সামাজিক উদ্যোক্তা ড. ইউনূসের নতুন প্রস্তাব by ড. এম এম আকাশ
ড. ইউনূস সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতায় আবার তাঁর 'সামাজিক উদ্যোক্তা' তত্ত্বের কথা বলেছেন। এর আগে বাংলাদেশে বন্দর নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি সমধমর্ী বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন যে চট্টগ্রাম বন্দরের মালিকানাও তিনি গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের হাতে অর্পণ করতে চান।
মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রীরাও ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদ করে সামাজিক মালিকানা স্থাপনের কথা বলেন। তাঁরা শ্রমিকের সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্যকে মালিকের মুনাফারূপে ব্যক্তিগতভাবে পকেটস্থ করার বিরেেদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করেন। সেই উদ্বৃত্ত মূল্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সামাজিক অধিকারগুলো (যেমন সর্বজনীন শিা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি) সংরণ এবং সামাজিক ভোগের জন্য ব্যয় করবে, এটাই মার্কসবাদীদের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়। সেই সঙ্গে এই সমগ্র বিষয়টি সুসম্পন্ন করার জন্য তাঁরা বাজার ব্যবস্থার বিপরীতে রাষ্ট্রের মাধ্যমে সামাজিক মালিকানাভিত্তিক পরিকল্পিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানান। সমাজতন্ত্রীরা আরও দাবি করেন যে, তাদের পরিকল্পিত উৎপাদনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের কল্যাণ, মুনাফা নয়।
ড. ইউনূস বর্তমানে যে নতুন অভিনব প্রস্তাবের অবতারণা করেছেন তাতে অবশ্য ' রাষ্ট্রের ভূমিকা' নগণ্যই থেকে যাবে এবং 'বাজারের' ভূমিকাই প্রাধান্য পাবে। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের মাধ্যমে কলকারখানা সম্পদ পরিচালনা দতার সঙ্গে কখনই করা সম্ভব নয়। তিনি 'রাষ্ট্রীয় একচেটিয়ার' বিপরীতে ব্যক্তি-উদ্যোক্তাদের বাজারভিত্তিক প্রতিযোগিতাকে সম্পদ সৃষ্টি ও পরিবর্ধনের অধিকতর গতিশীল দ উপায় বলে মনে করেন। তাই বাজার এবং প্রতিযোগিতার ওপর তাঁর অগাধ আস্থা বিদ্যমান। তবে একই সঙ্গে উদ্ধৃত্ত মূল্যের ব্যক্তিগতভাবে আত্মসাতেরও তিনি বিরোধিতা করেন। তাঁর ভাষায়, 'আমি পুঁজিবাদের মূল বক্তব্যে বিশ্বাসী। একটি মূল বক্তব্য হলো অর্থনৈতিক পদ্ধতি সবসময় প্রতিযোগিতামূলক হবে। সব প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও ব্যবস্থাপনায় দতা সৃষ্টির পেছনে প্রতিযোগিতা নামক শক্তির অবদান অসীম। পুঁজিবাদের আরেক মূল কথা হলো লাভকে উচ্চতম পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এর থেকেই জন্ম নেয় সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের প্রেরণা' (দেখুন মুহাম্মদ ইউনূস, গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন, পৃ- ২০৪)।
পুঁজিবাদের ব্যক্তি মালিকানা এবং প্রতিযোগিতা এই মূল দু'টি সূত্র মেনে নিয়ে ড. ইউনূস পুঁজিবাদের মধ্যে যেটুকু পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়েছেন তা তাঁর ভাষাতেই নিচে তুলে ধরছি।
