দুর্বল নেতৃত্ব রাষ্ট্রে বিপর্যয় ডেকে আনে by এলাহী নেওয়াজ খান
বহু জাতির গৌরবময় ইতিহাস ও বীরত্বগাঁথা ম্লান হয়ে গেছে দুর্বল নেতৃত্বের কারণে। আমাদের কাছের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, কিভাবে বাহাদুর শাহ জাফরের মতো দুর্বল নেতৃত্বের কারণে মোঘল সাম্রাজ্যের পতন দ্রুত তরান্বিত হয়েছিল।
একইভাবে রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য এবং পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। পারস্য সাম্রাজ্যের ওপর যখন আরব আধপত্য হয়েছিল; তখন তাদের দৃশ্যমান শক্তি আরবদের থেকে অনেক বেশি ছিল। সেটা সৈন্য, সম্পদ সবদিক দিয়েই। কিন্তু দুর্বল নেতৃত্ব ও বিলাসিতার কারণে ভেতরে ভেতরে সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খলদুন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-মুকাদিমায়’ লিখেছেন, রাজ্যশক্তির স্বভাব হলো যাবতীয় গৌরব নিজের জন্য কুক্ষিগত করা। ... শাসক যতদূর সম্ভব সমুদ্বয় শক্তি নিজের মধ্যে সংহত করে, সকল কিছু কুক্ষিগত করে নেয়। এইভাবে সে রাজ্য শক্তির সমস্ত গৌরব নিজের মধ্যে বহন করে এবং অন্যকে এর মধ্যে অংশগ্রহণে বাধা দেয়।
ইবনে খলদুন অতীতের যে রাজ্য শক্তির কথা বলেছেন তার সঙ্গে বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও শাসকদের মধ্যকার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য প্রাচীন ও বর্তমান যুগে একই। সে শুধু সুযোগ খুঁজতে থাকে। অতীতে একটি গোত্রের জনসংখ্যা, শক্তি ও প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষমতাই নির্ধারণ করতো তার স্থায়িত্ব। বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যেও একই ধর্ম, একই সংস্কৃতি ও একই ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক দল কেন্দ্রীক গোত্র তৈরি হয়। সেই দল যখন ক্ষমতায় যায়; তখন যাবতীয় গৌরব নিজের জন্য কুক্ষিগত করে। অন্যের অধিকারকে সম্পূর্ণ দলিত-মথিত করা হয়। বেপরোয়াভাবে লুণ্ঠিত হয় মানুষের সম্পদ। যেমন ইবনে খলদুন বলেছেন, অন্যদের জন্য একটি উট বা উটনীর ছেড়ে দেয় না এর ফলে যে বিপুল অর্থ ও সম্পদ কুক্ষিগত হয় তা গোত্রপতিদের বিলাসী জীবনের দিকে নিয়ে যায় এবং অসম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে- শাসন ক্ষমতায় দুর্বলতা এসে যাওয়া। আর তা কাটিয়ে ওঠার জন্য শাসন ব্যবস্থার আরো কঠোরতা ও রুঢ়তা নেমে আসে। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবন যাপনকে দুর্বল করে ফেলে।
আর বর্তমান যুগে শাসকেরা যখন ওই ধরনের দুর্বলতার মধ্যে পড়ে যায়; তখন টিকে থাকার জন্য শক্তিশালী কোনো রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে, বা একটি জাতির রাষ্ট্রক কার্যত: পরাজিতের মানসিকতার মধ্যে ফেলে দেয়। আর এ ধরনের পরিস্থিতি যখন একটি রাষ্ট্রে সৃষ্টি হয়; তখস সে দেশের নেতৃত্ব প্রভুর কামনা-বাসানার ক্রীড়নকে পরিণত হয়। প্রভুর সবকিছু অনুসরণ করতে থাকে। তা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, নিজস্ব স্বাধীন স্বকীয়তাই ভুলে যায়। প্রভুর সংস্কৃতি, আচার-আচরণ নিজের হয়ে যায়। মুসলিম শাসকদের এ ধরনের দাসত্ব ও নির্ভরতা অনিবার্য বিপর্যয় ডেকে আনে। কারণ ক্ষমতার মূল মালিককে ভুলে অন্য কোনো রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ওপর নির্ভরতা বিপদ ডেকে আনতে বাধ্য।
