নুহাশ পল্লী সম্ভাব্য রূপরেখা by ইকবাল আজিজ
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরই একটি লেখা লিখেছিলাম; মনে হয়েছিল সহসা হয়ত তাঁর সম্পর্কে আর লিখতে হবে না। কিন্তু হঠাৎ করেই লেখক হুমায়ূনের খেয়ালি ভাবনার অমর সৃষ্টি ‘নুহাশপল্লী’র ভবিষ্যত বিষয়ে আশঙ্কা বোধ করেছি; মনে হয়েছে বৃক্ষ ও প্রকৃতির পটভূমিতে নির্মিত লেখকের এই সৃজনশীল পল্লী নিয়ে অচিরেই তাঁর বংশধরদের
মধ্যে টানা-হেঁচড়া শুরু হতে পারে হয়ত হুমায়ূনের বিক্ষিপ্ত স্বপ্নের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে এই সম্ভাবনাময় পল্লী। ফলে লেখকের ভক্ত এ দেশের অসংখ্য মানুষ বঞ্চিত হবেন তপবনের আদর্শে গড়ে ওঠা একটি প্রাকৃতিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিকেন্দ্র থেকে। এ ছাড়া লোভী ও হিংস্র ডেভেলপাররাও বসে আছে একজন প্রতিভাবান লেখকের স্বপ্নকে ছিন্নভিন্ন করার অপেক্ষায়। তাই প্রতীক্ষায় আছি, কবে প্রয়াত লেখকের আপনজনদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে; তাঁরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসবেন হুমায়ূনের স্বপ্ন ‘নুহাশপল্লী’কে সংরক্ষণের জন্য।
নিউইয়র্ক থেকে হুমায়ূনের লাশ যেদিন ঢাকায় এল, সেদিনই মনে হয়েছিল বাঙালীর এই সর্বজনপ্রিয় লেখকের লাশ তাঁর স্বপ্নপল্লী ‘নুহাশপল্লী’তে দাফন হওয়া উচিত। কারণ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ‘নুহাশপল্লী’ হয়ে উঠেছিল হুমায়ূনের তীর্থভূমি। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মত্ত লেখক তাঁর বেশিরভাগ সময় কাটাতেন নিজের সৃষ্টি এই পল্লীনিবাসে।
হুমায়ূন প্রকৃতির বৃষ্টি ও জোছনাকে গভীরভাবে উপভোগ করতে চেয়েছিলেন এই পল্লীনিবাসে এসে; নগরজীবন ও পরিবেশ দূষণের ভয়ঙ্কর আগ্রাসন থেকে লেখক সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রেখেছিলেন তাঁর এই ‘নুহাশপল্লী’। ঔষধি গাছসহ লাগিয়েছিলেন নানা ধরনের গাছ। লেখকের এই প্রাকৃতিক নিবাস সম্পর্কে পত্রিকায় অনেক পড়েছি, মানুষের কাছে শুনেছি; কিন্তু একবারও সেখানে যাওয়া হয়নি। তবে হয়ত নিজের অজান্তেই অবচেতন মনে একটি গভীর ইচ্ছা বাসা বেঁধেছিল হুমায়ূনের স্বপ্নপুরী ‘নুহাশপল্লীতে’ হয়ত একদিন যাব; যখন তা আরও পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত হবে। টেলিভিশনের পর্দায় যতবারই হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর নুহাশপল্লীকে দেখেছি, ততবারই অনুভব করেছি লেখক তাঁর স্বপ্ন ও সৃজনশীলতার শেষ আশ্রয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন নুহাশপল্লীতে। রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিতের কল্পজগতের পাশাপাশি হুমায়ূনেরও যেন ছিল এক কল্পনার জগতÑযার আংশিক বিকাশ আমরা দেখতে পেয়েছি লেখকের গাজীপুরের পল্লীবাস নুহাশপল্লীতে। হয়ত বাকিটুকু পূর্ণাঙ্গ রূপ পেত আগামীতে। কিন্তু লেখক তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর স্বপ্নের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করে যেতে পারলেন না। এখন লেখকের আপনজনদেরই সব লোভ পরিহার করে এগিয়ে আসতে হবে ‘নুহাশপল্লীর’ সব সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে।
সবার আগে দরকার সংশ্লিষ্ট সবার ব্যক্তিগত লোভ সংবরণের। এ জন্য নুহাশ, শাওন ও মুহম্মদ জাফর ইকবালকে সচেতনভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। হুমায়ূনের স্বপ্নপুরী নুহাশপল্লীকে একটি বহুমুখী জাতীয় কল্যাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ার জন্য যোগ্য লোকদের নিয়ে অবিলম্বে গড়া দরকার ‘নুহাশপল্লী ট্রাস্টি বোর্ড’। প্রথমেই ব্যক্তিগত ভোগদখলের জন্য লেখকের প্রিয় এই পল্লীবাসের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে; জাতির সেরা প্রতিভার সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক বিকাশের ব্যবস্থা থাকবে এখানে।
