নতুন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী অজয় কুমার রায়
নাচ, গান ও ঢাকের শব্দে মুখরিত ভারতের নতুন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর গ্রাম মিরাটি। ঘরের কৃতী সন্তান প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছিল এই উৎসব। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে যাবতীয় বিবাদ, বিতর্ক ভুলে রাইসিনা হিলসে প্রণব মুখার্জির পা রাখার অপেক্ষায় ছিল মিরাটি গ্রামের মানুষ।
অবশেষে ২৫ জুলাই দেশের প্রথম নাগরিক হওয়ায় রাইসেনা হিলসে রাষ্ট্রপতি ভবনে পা রাখার মধ্য দিয়ে প্রণব বাবু ও মিরাটি গ্রামের মানুষের আশা আকাঙ্খা পূরণ হলো। ভারতের প্রথম বাঙালী রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণের সময় উপস্থিত ছিলেন বহুল আলোচিত ও সমালোচিত আরেক বাঙালী নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী পূর্ণ অ্যাজিটক সাংমাকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে প্রথম বাঙালী রাইসিনা হিলসের প্রথম বাঙালী বাসিন্দা হিসেবে ইতিহাসের সোনালি অধ্যায় ঢুকে গেলেন প্রণব মুখার্জি। ১০,৯৮,৮৮২ ভোটের মধ্যে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল ৪৯,৪৪২ ভোট। কিন্তু ভোটের ম্যাজিক ফিগার ছাড়িয়ে ৭,১৩,৭৬৩ ভোট পান প্রণব বাবু। তাতেই মিরাটি গ্রামের মানুষের আনন্দের বাজিমাত। প্রণব বাবুর এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবার প্রমাণিত হলো বাঙালীরা একবারই ভুল করে। দ্বিতীয়বার নয়। যে রকম একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য জনগণের বন্ধু সর্বহারার অগ্রদ্রুত বাঙালীর অহঙ্কার কমরেড জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হননি। বাঙালীর এই আক্ষেপ আর কখনই কাটবে না।
অনেকে মনে করেন কেমন রাষ্ট্রপতি হবেন প্রণব মুখার্জি? প্রণব হতে পারেন জৈল সিংহের মতো। যিনি ১৯৮২ সালে ২৫ জুলাই ৭ম রাষ্ট্রপ্রতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে বরখাস্তের কথা চিন্তা করেছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, প্রণব বাবু হতে পারেন এপিজে আবুল কালামের মতো ‘জনগণের বন্ধু’ অথবা হতে পারেন জলন্ধর প্রসাদ। যিনি ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রপতিদের জন্য অনুকরণীয় অনেক কিছুই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। যা পরবর্তীকালে প্রথা হিসেবে রয়ে গেছে। ইতিহাসের পাতায় উল্লিখিত, জলন্ধর প্রসাদ সপ্তাহে একদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হতেন। অনেক কিছু বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সঙ্গে জলন্ধর প্রসাদের বিরোধ থাকলেও তা কখনও কোন প্রকার সংঘাতে রূপ নেয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রপতি কেন গুরুত্বপূর্ণ? আলোচনা ছাড়া কখনও এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী দেশটির সর্বোচ্চ পদ হচ্ছে রাষ্ট্রপতির পদ। যে কোন সময় রাষ্ট্রপতি ইচ্ছে করলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ যথা লোকসভা ও রাজ্যসভার বিরুদ্ধে সমন জারি করতে পারেন। স্থগিত করতে পারেন পার্লামেন্ট ও ভেঙ্গে দিতে পারেন লোকসভা। ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে কেন্দ্রীয় সরকারের সব নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে মন্ত্রীদের মধ্যে দফতর বণ্টনসহ বিভিন্ন প্রদেশের গবর্নর নিয়োগসহ সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, এ্যাটর্নি জেনারেল ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতও নিয়োগ দেন তিনি। রাষ্ট্রপতি যে কোন সময় যুদ্ধের এবং শান্তির ঘোষণা দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। প্রয়োজনে তিন ধরনের জরুরী অবস্থার ঘোষণা দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। যেমন জাতীয়, প্রাদেশিক ও অর্থনৈতিক। পার্লামেন্টে পাস হওয়া যে কোন বিলে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির। তার স্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত কোন বিলই আইনে পরিণত হবে না এবং রাষ্ট্রপতি যুক্তিসঙ্গত না মনে করলে প্রত্যাখান করে আবার পার্লামেন্টে পাঠিয়ে দিতে পারেন।