আধুনিক পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব একে অপরের আধিপত্য বিস্তারের পরিবর্তে পারস্পরিক নির্ভরতার বিশ্বস্ত ভিত্তি রচনা করেছে। আর এ ভিত্তি রচিত হয়েছে একই ধর্ম ও বর্ণের ঐক্যের মধ্য দিয়ে, যা একটি সাংস্কৃতিক ঐক্য সৃষ্টি করেছে। ভাষাগত ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও একই ধর্ম ও বর্ণের ঐক্য তাদের মধ্যে এই সংহতি সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে পশ্চিমা রাষ্ট্রশক্তি নিজ জনগণের কল্যাণ, সুখ, শান্তির জন্য বেশি সজাগ থাকায় তাদের মধ্যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা কম থাকে। কারণ রাষ্ট্রীয় শক্তিতে যদি দলীয় গোত্রগত প্রাধান্য বিস্তারের আলমত ফুটে উঠে; অন্যের মতামতকে দমন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠণের প্রবণতা বেপরোয়া হয়ে ওঠে; তাহলে জনগণ বঞ্ছনার মধ্যে পড়ে যায়; যা অনিবার্যভাবে শাসকদের বিরুদ্ধে চলে যায়। ফলে রাষ্ট্রের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অন্য শক্তির ওপর নির্ভরতা বেড়ে যায়। যেভাবে ইরাক ও লিবিয়া দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেখানে নির্যাতিতরা অন্য দেশের ওপর নির্ভর করে শাসকদের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এর ফলে শাসক পরিবর্তন হলেও জনগণের ওপর সাহায্যকারী বিজয়ী শক্তির প্রাধান্য ওই দুটি রাষ্ট্রের প্রশাসনের সর্বত্র বিরাজমান। অর্থাৎ সাহায্যকারী রাষ্ট্রসমূহের স্বার্থ রক্ষার জন্য যা যা করার দরকার, তা তাদের করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। এ সব দেশের দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা দুর্বল ও নিপীড়নমূলক শাসনের ফলে বর্তমানে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল উভয়ই পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ইতিহাসের পাতা জুড়েই লক্ষ্য করা যায় একজন ব্যক্তিই কিম্বা একজন নেতাই একটি জাতিকে শক্তিশালী সংঘে পরিণত করে। কিন্তু একটি নেতা বা নেতৃত্ব যদি দুর্বল হয়ে পড়ে অন্য রাষ্ট্র শক্তির ওপর নির্ভর করতে শুরু করে তখন জনগণ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অন্য দেশের আধিপত্যকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিতে শুরু করে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের প্রসঙ্গ আনা যায়। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় সেনাপ্রধান ছিলেন এবং নয় বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ শাসন করেছেন। তার সম্পর্কে অনেকের আগে থেকে ধারণা ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি তিনি দিল্লি সফর করে যেভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন, তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি অনেক আগের থেকেই আরেকটি রাষ্ট্রের অনুগত হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তার ক্ষমতা দখল ছিল সেই আনুগত্যের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া। তার মূল লক্ষ্য ছিল তার মতো অনুগতদের পর্যায়ক্রমিক শাসন ক্ষমতায় আসার পথকে সুগম করা।
ধারণা করা যায় যে, ৯১ সালে ভুল হিসাব-নিকাশের কারণে তা সফল হয়নি। কিন্ত ৯৬ সালে তিনিই সেটা সফল করেন। সেই সফল্যের ধারাবাহিকতায় তিনি একটি জোটে সম্পৃক্ত হন এবং সাফল্যও লাভ করেন। যদিও এ ক্ষেত্রেও আরেক জন জেনারেল অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন। এ রকম পটভূমিতে এখন এ দেশের প্রধান বিরোধী দলও নিজেদের সেই নিয়তির হাতে সোপর্দ করেছে বলে অনেকে সন্দেহ করে।
