গতকাল সমকাল- ‘বংশমরো’—ফিলিপাইনের আগামীর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল by ফারুক চৌধুরী
বাংলাদেশে আমরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে এতটা জর্জরিত রয়েছি যে চারপাশের ঘটনাগুলোর অনিচ্ছাকৃতভাবেই আমরা অবজ্ঞা করে যাই। আমাদের সংবাদমাধ্যম হয়তো বা তাকে প্রাপ্য গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু ঘটনা তো ঘটেই যাচ্ছে পৃথিবীতে। বিশ্বের কোনো বিবর্তনই আমাদের জন্য থেমে নেই।
তবে এসব ঘটনা আর বিবর্তনের প্রভাব প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে আমাদের ওপর পড়বেই। পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইয়ের কথাই ধরি। এই বীর কিশোরীটি তো ইতিমধ্যেই একটি প্রজন্মকে প্রভাবান্বিত করেছে। সে বেঁচে উঠুক, সে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ কাজে সৎ সাহস জোগাক, এই তো কাম্য।
তবে এই নিবন্ধটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে। ফিলিপাইনের মিনদানাও প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মরোদের ভাষায় ‘বংশ’ মানে দেশ। ‘বংশমরো’, আমাদের উপমহাদেশীয় কথনে হবে মরোদেশ অর্থাৎ মরোদের দেশ। বাংলাদেশ যেমন বাঙালিদের দেশ। তবে উপমার শেষ এখানেই। কারণ, ‘বংশমরো’ কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়; ভবিষ্যতের ফিলিপাইনের মুসলমান-অধ্যুষিত একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল মাত্র।
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের আগে, ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে, মরোরা ফিলিপাইন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য একটি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল। এই সংগ্রামটি গত চার দশকের বিবর্তনের বিভিন্ন মত ও পথের বিভিন্ন সংগ্রামী পার্টির স্রোতধারার সৃষ্টি করেছে। ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে নিহতের সংখ্যা এখন প্রায় দেড় লাখের কোঠায়। লাখ লাখ মানুষ তাতে হয়েছে বাস্তুহারা এবং বড় কথাটি হচ্ছে, এই সংগ্রাম মিনদানাও প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি শোচনীয় আর্থসামাজিক অবস্থার সৃষ্টি করছে, ব্যাহত করেছে ফিলিপাইনের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে। অনেকের মতে, এই শান্তিচুক্তি শুধু মরোদের সশস্ত্র সংগ্রামের সমাপ্তিই ঘটাবে না; অভ্যন্তরীণ সংঘাতের একটি ব্যয়বহুল অধ্যায়ের ইতি টেনে ফিলিপাইনের অর্থনীতি ভবিষ্যতে উজ্জ্বলতর করবে।
ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, ষাটের দশকে মিনদানাওয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র (মুসলমানপ্রধান) স্থাপিত করার সংগ্রামের শুরু হয়। সেই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীটি মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এমএনএলএফ) নামে পরিচিত ছিল। মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট (এমআইএলএফ) এক অর্থে তারই উত্তরসূরি, যাদের বর্তমান লক্ষ্য স্বাধীনতা নয়, স্বায়ত্তশাসন মাত্র। ১৯৮৯ সালে এমএনএলএফ তাদের স্বাধীনতার দাবি প্রত্যাহার করে ফিলিপাইন সরকারের সঙ্গে যে সমঝোতা করেছিল, তার ফলে ১৯৯৬ সালে মুসলিম মিনদানাও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (এআরএমএম) সৃষ্ট হয়। সেই সমঝোতায় অনেক কিছুই স্বচ্ছ এবং বাস্তবধর্মী ছিল না বলে সেই দলের একটি অংশ এমএনএলএফ থেকে বেরিয়ে এসে এমআইএলএফের সৃষ্টি করে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের আবার হয় শুরু। ৭ অক্টোবরের শান্তিচুক্তিটি তারই ইতি টানল।
ফিলিপাইনের মুসলিম-অধ্যুষিত এই অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটে চতুর্দশ শতাব্দীতে অর্থাৎ ফিলিপাইনে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারের এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে। কিন্তু মুসলমানদের আধিপত্য মিনদানাও প্রদেশের পশ্চিম অঞ্চলের দ্বীপপুঞ্জের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সেখানে কয়েকটি অঞ্চলে তখন মুসলমান সুলতানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যারা ফিলিপাইনে স্প্যানিশ আধিপত্য সহজে স্বীকার করেনি। অতএব ফিলিপাইনের মুসলমানদের এই সমস্যাটি যথেষ্ট পুরোনো।
