আর্থিক সংকটে চিকিৎসা হয় না, কেউ খবরও নেয় না
আমার কথা পত্রিকায় লিখে কি লাভ হবে, আমাকে তো আর কেউ দেখতে আসে না! যৌবন থাকতে কেউ খোঁজ নেয়নি আর এখনতো যাওয়ার সময়। আবেগতাড়িত হয়ে কথাগুলো বলেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাত দলের প্রধান জননেতা, সাংবাদিক, ভাষা সৈনিক অলি আহাদ।
২০১০ সালে এলিফ্যান্ট রোড়ের বাসায় সাক্ষাতকারটি নিয়ে ছিলেন সংবাদ২৪.নেট এর প্রধান প্রতিবেদক ইকবাল হোসেন মজনু।
স্বাধীনতার পুরস্কার প্রাপ্ত বীরযোদ্ধা অলি আহাদ এ প্রতিবেদককে কাছে পেয়ে দেশ-জাতি-রাজনীতি নিয়ে তাঁর অসমাপ্ত স্বপ্নের কথা, অকৃতজ্ঞ মানুষের কথা বলেছেন।
তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘সরকার দূরে থাক, আমার সতীর্থরাও তো কেউ দেখতে আসে না। আসবেইবা কেন? আমাকে দিয়ে আর কি হবে, ভাষা আন্দোলনতো শেষ, আমাকে তো আর দরকার নেই’।
একজন অকুতোভয় নির্লোভ মানুষ হিসাবে পরিচিত সত্য সন্ধানী এই প্রতিবাদী পুরুষ ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার ইসলামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৭-৪৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন সম্পর্কিত আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে অলি আহদকে চার বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে।
৫৮ বছর পর ২০০৬ সালের ২০ মার্চ তাঁর বাহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ব বিদ্যালয়ের রেকর্ড শাখা অনুযায়ী অলি আহাদ ১৯৫০ সালে বিকম পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
তার লেখা ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫’ বইয়ে এ সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি উল্লেখও করেছেন।
অলি আহাদ দীর্ঘশ্বাস তুলে বলেন, পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেও জীবনে কোন কিছু পাইনি। কিন্ত যারা পাশই করেনি তারা আজ সুনামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালার অলি আহাদের একমাত্র মেয়ে ব্যারিষ্টার রুমিন ফারহানা আর স্ত্রী মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (এশিয়া মহাদেশের একমাত্র মহিলা মহাপরিচালক) অধ্যাপিকা রাশিদা বেগমকে নিয়েই এখন অলি আহাদের সময় কাটে।
সত্যের প্রয়োজনে যিনি নিজের বিরুদ্ধে কথা বলতেও কখনো এতটুকু চিন্তা করেননি। ইতিহাসের সেই উজ্জল পুরুষটি বার্ধক্যে অচল-অক্ষম হয়ে এখন নিজের নীতি নৈতিকতাকেই বার বার ধিক্কার দিচ্ছেন।
বয়ে বেড়াচ্ছেন শ্রবণ ও স্মৃতিশক্তিহীণ এক মানব দেহ। অধ্যাপিকা রাশিদা বেগম বলেন, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য! ইতিহাসের এই কালজয়ী মানুষটির নিজের কোন বাসস্থানই নেই। তার বাবা (অলি আহাদের শশুর) গণিতবিদ মরহুম মো. শাহাব উদ্দিনের দেয়া বাড়ি ও রাশিদা বেগমের চাকরীর পাওয়া টাকার আয় দিয়েই সংসার চলে তাদের। বিয়ের ৩৩ বছর পরও সেই অতীত স্মৃতি গুলো অলি আহাদকে কাঁদিয়ে বেড়াতে দেখে আসছেন এখনো।
কারণ একটাই স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত এই বীর সৈনিক বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে জীবনের শেষ প্রান্তে চলে যাওয়ার পরও রাষ্ট্র কিংবা কোন ব্যক্তি আজো তার কোন খবরই নেয়নি। পাননি কোন সরকারি অনুদান।
চিরবিদ্র্রোহী পুরুষটি এখন অসহায় গৃহবন্দী। ডাক্তাররা বলছেন, তাঁকে বাঁচাতে জরুরী কিছু চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন। হার্ট ও ফুসফুসের সমস্যা, চোখের সমস্যা, পায়ের সমস্যা, প্রস্টেট এলার্জ, পড়ে গিয়ে কোমর-হাঁটু পর্যন্ত অপারেশন অচল করে দিয়েছে এক সময়ের সুঠাম দেহের অধিকারী এই ভাষা সৈনিককে।
২০০৪ সালে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভাঙ্গার পর মূলত তিনি পুরোটাই ভেঙ্গে পড়েন। তখন হাসপাতালে অনেক সতির্থ, তৎকালীন সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকজন তাঁকে দেখতে গেলেও সরকারি বেসরকারি দান অনুদান কিছুই তিনি পাননি। ঠিক মতো কানে না শুনলেও স্ত্রী অধ্যাপক রাশিদা বেগমের সাহায্য নিয়ে অলি আহাদ বলেন, ভাষার মাস এলেই ভাষা সৈনিকের নাম আসে, আর এ মাস চলে গেলে আর কেউ ভুলেও মুখে আনে না।
যাদের জন্য মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন করেছি, সেই বাঙালীরাতো আমাদের ছিনিয়ে আনা ভাষায় কথা বলছে সেই আমার সান্তনা।
কিন্তু নির্লোভ এই মানুষটির আজ চিকিৎসার সামর্থ নেই। টাকার অভাবে তিনি নিজের জরুরী চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারছেন না। পায়ে সমস্যা থাকায় সারাদিন বাসায় ডান কাত হয়ে শুয়ে অসহায়ভাবে অতীত রোমন্থন করেই দিন কাটছে তার।