মোদ্দাকথা, দলগতভাবে যার যে অবস্থান যেখানেই থাক না কেন, বর্তমানের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির নেতৃত্ব দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে একাধিক রাষ্ট্রশক্তির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কোনো দলেরই এখন নিজস্ব কোনো সত্তা নেই। সবই বিদেশী শক্তির ইচ্ছাধীন হয়ে গেছে। এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা চলছে কোনো দলকে কোনো দেশ সমর্থন করছে তা নিয়ে। আবার কখনো কখনো এটাও আলোচনা হয় সকল দলই প্রতিবেশী একটি দেশের সমর্থন পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে। এর ফলে জনগণ বিশ্বাস বা নির্ভরতার জায়গাটা খুঁজে পাচ্ছে না। বিশ্বাসের জায়গাটাকে জেনারেল এরশাদ একদম নড়বড়ে করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ এখন ভাবছে, যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে লম্বা সময় আমাদের সেনাপ্রধান ছিলেন, যে ব্যক্তিটি নয় বছর দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন; সেই ব্যক্তিই যখন দিল্লীতে গিয়ে প্রকাশ্যে অধীনতা স্বীকার করে এসেছে; সেখানে আর কাকে বিশ্বাস করা যায়।
এ ক্ষেত্রে ভারতকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতের সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সা আছে। সে চাইবে সব সময় প্রতিবেশী ক্ষুদ্র দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে। তার সামরিক কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থে এটা প্রয়োজন। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে অন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের নেতারা যদি ঠিকমত দেশ চালাতে না পারে কিম্বা কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যদি অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়; তাহলে রাষ্ট্র দুর্বল হতে বাধ্য। এর ফলে অন্যের আধিপত্য বিস্তারের পথ সহজে সুগম হয়ে যায়। বর্তমান বাংলাদেশ ঠিক এ রকমই একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। বিদেশী শক্তিসমূহ পরিণতি কোন দিকে নিয়ে যায় সেটা দেখার জন্য জনগণ নীরব নিথর হয়ে বসে আছে।
এলাহী নেওয়াজ খান: সাংবাদিক
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খলদুন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-মুকাদিমায়’ লিখেছেন, রাজ্যশক্তির স্বভাব হলো যাবতীয় গৌরব নিজের জন্য কুক্ষিগত করা। ... শাসক যতদূর সম্ভব সমুদ্বয় শক্তি নিজের মধ্যে সংহত করে, সকল কিছু কুক্ষিগত করে নেয়। এইভাবে সে রাজ্য শক্তির সমস্ত গৌরব নিজের মধ্যে বহন করে এবং অন্যকে এর মধ্যে অংশগ্রহণে বাধা দেয়।
ইবনে খলদুন অতীতের যে রাজ্য শক্তির কথা বলেছেন তার সঙ্গে বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও শাসকদের মধ্যকার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য প্রাচীন ও বর্তমান যুগে একই। সে শুধু সুযোগ খুঁজতে থাকে। অতীতে একটি গোত্রের জনসংখ্যা, শক্তি ও প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষমতাই নির্ধারণ করতো তার স্থায়িত্ব। বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যেও একই ধর্ম, একই সংস্কৃতি ও একই ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক দল কেন্দ্রীক গোত্র তৈরি হয়। সেই দল যখন ক্ষমতায় যায়; তখন যাবতীয় গৌরব নিজের জন্য কুক্ষিগত করে। অন্যের অধিকারকে সম্পূর্ণ দলিত-মথিত করা হয়। বেপরোয়াভাবে লুণ্ঠিত হয় মানুষের সম্পদ। যেমন ইবনে খলদুন বলেছেন, অন্যদের জন্য একটি উট বা উটনীর ছেড়ে দেয় না এর ফলে যে বিপুল অর্থ ও সম্পদ কুক্ষিগত হয় তা গোত্রপতিদের বিলাসী জীবনের দিকে নিয়ে যায় এবং অসম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে- শাসন ক্ষমতায় দুর্বলতা এসে যাওয়া। আর তা কাটিয়ে ওঠার জন্য শাসন ব্যবস্থার আরো কঠোরতা ও রুঢ়তা নেমে আসে। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবন যাপনকে দুর্বল করে ফেলে।