৭ অক্টোবর ২০১২-এর চুক্তিটি আসলে সেই অঞ্চলের নিকট ভবিষ্যতেরই একটি রোডম্যাপ, যার ফলে বংশমরোর সৃষ্টি হবে এবং ১২ হাজার সশস্ত্র বিপ্লবীর ক্রমে ক্রমে নিরস্ত্রীকরণ ঘটবে। বংশমরোতে একটি বহুদলীয় পার্লামেন্টারি প্রথা স্থাপিত হবে, যা হবে প্রেসিডেন্সিয়াল প্রথায় পরিচালিত ফিলিপাইনেরই একটি অংশ। এই আঞ্চলিক সরকারের কর নীতি হবে নিজস্ব এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় তা একটি প্রধান ভূমিকা পালন করবে। বংশমরো সরকার চাইলে তাদের অঞ্চল শরিয়া আইন প্রবর্তন করতে পারবে।
এই শান্তিচুক্তির খুঁটিনাটি অনেক কিছুই এখনো আলোচনাধীন রয়েছে, তবে এটা স্বীকৃত যে স্বরাষ্ট্র ও দেশরক্ষানীতি, আর্থিক নিয়মাবলি, নিরাপত্তা এবং নাগরিকত্বের প্রশ্নগুলো রয়েছে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। চুক্তিতে এও রয়েছে যে রাজস্ব ও জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন হবে। প্রায় সাড়ে ১০ হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ৫০ লাখ মানুষের এই অঞ্চলটিতে স্বর্ণখনি ও সম্ভাবনাময় বনসম্পদ রয়েছে, যার মূল্য ৩০০ বিলিয়ন ডলারেরও অধিক বলে মনে করা হয়ে থাকে। স্বায়ত্তশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার এই চুক্তিটিকে স্বচ্ছ বলেই মনে করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে এগিয়ে মিনদানাওয়ের পশ্চিমের অঞ্চল ও দ্বীপপুঞ্জকে গণভোটের মাধ্যমেই বংশমরোতে যোগদান করার সুযোগ দেওয়া হবে। এই চুক্তিটির বাস্তবায়নের ট্রানজিশনাল কাউন্সিলে পুরোনো এমএনএলএফের সদস্যদেরও রাখা হবে।
অবশ্য এই চুক্তিটিতে কিছু সাংবিধানিক প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত ও অনিশ্চিত রয়ে গেছে। যার মধ্যে প্রধান প্রশ্নটি হলো, প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিতে পরিচালিত ফিলিপাইনের মতো একটি দেশের কেবল একটি অঞ্চলে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি প্রবর্তিত হতে পারে কি না। ফিলিপাইনের বর্তমানের কেন্দ্রীয় সরকারের মতে, তাতে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট বেনিগনো অ্যাকুইনো ২০১৬ সালে তাঁর সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চুক্তিটি চূড়ান্ত করতে আগ্রহী। মরো ইসলামিক ফ্রন্টের নেতা মুরাদ ইব্রাহিমও এই আশা পোষণ করেন। একসময়ের দুর্ধর্ষ এই ‘সন্ত্রাসী’ সেদিন ম্যানিলার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে এলেন শান্তির দূত হয়ে।
পূর্ব এশিয়া অঞ্চলটির জন্য এই চুক্তিটি বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত তা ফিলিপিনোদের দ্রুত অগ্রগতির সহায়ক হবে। সেই অঞ্চলের অবশিষ্ট চরমপন্থীদের জন্য তা পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের পার্বত্য চুক্তির যদি যথাযথ বাস্তবায়ন হতো, তা হলে এ দেশে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে শুধু আস্থারই সৃষ্টি করত না, রামুর মতো একটি জঘন্য এবং আত্মঘাতী ঘটনা থেকে আমাদের বিরত রাখত। দ্বিতীয়ত, থাইল্যান্ডের দক্ষিণে সংগ্রামরত মুসলমানপ্রধান তিনটি প্রদেশের জন্য এই চুক্তিটি পথপ্রদর্শক হতে পারে। থাইল্যান্ডে সশস্ত্র সংগ্রাম সেই দেশের দক্ষিণাঞ্চলে একটি অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ইন্দোনেশিয়ার পূর্বাঞ্চলের প্রান্তিক প্রদেশ পাপুয়ারও এই চুক্তিটি থেকে শিক্ষণীয় রয়েছে। এখানে বলা যেতে পারে, ইন্দোনেশিয়া তার পশ্চিমের আচেহ প্রদেশে ২০০৫ সালে যে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করেছিল, তা সুফলই বয়ে এনেছে।
যুক্তরাষ্ট্র মিনদানাওয়ের এই বিবর্তনকে স্বাগতই জানাবে। স্বাগত জানাবে এডিবি এবং বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাগুলোও। যুক্তরাষ্ট্রের তুষ্টির প্রধান কারণ হলো, এই অঞ্চলে তাদের প্রধান মিত্র ফিলিপাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে দক্ষিণ চীন সাগরে তার অবস্থান সুদৃঢ় হবে।