গত ২৫ জুলাই ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতির আসন গ্রহণ করেছেন ইউপিএ জোটের প্রথম বাঙালী প্রণব মুখার্জি। ২০০৭ সালের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ভারতের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল। এই আসনটি এখন ২৫ জুলাই ২০১২ সাল থেকে নির্ধারিত সময়ের জন্য বাঙালী কৃতী সন্তান প্রণব মুখার্জি বাবুর। এই প্রণব বাবুর জন্ম শৈশব, রাজনীতি, সফলতা ও ব্যর্থতা পাঠকের মাঝে তুলে ধরে আলোচনাকে এগিয়ে নিলাম। ১৯৩৫ সালের ১০ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা দক্ষ ও সক্রিয় রাজনীতিবিদ ছিলেন। তরুণ বয়সে খুবই ভোজনপ্রিয় ছিলেন প্রণব বাবু। নিজের খাদ্যাভাস সম্পর্কে বলেছিলেন আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন সকালবেলা নাস্তা করার পর মাকে জিজ্ঞেস করতাম দুপুরের খাবার কী? দুপুরে খাবার শেষে রাতের খাবারের কথা জিজ্ঞাসা করতাম। অর্থাৎ তিনি কখনো শরীর চর্চার ক্ষেত্রে খাবারটাকে অবহেলা, অনিয়মিত করেননি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তারপর কলেজ শিক্ষক হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। রাজনীতিবিদ বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেননি। নিজের আগ্রহে রাজনীতিতে এসেছেন এবং পশ্চিমবঙ্গের বাংলা পত্রিকা দেশের ডাকে সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি এবং নিখিল ভারতবঙ্গ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালেও তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ও মন্ত্রী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮২-১৯৮৪ এই তিন বছর তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ব্রিটেনের ইউরোমানি পত্রিকার এক জরিপে তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর একজন হিসেবে নির্বাচিত হন। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকা-ের পর দলীয় একটি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের শিকার হলে রাজীব গান্ধী তাকে মন্ত্রিপরিষদে স্থান দেননি। দল থেকে বহিষ্কার করেন কিছু দিনের জন্য। এ সময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে একটি দল গঠন করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে দলীয় কোন্দল মিটিয়ে আবার লোকজন নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৯১ সালে পিভি নরসীমা রাও প্রথমে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও পরে ক্যাবিনেট মন্ত্রী করলেন। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৯৭ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০৪ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট ইউপিএ কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করলে এ বছরই তিনি জঙ্গিপুর আসন থেকে প্রথমবার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে অসামান্য সফলতা অর্জন করেন। কর্মজীবনে অসাধারণ সাফল্যের জন্য ২০০৭ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে সম্মানিত হন। ২০১০ সালে এশিয়ার বর্ষসেরা অর্থমন্ত্রীর খেতাব নিজের ঘরে তুলে নেন।
ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন, সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন মিতভাষী। শত শত সম্মানের মুকুট মাথায় নিয়েও অহংকারবিহীন প্রণব মুখার্জি। স্ত্রী শুভ্রা, দুইপুত্র এবং এক মেয়ে নিয়ে প্রণব মুখার্জির সংসার। মেয়ে শর্মিষ্ঠা নৃত্য শিল্পী। অবসর সময়ে বই পড়তে, বাগান করতে এবং গান শুনতে বেশি ভালবাসেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসার টানটা তার হৃদয়ের অন্য প্রান্তে। লেখক হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছে। রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর বইগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চলমান রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে যে সুদূর সম্পর্ক তা বিশদ ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বর্ণনা করে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আর রাষ্ট্রপতি ছিলেন ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ। দক্ষতা ও চারিত্র্যিক গুণাবলীতে দু’জনেই ছিলেন খ্যাতির চুড়ায়। দীর্ঘ ষাট বছর পর ভারতবাসী আবার প্রবল দুই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনীতিক, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পেলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে অধিষ্ঠিত রয়েছে ড. মনমোহন সিং। ১৮ জুলাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২২ জুলাই ফলাফলের বিজয়ের মালা গলায় পরে ২৫ জুলাই রাইসেনা