বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৪৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. আলতাফ হোসেন খান, বীর প্রতীক দুঃসাহসী এক যোদ্ধা রাতের অন্ধকারে মো. আলতাফ হোসেন খানসহ মুক্তিযোদ্ধারা নিঃশব্দে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।
তাঁদের অবস্থানের অদূরে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা। তাঁরা কয়েকটি দল ও উপদলে বিভক্ত ছিলেন। একটি উপদলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
নির্ধারিত সময়ে মো. আলতাফ হোসেন খান নিজ দলের সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর। একযোগে গর্জে ওঠে তাঁদের সবার অস্ত্র। পাকিস্তানিদের দিক থেকেও একই সময়ে পাল্টা গোলাগুলি শুরু হয়। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
মুহূর্তে ঘটে প্রলয় কাণ্ড। গোলাগুলি আর আগুনের শিখায় চারদিক আকাশ রক্তিম হয়ে পড়ে। শেষ রাত থেকে সারা দিন যুদ্ধ হয়। পরদিনও। কয়েক দিন একটানা যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।
কয়েক দিন ধরে চলা এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তারা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় ১০০ জন পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী বাঙালি-অবাঙালি পুলিশ ও রাজাকার নিহত হয়।
এ যুদ্ধে মো. আলতাফ হোসেন খান দলনেতা হিসেবে যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁর দুঃসাহসিকতায় সহযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হন। তাঁরাও পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হন। তাঁদের দুঃসাহসিক আক্রমণে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ে। তাঁদের অস্ত্রের গুলিতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ ও রাজাকার নিহত হয়।
এ ঘটনা চিলমারীতে। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি। ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে চিলমারী। কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত। চিলমারীর অপর প্রান্তে রৌমারী। ১৯৭১ সালে রৌমারী ছিল মুক্ত এলাকা। রৌমারী থেকে মুক্তিযোদ্ধারা চিলমারী হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করত।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে চিলমারীর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ এলাকায় সার্বক্ষণিক নজর রাখার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন চিলমারীতে শক্ত এক প্রতিরক্ষা তৈরি করে।
প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল ৩২ বালুচ রেজিমেন্ট, ইপিসিএএফ, রাজাকার ও পুলিশ। সব মিলে এক ব্যাটালিয়ন শক্তি। তাদের মূল অবস্থানগুলো ছিল হাইস্কুল, রেলস্টেশন ও ওয়াপদা অফিসে।
মো. আলতাফ হোসেন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা (এ) কোম্পানিতে। রেজিমেন্টর অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মার্চ মাসে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসনের কথা বলে তাঁদের সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। তিনি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে মোতায়েন ছিলেন।
তাঁদের কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাঁর কোম্পানির সিনিয়র জেসিওর নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পার্বতীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি যুদ্ধ করেন। পার্বতীপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাঁরা প্রথমে অ্যাম্বুশ করেন। এরপর কয়েক ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধ হয়। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান।
ভারতে পুনর্গঠিত হওয়ার পর নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর, বৃহত্তর সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, ছাতক ও টেংরাটিলাসহ বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহস, দক্ষতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আলতাফ হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৬৭।
মো. আলতাফ হোসেন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন। ১৯৮০ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে। বাবার নাম সুলতান খান, মা ফাতেমা বেগম। স্ত্রী সরবানু বেগম। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: মেজর ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
নির্ধারিত সময়ে মো. আলতাফ হোসেন খান নিজ দলের সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর। একযোগে গর্জে ওঠে তাঁদের সবার অস্ত্র। পাকিস্তানিদের দিক থেকেও একই সময়ে পাল্টা গোলাগুলি শুরু হয়। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
মুহূর্তে ঘটে প্রলয় কাণ্ড। গোলাগুলি আর আগুনের শিখায় চারদিক আকাশ রক্তিম হয়ে পড়ে। শেষ রাত থেকে সারা দিন যুদ্ধ হয়। পরদিনও। কয়েক দিন একটানা যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।
কয়েক দিন ধরে চলা এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তারা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় ১০০ জন পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী বাঙালি-অবাঙালি পুলিশ ও রাজাকার নিহত হয়।
এ যুদ্ধে মো. আলতাফ হোসেন খান দলনেতা হিসেবে যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁর দুঃসাহসিকতায় সহযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হন। তাঁরাও পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হন। তাঁদের দুঃসাহসিক আক্রমণে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ে। তাঁদের অস্ত্রের গুলিতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা, ইপিসিএএফ ও রাজাকার নিহত হয়।
এ ঘটনা চিলমারীতে। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি। ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে চিলমারী। কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত। চিলমারীর অপর প্রান্তে রৌমারী। ১৯৭১ সালে রৌমারী ছিল মুক্ত এলাকা। রৌমারী থেকে মুক্তিযোদ্ধারা চিলমারী হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করত।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে চিলমারীর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ এলাকায় সার্বক্ষণিক নজর রাখার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন চিলমারীতে শক্ত এক প্রতিরক্ষা তৈরি করে।
প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল ৩২ বালুচ রেজিমেন্ট, ইপিসিএএফ, রাজাকার ও পুলিশ। সব মিলে এক ব্যাটালিয়ন শক্তি। তাদের মূল অবস্থানগুলো ছিল হাইস্কুল, রেলস্টেশন ও ওয়াপদা অফিসে।
মো. আলতাফ হোসেন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা (এ) কোম্পানিতে। রেজিমেন্টর অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মার্চ মাসে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসনের কথা বলে তাঁদের সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। তিনি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে মোতায়েন ছিলেন।
তাঁদের কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাঁর কোম্পানির সিনিয়র জেসিওর নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পার্বতীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি যুদ্ধ করেন। পার্বতীপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাঁরা প্রথমে অ্যাম্বুশ করেন। এরপর কয়েক ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধ হয়। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান।
ভারতে পুনর্গঠিত হওয়ার পর নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর, বৃহত্তর সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, ছাতক ও টেংরাটিলাসহ বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহস, দক্ষতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আলতাফ হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৬৭।
মো. আলতাফ হোসেন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন। ১৯৮০ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে। বাবার নাম সুলতান খান, মা ফাতেমা বেগম। স্ত্রী সরবানু বেগম। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: মেজর ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
No comments