আর বর্তমান যুগে শাসকেরা যখন ওই ধরনের দুর্বলতার মধ্যে পড়ে যায়; তখন টিকে থাকার জন্য শক্তিশালী কোনো রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে, বা একটি জাতির রাষ্ট্রক কার্যত: পরাজিতের মানসিকতার মধ্যে ফেলে দেয়। আর এ ধরনের পরিস্থিতি যখন একটি রাষ্ট্রে সৃষ্টি হয়; তখস সে দেশের নেতৃত্ব প্রভুর কামনা-বাসানার ক্রীড়নকে পরিণত হয়। প্রভুর সবকিছু অনুসরণ করতে থাকে। তা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, নিজস্ব স্বাধীন স্বকীয়তাই ভুলে যায়। প্রভুর সংস্কৃতি, আচার-আচরণ নিজের হয়ে যায়। মুসলিম শাসকদের এ ধরনের দাসত্ব ও নির্ভরতা অনিবার্য বিপর্যয় ডেকে আনে। কারণ ক্ষমতার মূল মালিককে ভুলে অন্য কোনো রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ওপর নির্ভরতা বিপদ ডেকে আনতে বাধ্য।
আধুনিক পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব একে অপরের আধিপত্য বিস্তারের পরিবর্তে পারস্পরিক নির্ভরতার বিশ্বস্ত ভিত্তি রচনা করেছে। আর এ ভিত্তি রচিত হয়েছে একই ধর্ম ও বর্ণের ঐক্যের মধ্য দিয়ে, যা একটি সাংস্কৃতিক ঐক্য সৃষ্টি করেছে। ভাষাগত ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও একই ধর্ম ও বর্ণের ঐক্য তাদের মধ্যে এই সংহতি সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে পশ্চিমা রাষ্ট্রশক্তি নিজ জনগণের কল্যাণ, সুখ, শান্তির জন্য বেশি সজাগ থাকায় তাদের মধ্যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা কম থাকে। কারণ রাষ্ট্রীয় শক্তিতে যদি দলীয় গোত্রগত প্রাধান্য বিস্তারের আলমত ফুটে উঠে; অন্যের মতামতকে দমন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠণের প্রবণতা বেপরোয়া হয়ে ওঠে; তাহলে জনগণ বঞ্ছনার মধ্যে পড়ে যায়; যা অনিবার্যভাবে শাসকদের বিরুদ্ধে চলে যায়। ফলে রাষ্ট্রের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অন্য শক্তির ওপর নির্ভরতা বেড়ে যায়। যেভাবে ইরাক ও লিবিয়া দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেখানে নির্যাতিতরা অন্য দেশের ওপর নির্ভর করে শাসকদের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এর ফলে শাসক পরিবর্তন হলেও জনগণের ওপর সাহায্যকারী বিজয়ী শক্তির প্রাধান্য ওই দুটি রাষ্ট্রের প্রশাসনের সর্বত্র বিরাজমান। অর্থাৎ সাহায্যকারী রাষ্ট্রসমূহের স্বার্থ রক্ষার জন্য যা যা করার দরকার, তা তাদের করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। এ সব দেশের দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা দুর্বল ও নিপীড়নমূলক শাসনের ফলে বর্তমানে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল উভয়ই পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ইতিহাসের পাতা জুড়েই লক্ষ্য করা যায় একজন ব্যক্তিই কিম্বা একজন নেতাই একটি জাতিকে শক্তিশালী সংঘে পরিণত করে। কিন্তু একটি নেতা বা নেতৃত্ব যদি দুর্বল হয়ে পড়ে অন্য রাষ্ট্র শক্তির ওপর নির্ভর করতে শুরু করে তখন জনগণ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অন্য দেশের আধিপত্যকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিতে শুরু করে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের প্রসঙ্গ আনা যায়। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় সেনাপ্রধান ছিলেন এবং নয় বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ শাসন করেছেন। তার সম্পর্কে অনেকের আগে থেকে ধারণা ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি তিনি দিল্লি সফর করে যেভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন, তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি অনেক আগের থেকেই আরেকটি রাষ্ট্রের অনুগত হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তার ক্ষমতা দখল ছিল সেই আনুগত্যের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া। তার মূল লক্ষ্য ছিল তার মতো অনুগতদের পর্যায়ক্রমিক শাসন ক্ষমতায় আসার পথকে সুগম করা।
ধারণা করা যায় যে, ৯১ সালে ভুল হিসাব-নিকাশের কারণে তা সফল হয়নি। কিন্ত ৯৬ সালে তিনিই সেটা সফল করেন। সেই সফল্যের ধারাবাহিকতায় তিনি একটি জোটে সম্পৃক্ত হন এবং সাফল্যও লাভ করেন। যদিও এ ক্ষেত্রেও আরেক জন জেনারেল অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন। এ রকম পটভূমিতে এখন এ দেশের প্রধান বিরোধী দলও নিজেদের সেই নিয়তির হাতে সোপর্দ করেছে বলে অনেকে সন্দেহ করে।
মোদ্দাকথা, দলগতভাবে যার যে অবস্থান যেখানেই থাক না কেন, বর্তমানের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির নেতৃত্ব দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে একাধিক রাষ্ট্রশক্তির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কোনো দলেরই এখন নিজস্ব কোনো সত্তা নেই। সবই বিদেশী শক্তির ইচ্ছাধীন হয়ে গেছে। এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা চলছে কোনো দলকে কোনো দেশ সমর্থন করছে তা নিয়ে। আবার কখনো কখনো এটাও আলোচনা হয় সকল দলই প্রতিবেশী একটি দেশের সমর্থন পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে। এর ফলে জনগণ বিশ্বাস বা নির্ভরতার জায়গাটা খুঁজে পাচ্ছে না। বিশ্বাসের জায়গাটাকে জেনারেল এরশাদ একদম নড়বড়ে করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ এখন ভাবছে, যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে লম্বা সময় আমাদের সেনাপ্রধান ছিলেন, যে ব্যক্তিটি নয় বছর দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন; সেই ব্যক্তিই যখন দিল্লীতে গিয়ে প্রকাশ্যে অধীনতা স্বীকার করে এসেছে; সেখানে আর কাকে বিশ্বাস করা যায়।
এ ক্ষেত্রে ভারতকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতের সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সা আছে। সে চাইবে সব সময় প্রতিবেশী ক্ষুদ্র দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে। তার সামরিক কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থে এটা প্রয়োজন। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে অন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের নেতারা যদি ঠিকমত দেশ চালাতে না পারে কিম্বা কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যদি অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়; তাহলে রাষ্ট্র দুর্বল হতে বাধ্য। এর ফলে অন্যের আধিপত্য বিস্তারের পথ সহজে সুগম হয়ে যায়। বর্তমান বাংলাদেশ ঠিক এ রকমই একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। বিদেশী শক্তিসমূহ পরিণতি কোন দিকে নিয়ে যায় সেটা দেখার জন্য জনগণ নীরব নিথর হয়ে বসে আছে।
এলাহী নেওয়াজ খান: সাংবাদিক
No comments