ঈর্ষনীয় সফলতাই মুজিব হত্যার কারণ by সরদার সিরাজুল ইসলাম
পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু মুজিব হত্যাকা-কে নৃশংসতম রাজনৈতিক হত্যাকা- বললে বোধ হয় বেশি বলা হবে না। মুক্ত বিবেকের কণ্ঠস্বর প্রয়াত মনীষী আবুল ফজল এই হত্যাকা-কে ১৫ আগস্ট ’৭৫ তারিখের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন এমনিভাবে।
(শেখ মুজিবকে যেমন দেখেছি পৃঃ ৭৬) :“যিশুখ্রিস্টকে হত্যার পাপের বোঝা ইহুদিরা আজো বয়ে বেড়াচ্ছে। শেখ মুজিব যিশু ছিলেন না, কিন্তু ছিলেন মানুষ। তাঁর পরিবারের শিশুরা, ছেলেরা, মেয়েরা সবাই মানুষ ছিল, ছিল আদম সন্তান। সম্ভবত এটি এ যুগের বৃহত্তম ও নৃসংশতম হত্যাকা-। এমন হৃদয়হীন নির্মমতার নজির অন্যত্র, মিলবে কিনা সন্দেহ...। ১৫ই আগস্টের ভোর রাত্রির নির্মমতা কারবালার নির্মমতাকে যেন ছেড়ে গেছে। কারবালায় দু’পক্ষের হাতে অস্ত্র ছিল, তারা ছিল পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। আর সে হত্যা কোন অর্থেই ঠা-া রক্তে ছিল না। কিন্তু আর মেয়েদের হত্যার কথা তো মুসলমান সৈনিক ভাবতেই পারে না। অথচ গত ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবের বাড়িতেই তাই ঘটেছে। এ দিনের অপরাধ আর পাপ সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে আমাদের আতঙ্কটা বেশি। কারণ বৃহৎ অপরাধ, বৃহৎ পাপ বিনা দ-ে যায় না। বাংলার মানুষকে সে দ- একদিন এক ভাবে ভোগ করতেই হবে। এটিও আমার এক বড় রকমের আতঙ্ক।”
যিশু হত্যায় মানুষ মাত্র একজন। আর শত্রুরা কেবল মুজিবকে হত্যা করেনি, পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে। যিশু হত্যা প্রকাশ্য দিবালোকে। আর মুজিবকে কোন গুপ্তঘাতক হত্যা করেনি। ঘাতকরা ঢাকঢোল পিটিয়ে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক পর্যন্ত নিয়ে বেরিয়েছিল রাত ১০টায়। পুরো রাজধানী শহরে ১০ ঘণ্টা ধরে কর্তৃত্ব রেখে রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাঁর দুই নিকট আত্মীয়-সহকর্মীর বাসভবনে আক্রমণ চালায় এবং একেবারে বিনা বাধায় হত্যাকা- চালায়।
খুনীদের স্বীকারোক্তি, নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি এবং তৎসময়ের ঘটনা প্রবাহ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য থেকে পরিষ্কার যে, আক্রান্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পদস্থ সেনারক্ষী পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য যে সময় ছিল তাকে একেবারে অপর্যাপ্ত বলা যাবে না। ট্যাঙ্ক বেরুল সে খবর ক্যান্টনমেন্টের অন্যরা জানবে না আর রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তায় এগিয়ে আসবে না এ কথা ইতিহাস মেনে নেবে না। বাস্তব সত্য এই যে, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় এগিয়ে আসেনি। ব্যতিক্রম কর্নেল জামিল। নিজের দায়িত্ব পালনে সাহসী লোকটি শাহাদাতের পথ বেছে নিলেন। সবচাইতে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, খুনীর তালিকায় যাদের নাম দেখা যায় তাদের মধ্যে রশিদ ছুটিতে এসেছিল, অন্যরা পালিয়ে আসার কথা বললেও এদের গুপ্তচর বেশে পাঠানো হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধার লেবাস পরতে। খেতাবও দেয়া হয়েছিল ডালিমকে (বীর উত্তম)। ১৫ আগস্ট (’৭৫) সকালে বঙ্গবন্ধুর খুনী ডালিম ক্যান্টনমেন্টে জিয়াকে হত্যার খবর দিলে তিনি গভীর আবেগে ণড়ঁ যধাব ফড়হব ধ ড়িহফবৎভঁষ লড়ন, পড়সব ড়হ শরংং সব, পড়সব রহ সু পধৎ বলে ডালিমকে আলিঙ্গন করে প্রমাণ রেখেছেন যে তিনিই মূল হোতা।