এদিকে ফিলিপাইনের এই চুক্তিটি সফল হলে এটা প্রমাণিত হবে যে প্রয়োজনবোধে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন একটি দেশের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করার পরিবর্তে শক্তিশালীই করে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
তবে এই নিবন্ধটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে। ফিলিপাইনের মিনদানাও প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মরোদের ভাষায় ‘বংশ’ মানে দেশ। ‘বংশমরো’, আমাদের উপমহাদেশীয় কথনে হবে মরোদেশ অর্থাৎ মরোদের দেশ। বাংলাদেশ যেমন বাঙালিদের দেশ। তবে উপমার শেষ এখানেই। কারণ, ‘বংশমরো’ কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়; ভবিষ্যতের ফিলিপাইনের মুসলমান-অধ্যুষিত একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল মাত্র।
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের আগে, ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে, মরোরা ফিলিপাইন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য একটি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল। এই সংগ্রামটি গত চার দশকের বিবর্তনের বিভিন্ন মত ও পথের বিভিন্ন সংগ্রামী পার্টির স্রোতধারার সৃষ্টি করেছে। ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে নিহতের সংখ্যা এখন প্রায় দেড় লাখের কোঠায়। লাখ লাখ মানুষ তাতে হয়েছে বাস্তুহারা এবং বড় কথাটি হচ্ছে, এই সংগ্রাম মিনদানাও প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি শোচনীয় আর্থসামাজিক অবস্থার সৃষ্টি করছে, ব্যাহত করেছে ফিলিপাইনের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে। অনেকের মতে, এই শান্তিচুক্তি শুধু মরোদের সশস্ত্র সংগ্রামের সমাপ্তিই ঘটাবে না; অভ্যন্তরীণ সংঘাতের একটি ব্যয়বহুল অধ্যায়ের ইতি টেনে ফিলিপাইনের অর্থনীতি ভবিষ্যতে উজ্জ্বলতর করবে।
ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, ষাটের দশকে মিনদানাওয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র (মুসলমানপ্রধান) স্থাপিত করার সংগ্রামের শুরু হয়। সেই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীটি মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এমএনএলএফ) নামে পরিচিত ছিল। মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট (এমআইএলএফ) এক অর্থে তারই উত্তরসূরি, যাদের বর্তমান লক্ষ্য স্বাধীনতা নয়, স্বায়ত্তশাসন মাত্র। ১৯৮৯ সালে এমএনএলএফ তাদের স্বাধীনতার দাবি প্রত্যাহার করে ফিলিপাইন সরকারের সঙ্গে যে সমঝোতা করেছিল, তার ফলে ১৯৯৬ সালে মুসলিম মিনদানাও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (এআরএমএম) সৃষ্ট হয়। সেই সমঝোতায় অনেক কিছুই স্বচ্ছ এবং বাস্তবধর্মী ছিল না বলে সেই দলের একটি অংশ এমএনএলএফ থেকে বেরিয়ে এসে এমআইএলএফের সৃষ্টি করে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের আবার হয় শুরু। ৭ অক্টোবরের শান্তিচুক্তিটি তারই ইতি টানল।
ফিলিপাইনের মুসলিম-অধ্যুষিত এই অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটে চতুর্দশ শতাব্দীতে অর্থাৎ ফিলিপাইনে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারের এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে। কিন্তু মুসলমানদের আধিপত্য মিনদানাও প্রদেশের পশ্চিম অঞ্চলের দ্বীপপুঞ্জের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সেখানে কয়েকটি অঞ্চলে তখন মুসলমান সুলতানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যারা ফিলিপাইনে স্প্যানিশ আধিপত্য সহজে স্বীকার করেনি। অতএব ফিলিপাইনের মুসলমানদের এই সমস্যাটি যথেষ্ট পুরোনো।