২০০৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী জাতীয় প্রেসক্লাবে বিদ্রোহী একুশ উদযাপন কমিটির উদ্যোগে “ভাষা আন্দোলন ও অলি আহাদ” শীর্ষক আলোচনা সভায় ভাষা আন্দোলনের নিয়ামক ও পুরোধা ব্যক্তিত্বরা ক্ষোভ প্রকাশ করে নির্লোভ, সত্যসন্ধানী, চির প্রতিবাদী এবং বাংলাদেশের নানা রাজনৈতিক ইতিহাসের অনিবার্য চরিত্র অলি আহাদকে রাষ্ট্রিয়ভাবে চিকিৎসার দাবি জানান। কিন্তু সেই দাবি আজো পুরণ হয়নি। এ নিয়ে আক্ষেপ নেই অলি আহাদের।
তিনি বলেন, যাবার সময় হয়েছে, এবার চলে গেলেই সবাই বেঁচে যায়। আরতো ভাষা আন্দোলনের দরকার নেই। তাহলে অলি আহাদরা থেকে কি হবে? অলি আহাদ বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারী তাঁর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। বাংলা ভাষার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন, জীবনে এর চেয়ে বড় ঘটনা আর কি হতে পারে। এখন তার বড় চাওয়া ব্যারিষ্টার পাস করা একমাত্র মেয়ে রুমিন ফারহানা যেন সুনামের সঙ্গে বড় হয়। দেশের নানা রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন এক উজ্জল নক্ষত্র ৮২ বছর বয়সের মানুষটি আজ চিকিৎসার অভাবে এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় শয্যাশায়ী অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
উপরোক্ত লেখা দুটি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং অনলাইন’এ প্রকাশিত হওয়ার পর পর’ই প্রবীন এই ভাষা সৈনিক’কে দেখতে গিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলের নেতা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সেদিন রাত ৯টায় এলিফ্যান্ট রোডের ৫৫/১, সায়েন্স ল্যাবরেটরি দক্ষিণা নামের বাসায় অলি আহাদ এবং রাত সাড়ে ৯টায় ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিত্সাধীন গিয়াস কামাল চৌধুরীকে দেখতে যান খালেদা জিয়া।
বর্নাঢ্য এই ভাষা সৈনিক অলি আহাদ এর জীবন বৃত্তান্ত : অলি আহাদ একজন ভাষা সৈনিক। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই দাবিতে জীবন জীবনবাজী রেখে লড়াই করেছেন। মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে পৃথিবীতে যে সকল আন্দোলন এ যাবতকালে সংগঠিত হয়েছে, তার মধ্যে বাঙ্গালীর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলন শ্রেষ্টতম। যার কারণে ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
ভাষা সৈনিক অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সদর উপজেলার ইসলামপুরে। তাঁর পিতা আবদুল ওহাব। তিনি ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার।
পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে গণভোটে তিনি ত্রিপুরা জেলার ৪ সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কাস ক্যাম্পের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ৷ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের কারণে ১৯৪৬ সালে আই এস সি পরীক্ষা দিতে পারেন নি। এরপর তিনি ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আই এস সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কলেজ জীবনেই তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসাবে রাজনীতিতে যুক্ত হন।
১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ। তিনি এ সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৫২ এর রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের জন্য তাকে প্রথম কারাগারে নিক্ষিপ্ত পাকিস্তান পুলিশ। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. কম পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তত্কালীন কর্তৃপক্ষ তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম কম পড়ার সুযোগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করে।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। এ আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে এবং রাজপথের সবখানে। ৫২’ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস। ওই দিন সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হতে থাকে। সকাল ১১ টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হয়।
২০ ফেব্রুয়ারী পাকিস্থান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকে তছনছ করে দেয়ার জন্য ঢাকাতে সমাবেশ, মিছিল-মিটিংযের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে। সকালের দিকে ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে ছাত্র-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এস এম হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভংগ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন।
বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময় ধরে উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভংগের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় বাংলার দামাল ছেলেরা দমনমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়।
বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ১১৪ ধারা ভঙ্গ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। সংগ্রাম পরিষদের সভায় আবদুল মতিন, অলি আহাদ ও গোলাম মওলা ১১৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ভোট দেন। ছাত্ররা ১০ জনে অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে ১১৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়।
২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১১৪ ধারা ভাঙ্গা শুরু করলে ছাত্রদের সাথে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়। অধিকার আদায়ের দাবিতে শত শত বিদ্রোহী কন্ঠে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই দাবীতে আন্দোলোন তীব্র হয়ে উঠে।
পুলিশের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাস। বুলেট আর লড়াই শুরু হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিক উদ্দীন, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মারা যায়। রফিক, জাব্বার, বরকত সহ নাম না জানা আরও অনেকের সাথে সালামও সেদিন গুলিবিদ্ধ হন।
২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে অনানুষ্ঠানিক ভাবে শহীদ শফিউর রহমানে পিতা আর ২৬ ফেব্রুয়ারি আবুল কালাম শামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেছিলেন। ইতিমধ্যে পুলিশ নিরাপত্তা আইনে আবুল হাশিম, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ, পুলিন দে, অধ্যাপক পৃথ্বিশ চক্রবর্তী, অলি আহাদ প্রমুখকে গ্রেফতার করে।
তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকাকালীন সময়ে প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের মধ্য তিনি মাওলানা ভাসানীর সাথে প্রগতিশীলদের পক্ষে যোগ দেন।
সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন কালে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী জনমত গঠন করেন। তাঁর রচিত ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ নামক গ্রন্হটি এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল। এবং সেই সময়ে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
সাধীনতা যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি আধিপত্যবাদ বিরোধী অবস্হান গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বাস্তবায়নের জন্য শাসকদের উপর তিনি চাপ সৃষ্টি করেন। তত্কালীন সরকারের অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর নের্তৃত্ব দুঃশাসন বিরোধী এক তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন।
সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারি করে সভা সমিতি বন্ধ করার প্রতিবাদে জানিয়ে জনাব অলি আহাদ ১৯৭৪ সালের ২৮ জুন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এ কারণে ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন বিশেষ ক্ষমতা আইনে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে।
আশির দশকে সামরিক শাসন ব্যবস্হার বিরুদ্ধে আপোসহীন ভূমিকার কারণেও তাঁকে একাধিকবার গ্রেফতার করে কারাগারে আটকে রাখা হয়। এরশাদ সরকার সামরিক ট্রাইবুনালে তাঁর বিচার করে। ওই সময় জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ইত্তেহাদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জনাব অলি আহাদকে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৪ প্রদান করা হয়।
২১শে ফেব্রুয়ারী রাত ১২:০১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সহ সারাদেশের সকল শহীদ মিনারে ১৬ কোটি জনতা ভাষার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের প্রতি গভীর বিনম্র শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার জন্য ফুলে ফুলে ভরে দেয়। মাস ব্যাপি হয় একুশে বই মেলা,মাতৃভাষায় কথাবলি,মাতৃভাষায় গান করি,মাতৃভাষায় কবিতা লিখি কিন্তু যারা এই ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছে তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য কতটুকু পালন করি?