মুজিবকে ভারতের দালাল বলে অভিসম্পাত জানানো হলেও ভারতের তরফ থেকে কোন সাহায্য আসেনি। আর তিনি তা চাননি। সার্বভৌমত্বের ঝুঁকি নেননি। শাহাদাতের পথই বেছে নিয়েছেন। রেখে গেছেন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। বলাবাহুল্য, বঙ্গবন্ধু নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোন সময় সতর্ক ছিলেন না। থাকেননি গণভবনে। রয়েছেন সাদামাটা নিজ বাড়িতে, নিয়োজিত ছিল ক’জন পুলিশ। রক্ষী বা সেনাবাহিনী ছিল না। ক্ষমতালিপ্সু পাপীরাই সব সময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। বাংলাদেশের কেউ মুজিবকে হত্যা করবে এ কথা তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন না। কেননা জনগণের মঙ্গল কামনায় মুজিবের কোন তুলনা নেই। আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, কেনেডি, ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ রাষ্ট্রনায়ককে আততায়ীরা অতর্কিত হত্যা করেছে। কিন্তু মুজিব হত্যা সেসব হত্যাকা-ের চাইতেও নির্মম। যিশু-গান্ধী বা মার্টিন লুথার কিং-কে কেন হত্যা করা হলো? ওরা তো রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন না। আর ইসলামের চার খলিফার মধ্যে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছিল কি অপরাধে?
বস্তুত মুজিবের সফলতা সম্ভাবনাই তাঁকে বাঁচতে দেয়নি। মুজিব সময় পেয়েছেন মাত্র ৩ বছর সাড়ে ৭ মাস। এই সময়ে রক্তস্নাত সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশকে কতটুকু দেয়া যায় একক প্রচেষ্টায়। মাত্র তিন মাসের মধ্যে মিত্রবাহিনীকে দেশে ফেরত পাঠালেন। নিজস্ব প্রচেষ্টায় দেশকে পুনঃগঠনে ব্রতী হলেন। অথচ গণচীনের মতো দেশকে ১১ বছর সরাসরি সহযোগিতা নিতে হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং তা বর্ডার খোলা রেখেছিল। বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণচীন উভয় দেশেই দুর্ভিক্ষে যথাক্রমে ৩ ও ৪ কোটি লোক মারা যায়। বাংলাদেশে অত বড় বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে মুজিবের নেতৃত্বে।
মনীষী হেগেলের ভাষায় মহৎ সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। নাম গোত্রহীন অজপাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়ার সাধারণ কৃষকের সন্তান স্বীয় প্রতিভা সাহসে বিকশিত মুজিবকে আশ্রয় করে এ দেশের মানুষ একটি রাষ্ট্র পেয়েছে। নির্মোহ সমাজ বিজ্ঞানী মুজিবের একজন কট্টর সমালোচক আহম্মদ শরীফের ভাষায় (সাপ্তাহিক পূর্বাভাষ, ১৯ আগস্ট, ১৯৯১) “ঊনসত্তরের পরে এই উপমহাদেশে এমনকি তৎকালীন বিশ্বে এত জনপ্রিয়তা কেউ পাননি।” আহম্মদ ছফার মতে, (পূর্বাভাষ, ২৯ জুলাই, ১৯৯১) “তিন হাজার বছরের ইতিহাসে তাঁর তুলনা নেই।” ১২ আগস্ট ১৯৯৩ বঙ্গবন্ধুর মাজারে (টুঙ্গিপাড়ায়) ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাঙালীর আকাক্সক্ষাকে ধারণ করেছিলেন। আপোস করেননি।...যাতে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে না পারে এবং রাষ্ট্রকে পিছিয়ে ফেলার জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা শেখ মুজিবের মতো বীরকে সম্মান দেখাতে পারিনি। এ ব্যর্থতার দায়ভার কতকাল বয়ে বেড়াব? (আজকের কাগজ/সংবাদ/খবর ১৩ আগস্ট, ১৯৯৩)। তাকে কোন দুর্নীতি স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ চিন্তা করা যায় না।” রাজনীতিক গবেষক আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর) বঙ্গবন্ধু মুজিব ১৯৭২ সনে নোবেল পুরস্কার পেতেন যদি ঢাকা বিমানবন্দরে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতেন। (রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নোবেলের হকদার তিনি ছিলেন, কিন্তু মার্কিনীরা দেয়নি, কারণ তারা এ রাষ্ট্র চায়নি হত্যাকে সমর্থন করেনি। কিন্তু ওদের ক্ষমা করেন কিভাবে? (লেখক)।