'পুঁজিবাদের (অন্য) দুই মূল বিষয়ে আমি পরিবর্তন আনতে চাই। প্রথম যে পরিবর্তন আনতে চাই তা হলো একটি ফোলানো ফাঁপানো চরিত্রকে পুঁজিবাদ থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়া। তিনি হলেন পুঁজিবাদী উদ্যোক্তা... উদ্যোক্তা ও শ্রমিকদের মধ্যে পুরনো, যে নি্লিদ্র দেয়াল নির্মাণ করে রাখা হয়েছে তাহলে তা অদৃশ্য হয়ে যাবে। এটা হয়ে উঠবে ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় যে একজন মানুষ নিজের উদ্যোগে কিছু করার চেষ্টা করবে, না মাইনে করা শ্রমিক হয়ে থাকবে...দ্বিতীয় যে পরিবর্তন আনতে চাই তা হলো উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের ইচ্ছা সম্বন্ধীয়। মুনাফার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের মূলনীতিকে সম্প্রসারিত করে আমি সামাজিক ল্যগুলোকে এর মধ্যে স্থান করে দিতে চাই...উদ্যোক্তা দুটি পৃথক ল্যের যোগফলকে সর্বোচ্চ সীমায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। তার মধ্যে একটা হবে মুনাফা। অন্যটি হবে সামাজিক মঙ্গল। ...যে সমহ্মত্ম উদ্যোক্তা সামাজিক মঙ্গলকেই মুখ্য ল্য হিসেবে নিয়ে ব্যবসায় নামবেন তাঁকে আমরা সামাজিক উদ্যোক্তা বা ওমডধটফ ঋর্ভরণযরণভণলর বলব'। [প্রাগুক্ত, পৃ- ২০৫]
উপরের উদ্ধৃতি থেকে এটা পরিষ্কার যে, ড. ইউনূস পুঁজিবাদের 'বক্তিগত মালিকানা' ও 'বাজারভিত্তিক প্রতিযোগিতা' অুণ্ন রেখেই 'ভাল মানুষ সামাজিক উদ্যোক্তাদের দ্বারা সামাজিক মঙ্গল ত্বরান্বিত করতে চাচ্ছেন। তিনি মনে করেন যে, 'সামাজিক উদ্যোক্তা' হওয়াটা একটা ব্যক্তিগত অভিরিেচর ব্যাপার। যে কেউই তা হতে পারেন। এ ধরনের ধারণার সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করবে সমাজে অসংখ্য ধনী লোক খুঁজে পাওয়ার ওপর যাঁরা একই সঙ্গে দ উদ্যোক্তা এবং সামাজিক কল্যাণে নিবেদিত। কিন্তু এটাও কি কোন নতুন কথা? ইউরোপের রবার্ট ওয়েন, চার্লস ফুঁরিয়ে এবং সেইন্ট সাইমনরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে 'ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র' কায়েমের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণের চেষ্টা অষ্টাদশ শতাব্দীতেই করেছিলেন এবং তাঁরা ব্যর্থও হয়েছিলেন। তাঁদের সামাজিক উদ্যোগের দ্বীপগুলো মোটেও স্থায়ী হয়নি। মার্কসবাদীরা তাই পুঁজিবাদের ভেতরে এ করম ব্যক্তির সদিচ্ছা নির্ভর 'সামাজিক উদ্যোগের' প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার কোন সম্ভাবনা স্বীকার করেন না। ড. ইউনূসের প্রহ্মত্মাবনায় সবচেয়ে দুর্বল দিকটি হচ্ছে এখানে একজন ধনী লোকের ব্যক্তিগত সদিচ্ছার ওপর সমগ্র সামাজিক প্রকল্পটি নির্ভরশীল। পুঁজি ও পুঁজিপতি থাকবে কিন্তু তাদের পুঁজিপতি সুলভ মুনাফাবৃত্তি থাকবে না_এ রকম একটা 'স্বপ্ন' তিনি দেখতে চাচ্ছেন। এ রকম লোক কি পুঁজিবাদের মধ্যে আদৌ পাওয়া যাবে? হয়ত পাওয়া যাবে, হয়ত নয়। তবে এটুকু নিশ্চিত যে সংখ্যায় তারা বেশি হবেন না। ড. ইউনূস নিজেই এই সমস্যার আশঙ্কা মাথায় রেখে এই প্রশ্নের অগ্রিম জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন_ 