নুহাশপল্লীতে হুমায়ূনের কবর দেয়া হয়েছেÑএতে কোন ভুল হয়নি। বরং ভবিষ্যতে এই কবর এবং নুহাশপল্লীর প্রকৃতি, বৃক্ষ, জলাশয় ও অন্যান্য স্থাপনাকে কেন্দ্র করে এখানে এক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক এখানে আসবেন, তাঁরা এই প্রাকৃতিক নিবাসের সৌন্দর্য উপভোগ করবেন এবং হুমায়ূনের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। সময় যত যাবে, ততই সকল বাঙালী ও বিশ্ববাসীর কাছে ‘নুহাশপল্লীর’ আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য নুহাশপল্লীতে আর কবরের দরকার নেই; সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, নুহাশ পল্লী যেন ভবিষ্যতে হুমায়ূনের পারিবারিক কবরস্থান হয়ে না ওঠে। হুমায়ূনের মা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাই কিংবা বোনদের কাউকে যেন এখানে কবরস্থ করা না হয়।
তবে ‘নুহাশপল্লী’তে কী থাকবে? এখানে গড়ে তোলা হবে দেশের সেরা মেধাবী ও সৃজনশীল বালক বালিকাদের বিদ্যালয়; রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন তপবনের আদর্শে শান্তিনিকেতনে যে প্রাকৃতিক বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেনÑঅনেকটা তেমনই হবে এর কাঠামো। সাহিত্য, সঙ্গীত ও বিজ্ঞান নিয়ে এখানে গবেষণার সুযোগ থাকবে। সেই সঙ্গে থাকবে পৃথিবীর সব ধরনের সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের আর্কাইভ। নুহাশপল্লীতে লেখকদের থাকার জন্য ডরমিটরি গড়ে তোলা যেতে পারেÑ যেখানে লেখক ও শিল্পীরা সুনির্দিষ্ট ভাড়ার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট সময় থাকতে পারবেন। কেবল সৃজনশীল কাজের জন্য তাঁরা এ সুযোগ পাবেন। ‘নুহাশপল্লী’ হতে পারে সারাবিশ্বের সৃজনশীল মানুষদের তীর্থকেন্দ্র। যাঁরা বাংলাদেশে আসবেনÑ তাঁরা সবাই নুহাশপল্লীতে যাবেন।
হুমায়ূনের মৃত্যুর পরে ঢাকায় যে নাগরিক স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে বক্তারা ‘নুহাশপল্লীর’ বিষয়ে কিছুই বলেননি। এর ফলে হুমায়ূনের এই প্রিয় পল্লীবাসের ভবিষ্যতের বিষয়ে আরও অনেকের মতো বাস্তবিকই আশঙ্কা বোধ করেছি। তখন কেউ কেউ হুমায়ূনের নামে ‘ক্যান্সার হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। বাংলাদেশে হুমায়ূনের নামে অবশ্যই একটা ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপিত হতে পারে; কিন্তু তা ‘নুহাশপল্লীতে’ নয়।
সার্বক্ষণিক একটি যোগ্য ট্রাস্টি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হলে ‘নুহাশপল্লী’ বাস্তবিকই একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠবে। অবশ্যই সেক্যুলার, অরাজনৈতিক, যুক্তিবাদী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এখানে সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে। নুহাশপল্লী ট্রাস্টি বোর্ডে কারা থাকবেন? নুহাশ, শাওন ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল ছাড়া এর সঙ্গে থাকতে পারেন আনিসুজ্জামান ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমি বরাবরই লক্ষ্য করেছি, হুমায়ূন এ দু’জন শিক্ষাবিদের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রাথমিকভাবে এই পাঁচজনকে নিয়ে ‘নুহাশপল্লী’র কাজ শুরু হতে পারে; পরে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আরও বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু কিছুতেই বৃক্ষ, প্রকৃতি ও জলাশয়নির্ভর এই পল্লীবাসের প্রাকৃতিক অবকাঠামো যেন সর্বদা অক্ষুণ থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। নুহাশপল্লীকে ঘিরে হুমায়ূনের স্বপ্নের কথা আমরা উপলব্ধি করতে পারি; সম্ভবত তাঁর নিকটজনেরা আরও গভীরভাবে তা উপলব্ধি করছেন। তবে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। কখনও কারও ষড়যন্ত্র ও লোভের বলি হয়ে এই প্রাকৃতিক ‘শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আশ্রমের’ বিপুল সম্ভাবনা যেন বিনষ্ট না হয়। আমরা অনেকেই এখন বৃষ্টি ও জোছনাকে উপভোগ করতে নুহাশপল্লীতে যাব। কোন পারিবারিক গোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্য যেন এখানে গড়ে না ওঠে। এজন্য সবাইকে আত্মত্যাগের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেকেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত, আগামীতে হুমায়ূনের স্মৃতি ও কীর্তি যথাযথভাবে রক্ষা করা।
১৯৭৫ সালে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ নামের কল্পউপন্যাসে ‘সিরানপল্লী’ নামে বিজ্ঞানীদের একটি আবাসিক এলাকার কথা বলেছেন। সম্ভবত গাজীপুরের গ্রাম এলাকায় একান্ত নিজস্ব ভাবনায় ‘নুহাশপল্লী’ গড়ে তোলার সময় ‘সিরানপল্লী’র কথা তাঁর মনে ছিল। তাঁর পুত্রদেরও নামও তিনি লেখেছেন কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসে বর্ণিত বিজ্ঞানীদের নামে। হুমায়ূন যে সর্বদা বিজ্ঞানমনস্কÑএ সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু চেতনার দরোজা সর্বদা খোলা রেখেছেন; উদার মানবিকতা কিংবা কল্যাণকারী আধ্যাত্মিকতা তাঁকে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে গেছে। এই সবকিছু মিলে মহাপ্রতিভাবান ও মহাসৃজনশীল হুমায়ূন আহমেদ; তাঁর সায়েন্স ফিকশনে বর্ণিত বিজ্ঞানীদের মতোই তিনি প্রতিভাবান। সেই প্রতিভাবান ও সৃজনশীল হুমায়ূন আহমেদ যেমন বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে; তেমনই তিনি অমর হবেন ‘নুহাশপল্লী’র মাধ্যমে। তাই বৃক্ষ ও প্রকৃতিসহ এই পল্লীবাসকে অবিকৃতিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এখানে জোছনা রাতে বাংলার প্রাচীন কোন লোকসঙ্গীত শোনার সময় মনে পড়বে হুমায়ূনকে; ঠিক একইভাবে বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনার কিংবা সাহিত্য আলোচনায় এই মহৎ সাহিত্যিক স্মরণে আসবেন। তাই নুহাশপল্লীকে সক্রিয় রাখতে হবে; একে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।
iqbalaziz.poet@gmail.com
নিউইয়র্ক থেকে হুমায়ূনের লাশ যেদিন ঢাকায় এল, সেদিনই মনে হয়েছিল বাঙালীর এই সর্বজনপ্রিয় লেখকের লাশ তাঁর স্বপ্নপল্লী ‘নুহাশপল্লী’তে দাফন হওয়া উচিত। কারণ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ‘নুহাশপল্লী’ হয়ে উঠেছিল হুমায়ূনের তীর্থভূমি। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মত্ত লেখক তাঁর বেশিরভাগ সময় কাটাতেন নিজের সৃষ্টি এই পল্লীনিবাসে।
হুমায়ূন প্রকৃতির বৃষ্টি ও জোছনাকে গভীরভাবে উপভোগ করতে চেয়েছিলেন এই পল্লীনিবাসে এসে; নগরজীবন ও পরিবেশ দূষণের ভয়ঙ্কর আগ্রাসন থেকে লেখক সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রেখেছিলেন তাঁর এই ‘নুহাশপল্লী’। ঔষধি গাছসহ লাগিয়েছিলেন নানা ধরনের গাছ। লেখকের এই প্রাকৃতিক নিবাস সম্পর্কে পত্রিকায় অনেক পড়েছি, মানুষের কাছে শুনেছি; কিন্তু একবারও সেখানে যাওয়া হয়নি। তবে হয়ত নিজের অজান্তেই অবচেতন মনে একটি গভীর ইচ্ছা বাসা বেঁধেছিল হুমায়ূনের স্বপ্নপুরী ‘নুহাশপল্লীতে’ হয়ত একদিন যাব; যখন তা আরও পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত হবে। টেলিভিশনের পর্দায় যতবারই হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর নুহাশপল্লীকে দেখেছি, ততবারই