শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায় by শতদল বড়ুয়া

আজ শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি। যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে। ধর্মীয় আবেশে পুলকিত হৃদয়ে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা বিহারে সমবেত হয়ে পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বুদ্ধ পূজা উৎসর্গ করবেন। কেউ কেউ অষ্টশীলও গ্রহণ করবেন।


আজকের দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী হলোÑসিদ্ধার্থের গৃহাভিনিষ্ক্রমণ, বুদ্ধের ধর্মচক্র প্রবর্তন, গ- আম্র বৃক্ষমূলে যমক ঋদ্ধি প্রদর্শন এবং আগামীকাল থেকে ভিক্ষুসংঘের বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান।
ধর্মচক্র প্রবর্তন। সেদিন ছিল আজকের আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি। মহাকারুণিক বুদ্ধ চিন্তায় নিমগ্ন হলেন এই ভেবেÑআমার বহু জন্মের সাধনায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়সমূহ এতই কঠিন যে, সহজে বোঝা সবার পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ তারা নানা বিষয়ে আত্মভোলা, পঞ্চকাম বিষয়ে তন্ময় ও তদ্গত। ভগবানের এরকম দুশ্চিন্তার কথা মহাব্রহ্ম জ্ঞাত হয়ে ব্রহ্মলোক থেকে ভগবান সকাশে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে মহামনব-আপনার দুশ্চিন্তার তেমন কোন কারণ নেই। আপনার দেশিত ধর্মের মর্মকথা বোঝার লোক ইহজগতে পাওয়া যাবে।
ভগবান আধ্যাত্মিক ধ্যানদৃষ্টি প্রাণী জগতের দিকে নিক্ষেপ করে প্রথমে ঋষি আলাড় কালামের বিষয়ে চিন্তা করলেন। ভগবানের দৃষ্টিতে আলাড় কালামের দেহত্যাগের ঘটনা স্পষ্ট হলো। বুদ্ধ এরপর চিন্তা করলেন রামপুত্র ঋষি রুদ্রকের কথা। তিনিও গতকাল কালগত হয়েছেন। এরপর বুদ্ধের স্মৃতিপটে উদিত হলো সেই আগেকার পাঁচ শিষ্যের কথা। তিনি পাঁচ শিষ্যের সন্ধানে গয়া হতে বারানসী যাত্রা পথে বুদ্ধের সঙ্গে উপক নামক আজীবকের দেখা হলো। উপক দূর হতে তথাগতের উপস্থিতি দেখে বললেনÑবন্ধুবর আপনার প্রশান্ত মুখচ্ছবি দেখে মনে হচ্ছে আপনার হৃদয় আধ্যাত্মিক ধ্যানসম্পদে পরিপূর্ণ।
মহাকারুণিক বুদ্ধ মহাসংবেগ জড়িত কণ্ঠে তাঁর সাধনালব্ধ দুঃখমুক্তির মার্গ সম্বন্ধে দেশনা করতে শুরু করলেন। পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণের উদ্দেশে বুদ্ধ বললেন- ‘হে ভিক্ষুগণ! নির্বাণকামী ব্রতচারী কখনও এই দুই ‘অন্তে’ যাবে না। প্রথম অন্ত হচ্ছে কামোপভোগে সুখ আছে, এরূপ কামে সুখোদ্রেকের প্রতি অনুরক্ত হওয়া। ইহা অত্যন্ত হীন, ইতরজন সেব্য, অনার্য ও অনর্থকর, দ্বিতীয় অন্তটি হচ্ছেÑআত্মনিগ্রহে অনুরোক্তি, অর্থাৎ পারলৌকিক সুখের আশায় শরীরকে কষ্ট দেয়া। ইহাও দুঃখদায়ক, নিকৃষ্ট ও অনর্থক। এই অন্তে না গিয়ে তথাগত এমন একটি মধ্যমপন্থা আবিষ্কার করেছেন যা জ্ঞানচক্ষু উৎপন্ন করে, যা উপশম, প্রজ্ঞা, নির্বানের হেতু হয়। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ হলো সেই ‘মধ্যম পন্থা।’
‘হে ভিক্ষুগণ। আপনারা জ্ঞাত আছেন জগতে দুঃখ বিদ্যমান। জন্ম দুঃখজনক, জরা দুঃখজনক, ব্যাধি দুঃখজনক ও মরণ দুঃখজনক। অপ্রিয়ের সংযোগ দুঃখজনক, প্রিয়ের বিয়োগ দুঃখজনক। অভিষ্ট বস্তু না পাওয়া দুখজনক। অতএব, পঞ্চস্কন্দই দুঃখজনক। এ দুঃখের বিদ্যমানতা হলো প্রথম আর্যসত্য।