'এই ধরনের সামাজিক উদ্যোক্তা কি পৃথিবীতে বিরল মনে করেন? তাঁদের খুঁজে পাওয়া কি দুষ্কর হবে? মোটেই আমার তা মনে হয় না। আমরা সন্ধানে নামলেই তাঁদের খুঁজে পেতে আরম্ভ করব। যত বেশি তাঁদের সন্ধান করব, তত বেশি তাঁদের পাওয়া যাবে।' ড. ইউনূস আরও মনে করেন যে একটি 'সামাজিক পুঁজিবাজার' (ওমডধটফ ডটযর্ধটফ বটরপর্ণ) সৃষ্টি করে সেখানে সমাজমনস্ক ব্যক্তিরা তাদের সঞ্চয় জমা রাখলে এবং সেখান থেকে যে কোন উদ্যোগী ব্যক্তি তাঁর প্রাথমিক পুঁজিটুকু সংগ্রহ করে নিতে সম হলে অনেক ব্যক্তিই সামাজিক উদ্যোক্তা হতে এগিয়ে আসবেন। তাদের সুপ্ত সম্ভাবনা ও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এভাবে প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী খাতের পাশাপাশি একটি 'সামাজিক ব্যবসা খাত' গড়ে উঠবে এবং পুঁজিবাদী খাতের সঙ্গে 'সামাজিক উদ্যোক্তা পরিচালিত উদ্যোগগুলোর' একটি নতুন প্রতিযোগিতা শুরু করা সম্ভব হবে। তাঁর ভাষায়, 'অর্থনীতি বিদ্যার প্রমাণ করা উচিত যে খোলাবাজার শুধু শোষণকারী পুঁজিপতিদের খেলার মাঠ নয়। প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্য এটা সকল সমস্যার সমাধান সন্ধানের কর্মস্থল' [প্রাগুক্ত, পৃ-২০৬]। এ নতুন সামাজিক ব্যবস্থায় সামাজিক উদ্যোক্তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে ড. ইউনূস সমাজে তিন ধরনের লোকের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়, 'একদিকে আছে পুঁজিপতিরা যারা কেবলই ব্যক্তিগত লাভের জন্য সদা সচেষ্ট। এরা শুধু নিজেদের জন্য মুনাফা বাড়াতে চায়। সমাজের দায়-দায়িত্বের পরোয়া করে না। এমন বিনিয়োগেও তারা এগিয়ে আসবে যেখানে ব্যক্তিগত লাভ আছে বটে তবে সমাজের অমঙ্গল হয়... অন্যদিকে রয়েছে সামাজিক উদ্যোক্তারা যাদের উদ্দীপনার উৎস হলো সমাজ সচেতনতা। যে উদ্যোগ সামাজিক কল্যাণ সাধন করবে সেখানেই তারা বিনিয়োগ করে, অবশ্যই নিজেদের অর্থনৈতিক অস্তিত্ব বাঁচিয়ে... এই দুই বিপরীতধমর্ী দলের মাঝামাঝি, অধিকাংশ উদ্যোক্তা সংস্থা লাভ ও সামাজিক কর্তব্য এই উভয়ের সমন্বয়ে সর্বোচ্চ প্রশান্তি পাবার চেষ্টা করে।' [প্রাগুক্ত পৃ- ২০৬]। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, ড. ইউনূস 'সরকারী মালিকানাধীন ব্যবসা' এবং 'পুঁজিবাদী মালিকানাধীন স্বার্থপর ব্যবসা' উভয়ের বিরুদ্ধেই অবস্থান গ্রহণ করেছেন। (চলবে)
ড. ইউনূস বর্তমানে যে নতুন অভিনব প্রস্তাবের অবতারণা করেছেন তাতে অবশ্য ' রাষ্ট্রের ভূমিকা' নগণ্যই থেকে যাবে এবং 'বাজারের' ভূমিকাই প্রাধান্য পাবে। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের মাধ্যমে কলকারখানা সম্পদ পরিচালনা দতার সঙ্গে কখনই করা সম্ভব নয়। তিনি 'রাষ্ট্রীয় একচেটিয়ার' বিপরীতে ব্যক্তি-উদ্যোক্তাদের বাজারভিত্তিক প্রতিযোগিতাকে সম্পদ সৃষ্টি ও পরিবর্ধনের অধিকতর গতিশীল দ উপায় বলে মনে করেন। তাই বাজার এবং প্রতিযোগিতার ওপর তাঁর অগাধ আস্থা বিদ্যমান। তবে একই সঙ্গে উদ্ধৃত্ত মূল্যের ব্যক্তিগতভাবে আত্মসাতেরও তিনি বিরোধিতা করেন। তাঁর ভাষায়, 'আমি পুঁজিবাদের মূল বক্তব্যে বিশ্বাসী। একটি মূল বক্তব্য