“বঙ্গবন্ধু কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। বঙ্গবন্ধু সমগ্র বিশ্বের সম্পদ।” কথাটি আবেগপ্রবণ বলে কেউ কেউ উড়িয়ে দিতে চাইবেন হয়তো। বাস্তবে মুজিবের কর্মকা- এই ভূখ-ের গ-ী পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত তা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে তা হয়তো আমরা খেয়াল করি না বা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে চলি।
১৯৭৩ সনে জগতখ্যাত ফরাসী দার্শনিক আর্দে মার্লো ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন, “তাঁকে আর শুধু একজন সাধারণ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ভাবা যায় না। তাকে দেখা যায় বাংলার প্রকৃতির আকাশ-বাতাস, পাহাড়, পর্বত, বৃক্ষরাজি শস্যক্ষেত্রে মাঝে।”
বঙ্গবন্ধুর নজিরবিহীন কৃতি
বিশ্বের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ (মার্চ ’৭১) আন্দোলন একটি নজিরবিহীন ঘটনা। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন সফল হয়নি। অস্ত্রের জোরে সমরনায়কদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ঘটনা ইতিহাসের পাতায় নতুন কোন সংযোজন নয়। কিন্তু শুধু সমরনায়কদের কথাই বা বলি কেন, রাজনৈতিকভাবেও বিপ্লব, সশস্ত্র অভ্যুত্থান ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল বা দেশের শাসনভার গ্রহণের ঘটনাবলীর সাক্ষ্য দেবে যুগ-যুগান্তরের ইতিহাস। বাস্তিল কারাগারের পতন ও ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ও লেনিনের ক্ষমতায় অধিরোহণ, চীনে গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে মাও সেতুং-এর লং মার্চের জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ক রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের কথা শিক্ষিত সচেতন মানুষের অবিদিত নয়। কিন্তু তবু বলতে হয় বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন আজও দুনিয়ার এক নজিরবিহীন ইতিহাস। কারণ এই আন্দোলন শুধু আমাদের সফল মুক্তিযুদ্ধের সূচনার পটভূমিই তৈরি করেনি, বরং সেই আন্দোলনকালেই কার্যত বাঙালীরা কয়েক দিনের জন্য হলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা চালিয়েছিল। সেদিনের পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং ঢাকায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এতদাঞ্চলের গোটা প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছিল একটিমাত্র মানুষের নির্দেশ অনুযায়ীÑতিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আসলে সে দিনের পাক সরকারকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এখানে চলছিল একটা প্যারালাল সরকার। পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে শহরে প্রবেশ করতে মুজিবের অনুমতি নিতে হয়েছে আর মুজিবের নির্দেশে পূর্ব পাক প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী অস্বীকার জানান টিক্কা খানকে গভর্নরের শপথ পড়াতে। এ কথা বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না যে, উত্তাপের সেই প্রাণস্পন্দিত দিনগুলোতে ৩২ নম্বর ধানম-িই ছিল যেন ‘হোয়াইট হাউস’ কিংবা ‘১০নং ডাউনিং স্ট্রীট’। অসহযোগ আন্দোলনের চাইতে বড় সার্থকতা আর কি হতে পারে। সেই আন্দোলন যে কতটা তীব্ররূপ ধারণ করেছিল, জনমনে কি বৈপ্লবিক আবেদন সৃষ্টি করেছিল এবং পরবর্তীতে এর সুদূরপ্রসারী ফল কি দাঁড়িয়েছিল তা সঠিক তথ্য তুলে ধরা একান্ত জরুরী।
২. ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাঙালীরা কোন দিনই স্বাধীন ছিল না। পাল বা সুলতানী আমল এমনকি যাকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বলা হয়, তার আমলেও নয়। আর নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ বাঙালী ছিলেন না। লর্ড ক্লাইভ বলেছিলেন পলাশী যুদ্ধের আশপাশে যে সব কৃষক মাঠে চাষ করছিল তারা যদি নবাবের পক্ষ হয়ে আক্রমণ করত লাঠিসোটা নিয়ে তাহলেও ইংরেজরা জয়ী হতে পারত না। অর্থাৎ বাঙালীরা ঐক্যবদ্ধ ছিল না, নবাবের প্রতি। বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার কৃতিত্ব সাধারণ বাঙালী কৃষকের সন্তান সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমানের।
৩. ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ (অলিখিত এবং স্বল্প সময়ের) বিশ্বের সেরা ভাষণ। এর আগে আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিস বার্গ এড্রেস বিশ্বের সেরা ভাষণ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ দাশপ্রথা নিয়ে গৃহযুদ্ধে শহীদদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণ। ভার্জিনিয়ার গেটিসবার্গে দাসপ্রথার পক্ষে-বিপক্ষে যুদ্ধে প্রচুর সৈন্য মারা যায়, তাদের উদ্দেশে প্রদত্ত তিন মিনিটের ভাষণ এখানে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা ছিল না, ছিল গৃহযুদ্ধ এড়ানোর। যুক্তরাষ্ট্রের ষোলতম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ‘গেটিসবার্গ এড্রেস’ খ্যাত ভাষণটি ছিল লিখিত এবং পরিসর ছিল সীমিত। যার সারমর্ম ছিল জনকল্যাণ করতে পারে জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকার ‘যা পৃথিবী থেকে ধ্বংস হবে না।’ অপরদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত (জনসভাস্থলের ওপর বোমারু বিমান) এলাকায় দাঁড়িয়ে, বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণটির বিষয়বস্তু অনেক বেশি সার্বজনীন। রণকৌশল, স্বাধীনতা আদায় ও রক্ষা এবং জনগণকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাসহ কূপম-ুকতা থেকে মুক্ত করার দিকনির্দেশনা, সুদূরপ্রসারী অঙ্গীকার। কাব্যিক কৌশলে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার এবং তার অনুপস্থিতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া বিশেষ করে বৃহৎ শত্রুর বিরুদ্ধে আরেক বৃহৎ শক্তির সাহায্য নিয়ে বিজয়ী হওয়া এবং ভারতের কাছে দায়বদ্ধ না হওয়ার (বিচ্ছিন্নতাবাদী অপবাদ হলে দেশ স্বাধীন হতো না) দ্বিতীয় নজির পাওয়া যাবে না। ঘবংি বিবশ ৭ এপ্রিল ’৭১ সংখ্যায় ভাষণটির জন্য বঙ্গবন্ধুকে চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তাই এ কথা বলার সময় এসেছে যে, লিঙ্কনের ভাষণের কৌলিন্য স্নান করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
৪.বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চের (১৯৭১) রাতে শত্রু পাকবাহিনী আটক করেছিল। সমালোচকরা বলেন আত্মসমর্পণ। এটি আত্মসমর্পণ ছিল না, কেননা তিনি বন্দী হওয়ার পূর্বেই স্বাধীনতার ঘোষণা ঞযরং সধু নব সু ষধংঃ সধংংধমব ভৎড়স ঃড়ফধু ইধহমষধফবংয রং ওহফবঢ়বহফবহঃ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৩য় খ-, পৃ. ১) স্বকণ্ঠে রেকর্ড করেন আক্রান্ত হওয়ার পরে বিশ্বব্যাপী প্রচারের জন্য এবং তা যথারীতি রাত ১২টার পরেই প্রচারিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর পাকবাহিনীর কারাগারে অবস্থানকালে শত নির্যাতন, ফাঁসির দড়ি সামনে দেখেও তার কাক্সিক্ষত (উচ্চারিত) স্বাধীনতা থেকে বিচ্যুৎ হননি। (চলবে)