অনুভব করেছি লেখক তাঁর স্বপ্ন ও সৃজনশীলতার শেষ আশ্রয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন নুহাশপল্লীতে। রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিতের কল্পজগতের পাশাপাশি হুমায়ূনেরও যেন ছিল এক কল্পনার জগতÑযার আংশিক বিকাশ আমরা দেখতে পেয়েছি লেখকের গাজীপুরের পল্লীবাস নুহাশপল্লীতে। হয়ত বাকিটুকু পূর্ণাঙ্গ রূপ পেত আগামীতে। কিন্তু লেখক তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর স্বপ্নের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করে যেতে পারলেন না। এখন লেখকের আপনজনদেরই সব লোভ পরিহার করে এগিয়ে আসতে হবে ‘নুহাশপল্লীর’ সব সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে।
সবার আগে দরকার সংশ্লিষ্ট সবার ব্যক্তিগত লোভ সংবরণের। এ জন্য নুহাশ, শাওন ও মুহম্মদ জাফর ইকবালকে সচেতনভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। হুমায়ূনের স্বপ্নপুরী নুহাশপল্লীকে একটি বহুমুখী জাতীয় কল্যাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ার জন্য যোগ্য লোকদের নিয়ে অবিলম্বে গড়া দরকার ‘নুহাশপল্লী ট্রাস্টি বোর্ড’। প্রথমেই ব্যক্তিগত ভোগদখলের জন্য লেখকের প্রিয় এই পল্লীবাসের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে; জাতির সেরা প্রতিভার সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক বিকাশের ব্যবস্থা থাকবে এখানে।
নুহাশপল্লীতে হুমায়ূনের কবর দেয়া হয়েছেÑএতে কোন ভুল হয়নি। বরং ভবিষ্যতে এই কবর এবং নুহাশপল্লীর প্রকৃতি, বৃক্ষ, জলাশয় ও অন্যান্য স্থাপনাকে কেন্দ্র করে এখানে এক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক এখানে আসবেন, তাঁরা এই প্রাকৃতিক নিবাসের সৌন্দর্য উপভোগ করবেন এবং হুমায়ূনের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। সময় যত যাবে, ততই সকল বাঙালী ও বিশ্ববাসীর কাছে ‘নুহাশপল্লীর’ আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য নুহাশপল্লীতে আর কবরের দরকার নেই; সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, নুহাশ পল্লী যেন ভবিষ্যতে হুমায়ূনের পারিবারিক কবরস্থান হয়ে না ওঠে। হুমায়ূনের মা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাই কিংবা বোনদের কাউকে যেন এখানে কবরস্থ করা না হয়।
তবে ‘নুহাশপল্লী’তে কী থাকবে? এখানে গড়ে তোলা হবে দেশের সেরা মেধাবী ও সৃজনশীল বালক বালিকাদের বিদ্যালয়; রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন তপবনের আদর্শে শান্তিনিকেতনে যে প্রাকৃতিক বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেনÑঅনেকটা তেমনই হবে এর কাঠামো। সাহিত্য, সঙ্গীত ও বিজ্ঞান নিয়ে এখানে গবেষণার সুযোগ থাকবে। সেই সঙ্গে থাকবে পৃথিবীর সব ধরনের সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের আর্কাইভ। নুহাশপল্লীতে লেখকদের থাকার জন্য ডরমিটরি গড়ে তোলা যেতে পারেÑ যেখানে লেখক ও শিল্পীরা সুনির্দিষ্ট ভাড়ার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট সময় থাকতে পারবেন। কেবল সৃজনশীল কাজের জন্য তাঁরা এ সুযোগ পাবেন। ‘নুহাশপল্লী’ হতে পারে সারাবিশ্বের সৃজনশীল মানুষদের তীর্থকেন্দ্র। যাঁরা বাংলাদেশে আসবেনÑ তাঁরা সবাই নুহাশপল্লীতে যাবেন।
হুমায়ূনের মৃত্যুর পরে ঢাকায় যে নাগরিক স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে বক্তারা ‘নুহাশপল্লীর’ বিষয়ে কিছুই বলেননি। এর ফলে হুমায়ূনের এই প্রিয় পল্লীবাসের ভবিষ্যতের বিষয়ে আরও অনেকের মতো বাস্তবিকই আশঙ্কা বোধ করেছি। তখন কেউ কেউ হুমায়ূনের নামে ‘ক্যান্সার হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। বাংলাদেশে হুমায়ূনের নামে অবশ্যই একটা ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপিত হতে পারে; কিন্তু তা ‘নুহাশপল্লীতে’ নয়।