হলো অর্থনৈতিক পদ্ধতি সবসময় প্রতিযোগিতামূলক হবে। সব প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও ব্যবস্থাপনায় দতা সৃষ্টির পেছনে প্রতিযোগিতা নামক শক্তির অবদান অসীম। পুঁজিবাদের আরেক মূল কথা হলো লাভকে উচ্চতম পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এর থেকেই জন্ম নেয় সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের প্রেরণা' (দেখুন মুহাম্মদ ইউনূস, গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন, পৃ- ২০৪)।
পুঁজিবাদের ব্যক্তি মালিকানা এবং প্রতিযোগিতা এই মূল দু'টি সূত্র মেনে নিয়ে ড. ইউনূস পুঁজিবাদের মধ্যে যেটুকু পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়েছেন তা তাঁর ভাষাতেই নিচে তুলে ধরছি।
'পুঁজিবাদের (অন্য) দুই মূল বিষয়ে আমি পরিবর্তন আনতে চাই। প্রথম যে পরিবর্তন আনতে চাই তা হলো একটি ফোলানো ফাঁপানো চরিত্রকে পুঁজিবাদ থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়া। তিনি হলেন পুঁজিবাদী উদ্যোক্তা... উদ্যোক্তা ও শ্রমিকদের মধ্যে পুরনো, যে নি্লিদ্র দেয়াল নির্মাণ করে রাখা হয়েছে তাহলে তা অদৃশ্য হয়ে যাবে। এটা হয়ে উঠবে ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় যে একজন মানুষ নিজের উদ্যোগে কিছু করার চেষ্টা করবে, না মাইনে করা শ্রমিক হয়ে থাকবে...দ্বিতীয় যে পরিবর্তন আনতে চাই তা হলো উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের ইচ্ছা সম্বন্ধীয়। মুনাফার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের মূলনীতিকে সম্প্রসারিত করে আমি সামাজিক ল্যগুলোকে এর মধ্যে স্থান করে দিতে চাই...উদ্যোক্তা দুটি পৃথক ল্যের যোগফলকে সর্বোচ্চ সীমায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। তার মধ্যে একটা হবে মুনাফা। অন্যটি হবে সামাজিক মঙ্গল। ...যে সমহ্মত্ম উদ্যোক্তা সামাজিক মঙ্গলকেই মুখ্য ল্য হিসেবে নিয়ে ব্যবসায় নামবেন তাঁকে আমরা সামাজিক উদ্যোক্তা বা ওমডধটফ ঋর্ভরণযরণভণলর বলব'। [প্রাগুক্ত, পৃ- ২০৫]
উপরের উদ্ধৃতি থেকে এটা পরিষ্কার যে, ড. ইউনূস পুঁজিবাদের 'বক্তিগত মালিকানা' ও 'বাজারভিত্তিক প্রতিযোগিতা' অুণ্ন রেখেই 'ভাল মানুষ সামাজিক উদ্যোক্তাদের দ্বারা সামাজিক মঙ্গল ত্বরান্বিত করতে চাচ্ছেন। তিনি মনে করেন যে, 'সামাজিক উদ্যোক্তা' হওয়াটা একটা ব্যক্তিগত অভিরিেচর ব্যাপার। যে কেউই তা হতে পারেন। এ ধরনের ধারণার সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করবে সমাজে অসংখ্য ধনী লোক খুঁজে পাওয়ার ওপর যাঁরা একই সঙ্গে দ উদ্যোক্তা এবং সামাজিক কল্যাণে নিবেদিত। কিন্তু এটাও কি কোন নতুন কথা? ইউরোপের রবার্ট ওয়েন, চার্লস ফুঁরিয়ে এবং সেইন্ট সাইমনরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে 'ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র' কায়েমের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণের চেষ্টা অষ্টাদশ শতাব্দীতেই করেছিলেন এবং তাঁরা ব্যর্থও হয়েছিলেন। তাঁদের সামাজিক উদ্যোগের দ্বীপগুলো মোটেও স্থায়ী হয়নি। মার্কসবাদীরা তাই পুঁজিবাদের ভেতরে এ করম