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
যিশু হত্যায় মানুষ মাত্র একজন। আর শত্রুরা কেবল মুজিবকে হত্যা করেনি, পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে। যিশু হত্যা প্রকাশ্য দিবালোকে। আর মুজিবকে কোন গুপ্তঘাতক হত্যা করেনি। ঘাতকরা ঢাকঢোল পিটিয়ে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক পর্যন্ত নিয়ে বেরিয়েছিল রাত ১০টায়। পুরো রাজধানী শহরে ১০ ঘণ্টা ধরে কর্তৃত্ব রেখে রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাঁর দুই নিকট আত্মীয়-সহকর্মীর বাসভবনে আক্রমণ চালায় এবং একেবারে বিনা বাধায় হত্যাকা- চালায়।
খুনীদের স্বীকারোক্তি, নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি এবং তৎসময়ের ঘটনা প্রবাহ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য থেকে পরিষ্কার যে, আক্রান্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পদস্থ সেনারক্ষী পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য যে সময় ছিল তাকে একেবারে অপর্যাপ্ত বলা যাবে না। ট্যাঙ্ক বেরুল সে খবর ক্যান্টনমেন্টের অন্যরা জানবে না আর রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তায় এগিয়ে আসবে না এ কথা ইতিহাস মেনে নেবে না। বাস্তব সত্য এই যে, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় এগিয়ে আসেনি। ব্যতিক্রম কর্নেল জামিল। নিজের দায়িত্ব পালনে সাহসী লোকটি শাহাদাতের পথ বেছে নিলেন। সবচাইতে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, খুনীর তালিকায় যাদের নাম দেখা যায় তাদের মধ্যে রশিদ ছুটিতে এসেছিল, অন্যরা পালিয়ে আসার কথা বললেও এদের গুপ্তচর বেশে পাঠানো হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধার লেবাস পরতে। খেতাবও দেয়া হয়েছিল ডালিমকে (বীর উত্তম)। ১৫ আগস্ট (’৭৫) সকালে বঙ্গবন্ধুর খুনী ডালিম ক্যান্টনমেন্টে জিয়াকে হত্যার খবর দিলে তিনি গভীর আবেগে ণড়ঁ যধাব ফড়হব ধ ড়িহফবৎভঁষ লড়ন, পড়সব ড়হ শরংং সব, পড়সব রহ সু পধৎ বলে ডালিমকে আলিঙ্গন করে প্রমাণ রেখেছেন যে তিনিই মূল হোতা।
মুজিবকে ভারতের দালাল বলে অভিসম্পাত জানানো হলেও ভারতের তরফ থেকে কোন সাহায্য আসেনি। আর তিনি তা চাননি। সার্বভৌমত্বের ঝুঁকি নেননি। শাহাদাতের পথই বেছে নিয়েছেন। রেখে গেছেন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। বলাবাহুল্য, বঙ্গবন্ধু নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোন সময় সতর্ক ছিলেন না। থাকেননি গণভবনে। রয়েছেন সাদামাটা নিজ বাড়িতে, নিয়োজিত ছিল ক’জন পুলিশ। রক্ষী বা সেনাবাহিনী ছিল না। ক্ষমতালিপ্সু পাপীরাই সব সময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। বাংলাদেশের কেউ মুজিবকে হত্যা করবে এ কথা তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন না। কেননা জনগণের মঙ্গল কামনায় মুজিবের কোন তুলনা নেই। আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, কেনেডি, ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ রাষ্ট্রনায়ককে আততায়ীরা অতর্কিত হত্যা করেছে। কিন্তু মুজিব হত্যা সেসব হত্যাকা-ের চাইতেও নির্মম। যিশু-গান্ধী বা মার্টিন লুথার কিং-কে কেন হত্যা করা হলো? ওরা তো রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন না। আর ইসলামের চার খলিফার মধ্যে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছিল কি অপরাধে?