‘হে ভিক্ষুগণÑদুঃখ সমুদয় হলো দ্বিতীয় আর্যসত্য। দুঃখ উৎপন্নধর্মী, কামতৃষ্ণা, ভব তৃষ্ণা ও বিনাশ তৃষ্ণা ইত্যাদি প্রতিনিয়ত দুঃখ সৃষ্টি করে চলেছে। দুঃখ নিরোধ হলো তৃতীয় আর্যসত্য। দুঃখ দূর করা যায়। বৈরাগ্যের দ্বারা ঐ তৃষ্ণা পূর্ণভাবে নিরোধ করা যায়। এভাবে মুক্তির পথ উন্মুক্ত হয়। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই হলো দুঃখ নিরোধগামী প্রতিপদা নামক চতুর্থ আর্যসত্য। দুঃখ নিরোধের উপায় হলো আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুশীলন। তা হলোÑসম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি এবং সম্যক সমাধি। দুই অন্ত বর্জিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই হলো মধ্যপন্থা, যা পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ হতে মুক্ত করে এবং নির্বাণ অভিমুখে অগ্রসরমাণ।
চারি আর্যসত্যের যথার্থ জ্ঞানই হলো সম্যক দৃষ্টি। পৃথিবীতে দুঃখ আছে। এই দুঃখ মানবের তীব্র তৃষ্ণা হতে উৎপন্ন হয়েছে। এই তৃষ্ণা বিনাশ করে কায়মনোবাক্যে সদাচার সত্য, প্রেম ও আন্তরিকতার সঙ্গে আচরণ করলে মানব জাতির কল্যাণ সাধিত হয়। মানব জাতির কল্যাণ মানে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করা। এ সত্য সম্যকভাবে অনুধাবন করাই হলো সম্যক দৃষ্টি। নিজের ও অন্যের মঙ্গল কামনা সম্যক সংকল্প। শুধু নিজের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা বাড়ানোর সংকল্প করলে নিজের যেমন ক্ষতি হয়, অন্যদেরও তেমনি যৎসামান্য ক্ষতি হয়ে থাকে। এতে বিশ্বে শান্তির পরিবর্তে হানাহানির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে কামভোগে আসক্ত না থেকে অন্যের প্রতি মৈত্রীভাব পোষণ করে অন্যের সুখ-শান্তি বৃদ্ধিকল্পে নিজেকে সংবরণ করে এবং অন্যকে সৎ উপদেশ দেয়া অপরিহার্য একটা বিষয়।
সত্য কথা, প্রিয় ও মিত ভাষণ দ্বারা মানুষে মানুষে মৈত্রী সৃষ্টি হয়। এতে করে সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়। ইহাই ‘সম্যক বাক্য।’ প্রাণীহত্যা, চুরি, ব্যভিচার না করে লোকের কল্যাণকর কর্ম করাই হলো ‘সম্যক কর্ম।’ সৎ উপায়ে জীবিকা অর্জন হলো, ‘সম্যক আজীব।’ বুদ্ধ বললেন, হে ভিক্ষুগণ, এই ক্ষণভঙ্গুর দেহ কতকগুলো অপবিত্র পদার্থের সুশংকল সমাবেশ ছাড়া আর কিছু নয়। এ সত্য হৃদয়ঙ্গম করে দেহের সুখ-দুঃখ বেদনার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত। স্পন্দনশীল ও চঞ্চল চিত্তের গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রেখে ইন্দ্রিয়াদি হতে যে সমস্ত বন্ধন উৎপন্ন হয় সেগুলো বিনাশ করার চিন্তা সতত জাগরুক রাখতে হবে। এটাই ‘সম্যক স্মৃতি।’
নিজের শরীরের উপর, মৃতদেহের উপর মৈত্রী, করুণা, প্রভৃতি মনোবৃত্তির উপর কিংবা পৃথিবী, জল, তেজ ইত্যাদি পদার্থের উপর চিত্ত একাগ্র করে চারটি ধ্যান সম্পাদন করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব এবং অবশ্যই কর্তব্য। এটাই ‘সম্যক সমাধি।’ অতঃপর তিনি প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি ব্যাখ্যা করলেন।
বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধত্ব লাভের ঠিক দু’মাস পরে পবিত্র আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে ঋষিপতন মৃগদাবের মনোরম তপোবনে তথাগত বুদ্ধ ধর্মচক্র প্রবর্তন করলেন। প্রথমে কো-ন্য পরে অন্য চারজন ভিক্ষু বুদ্ধের ধর্মতত্ত্ব বুঝতে পেরে বুদ্ধের অনুসারী হলেন। বুদ্ধ তাঁদের প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করলেন। তখন স্বয়ং বুদ্ধসহ পৃথিবীতে অরহতের সংখ্যা হলো ছয়জন।’