অর্থাভাবে এর আগেও নিদারুন কষ্টে প্রিয় ভাষা সৈনিক অলি আহাদ বলেছিলেন “কি হবে পত্রিকায় লিখে, আমাদের কেউ দেখতে আসে না-খবরও রাখে না ।” মৃত্যুর স্বাদ প্রত্যেক মানুষকেউ গ্রহন করতে হবে। এই চিরন্তন সত্যকে বিশ্বাস করেও বলতে চাই যারা অলি আহাদের শেষ অন্তিম মুহুর্তে খবর রাখেনি, তারা যেন তার শবদেহে ফুলে ফুলে ভরে না দেয়।
শ্রদ্ধা আর বিনম্র ভালোবাসার ফটোসেশনের দৃশ্য আমরা দেখতে চাই না। আমরা দেখতে চাইনা রাষ্ট্র রাষ্ট্রের সবচেয়ে গর্বের মানুষের পাশে সময়মত না দাড়িয়ে মৃত্যুর পরেই শোক বিবৃতি, শোক বই খোলা, কালো ব্যানারে গোটা শহর ছেয়ে দেওয়া, স্মরণ সভা করা আর নাগরিক শোকসভার আয়োজন করে তার আত্মার প্রতি লোকদেখানো শ্রদ্ধা নিবেদন করা।
রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আর কোন বীর বাংঙ্গালীর অবহেলায়, অযত্নে ও অর্থাভাবে অলি আহাদের মত ধুকে ধুকে মৃত্যুর প্রহর গুনতে না হয়। সাংবাদিক নির্মল সেন, গিয়াস কামাল চৌধুরী, ভাষা সৈনিক মতিন সহ জাতীয় বীরদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সরকার রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ দায়িত্ব পালন করবে এই আমাদের প্রত্যাশা।
হয়তো লেখার যবনিকা টানার আগেই বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতা থেকে আরেকটি নক্ষত্রের বিদায় হবে। সারাদেশ জুড়ে শোকে দুঃখে কেঁদে উঠবে কোটি জনতার প্রান, তার পরেও বলি হে ভাষা সৈনিক, বাংঙ্গালী জাতির গর্বের সন্তান, তোমাকে জানাই লাল সালাম।
তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘সরকার দূরে থাক, আমার সতীর্থরাও তো কেউ দেখতে আসে না। আসবেইবা কেন? আমাকে দিয়ে আর কি হবে, ভাষা আন্দোলনতো শেষ, আমাকে তো আর দরকার নেই’।
একজন অকুতোভয় নির্লোভ মানুষ হিসাবে পরিচিত সত্য সন্ধানী এই প্রতিবাদী পুরুষ ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার ইসলামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৭-৪৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন সম্পর্কিত আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে অলি আহদকে চার বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে।
৫৮ বছর পর ২০০৬ সালের ২০ মার্চ তাঁর বাহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ব বিদ্যালয়ের রেকর্ড শাখা অনুযায়ী অলি আহাদ ১৯৫০ সালে বিকম পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
তার লেখা ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫’ বইয়ে এ সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি উল্লেখও করেছেন।
অলি আহাদ দীর্ঘশ্বাস তুলে বলেন, পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেও জীবনে কোন কিছু পাইনি। কিন্ত যারা পাশই করেনি তারা আজ সুনামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালার অলি আহাদের একমাত্র মেয়ে ব্যারিষ্টার রুমিন ফারহানা আর স্ত্রী মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (এশিয়া মহাদেশের একমাত্র মহিলা মহাপরিচালক) অধ্যাপিকা রাশিদা বেগমকে নিয়েই এখন অলি আহাদের সময় কাটে।
সত্যের প্রয়োজনে যিনি নিজের বিরুদ্ধে কথা বলতেও কখনো এতটুকু চিন্তা করেননি। ইতিহাসের সেই উজ্জল পুরুষটি বার্ধক্যে অচল-অক্ষম হয়ে এখন নিজের নীতি নৈতিকতাকেই বার বার ধিক্কার দিচ্ছেন।
বয়ে বেড়াচ্ছেন শ্রবণ ও স্মৃতিশক্তিহীণ এক মানব দেহ। অধ্যাপিকা রাশিদা বেগম বলেন, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য! ইতিহাসের এই কালজয়ী মানুষটির নিজের কোন বাসস্থানই নেই। তার বাবা (অলি আহাদের শশুর) গণিতবিদ মরহুম মো. শাহাব উদ্দিনের দেয়া বাড়ি ও রাশিদা বেগমের চাকরীর পাওয়া টাকার আয় দিয়েই সংসার চলে তাদের। বিয়ের ৩৩ বছর পরও সেই অতীত স্মৃতি গুলো অলি আহাদকে কাঁদিয়ে বেড়াতে দেখে আসছেন এখনো।
কারণ একটাই স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত এই বীর সৈনিক বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে জীবনের শেষ প্রান্তে চলে যাওয়ার পরও রাষ্ট্র কিংবা কোন ব্যক্তি আজো তার কোন খবরই নেয়নি। পাননি কোন সরকারি অনুদান।