ব্যক্তির সদিচ্ছা নির্ভর 'সামাজিক উদ্যোগের' প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার কোন সম্ভাবনা স্বীকার করেন না। ড. ইউনূসের প্রহ্মত্মাবনায় সবচেয়ে দুর্বল দিকটি হচ্ছে এখানে একজন ধনী লোকের ব্যক্তিগত সদিচ্ছার ওপর সমগ্র সামাজিক প্রকল্পটি নির্ভরশীল। পুঁজি ও পুঁজিপতি থাকবে কিন্তু তাদের পুঁজিপতি সুলভ মুনাফাবৃত্তি থাকবে না_এ রকম একটা 'স্বপ্ন' তিনি দেখতে চাচ্ছেন। এ রকম লোক কি পুঁজিবাদের মধ্যে আদৌ পাওয়া যাবে? হয়ত পাওয়া যাবে, হয়ত নয়। তবে এটুকু নিশ্চিত যে সংখ্যায় তারা বেশি হবেন না। ড. ইউনূস নিজেই এই সমস্যার আশঙ্কা মাথায় রেখে এই প্রশ্নের অগ্রিম জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন_ 'এই ধরনের সামাজিক উদ্যোক্তা কি পৃথিবীতে বিরল মনে করেন? তাঁদের খুঁজে পাওয়া কি দুষ্কর হবে? মোটেই আমার তা মনে হয় না। আমরা সন্ধানে নামলেই তাঁদের খুঁজে পেতে আরম্ভ করব। যত বেশি তাঁদের সন্ধান করব, তত বেশি তাঁদের পাওয়া যাবে।' ড. ইউনূস আরও মনে করেন যে একটি 'সামাজিক পুঁজিবাজার' (ওমডধটফ ডটযর্ধটফ বটরপর্ণ) সৃষ্টি করে সেখানে সমাজমনস্ক ব্যক্তিরা তাদের সঞ্চয় জমা রাখলে এবং সেখান থেকে যে কোন উদ্যোগী ব্যক্তি তাঁর প্রাথমিক পুঁজিটুকু সংগ্রহ করে নিতে সম হলে অনেক ব্যক্তিই সামাজিক উদ্যোক্তা হতে এগিয়ে আসবেন। তাদের সুপ্ত সম্ভাবনা ও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এভাবে প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী খাতের পাশাপাশি একটি 'সামাজিক ব্যবসা খাত' গড়ে উঠবে এবং পুঁজিবাদী খাতের সঙ্গে 'সামাজিক উদ্যোক্তা পরিচালিত উদ্যোগগুলোর' একটি নতুন প্রতিযোগিতা শুরু করা সম্ভব হবে। তাঁর ভাষায়, 'অর্থনীতি বিদ্যার প্রমাণ করা উচিত যে খোলাবাজার শুধু শোষণকারী পুঁজিপতিদের খেলার মাঠ নয়। প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্য এটা সকল সমস্যার সমাধান সন্ধানের কর্মস্থল' [প্রাগুক্ত, পৃ-২০৬]। এ নতুন সামাজিক ব্যবস্থায় সামাজিক উদ্যোক্তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে ড. ইউনূস সমাজে তিন ধরনের লোকের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়, 'একদিকে আছে পুঁজিপতিরা যারা কেবলই ব্যক্তিগত লাভের জন্য সদা সচেষ্ট। এরা শুধু নিজেদের জন্য মুনাফা বাড়াতে চায়। সমাজের দায়-দায়িত্বের পরোয়া করে না। এমন বিনিয়োগেও তারা এগিয়ে আসবে যেখানে ব্যক্তিগত লাভ আছে বটে তবে সমাজের অমঙ্গল হয়... অন্যদিকে রয়েছে সামাজিক উদ্যোক্তারা যাদের উদ্দীপনার উৎস হলো সমাজ সচেতনতা। যে উদ্যোগ সামাজিক কল্যাণ সাধন করবে সেখানেই তারা বিনিয়োগ করে, অবশ্যই নিজেদের অর্থনৈতিক অস্তিত্ব বাঁচিয়ে... এই দুই বিপরীতধমর্ী দলের মাঝামাঝি, অধিকাংশ উদ্যোক্তা সংস্থা লাভ ও সামাজিক কর্তব্য এই উভয়ের সমন্বয়ে সর্বোচ্চ প্রশান্তি পাবার চেষ্টা করে।' [প্রাগুক্ত পৃ- ২০৬]। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, ড. ইউনূস 'সরকারী মালিকানাধীন ব্যবসা' এবং 'পুঁজিবাদী মালিকানাধীন স্বার্থপর ব্যবসা' উভয়ের বিরুদ্ধেই অবস্থান গ্রহণ করেছেন। (চলবে)
No comments