৭ অক্টোবর ২০১২-এর চুক্তিটি আসলে সেই অঞ্চলের নিকট ভবিষ্যতেরই একটি রোডম্যাপ, যার ফলে বংশমরোর সৃষ্টি হবে এবং ১২ হাজার সশস্ত্র বিপ্লবীর ক্রমে ক্রমে নিরস্ত্রীকরণ ঘটবে। বংশমরোতে একটি বহুদলীয় পার্লামেন্টারি প্রথা স্থাপিত হবে, যা হবে প্রেসিডেন্সিয়াল প্রথায় পরিচালিত ফিলিপাইনেরই একটি অংশ। এই আঞ্চলিক সরকারের কর নীতি হবে নিজস্ব এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় তা একটি প্রধান ভূমিকা পালন করবে। বংশমরো সরকার চাইলে তাদের অঞ্চল শরিয়া আইন প্রবর্তন করতে পারবে।
এই শান্তিচুক্তির খুঁটিনাটি অনেক কিছুই এখনো আলোচনাধীন রয়েছে, তবে এটা স্বীকৃত যে স্বরাষ্ট্র ও দেশরক্ষানীতি, আর্থিক নিয়মাবলি, নিরাপত্তা এবং নাগরিকত্বের প্রশ্নগুলো রয়েছে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। চুক্তিতে এও রয়েছে যে রাজস্ব ও জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন হবে। প্রায় সাড়ে ১০ হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ৫০ লাখ মানুষের এই অঞ্চলটিতে স্বর্ণখনি ও সম্ভাবনাময় বনসম্পদ রয়েছে, যার মূল্য ৩০০ বিলিয়ন ডলারেরও অধিক বলে মনে করা হয়ে থাকে। স্বায়ত্তশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার এই চুক্তিটিকে স্বচ্ছ বলেই মনে করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে এগিয়ে মিনদানাওয়ের পশ্চিমের অঞ্চল ও দ্বীপপুঞ্জকে গণভোটের মাধ্যমেই বংশমরোতে যোগদান করার সুযোগ দেওয়া হবে। এই চুক্তিটির বাস্তবায়নের ট্রানজিশনাল কাউন্সিলে পুরোনো এমএনএলএফের সদস্যদেরও রাখা হবে।
অবশ্য এই চুক্তিটিতে কিছু সাংবিধানিক প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত ও অনিশ্চিত রয়ে গেছে। যার মধ্যে প্রধান প্রশ্নটি হলো, প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিতে পরিচালিত ফিলিপাইনের মতো একটি দেশের কেবল একটি অঞ্চলে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি প্রবর্তিত হতে পারে কি না। ফিলিপাইনের বর্তমানের কেন্দ্রীয় সরকারের মতে, তাতে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট বেনিগনো অ্যাকুইনো ২০১৬ সালে তাঁর সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চুক্তিটি চূড়ান্ত করতে আগ্রহী। মরো ইসলামিক ফ্রন্টের নেতা মুরাদ ইব্রাহিমও এই আশা পোষণ করেন। একসময়ের দুর্ধর্ষ এই ‘সন্ত্রাসী’ সেদিন ম্যানিলার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে এলেন শান্তির দূত হয়ে।
পূর্ব এশিয়া অঞ্চলটির জন্য এই চুক্তিটি বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত তা ফিলিপিনোদের দ্রুত অগ্রগতির সহায়ক হবে। সেই অঞ্চলের অবশিষ্ট চরমপন্থীদের জন্য তা পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের পার্বত্য চুক্তির যদি যথাযথ বাস্তবায়ন হতো, তা হলে এ দেশে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে শুধু আস্থারই সৃষ্টি করত না, রামুর মতো একটি জঘন্য এবং আত্মঘাতী ঘটনা থেকে আমাদের বিরত রাখত। দ্বিতীয়ত, থাইল্যান্ডের দক্ষিণে সংগ্রামরত মুসলমানপ্রধান তিনটি প্রদেশের জন্য এই চুক্তিটি পথপ্রদর্শক হতে পারে। থাইল্যান্ডে সশস্ত্র সংগ্রাম সেই দেশের দক্ষিণাঞ্চলে একটি অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ইন্দোনেশিয়ার পূর্বাঞ্চলের প্রান্তিক প্রদেশ পাপুয়ারও এই চুক্তিটি থেকে শিক্ষণীয় রয়েছে। এখানে বলা যেতে পারে, ইন্দোনেশিয়া তার পশ্চিমের আচেহ প্রদেশে ২০০৫ সালে যে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করেছিল, তা সুফলই বয়ে এনেছে।
যুক্তরাষ্ট্র মিনদানাওয়ের এই বিবর্তনকে স্বাগতই জানাবে। স্বাগত জানাবে এডিবি এবং বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাগুলোও। যুক্তরাষ্ট্রের তুষ্টির প্রধান কারণ হলো, এই অঞ্চলে তাদের প্রধান মিত্র ফিলিপাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে দক্ষিণ চীন সাগরে তার অবস্থান সুদৃঢ় হবে।
এদিকে ফিলিপাইনের এই চুক্তিটি সফল হলে এটা প্রমাণিত হবে যে প্রয়োজনবোধে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন একটি দেশের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করার পরিবর্তে শক্তিশালীই করে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
No comments