চিরবিদ্র্রোহী পুরুষটি এখন অসহায় গৃহবন্দী। ডাক্তাররা বলছেন, তাঁকে বাঁচাতে জরুরী কিছু চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন। হার্ট ও ফুসফুসের সমস্যা, চোখের সমস্যা, পায়ের সমস্যা, প্রস্টেট এলার্জ, পড়ে গিয়ে কোমর-হাঁটু পর্যন্ত অপারেশন অচল করে দিয়েছে এক সময়ের সুঠাম দেহের অধিকারী এই ভাষা সৈনিককে।
২০০৪ সালে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভাঙ্গার পর মূলত তিনি পুরোটাই ভেঙ্গে পড়েন। তখন হাসপাতালে অনেক সতির্থ, তৎকালীন সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকজন তাঁকে দেখতে গেলেও সরকারি বেসরকারি দান অনুদান কিছুই তিনি পাননি। ঠিক মতো কানে না শুনলেও স্ত্রী অধ্যাপক রাশিদা বেগমের সাহায্য নিয়ে অলি আহাদ বলেন, ভাষার মাস এলেই ভাষা সৈনিকের নাম আসে, আর এ মাস চলে গেলে আর কেউ ভুলেও মুখে আনে না।
যাদের জন্য মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন করেছি, সেই বাঙালীরাতো আমাদের ছিনিয়ে আনা ভাষায় কথা বলছে সেই আমার সান্তনা।
কিন্তু নির্লোভ এই মানুষটির আজ চিকিৎসার সামর্থ নেই। টাকার অভাবে তিনি নিজের জরুরী চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারছেন না। পায়ে সমস্যা থাকায় সারাদিন বাসায় ডান কাত হয়ে শুয়ে অসহায়ভাবে অতীত রোমন্থন করেই দিন কাটছে তার।
২০০৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী জাতীয় প্রেসক্লাবে বিদ্রোহী একুশ উদযাপন কমিটির উদ্যোগে “ভাষা আন্দোলন ও অলি আহাদ” শীর্ষক আলোচনা সভায় ভাষা আন্দোলনের নিয়ামক ও পুরোধা ব্যক্তিত্বরা ক্ষোভ প্রকাশ করে নির্লোভ, সত্যসন্ধানী, চির প্রতিবাদী এবং বাংলাদেশের নানা রাজনৈতিক ইতিহাসের অনিবার্য চরিত্র অলি আহাদকে রাষ্ট্রিয়ভাবে চিকিৎসার দাবি জানান। কিন্তু সেই দাবি আজো পুরণ হয়নি। এ নিয়ে আক্ষেপ নেই অলি আহাদের।
তিনি বলেন, যাবার সময় হয়েছে, এবার চলে গেলেই সবাই বেঁচে যায়। আরতো ভাষা আন্দোলনের দরকার নেই। তাহলে অলি আহাদরা থেকে কি হবে? অলি আহাদ বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারী তাঁর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। বাংলা ভাষার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন, জীবনে এর চেয়ে বড় ঘটনা আর কি হতে পারে। এখন তার বড় চাওয়া ব্যারিষ্টার পাস করা একমাত্র মেয়ে রুমিন ফারহানা যেন সুনামের সঙ্গে বড় হয়। দেশের নানা রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন এক উজ্জল নক্ষত্র ৮২ বছর বয়সের মানুষটি আজ চিকিৎসার অভাবে এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় শয্যাশায়ী অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
উপরোক্ত লেখা দুটি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং অনলাইন’এ প্রকাশিত হওয়ার পর পর’ই প্রবীন এই ভাষা সৈনিক’কে দেখতে গিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলের নেতা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সেদিন রাত ৯টায় এলিফ্যান্ট রোডের ৫৫/১, সায়েন্স ল্যাবরেটরি দক্ষিণা নামের বাসায় অলি আহাদ এবং রাত সাড়ে ৯টায় ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিত্সাধীন গিয়াস কামাল চৌধুরীকে দেখতে যান খালেদা জিয়া।
বর্নাঢ্য এই ভাষা সৈনিক অলি আহাদ এর জীবন বৃত্তান্ত : অলি আহাদ একজন ভাষা সৈনিক। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই দাবিতে জীবন জীবনবাজী রেখে লড়াই করেছেন। মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে পৃথিবীতে যে সকল আন্দোলন এ যাবতকালে সংগঠিত হয়েছে, তার মধ্যে বাঙ্গালীর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলন শ্রেষ্টতম। যার কারণে ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
ভাষা সৈনিক অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সদর উপজেলার ইসলামপুরে। তাঁর পিতা আবদুল ওহাব। তিনি ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার।
পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে গণভোটে তিনি ত্রিপুরা জেলার ৪ সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কাস ক্যাম্পের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ৷ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের কারণে ১৯৪৬ সালে আই এস সি পরীক্ষা দিতে পারেন নি। এরপর তিনি ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আই এস সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কলেজ জীবনেই তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসাবে রাজনীতিতে যুক্ত হন।
১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ। তিনি এ সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৫২ এর রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের জন্য তাকে প্রথম কারাগারে নিক্ষিপ্ত পাকিস্তান পুলিশ। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. কম পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তত্কালীন কর্তৃপক্ষ তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম কম পড়ার সুযোগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করে।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। এ আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে এবং রাজপথের সবখানে। ৫২’ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস। ওই দিন সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হতে থাকে। সকাল ১১ টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হয়।
২০ ফেব্রুয়ারী পাকিস্থান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকে তছনছ করে দেয়ার জন্য ঢাকাতে সমাবেশ, মিছিল-মিটিংযের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে। সকালের দিকে ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে ছাত্র-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এস এম হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভংগ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন।
বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময় ধরে উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভংগের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় বাংলার দামাল ছেলেরা দমনমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়।
বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ১১৪ ধারা ভঙ্গ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। সংগ্রাম পরিষদের সভায় আবদুল মতিন, অলি আহাদ ও গোলাম মওলা ১১৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ভোট দেন। ছাত্ররা ১০ জনে অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে ১১৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়।
২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১১৪ ধারা ভাঙ্গা শুরু করলে ছাত্রদের সাথে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়। অধিকার আদায়ের দাবিতে শত শত বিদ্রোহী কন্ঠে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই দাবীতে আন্দোলোন তীব্র হয়ে উঠে।
পুলিশের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাস। বুলেট আর লড়াই শুরু হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিক উদ্দীন, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মারা যায়। রফিক, জাব্বার, বরকত সহ নাম না জানা আরও অনেকের সাথে সালামও সেদিন গুলিবিদ্ধ হন।
২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে অনানুষ্ঠানিক ভাবে শহীদ শফিউর রহমানে পিতা আর ২৬ ফেব্রুয়ারি আবুল কালাম শামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেছিলেন। ইতিমধ্যে পুলিশ নিরাপত্তা আইনে আবুল হাশিম, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ, পুলিন দে, অধ্যাপক পৃথ্বিশ চক্রবর্তী, অলি আহাদ প্রমুখকে গ্রেফতার করে।
তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকাকালীন সময়ে প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের মধ্য তিনি মাওলানা ভাসানীর সাথে প্রগতিশীলদের পক্ষে যোগ দেন।
সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন কালে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী জনমত গঠন করেন। তাঁর রচিত ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ নামক গ্রন্হটি এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল। এবং সেই সময়ে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
সাধীনতা যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি আধিপত্যবাদ বিরোধী অবস্হান গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বাস্তবায়নের জন্য শাসকদের উপর তিনি চাপ সৃষ্টি করেন। তত্কালীন সরকারের অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর নের্তৃত্ব দুঃশাসন বিরোধী এক তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন।
সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারি করে সভা সমিতি বন্ধ করার প্রতিবাদে জানিয়ে জনাব অলি আহাদ ১৯৭৪ সালের ২৮ জুন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এ কারণে ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন বিশেষ ক্ষমতা আইনে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে।
আশির দশকে সামরিক শাসন ব্যবস্হার বিরুদ্ধে আপোসহীন ভূমিকার কারণেও তাঁকে একাধিকবার গ্রেফতার করে কারাগারে আটকে রাখা হয়। এরশাদ সরকার সামরিক ট্রাইবুনালে তাঁর বিচার করে। ওই সময় জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ইত্তেহাদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জনাব অলি আহাদকে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৪ প্রদান করা হয়।
২১শে ফেব্রুয়ারী রাত ১২:০১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সহ সারাদেশের সকল শহীদ মিনারে ১৬ কোটি জনতা ভাষার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের প্রতি গভীর বিনম্র শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার জন্য ফুলে ফুলে ভরে দেয়। মাস ব্যাপি হয় একুশে বই মেলা,মাতৃভাষায় কথাবলি,মাতৃভাষায় গান করি,মাতৃভাষায় কবিতা লিখি কিন্তু যারা এই ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছে তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য কতটুকু পালন করি?
অর্থাভাবে এর আগেও নিদারুন কষ্টে প্রিয় ভাষা সৈনিক অলি আহাদ বলেছিলেন “কি হবে পত্রিকায় লিখে, আমাদের কেউ দেখতে আসে না-খবরও রাখে না ।” মৃত্যুর স্বাদ প্রত্যেক মানুষকেউ গ্রহন করতে হবে। এই চিরন্তন সত্যকে বিশ্বাস করেও বলতে চাই যারা অলি আহাদের শেষ অন্তিম মুহুর্তে খবর রাখেনি, তারা যেন তার শবদেহে ফুলে ফুলে ভরে না দেয়।
শ্রদ্ধা আর বিনম্র ভালোবাসার ফটোসেশনের দৃশ্য আমরা দেখতে চাই না। আমরা দেখতে চাইনা রাষ্ট্র রাষ্ট্রের সবচেয়ে গর্বের মানুষের পাশে সময়মত না দাড়িয়ে মৃত্যুর পরেই শোক বিবৃতি, শোক বই খোলা, কালো ব্যানারে গোটা শহর ছেয়ে দেওয়া, স্মরণ সভা করা আর নাগরিক শোকসভার আয়োজন করে তার আত্মার প্রতি লোকদেখানো শ্রদ্ধা নিবেদন করা।
রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আর কোন বীর বাংঙ্গালীর অবহেলায়, অযত্নে ও অর্থাভাবে অলি আহাদের মত ধুকে ধুকে মৃত্যুর প্রহর গুনতে না হয়। সাংবাদিক নির্মল সেন, গিয়াস কামাল চৌধুরী, ভাষা সৈনিক মতিন সহ জাতীয় বীরদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সরকার রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ দায়িত্ব পালন করবে এই আমাদের প্রত্যাশা।
হয়তো লেখার যবনিকা টানার আগেই বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতা থেকে আরেকটি নক্ষত্রের বিদায় হবে। সারাদেশ জুড়ে শোকে দুঃখে কেঁদে উঠবে কোটি জনতার প্রান, তার পরেও বলি হে ভাষা সৈনিক, বাংঙ্গালী জাতির গর্বের সন্তান, তোমাকে জানাই লাল সালাম।
No comments