ঋষিপতন মৃগদাবে প্রথম বর্ষাবাস : আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরদিন অর্থাৎ কাল থেকে শুরু হচ্ছে তিন মাসব্যাপী ‘বর্ষাবাস।’ ভিক্ষুসংঘরা তিন মাসব্যাপী বুদ্ধের বিধান অনুযায়ী ধর্মীয় চর্চায় রত থেকে সুনির্দিষ্ট নিয়মগুলো পালনে ব্রত হবে না । বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাতের জন্য গ্রাম অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ অসুবিধা বিধায় বুদ্ধ তিন মাস পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণসহ ঋষিপতন মৃগদাবে বর্ষা যাপন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই সময়ে বারানসীর এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় শ্রেষ্ঠীপুত্র যশ হঠাৎ ভোগ, বিলাস ও সংসারের প্রতি বীতস্পৃহ হয়ে সংসার ত্যাগ করে বের হয়ে পড়লেন। যশ যখন ঋষিপতনে এসে পৌঁছলেন এই সময় বুদ্ধ আরাম প্রাঙ্গণে প্রভাত সমীর সেবন করতে করতে চংক্রমণ করছিলেন। তথাগত বুদ্ধ যশকে দেখতে পেয়ে তাঁর চিত্ত- পরিবিতর্ক পরিজ্ঞাত হয়ে তাঁকে সম্বোধন করে বললেন- কুলপুত্র যশ! এখানে এসে বসো। আমি তোমাদের উপদেশ দেব। বুদ্ধ যশকে দান, শীল, ভাবনা, কামোপভোগের অপকারিতা ও নৈষ্ক্রম্যের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন। এরপর চতুরার্য সত্য ও আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্বন্ধে বিস্তারিত খুলে বললেন। বুদ্ধের এ উপদেশ শুনে যশের বিরাজ বিমল ধর্মচক্ষু উৎপন্ন হলো। তিনি অনুভব করতে পারলেন উৎপত্তিশীল বস্তুসমূহ বিনাশপ্রাপ্ত অবধারিত। এদিকে যশের খোঁজে তাঁর পিতামাতা ঋষিপতনে এলে বুদ্ধ তাঁদেরও ধর্মের বাণী খুব সহজ ভাষায় ব্যক্ত করলেন। এতে যশের পিতামাতাও বুদ্ধের অনুসারী হয়ে গেলেন। যশের পিতা গৃহপতি শ্রেষ্ঠী প্রথম ‘বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের’ শরণ নিলেন।
যশের পিতা প্রথম বুদ্ধের ত্রিবাচিক উপাসক হলেন। এরপর যশ উপসম্পদা গ্রহণ করেন। যশসহ অরহতের সংখ্যা হলো সাতজন। যশের মাতা, যশের পূর্ব সম্পর্কের স্ত্রী- এরা দু’জন বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘের শরণ গ্রহণ করে ত্রিবাচিকা উপাসিকা হবার গৌরভ লাভ করেন। ক্রমান্বয়ে বুদ্ধের প্রবর্তিত ধর্মচক্র শুরু করল আবর্তন।
আজ দিনের কর্মসূচী শুরু হয়েছে ভোররাতে বিহার হতে বিশেষ সূত্রপাঠের মধ্য দিয়ে। বিশ্বের শান্তি কামনা করে এ সূত্রপাঠ করা হবে। সকাল সাতটায় বিহার প্রাঙ্গণে উত্তোলন করা হবে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা। শিশু-কিশোরের কলকাকলীতে বিহার সারাদিন থাকতে সরগরম। দায়ক- দায়িকারা পূজার নানা সামগ্রী নিয়ে বিহারে উপস্থিত হবেন। সমবেত সকলে পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কেউ কেউ অষ্টশীলও গ্রহণ করবেন। পরপর কয়েকবার বুদ্ধ পূজা উৎসর্গ হবে। দিনের প্রথম ভাগের কর্মসূচী শেষ হবে দুপুর বারোটার মধ্যে।
বেলা তিনটায় শুরু হবে স্ব-স্ব বিহারের অধ্যক্ষের পৌরহিত্যে ধর্মীয় আলোচনাসভা। আজকের দিনের তাৎপর্য তুলে ধরে ধর্মীর আলোচনায় ভিক্ষুসংঘের পাশাপাশি দায়ক-দায়িকারাও অংশ নেবেন। কোন কোন বিহারে খ-কালীন বিদশন ভাবনা ও পরিচালিত হবে। সন্ধ্যায় বিহারে করা হবে আলোকসজ্জা। সকালবেলার মতো সন্ধ্যায়ও সম্মিলিত প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিহার পাবে আবারও পূর্ণতা। রাত আটটা, নয়টায় দিনের কর্মসূচী শেষ হবে। ধর্মীয় আবেশে পল্লবিত হয়ে সকলে বাসা ও বাড়িতে ফিরবেন। ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।’

No comments

Powered by Blogger.