছাত্রনেতা আ জ ম নাছির উদ্দিন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আখতারুজ্জামান বাবুর সমর্থন মহিউদ্দিন চৌধুরীর দিকেই।
জানা যায়, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও চট্টগ্রামের দলীয় কোন্দল নিরসন করতে পারেননি। ২০০৬ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি।
তোফায়েল-ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বিরোধ ভোলায় : ভোলায় বিরোধে জড়িয়ে আছেন দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। গত রমজানে শহরে জেলা আওয়ামী লীগ একই দিনে আলাদা ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে। ভোলা টাউল হলে অনুষ্ঠিত ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। অন্যদিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি ছিলেন ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত নির্বাচনের প্রাক্কালে শেখ হাসিনার একটি ঘোষণা থেকেই এ বিরোধের সূত্রপাত। ওই নির্বাচনের চার-পাঁচ দিন আগে ভোলার বাংলা স্কুল মাঠে ভিডিও কনফারেন্সে দেওয়া বক্তব্যে শেখ হাসিনা ভোটারদের উদ্দেশে বলেছিলেন, 'আপনারা আপনাদের মূল্যবান ভোটটি দিয়ে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনকে জয়যুক্ত করুন, এর প্রতিদান হিসেবে আপনাদের একজন মন্ত্রী উপহার দিব।' ওই অনুষ্ঠানে তোফায়েল-হুমায়ুন দুজনই উপস্থিত ছিলেন।
দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান, গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে ভোলায় তোফায়েলের বাসায় থেকেই নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছিলেন হুমায়ুন। নির্বাচনের এক দিন আগে তোফায়েলের বাসা থেকে হুমায়ুন চলে যান। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা তাঁকে নিজের বাসায় নিয়ে যান।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে সম্প্রতি মাঠে নেমেছেন তোফায়েল আহমেদ। অন্যদিকে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনকে সামনে রেখে মজনু মোল্লা পাল্টা অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর গ্রুপকে দলের মূল স্রোত বলে দাবি করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতি করি। ভোলায় আমাদের অন্য কোনো প্রভু নেই।'
এদিকে তোফায়েল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভোলার আওয়ামী লীগে এক ব্যক্তি ব্যতীত (ফজলুল কাদের) কোনো দ্বিধাবিভক্তি নেই।'
চাঁদপুরে তিন ধারা : দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং কেন্দ্রীয় নেতা সুজিত রায় নন্দীর বাড়ি চাঁদপুরে। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, তিন নেতাই যাঁর যাঁর ইচ্ছামতো এলাকার সংগঠন চালাতে চান। কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ তিন ধারায় বিভক্ত। চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০০৫ সালের নভেম্বরে।
স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচন ঘিরে জেলা আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয় ডা. দীপু মনির। অতিসম্প্রতি মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে দূরত্ব আরো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সূত্র মতে, চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামছুল হক ভুঁইয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লোক হিসেবে বিবেচিত। জেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বিল্লালও তাঁর সঙ্গে আছেন। যুবলীগের এই নেতা চাঁদপুর সদর উপজেলার ৮ নম্বর বাগাদী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান এবং অভিযোগ তোলেন দীপু মনির দিকে। যুবলীগের এই নেতা বলেন, 'বিগত ইউপি নির্বাচনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লোকজন আমার বিরোধিতা করেছেন। এ কারণে আমি পরাজিত হয়েছি।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দীপু মনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একক প্রার্থী নির্বাচন করার জন্য আমি সহযোগিতা করেছিলাম মাত্র। এর বাইরে আমার কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে দিয়ে এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ ও টিআর-কাবিখার চাল-গম বিতরণ করানোই দীপু মনির সঙ্গে স্থানীয় সংগঠনের দ্বন্দ্বের মূল কারণ। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দীপু মনি। তিনি বলেন, 'জনসংখ্যার অনুপাতে এবং আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই টিআর-কাবিখা বিতরণ করা হয়।'
জানা গেছে, গত ১০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ায় ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে সংবর্ধনা দেয় জেলা আওয়ামী লীগ। ওই অনুষ্ঠানে মহীউদ্দীন খান আলমগীর আগে উঠলেও কিছুক্ষণ পর মঞ্চে যান দীপু মনি। অনুষ্ঠানে চাঁদপুরে দীপু মনির অনুসারী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। গত রমজান মাসে চাঁদপুর ক্লাবে জেলা আওয়ামী লীগের ইফতার পার্টি এবং ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সফর ছাড়া চাঁদপুরের চার সংসদ সদস্যকে একমঞ্চে দেখা যায়নি কখনো।
ফরিদপুরে সাজেদা-মোশাররফ দ্বন্দ্ব : এ জেলায় আছেন আওয়ামী লীগের তিন প্রভাবশালী নেতা। তাঁরা হলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও কাজী জাফরউল্লাহ এবং প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সাজেদা চৌধুরী ও কাজী জাফরউল্লাহ একসঙ্গে থাকলেও মোশাররফের সঙ্গে তাঁদের রয়েছে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব। সাজেদা ও জাফরউল্লাহ একে অপরের এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে গেলেও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকা ছাড়া কোথাও যান না।