সার্বক্ষণিক একটি যোগ্য ট্রাস্টি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হলে ‘নুহাশপল্লী’ বাস্তবিকই একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠবে। অবশ্যই সেক্যুলার, অরাজনৈতিক, যুক্তিবাদী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এখানে সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে। নুহাশপল্লী ট্রাস্টি বোর্ডে কারা থাকবেন? নুহাশ, শাওন ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল ছাড়া এর সঙ্গে থাকতে পারেন আনিসুজ্জামান ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমি বরাবরই লক্ষ্য করেছি, হুমায়ূন এ দু’জন শিক্ষাবিদের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রাথমিকভাবে এই পাঁচজনকে নিয়ে ‘নুহাশপল্লী’র কাজ শুরু হতে পারে; পরে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আরও বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু কিছুতেই বৃক্ষ, প্রকৃতি ও জলাশয়নির্ভর এই পল্লীবাসের প্রাকৃতিক অবকাঠামো যেন সর্বদা অক্ষুণ থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। নুহাশপল্লীকে ঘিরে হুমায়ূনের স্বপ্নের কথা আমরা উপলব্ধি করতে পারি; সম্ভবত তাঁর নিকটজনেরা আরও গভীরভাবে তা উপলব্ধি করছেন। তবে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। কখনও কারও ষড়যন্ত্র ও লোভের বলি হয়ে এই প্রাকৃতিক ‘শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আশ্রমের’ বিপুল সম্ভাবনা যেন বিনষ্ট না হয়। আমরা অনেকেই এখন বৃষ্টি ও জোছনাকে উপভোগ করতে নুহাশপল্লীতে যাব। কোন পারিবারিক গোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্য যেন এখানে গড়ে না ওঠে। এজন্য সবাইকে আত্মত্যাগের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেকেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত, আগামীতে হুমায়ূনের স্মৃতি ও কীর্তি যথাযথভাবে রক্ষা করা।
১৯৭৫ সালে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ নামের কল্পউপন্যাসে ‘সিরানপল্লী’ নামে বিজ্ঞানীদের একটি আবাসিক এলাকার কথা বলেছেন। সম্ভবত গাজীপুরের গ্রাম এলাকায় একান্ত নিজস্ব ভাবনায় ‘নুহাশপল্লী’ গড়ে তোলার সময় ‘সিরানপল্লী’র কথা তাঁর মনে ছিল। তাঁর পুত্রদেরও নামও তিনি লেখেছেন কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসে বর্ণিত বিজ্ঞানীদের নামে। হুমায়ূন যে সর্বদা বিজ্ঞানমনস্কÑএ সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু চেতনার দরোজা সর্বদা খোলা রেখেছেন; উদার মানবিকতা কিংবা কল্যাণকারী আধ্যাত্মিকতা তাঁকে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে গেছে। এই সবকিছু মিলে মহাপ্রতিভাবান ও মহাসৃজনশীল হুমায়ূন আহমেদ; তাঁর সায়েন্স ফিকশনে বর্ণিত বিজ্ঞানীদের মতোই তিনি প্রতিভাবান। সেই প্রতিভাবান ও সৃজনশীল হুমায়ূন আহমেদ যেমন বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে; তেমনই তিনি অমর হবেন ‘নুহাশপল্লী’র মাধ্যমে। তাই বৃক্ষ ও প্রকৃতিসহ এই পল্লীবাসকে অবিকৃতিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এখানে জোছনা রাতে বাংলার প্রাচীন কোন লোকসঙ্গীত শোনার সময় মনে পড়বে হুমায়ূনকে; ঠিক একইভাবে বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনার কিংবা সাহিত্য আলোচনায় এই মহৎ সাহিত্যিক স্মরণে আসবেন। তাই নুহাশপল্লীকে সক্রিয় রাখতে হবে; একে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।
iqbalaziz.poet@gmail.com
No comments