হিলসে অধিষ্ঠিত হলেন বাঙালী কৃতীসন্তান প্রণব মুখার্জি। দু’জনের চারিত্র্যিক সততা, আদর্শগত অবস্থান, ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কংগ্রেস পার্টির নেতা হয়ে দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে দু’জনে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু রাজনীতির মাঠে দু’জনের ঘনিষ্ঠতা সর্বজনবিদিত। রাজনৈতিক অঙ্গনে মনমোহন সিংহের চেয়ে প্রণব মুখার্জি জ্যেষ্ঠ কিন্তু বয়সে মনমোহনই বড়। বর্তমান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মনমোহন ও প্রণব যথাক্রমে নাম্বার ওয়ান ও নাম্বার টু হলেও দু’জনেই দু’জনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করেছেন। মনমোহন সবসময়ই প্রণবকে মূল্যায়ন করেছেন। তার মতামত ও সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কখনোই একটি ইস্যুতে দু’জন দু’রকম মতামত দেননি। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে অনেকের ভিন্ন মতের দ্বন্দ্ব থাকলেও মনমোহনের কাছে ভিন্নমতের নজির কখনো দেখা যায়নি। অর্থাৎ মনমোহনের মন্ত্রিসভায় প্রণব মুখার্জি ছিলেন অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
রাইসিনা হিলসে শপথ নেয়ার পর প্রথমবারের মতো বক্তৃতা দেয়ার সময় উল্লেখ করেন, যুদ্ধের যুগ শেষ হয়ে যায়নি। আমরা চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে আছি। এই যুদ্ধ হলো সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ। আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধ। নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত এই স্নায়ুযুদ্ধের কারণে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অঞ্চল উত্তপ্ত হয়েছিল। ভারত সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে সামনের প্রথম সারিতেই আছে। দারিদ্র্য ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলেন, ভারতকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে হবে। আধুনিক ভারতের অভিধান থেকে দারিদ্র্য শব্দটি তুলে ফেলতে হবে। ক্ষুধা দূর করতে হবে। কারণ ক্ষুধার মতো কষ্ট আর লজ্জার আর কিছু নেই। আর দুর্নীতি এমন একটা বিষয়, যা জাতির উন্নয়নের গতিধারার বড় বাধা সৃষ্টি করে। কোন ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। আমাদের অবশ্যই দুর্নীতির ময়দানে নিজেকে ছিনতাই হতে দেয়া যাবে না।
এখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার কী ভূমিকা হবে? তা দেখার বিষয়। কারণ দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে কীভাবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দেবেন। না প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে আগের মতো মধুর সম্পর্ক থাকবে? যদিও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় উল্লেখ করেছেন তিনি অন্যসব রাষ্ট্রপতির চেয়ে ব্যতিক্রম ও দায়িত্ব সচেতন হবেন। তবে এখন রাষ্ট্রপতির রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতবাসীর কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সফল হবেন, তা প্রত্যাশা।
অনেকে মনে করেন কেমন রাষ্ট্রপতি হবেন প্রণব মুখার্জি? প্রণব হতে পারেন জৈল সিংহের মতো। যিনি ১৯৮২ সালে ২৫ জুলাই ৭ম রাষ্ট্রপ্রতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে বরখাস্তের কথা চিন্তা করেছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, প্রণব বাবু হতে পারেন এপিজে আবুল কালামের মতো ‘জনগণের বন্ধু’ অথবা হতে পারেন জলন্ধর প্রসাদ। যিনি ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রপতিদের জন্য অনুকরণীয় অনেক কিছুই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। যা পরবর্তীকালে প্রথা হিসেবে রয়ে গেছে। ইতিহাসের পাতায় উল্লিখিত, জলন্ধর প্রসাদ সপ্তাহে একদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হতেন। অনেক কিছু বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সঙ্গে জলন্ধর প্রসাদের বিরোধ থাকলেও তা কখনও কোন প্রকার সংঘাতে রূপ নেয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রপতি কেন গুরুত্বপূর্ণ? আলোচনা ছাড়া কখনও এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী দেশটির সর্বোচ্চ পদ হচ্ছে রাষ্ট্রপতির পদ। যে কোন সময় রাষ্ট্রপতি ইচ্ছে করলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ যথা লোকসভা ও রাজ্যসভার বিরুদ্ধে সমন জারি করতে পারেন। স্থগিত করতে পারেন পার্লামেন্ট ও ভেঙ্গে দিতে পারেন লোকসভা। ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে কেন্দ্রীয় সরকারের সব নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে মন্ত্রীদের মধ্যে দফতর বণ্টনসহ বিভিন্ন প্রদেশের গবর্নর নিয়োগসহ সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, এ্যাটর্নি জেনারেল ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতও নিয়োগ দেন তিনি। রাষ্ট্রপতি যে কোন সময় যুদ্ধের এবং শান্তির ঘোষণা দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। প্রয়োজনে তিন ধরনের জরুরী অবস্থার ঘোষণা দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। যেমন জাতীয়, প্রাদেশিক ও অর্থনৈতিক। পার্লামেন্টে পাস হওয়া যে কোন বিলে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির। তার স্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত কোন বিলই আইনে পরিণত হবে না এবং রাষ্ট্রপতি যুক্তিসঙ্গত না মনে করলে প্রত্যাখান করে আবার পার্লামেন্টে পাঠিয়ে দিতে পারেন।
গত ২৫ জুলাই ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতির আসন গ্রহণ করেছেন ইউপিএ জোটের প্রথম বাঙালী প্রণব মুখার্জি। ২০০৭ সালের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ভারতের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল। এই আসনটি এখন ২৫ জুলাই ২০১২ সাল থেকে নির্ধারিত সময়ের জন্য বাঙালী কৃতী সন্তান প্রণব মুখার্জি বাবুর। এই প্রণব বাবুর জন্ম শৈশব, রাজনীতি, সফলতা ও ব্যর্থতা পাঠকের মাঝে তুলে ধরে আলোচনাকে এগিয়ে নিলাম। ১৯৩৫ সালের ১০ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা দক্ষ ও সক্রিয় রাজনীতিবিদ ছিলেন। তরুণ বয়সে খুবই ভোজনপ্রিয় ছিলেন প্রণব বাবু। নিজের খাদ্যাভাস সম্পর্কে বলেছিলেন আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন সকালবেলা নাস্তা করার পর মাকে জিজ্ঞেস করতাম দুপুরের খাবার কী? দুপুরে খাবার শেষে রাতের খাবারের কথা জিজ্ঞাসা করতাম। অর্থাৎ তিনি কখনো শরীর চর্চার ক্ষেত্রে খাবারটাকে অবহেলা, অনিয়মিত করেননি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তারপর কলেজ শিক্ষক হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। রাজনীতিবিদ বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেননি। নিজের আগ্রহে রাজনীতিতে এসেছেন এবং পশ্চিমবঙ্গের বাংলা পত্রিকা দেশের ডাকে সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি এবং নিখিল ভারতবঙ্গ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালেও তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ও মন্ত্রী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮২-১৯৮৪ এই তিন বছর তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ব্রিটেনের ইউরোমানি পত্রিকার এক জরিপে তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর একজন হিসেবে নির্বাচিত হন। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকা-ের পর দলীয় একটি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের শিকার হলে রাজীব গান্ধী তাকে মন্ত্রিপরিষদে স্থান দেননি। দল থেকে বহিষ্কার করেন কিছু দিনের জন্য। এ সময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে একটি দল গঠন করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে দলীয় কোন্দল মিটিয়ে আবার লোকজন নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৯১ সালে পিভি নরসীমা রাও প্রথমে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও পরে ক্যাবিনেট মন্ত্রী করলেন। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৯৭ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০৪ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট ইউপিএ কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করলে এ বছরই তিনি জঙ্গিপুর আসন থেকে প্রথমবার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে অসামান্য সফলতা অর্জন করেন। কর্মজীবনে অসাধারণ সাফল্যের জন্য ২০০৭ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে সম্মানিত হন। ২০১০ সালে এশিয়ার বর্ষসেরা অর্থমন্ত্রীর খেতাব নিজের ঘরে তুলে নেন।
ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন, সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন মিতভাষী। শত শত সম্মানের মুকুট মাথায় নিয়েও অহংকারবিহীন প্রণব মুখার্জি। স্ত্রী শুভ্রা, দুইপুত্র এবং এক মেয়ে নিয়ে প্রণব মুখার্জির সংসার। মেয়ে শর্মিষ্ঠা নৃত্য শিল্পী। অবসর সময়ে বই পড়তে, বাগান করতে এবং গান শুনতে বেশি ভালবাসেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসার টানটা তার হৃদয়ের অন্য প্রান্তে। লেখক হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছে। রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর বইগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চলমান রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে যে সুদূর সম্পর্ক তা বিশদ ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বর্ণনা করে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আর রাষ্ট্রপতি ছিলেন ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ। দক্ষতা ও চারিত্র্যিক গুণাবলীতে দু’জনেই ছিলেন খ্যাতির চুড়ায়। দীর্ঘ ষাট বছর পর ভারতবাসী আবার প্রবল দুই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনীতিক, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পেলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে অধিষ্ঠিত রয়েছে ড. মনমোহন সিং। ১৮ জুলাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২২ জুলাই ফলাফলের বিজয়ের মালা গলায় পরে ২৫ জুলাই রাইসেনা হিলসে অধিষ্ঠিত হলেন বাঙালী কৃতীসন্তান প্রণব মুখার্জি। দু’জনের চারিত্র্যিক সততা, আদর্শগত অবস্থান, ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কংগ্রেস পার্টির নেতা হয়ে দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে দু’জনে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু রাজনীতির মাঠে দু’জনের ঘনিষ্ঠতা সর্বজনবিদিত। রাজনৈতিক অঙ্গনে মনমোহন সিংহের চেয়ে প্রণব মুখার্জি জ্যেষ্ঠ কিন্তু বয়সে মনমোহনই বড়। বর্তমান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মনমোহন ও প্রণব যথাক্রমে নাম্বার ওয়ান ও নাম্বার টু হলেও দু’জনেই দু’জনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করেছেন। মনমোহন সবসময়ই প্রণবকে মূল্যায়ন করেছেন। তার মতামত ও সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কখনোই একটি ইস্যুতে দু’জন দু’রকম মতামত দেননি। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে অনেকের ভিন্ন মতের দ্বন্দ্ব থাকলেও মনমোহনের কাছে ভিন্নমতের নজির কখনো দেখা যায়নি। অর্থাৎ মনমোহনের মন্ত্রিসভায় প্রণব মুখার্জি ছিলেন অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
রাইসিনা হিলসে শপথ নেয়ার পর প্রথমবারের মতো বক্তৃতা দেয়ার সময় উল্লেখ করেন, যুদ্ধের যুগ শেষ হয়ে যায়নি। আমরা চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে আছি। এই যুদ্ধ হলো সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ। আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধ। নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত এই স্নায়ুযুদ্ধের কারণে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অঞ্চল উত্তপ্ত হয়েছিল। ভারত সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে সামনের প্রথম সারিতেই আছে। দারিদ্র্য ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলেন, ভারতকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে হবে। আধুনিক ভারতের অভিধান থেকে দারিদ্র্য শব্দটি তুলে ফেলতে হবে। ক্ষুধা দূর করতে হবে। কারণ ক্ষুধার মতো কষ্ট আর লজ্জার আর কিছু নেই। আর দুর্নীতি এমন একটা বিষয়, যা জাতির উন্নয়নের গতিধারার বড় বাধা সৃষ্টি করে। কোন ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। আমাদের অবশ্যই দুর্নীতির ময়দানে নিজেকে ছিনতাই হতে দেয়া যাবে না।
এখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার কী ভূমিকা হবে? তা দেখার বিষয়। কারণ দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে কীভাবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দেবেন। না প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে আগের মতো মধুর সম্পর্ক থাকবে? যদিও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় উল্লেখ করেছেন তিনি অন্যসব রাষ্ট্রপতির চেয়ে ব্যতিক্রম ও দায়িত্ব সচেতন হবেন। তবে এখন রাষ্ট্রপতির রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতবাসীর কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সফল হবেন, তা প্রত্যাশা।
No comments