জানা যায়, ২০০৫ সালের সম্মেলনে গঠিত ৭১ সদস্যের জেলা কমিটিতে কাজী জাফরউল্লাহর সমর্থক হিসেবে পরিচিত উপজেলা পর্যায়ের ১৫-১৬ জন নেতা অন্তর্ভুক্ত হন। অন্যদিকে মোশাররফ হোসেনের সমর্থক মাত্র দুই-তিনজন নেতা কমিটিতে ঠাঁই পান। সেই থেকেই দুজনের দ্বন্দ্বের শুরু। তবে তা কখনোই প্রকাশ্য রূপ নেয়নি।
জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির মেয়াদ ২০০৯ সালে শেষ হলেও এখনো সম্মেলন হয়নি। সবশেষ সম্মেলনে কাজী জায়নুল আবেদীন সভাপতি এবং হাসিবুল হাসান লাবলু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। লাবলু মারা যান ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারি। এরপর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কে হবেন তা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় খন্দকার মোশাররফ ও লাবলুর সমর্থকদের মধ্যে। জেলা কমিটির বর্ধিত সভায় লাবলুর ছোট ভাই ও জেলা কমিটির সদস্য মনিরুল হাসান মিঠুকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সময়ে মন্ত্রীর সমর্থকরা ওই কমিটির এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। বিষয়টি আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সৈয়দ মাসুদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি নেতারা দলের সভাপতির কাছে জানিয়েও প্রতিকার পাননি। অন্যদিকে মনিরুল হাসান মিঠু বলেন, দীর্ঘদিন দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের অবহেলা-অবমূল্যায়ন আর বিএনপি, জামায়াত ও সুযোগ সন্ধানীদের দলে আধিপত্য বিস্তারের কারণে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে।
ওই দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর সমর্থকরা শহরের আলীপুর এলাকায় লাবলুর বাড়িতে ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ করে বলে তাঁর পরিবারের অভিযোগ। লাবলুর সমর্থকরা আলাদা সভা-সমাবেশের আয়োজন করলে পুলিশ দিয়ে সে কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ আছে, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও তাঁর ছেলে আয়মন আকবর চৌধুরীকে তাঁদের গ্রামের বাড়ি ও নির্বাচনী এলাকায় যেতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন মন্ত্রীর সমর্থকরা। তাঁরা ফরিদপুর-সালথা আঞ্চলিক সড়কে ফরিদপুর সদরের বিভিন্ন স্থানে ঢাল-সড়কি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন। তবে এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন মন্ত্রীর সমর্থক এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোকাররম মিয়া বাবু। মন্ত্রীর সঙ্গে সাজেদা চৌধুরী ও কাজী জাফরউল্লাহর সম্পর্ক চমৎকার বলে দাবি করলেও তিনি অভিযোগ করেন, আয়মন আকবর চৌধুরী নিজ এলাকা বাদ দিয়ে ফরিদপুর সদর এলাকায় অযাচিত হস্তক্ষেপ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে ইন্ধন দেওয়ার চেষ্টা করেন।
বরিশালে ভাই-দাদু দ্বন্দ্ব তুঙ্গে : এ জেলায় আছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। তিনি জেলা কমিটিরও সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বড় পরিচয়- তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি ভাই বলেই পরিচিত। অন্যদিকে আছেন মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র শওকত হোসেন হিরণ। দলীয় নেতা-কর্মীরা তাঁকে দাদু বলে সম্বোধন করেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ভাই-দাদুর দুই ধারায় বিভক্ত। উপজেলার রাজনীতি পুরোটাই ভাইয়ের কবজায়, আর মহানগরের রাজনীতি দাদুনির্ভর। যদিও হাসানাত আবদুল্লাহ একসময় ছিলেন হিরণের গুরুর মতো।
জানা গেছে, বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগে অধিপত্য বিস্তারের জন্য দুই নেতা আদাজল খেয়ে নেমেছেন। হাসানাতের অনুসারীদের ঠিকাদারি কাজের টোপ দিয়ে নিজের দিকে টানতে শুরু করেছেন হিরণ। এরই মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সৈয়দ আনিস, সদর উপজেলা শাখার সভাপতি আনোয়ার হোসাইন, ছাত্রনেতা জসীম উদ্দিন, পানামা ফারুক, কুতুব রানা, জিয়া উদ্দিন, ছাবিদ হোসেন, মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ান, সাংগঠনিক সম্পাদক তৌছিক আহমেদ রাহাদসহ বেশির ভাগ নেতা-কর্মী মেয়রের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নগরীতে হঠাৎ করেই হিরণের ক্ষমতার কাছে হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর অনুসারীরা কাবু হয়ে পড়েছেন। একসময়ের গুরু-শিষ্যের স্নায়ুযুদ্ধ এখন প্রকাশ্যে এসেছে। এতে মহানগর আওয়ামী লীগে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা।
স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৯ জুলাই ছাত্রলীগের ৩০ ওয়ার্ডসহ চারটি থানা কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে হাসানাতের অনুসারী নেতা-কর্মীরা ঠাঁই না পাওয়ায় তা বাতিল করা হয়। অতিসম্প্রতি মহানগর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্য কো-অপট করা হয়। সেখানে হাসানাতপন্থী নেতা-কর্মীদের স্থান দেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস এমপি বলেন, 'দলে বিভক্তি নেই। বরিশালের নেতা হাসানাত ভাই, আমরা সবাই কর্মী।' কারো নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, 'কেউ যদি নিজেকে দলের অনেক কিছু মনে করেন, তাহলে তার খেসারত তাঁকেই দিতে হবে।'
এ প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নির্মলেন্দু চক্রবর্তী (ফরিদপুর), রফিকুল ইসলাম (বরিশাল) ও ফারুক আহমেদ (চাঁদপুর)।
No comments