বস্তুত মুজিবের সফলতা সম্ভাবনাই তাঁকে বাঁচতে দেয়নি। মুজিব সময় পেয়েছেন মাত্র ৩ বছর সাড়ে ৭ মাস। এই সময়ে রক্তস্নাত সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশকে কতটুকু দেয়া যায় একক প্রচেষ্টায়। মাত্র তিন মাসের মধ্যে মিত্রবাহিনীকে দেশে ফেরত পাঠালেন। নিজস্ব প্রচেষ্টায় দেশকে পুনঃগঠনে ব্রতী হলেন। অথচ গণচীনের মতো দেশকে ১১ বছর সরাসরি সহযোগিতা নিতে হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং তা বর্ডার খোলা রেখেছিল। বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণচীন উভয় দেশেই দুর্ভিক্ষে যথাক্রমে ৩ ও ৪ কোটি লোক মারা যায়। বাংলাদেশে অত বড় বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে মুজিবের নেতৃত্বে।
মনীষী হেগেলের ভাষায় মহৎ সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। নাম গোত্রহীন অজপাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়ার সাধারণ কৃষকের সন্তান স্বীয় প্রতিভা সাহসে বিকশিত মুজিবকে আশ্রয় করে এ দেশের মানুষ একটি রাষ্ট্র পেয়েছে। নির্মোহ সমাজ বিজ্ঞানী মুজিবের একজন কট্টর সমালোচক আহম্মদ শরীফের ভাষায় (সাপ্তাহিক পূর্বাভাষ, ১৯ আগস্ট, ১৯৯১) “ঊনসত্তরের পরে এই উপমহাদেশে এমনকি তৎকালীন বিশ্বে এত জনপ্রিয়তা কেউ পাননি।” আহম্মদ ছফার মতে, (পূর্বাভাষ, ২৯ জুলাই, ১৯৯১) “তিন হাজার বছরের ইতিহাসে তাঁর তুলনা নেই।” ১২ আগস্ট ১৯৯৩ বঙ্গবন্ধুর মাজারে (টুঙ্গিপাড়ায়) ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাঙালীর আকাক্সক্ষাকে ধারণ করেছিলেন। আপোস করেননি।...যাতে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে না পারে এবং রাষ্ট্রকে পিছিয়ে ফেলার জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা শেখ মুজিবের মতো বীরকে সম্মান দেখাতে পারিনি। এ ব্যর্থতার দায়ভার কতকাল বয়ে বেড়াব? (আজকের কাগজ/সংবাদ/খবর ১৩ আগস্ট, ১৯৯৩)। তাকে কোন দুর্নীতি স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ চিন্তা করা যায় না।” রাজনীতিক গবেষক আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর) বঙ্গবন্ধু মুজিব ১৯৭২ সনে নোবেল পুরস্কার পেতেন যদি ঢাকা বিমানবন্দরে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতেন। (রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নোবেলের হকদার তিনি ছিলেন, কিন্তু মার্কিনীরা দেয়নি, কারণ তারা এ রাষ্ট্র চায়নি হত্যাকে সমর্থন করেনি। কিন্তু ওদের ক্ষমা করেন কিভাবে? (লেখক)।
“বঙ্গবন্ধু কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। বঙ্গবন্ধু সমগ্র বিশ্বের সম্পদ।” কথাটি আবেগপ্রবণ বলে কেউ কেউ উড়িয়ে দিতে চাইবেন হয়তো। বাস্তবে মুজিবের কর্মকা- এই ভূখ-ের গ-ী পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত তা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে তা হয়তো আমরা খেয়াল করি না বা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে চলি।
১৯৭৩ সনে জগতখ্যাত ফরাসী দার্শনিক আর্দে মার্লো ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন, “তাঁকে আর শুধু একজন সাধারণ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ভাবা যায় না। তাকে দেখা যায় বাংলার প্রকৃতির আকাশ-বাতাস, পাহাড়, পর্বত, বৃক্ষরাজি শস্যক্ষেত্রে মাঝে।”
বঙ্গবন্ধুর নজিরবিহীন কৃতি
বিশ্বের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ (মার্চ ’৭১) আন্দোলন একটি নজিরবিহীন ঘটনা। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন সফল হয়নি। অস্ত্রের জোরে সমরনায়কদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ঘটনা ইতিহাসের পাতায় নতুন কোন সংযোজন নয়। কিন্তু শুধু সমরনায়কদের কথাই বা বলি কেন, রাজনৈতিকভাবেও বিপ্লব, সশস্ত্র অভ্যুত্থান ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল বা দেশের শাসনভার গ্রহণের ঘটনাবলীর সাক্ষ্য দেবে যুগ-যুগান্তরের ইতিহাস। বাস্তিল কারাগারের পতন ও ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ও লেনিনের ক্ষমতায় অধিরোহণ, চীনে গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে মাও সেতুং-এর লং মার্চের জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ক রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের কথা শিক্ষিত সচেতন মানুষের অবিদিত নয়। কিন্তু তবু বলতে হয় বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন আজও দুনিয়ার এক নজিরবিহীন ইতিহাস। কারণ এই আন্দোলন শুধু আমাদের সফল মুক্তিযুদ্ধের সূচনার পটভূমিই তৈরি করেনি, বরং সেই আন্দোলনকালেই কার্যত বাঙালীরা কয়েক দিনের জন্য হলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা চালিয়েছিল। সেদিনের পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং ঢাকায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এতদাঞ্চলের গোটা প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছিল একটিমাত্র মানুষের নির্দেশ অনুযায়ীÑতিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আসলে সে দিনের পাক সরকারকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এখানে চলছিল একটা প্যারালাল সরকার। পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে শহরে প্রবেশ করতে মুজিবের অনুমতি নিতে হয়েছে আর মুজিবের নির্দেশে পূর্ব পাক প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী অস্বীকার জানান টিক্কা খানকে গভর্নরের শপথ পড়াতে। এ কথা বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না যে, উত্তাপের সেই প্রাণস্পন্দিত দিনগুলোতে ৩২ নম্বর ধানম-িই ছিল যেন ‘হোয়াইট হাউস’ কিংবা ‘১০নং ডাউনিং স্ট্রীট’। অসহযোগ আন্দোলনের চাইতে বড় সার্থকতা আর কি হতে পারে। সেই আন্দোলন যে কতটা তীব্ররূপ ধারণ করেছিল, জনমনে কি বৈপ্লবিক আবেদন সৃষ্টি করেছিল এবং পরবর্তীতে এর সুদূরপ্রসারী ফল কি দাঁড়িয়েছিল তা সঠিক তথ্য তুলে ধরা একান্ত জরুরী।
২. ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাঙালীরা কোন দিনই স্বাধীন ছিল না। পাল বা সুলতানী আমল এমনকি যাকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বলা হয়, তার আমলেও নয়। আর নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ বাঙালী ছিলেন না। লর্ড ক্লাইভ বলেছিলেন পলাশী যুদ্ধের আশপাশে যে সব কৃষক মাঠে চাষ করছিল তারা যদি নবাবের পক্ষ হয়ে আক্রমণ করত লাঠিসোটা নিয়ে তাহলেও ইংরেজরা জয়ী হতে পারত না। অর্থাৎ বাঙালীরা ঐক্যবদ্ধ ছিল না, নবাবের প্রতি। বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার কৃতিত্ব সাধারণ বাঙালী কৃষকের সন্তান সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমানের।
৩. ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ (অলিখিত এবং স্বল্প সময়ের) বিশ্বের সেরা ভাষণ। এর আগে আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিস বার্গ এড্রেস বিশ্বের সেরা ভাষণ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ দাশপ্রথা নিয়ে গৃহযুদ্ধে শহীদদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণ। ভার্জিনিয়ার গেটিসবার্গে দাসপ্রথার পক্ষে-বিপক্ষে যুদ্ধে প্রচুর সৈন্য মারা যায়, তাদের উদ্দেশে প্রদত্ত তিন মিনিটের ভাষণ এখানে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা ছিল না, ছিল গৃহযুদ্ধ এড়ানোর। যুক্তরাষ্ট্রের ষোলতম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ‘গেটিসবার্গ এড্রেস’ খ্যাত ভাষণটি ছিল লিখিত এবং পরিসর ছিল সীমিত। যার সারমর্ম ছিল জনকল্যাণ করতে পারে জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকার ‘যা পৃথিবী থেকে ধ্বংস হবে না।’ অপরদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত (জনসভাস্থলের ওপর বোমারু বিমান) এলাকায় দাঁড়িয়ে, বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণটির বিষয়বস্তু অনেক বেশি সার্বজনীন। রণকৌশল, স্বাধীনতা আদায় ও রক্ষা এবং জনগণকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাসহ কূপম-ুকতা থেকে মুক্ত করার দিকনির্দেশনা, সুদূরপ্রসারী অঙ্গীকার। কাব্যিক কৌশলে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার এবং তার অনুপস্থিতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া বিশেষ করে বৃহৎ শত্রুর বিরুদ্ধে আরেক বৃহৎ শক্তির সাহায্য নিয়ে বিজয়ী হওয়া এবং ভারতের কাছে দায়বদ্ধ না হওয়ার (বিচ্ছিন্নতাবাদী অপবাদ হলে দেশ স্বাধীন হতো না) দ্বিতীয় নজির পাওয়া যাবে না। ঘবংি বিবশ ৭ এপ্রিল ’৭১ সংখ্যায় ভাষণটির জন্য বঙ্গবন্ধুকে চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তাই এ কথা বলার সময় এসেছে যে, লিঙ্কনের ভাষণের কৌলিন্য স্নান করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
৪.বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চের (১৯৭১) রাতে শত্রু পাকবাহিনী আটক করেছিল। সমালোচকরা বলেন আত্মসমর্পণ। এটি আত্মসমর্পণ ছিল না, কেননা তিনি বন্দী হওয়ার পূর্বেই স্বাধীনতার ঘোষণা ঞযরং সধু নব সু ষধংঃ সধংংধমব ভৎড়স ঃড়ফধু ইধহমষধফবংয রং ওহফবঢ়বহফবহঃ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৩য় খ-, পৃ. ১) স্বকণ্ঠে রেকর্ড করেন আক্রান্ত হওয়ার পরে বিশ্বব্যাপী প্রচারের জন্য এবং তা যথারীতি রাত ১২টার পরেই প্রচারিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর পাকবাহিনীর কারাগারে অবস্থানকালে শত নির্যাতন, ফাঁসির দড়ি সামনে দেখেও তার কাক্সিক্ষত (উচ্চারিত) স্বাধীনতা থেকে বিচ্যুৎ হননি। (চলবে)
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
No comments